অটোয়া, শনিবার ১২ অক্টোবর, ২০২৪
ভিন্ন জীবন (পর্ব- চার) - সুফিয়া ফারজানা

ভিন্ন জীবন (পর্ব-তিন) পড়তে ক্লিক করুন 

পর্ব- চার
প্তাহে দুই দিন হাট বসে, রবিবার আর বুধবার। সেদিন বুধবার। বরাবরের মতই সেদিনও সেলিম লাল সবুজ রঙ মিলিয়ে দুই ডজন কাচের চুড়ি কিনেছিল লিলির জন্য। হাট থেকে আসার পথেই শরীরে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল সেলিমের। কিছুতেই ভালো লাগছিল না তার। বাড়িতে ঢুকেই বাজারের ব্যাগটা মায়ের হাতে দিয়ে তার ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পরে সেলিম। 

লিলি তখন শ্বশুরের জন্য চা বানাচ্ছে। সেদিন চায়ের সাথে চিঁড়া ভাজা খেতে চেয়েছিলেন সিকান্দার আলী। শ্বশুরকে চা - নাস্তা দিয়ে লিলি চিঁড়া ভাজা আর চা নিয়ে আসে সেলিমের জন্য। ঘরে ঢুকেই লিলি দেখে এক অদ্ভুত দৃশ্য। বিছানায় শুয়ে কাটা মুরগির মত ছটফট করছে তার সেলিম। তার পুরো শরীর ঘামে ভেজা। লিলি দৌড়ে তার শাশুড়ি কে ডেকে নিয়ে আসে।

তারপরের ঘটনা খুব ভালো মনেও পরে না লিলির। ডাঃ আসলেন, চলেও গেলেন। তারপর অনেক লোক জমা হল, বাড়িভর্তি লোক। কেউ বলছিল, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক।
কেউ কেউ আবার বলছিল, স্ট্রোক। টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছিল লিলির কানে, 'জোয়ান পোলাডা, আহারে, ছয়ডা মাসও হয় নাই বিয়া করছে।' কেউ বলছিল, 'আহারে, নতুন বউডার কি হইবো? বউডার কপালডাই খারাপ।'

লিলিও কি জ্ঞান হারিয়েছিল? সেই দিনের কোন স্মৃতিই আর মনে পরে না তার। শুধু মনে আছে, বাজারের ব্যাগ থেকে ইলিশ মাছ আর কচুর মুখি বের করতে গিয়ে ব্যাগের একদম তলায় কাগজের প্যাকেটে মোড়ানো লাল সবুজ কাচের চুড়িগুলো বের করেছিল কেউ একজন। সবগুলো চুড়িই ভেংগে গেছে। আগের রাতেই ঘুমানোর সময় সেলিম জানতে চেয়েছিল, তার প্রিয় রং কি। 'বউ, কও তো, কি রং তোমার ভালো লাগে?' লিলি বলতে চায়নি কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত অনেক জোরাজুরির পর সে জানতে পেরেছিল, লাল আর সবুজ তার প্রিয় রং। এর আগে তো কেউ এভাবে জানতে চায়নি তার প্রিয় রং, তার পছন্দ অপছন্দ।  তাই লিলি নিজেও জানতে পারেনি কখনও, কোন রং তার প্রিয়।। 

সেদিন সেলিম কবরে যাওয়ার সাথে সাথে লাল সবুজ কাঁচের চুড়ির মতই ভেংগে গিয়েছিল তার লাল নীল স্বপ্নগুলো, যা জীবনে প্রথম সে দেখেছিল গত ছয়টি মাস ধরে, সেলিমের সাথে না ঘুমানো রাতগুলোতে।। 

এরপর আবার সেই দরিদ্র বাবা, আবার সেই অভাবের সংসারে ফিরে আসা। না, শ্বশুর বাড়িতে তার জায়গা হয়নি। একে তো প্রথম থেকেই সেলিমের মা কখনোই তাকে মেনে নেননি মন থেকে, তার উপর তার জোয়ান তরতাজা ছেলের এই অকাল আকস্মিক মৃত্যুর জন্য তিনি অপয়া বউটিকেই দায়ী করেছিলেন মনে মনে। অবশ্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল শ্বশুর বাড়িতে লিলির জায়গা না হওয়ার। যৌতুক বাবদ যা যা দেয়ার কথা ছিল, তার কিছু ই লিলির বাবা দিতে পারেননি এই ছয় মাসে। দিতে যে পারবেন কখনও, সে রকম কোন সম্ভাবনাও ছিল না।

সেলিম লিলিকে প্রচন্ড রকম ভালবাসতো বলেই সেলিমের বাবা মা সাহস পাননি এতদিন কিছু বলার। কিন্তু আজ তো সেলিমই নেই। তাহলে এই অপয়া গরিবের মেয়েটিকে আর বাড়িতে রাখার প্রয়োজনই বা কি??

বাবার বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে ফেরত আসার কয়েক দিন পরেই লিলি বুঝতে পারে, সেলিম চলে গেলেও তাকে একেবারে একা ফেলে যায়নি। রাত জেগে একসাথে দেখা  লাল নীল স্বপ্নগুলো সে ফেলে গেছে লিলিরই অভ্যন্তরে। লিলি বুঝতে পারে, সে অন্তঃসত্ত্বা।। (চলবে) 

সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ