অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
আমি এক বৃক্ষ, আমার কাহিনী - বেলাল উদ্দিন

     আমার বসবাস নদী তীরবর্তী এক গ্রামে। আমি কীভাবে বড় হলাম, বেড়ে উঠলাম তা বড় শ্বাপদসংকুল এক কাহিনী। গ্রামের এক অবস্থাসম্পন্ন বাড়ির বারান্দার কোণে আমার জন্ম। এ বাড়িতে অনেক মানুষের আবাসন। বেশিরভাগ থাকেন দুরবিদেশে আর বাকী যারা আছেন তারা ব্যবসা ও ক্ষেতখামার নিয়ে সদা ব্যস্ত। প্রকৃতির কৃপায় আমি ধরণীর আলো দেখি প্রথম। তখন থেকেই আমার উপর কত ধরনের খড়গ নামলো তার ইয়ত্তা নেই।
     আমার জন্মের পর থেকে পদপৃষ্ট হতে লাগলাম। একটু বড় হই তো ছোট ছোট পোলাপান আমার মুকুলটা ছিড়ে আবার আরেকটু বড় হলে পাতা ছিড়ে ফেলে। আমি তো কিছু বলার সাহস নেই কারণ আমি অনধিকার চর্চা করে এখানে বসত করছি। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় আমি প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে আমার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছি -- কে এ অনধিকার চর্চাকে আমল দিবে। একে তো হাঁটাচলার জায়গা তারপরে বারান্দার কোণ কে সহ্য করবে। সবার নজর কিন্তুআবার আমার দিকে নেই কেউ কেউ আবার একটু করুণা করে। সামান্য করুণাকে পুঁজি করে আমার বেড়ে ওঠার সংগ্রাম চলতে লাগলো। কিছুদিন পর আমি ডালপালা মেলতে শুরু করলাম আবার সাড়াশি আক্রমনের শিকার হওয়ার উপক্রম। বটির আঘাতে প্রাণ যাওয়ার মত অবস্থা এমনি সময় পরিবার প্রধানের হস্তক্ষেপ। এযাত্রায় বেঁচে গেলাম। পরিবার প্রধান বড় ছেলেকে ওকে কেটে ফেললে কেমন হয় জানতে চাইলেন? বড় ছেলে বললেন থাকুক না ফলজ একটা কিছু বড় হলে একদিন কাজে আসবে। আমিও পুলকিত হলাম এ ভেবে যে আমার পক্ষে একজন জৈষ্ঠ্যকে পেলাম। আমিও উনার দৃষ্ঠিগোচরে আসলাম। উনার কৃপায় আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম। কিন্তু পাশের বাড়ির ছাগলের অত্যাচারে আমি একদিন অঙ্গহারা হলাম আর বেঁচে থাকার শঙ্কায় পড়ে গেলাম। সৌভাগ্যবশতঃ বড়সাবের পরিচর্যায় আবারও জীবন পেতে শুরু করলাম।
     আমার বয়স যখন চার তখন আমার উপর নেমে আসলো খড়গ। ভাদ্র মাসের ইরি ধানের মৌসুম। ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে আর খড় আমার উপর পড়তে পড়তে গাদা হয়ে গেল। দুদিন খড়ের গাদার ভর আমার উপর থাকলো আর জমানো গাদা এত উত্তাপ ছড়ালো যার ফলে আমি প্রায় সিদ্ধ অবস্থা। এহেন পরিস্থিতিতে বড়সাব আবার ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির। তিনি তাৎক্ষণিক গাদার খড় সরিয়ে আমাকে মুক্ত করলেন এতক্ষনে আমার চেহারা বিবর্ণ প্রায়, ডালপালা যা একটু গজিয়েছিল সেগুলো এবড়ো-তেবড়ো অবস্থা। আমার ত্রাণকর্তা নিজ হাতে ডালপালা সোজা করে দিলেন, ঠান্ডা পানি আমার গায়ে ঢেলে বিবর্ণ চেহারার অবয়ব পরিবর্তনে সচেষ্ট হলেন। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমি আবারও নব উদ্যমে বেড়ে উঠার সংগ্রামে নেমে পড়লাম। কদিন পর আমার স্বাভাবিক জৌলুস ফিরে আসতে শুরু হলো, বড় সাবের আদর সোহাগ পেতে লাগলাম আন্তরিকভাবে প্রতিদিন। এভাবেই আমি এগুতে লাগলাম।
     নতুন কুঁড়ি নিয়ে, নতুন ডালপালা প্রসারিত করে যখন মোটামুটি আমার একটা দৃশ্যমান আকৃতি হলো তখন মেজোসাব বটি হাতে আমার কাছে হাজির। আমি তো বোবা জিনিস কথা বলতে পারি না, কথার জবাব দিতে পারি না বুঝতে পারলাম আমার আশেপাশে কে একজন বিরুপ মনোভাব নিয়ে এসেছেন। এমন সময় বড়সাব হাজির। তিনি মেজোসাবকে জিজ্ঞাসা করলেন কী ব্যাপার বটি হাতে কেন? উনি জবাব দিলেন ওকে কেটে দিব? বড়সাব বললেন কেটে কী লাভ? একটা তো লাগানো যায় না আবার কাটতে চাও? মেজোসাব বললেন ঘরের কোণে এর অবস্থান বড় হলে ওর ডালে বাসা বাধবে কীটপতঙ্গ,পোকামাকড় পোলাপানদের কামড় দিবে। বড়সাব বললেন খেয়াল রাখলে ওসবের কিছু হবে না। মনে একটু কষ্ট নিয়ে মেজোসাব চলে গেলেন আমিও বেঁচে গেলাম নির্ঘাত মৃত্যুর মিছিল থেকে।
     বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমিও আরো বড় হতে লাগলাম, যথেষ্ট জায়গা দখল করে প্রসারিত হলাম। আসলো অগ্রহায়ন মাস আবার ধান মাড়াইয়ের পালা। এবারও আমার উপর খড়ের গাদার খবরদারী, কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর অত্যধিক চাপে নুয়ে পড়লাম মাটির দিকে। বড়সাবের নজর এড়ালো না, তিনি সাথে সাথে খড়ের গাদা সরিয়ে আমাকে আবার স্বাভাবিক অবস্থানে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন। অল্পদিনের মধ্যে আমি আবার পুরো আকারপ্রাপ্ত হলাম। পরের বছর আমার আকার বাড়লো, উঁচু হলাম। এবার বসন্তের আগমনে আমি শিহরিত হলাম। আমার কান্ডে আসতে থাকলো ফুলের মুকুল, সময়ের পরিক্রমায় সেগুলো হলো পরিপূর্ণ ফল, পাকতে লাগলো। সবাই সকাল, বিকাল এমনকি ভরদুপুরে আমার পানে চেয়ে থাকে, আমার ফল কুড়িয়ে মনের আনন্দে গলাধঃকরণ করে। এখন আমি সারাটি বছর সবাইকে সেবা দেই, আমার প্রতিও সবাই করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ভাবে আমি কি ছিলাম আর কি হলাম। আমিই সেই 'পেয়ারা' বৃক্ষ। আমি প্রকৃতির মধ্যে আছি, আমার সাথে বৈরী আচরণ করা---+-----।

বেলাল উদ্দিন । সিলেট, বাংলাদেশ