ও পাড়ের ডাক - মোঃ মোশফিকুর রহমান
হঠাৎ কি একটা স্বপ্ন দেখে মৃদুলের ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো, চারিদিকে সুনশান নীরবতা, এ যেন এক অন্য পৃথিবী! হয়তো করোনা ইস্যুর কারণে সৃষ্টি কর্তা এই পৃথিবীর মানুষগুলোকে অন্যকোন গ্রহে স্থানান্তরিত করেছেন! কেননা, এই ক'দিনেই চেনা পৃথিবীটাই মৃদুলের কাছে অচেনা লাগছে!
গত কয়েক'টা দিন এমনই ভাবে কাটছে। অফিসেও তেমন কাজ নেই তার। চারদিকে করোনা আতঙ্কে বাজার, দোকান-পাট,রাস্তা-ঘাট সবই বন্ধ। শুনছে পুলিশ নাকি গত কয়েকদিন থেকে পাবলিকের উপর বেজায় নাখোশ! অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে বাংলাদেশী খেলোয়াড়রা যেভাবে ইন্ডিয়ান বোলারদের উপরে ক্ষেপে তুলোধুনো করে ছেড়েছিলো, ঠিক তেমনি করেই নাকি তারা এবার পাবলিকের উপর ব্যাটিং চালাচ্ছে! সেই ভয়েই মৃদুলও বাসার বাহিরে যায়না!
তাই সকাল বিকেল রাত শুধু ঘুম আর ঘুম! এ যেনো ঘুমন্ত মানুষের রাজ্য! প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে যাচ্ছেনা! গেলেও আর্মি, পুলিশ আর ভোট চোর পাতি নেতাদের লাঠির আঘাতের ভয় আছে! তাই মৃদুল সারাদিন বাড়ির বাইরে যায়না!
প্রথম প্রথম মৃদুলের অন্য রকম একটা ফিলিংস কাজ করতো,আর যাই হোক কাজ হতে তো বাঁচাগেল! কিন্তু এই ক 'টা দিনেই সে বুঝে গেছে, এটা মৃদুলদের মতো উচ্চ শিক্ষিত কামলাদের জন্য জেলখানার আযাব সমতুল্য! হঠাৎ করে কাজ হতে মুক্ত হওয়ায় গা ছমছম করে! কোথায় যেন একটা অচেনা ব্যথা অনুভব হয়! এ সময় যদি একজন সঙ্গী পাশে থাকতো?
অথচ কত বছরই তো সে একাকী কাটিয়ে দিলো, কখনোই তো কারও অভাববোধ মনে হয়নি! কিন্তু আজকাল এমন লাগে কেন? বনলতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেতো কখনই এমন লাগেনি তার!
বনলতা মৃদুলের জীবন থেকে দূরে সরে গেছে সেই কবে! অথচ এই লকডাউনের সময়টাতে কেন জানি বারবার বনলাতার কথাই তার মনে পড়ছে। অথচ দীর্ঘ চারটা বছর একবারের জন্যেও বনলতার কথা তার মনে পরেনি। আর বনলতাও তার খোঁজ নেয়নি! তাহলে এখন বার বার কেন বনলতা মৃদুলের স্বপ্ন রাজ্যে ভীড় করছে,বুঝতে পারছেনা। তবে কী মৃদুল ইদানিং একাকীত্ব বোধ করছে?
কত শীত, বসন্ত চলে গেছে মৃদুল একটি বারের জন্যও খেয়াল করেনি! অথচ এর মাঝে কত যে অষ্টাদশী মৃদুলের জীবনে উঁকি মেরেছে, সে একবারের জন্যেও তাদের দিকে ফিরেও তাকায় নি। কিন্তু হঠাৎ তার এমন শূণ্যতার কারণ কী সেও খুঁজে পাচ্ছেনা, সেতো চেয়েছিল একাকীই বাকি জীবনটা অতিবাহিত করবে। তবে এখন কিসের অভাববোধ রোজ তাকে গ্রাস করছে?
যখনই ঘুমাতে যায়,তখনই অনুভব করে কেউ একজন তার বুকে মাথা দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে! আর তার কপালে আলতো চুম্বন দিয়ে বলতে থাকে, চাইলেই কি আমাকে ভুলে থাকতে পারবে?
-কে, কে তুমি? আমি তোমাকে তো চিনতে পারলাম না!
-সত্যিই কি তুমি আমায় চিনতে পারনি? আমার উষ্ণ বুকের উথাল পাথাল ঠেউ অনুভব করতে পারনি না? আমার বাঁকা ঠোঁটের নরম ছোঁয়াটা তোমার হৃদয়ে দাগ কাটছে না?
-কে, বনলতা! কিন্তু বনলতা তো সেই কবে চলে গেছে! তাহলে কে এই রমণী?
-মৃদুল, কি ভাবছো এ সব! তুমি তোমার বনলতাকে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? অথচ দেখো আমি কিন্তু তোমাকে এখনো ভুলতে পারিনি! পৃথিবী করোনা ভাইরাস দিয়ে যখন মানব জীবন শুণ্য করে চলছে প্রতিনিয়ত! তবুও আমি সব বাধা পেরিয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি, তোমাকে আমার কাছে রাখব বলে! চলো দুজনে আজ হারিয়ে যাব, নিস্তেজ পৃথিবীর সকল মায়া-মমতা ত্যাগ করে ওই দূর আকাশে বুকে! এসো সোনা, তোমার বনলতা তোমাকে নিতে এসেছে! আমার হাত ধরে, দ্রুত চলো! নয়তো করোনা ভাইরাসের বিষাক্ত ছোবলে তুমি, আমি এক হতে পারবনা!
-না, আমি তোমার সাথে যাবনা! আমাকে তুমি ভুলে যাও! এ পৃথিবীর বুকেই আমি হাজার বছর ধরে নিঃশ্বাস নিতে চাই! কেউ আমাকে এখান হতে নিয়ে যেতে পারবেনা।
-কি বোকার মতো কথা বলছো মৃদুল, আমি কত দূর হতে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি, তুমি একবারও খেয়াল করেছো? তুমি না গেলে আমি মনে অনেক কষ্ট পাবো! আর তুমি চাইলেও এই পৃথিবীটা তোমাদের নেই! এ পৃথিবীর সবকিছু তোমরা কবেই ধ্বংস করেছো! অযথা এ পৃথিবীর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই! চলো সোনা, তোমাকে আজ আমার সঙ্গে যেতেই হবে!
-না, বনলতা না! তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই, তুমি যেখানে আছো সেখানেই থাক! আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমার সঙ্গে যাবনা! আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
বনলতা মৃদুলকে তার বুকে আরো শক্ত করে জড়াতে থাকে, আর অট্টহাসিতে পৃথিবী প্রকম্পিত করতে থাকে! আর বলতে থাকে, "বললেই হলো,আমি তোমাকে নিয়েই যাব! এ পৃথিবীতে এখন আর তোমার কোনো অধিকার নেই!"
হঠাৎ করেই, বিকট শব্দ করে মৃদুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল! সারা শরীর ঘেমে একাকার! চারদিকে তাকিয়ে দেখে, কোথাও কেউ নেই! চারদিকে ঘন অন্ধকার, দূর হতে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এবার বুঝি মৃদুলের জীবনেও ও পাড়ের ডাক এসে গেছে!
মোঃ মোশফিকুর রহমান
কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী।
-
গল্প//উপন্যাস
-
09-04-2020
-
-