সুনির্মল বসুর ছোটগল্প “স্বপ্নের খোঁজে”
সবাই বলত, তোর কিস্যু হবে না।
মন খারাপ হোত সুজনের। মন খারাপ হলে, ও নদীর কাছে যেত, সবুজ ধানক্ষেতে হেঁটে যেত।
মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে উদাস বাউলের মতো অজানা নগরীর পথে হেঁটে যেত, আবার ফিরেও আসতো, মায়ের মুখটা ভেবে। সুজন বুঝতে পারতো, ওর জন্য মায়ের কত কষ্ট।
সুজন ছোট বেলায় ঘুড়ি ওড়াতো,ওর মনটা রঙীন ঘুড়ির মতো দূরদেশে উড়ে যেত।
শচীন কাকা একদিন বললেন, তোর কিস্যু হবে না।
কেন,
তোর মন,
মনের কি দোষ,
স্বাভাবিক নয়,
কিছু হ ওয়া মানে কি,
বড় হয়ে বাড়ী গাড়ী ফ্লাট,
একদিন মধুরিমা এলো ওর জীবনে। সকাল বিকেল সন্ধে তখন স্বপ্নে মশগুল। আকাশ তখন ঘন নীল, গাছের পাতা সবুজ, গাঢ়। স্কুলে ছাত্র পড়িয়ে আসার পর, সুজন বাইরে বেরোতে চায় না। ওর মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনার কোন চেষ্টা নেই। মধুরিমা বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি সবার মত নও।
কেন,
নিজের ভালো বোঝো না,
আমি পৃথিবী কে ভালবাসি, তোমাকে ভালোবাসি।
তাতে কি হয়,
কবিতা লেখা হয়,
এতে কি পেট ভরে,
মন ভরে,
আমার পোষাবে না, আমি চললাম।
সবাই সুজনকে একলা ফেলে চলে গেল।
এখন শূণ্য ঘরে সুজন একা। অন্ধকার ঘরে থাকতে থাকতে ,ও আলোর জ্যোতি রেখা একদিন দেখতে পেল। নদীর ঢেউ, রাতের আকাশ, পদ্ম দীঘির পাড়, বউ কথা কও পাখির ডাক, ঝাউ পাইনের বনে বয়ে যাওয়া উতরোল বাতাস, ভোর বেলার শিশির পতনের শব্দ, চাঁদের মনোমোহিনী আলো, তারাদের ঝিকিমিকি, সব ওর লেখায় উঠে এলো।
মনে যত অন্ধকার, লেখায় তত আলো এসে পড়লো। সুজনের মন তখন সৃষ্টির নেশায় মেতে উঠেছে। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ ব্যর্থতার ছবি ওর কলমে ফুটে উঠল। জীবনকে গভীর আশ্লেষে ভালোবেসে ফেলল সুজন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে সাজিয়ে মানুষের জন্য রেখে যাবো। হাতে সময় কমে আসছে। কাজ অনেক। সময়টাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। আমি যেন আমার অনুভবের কথা সবটুকু বলে যেতে পারি। আমার লেখায় মানুষ যেন জীবনের সঠিক সত্যটুকু খুঁজে পায়।
ওর কবিতার বই বেরোলো। ওর উপন্যাসের চাহিদা বাড়লো। পত্রপত্রিকায় নানা লেখা ছাপা হলো।
বিদেশ থেকে চিঠি এলো, মিস্টার সেন, আপনি আমাদের দেশে আসেন।
সুজন ভাবে, যেভাবে সবাই স্বপ্ন খোঁজে, আমি তো কখনো সেভাবে স্বপ্ন খুঁজিনি।
আমি ভালবাসতাম গাছপালা রোদ্দুর, আমি ভালবাসতাম আমার গ্রাম বাংলা, শাপলা শালুক, সরল মানুষের মুখ। আমার লেখায় বারবার বড় দীঘি, বকুল ফুলের গন্ধ, পলাশ বনে কাটানো বিকেল, সমুদ্র জলের প্রশান্তির ছবি আঁকতে চেয়েছি।
আজ মনে হয়, আমি কোনো স্বপ্ন দেখি নি। আমি ভালোবাসাকে খুঁজছিলাম, প্রকৃতির মধ্যে, মানুষের মধ্যে। এভাবে মানুষের ভালোবাসা স্বপ্নের মত আমার কাছে ফিরে আসবে, আমি তো কখনো এমন ভাবে ভাবি নি।
আজ ওর মা নেই, ওর জন্য মায়ের মনে অনেক কষ্ট ছিল। সবাই বলতো, তোর কিস্যু হবে না।
দেওয়ালে মায়ের প্রতিকৃতির সামনে সুজন এগিয়ে যায়। মনে মনে বলে, আমি পেরেছি মা, শুধু তুমি দেখলে না। প্রতিকৃতির মধ্যে দিয়ে ওর মা যেন তখন বলে উঠলেন, প্রকৃতি আর মানুষকে ভালোবাসিস তুই, সেই ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে, মানুষের ভালোবাসাই তোর কাছে স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়।
সুনির্মল বসু । পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
লেখক পরিচিতি,- সুনির্মল বসুর জন্ম ১৯৫০সালের ৩রা নভেম্বর, কলকাতায়। পিতা, সুবোধ কুমার বসু ও মাতা গীতা রানী বসু। শিক্ষাগত যোগ্যতা,এম,এ,বি,এড। অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক। প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ,শিকড়ে বৃষ্টির শব্দ, ভালোবাসার কবিতা মালা, পানকৌড়ি, চেতক, পাঁচে পঞ্চবান প্রভৃতি। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকার নিয়মিত লেখক।
-
গল্প//উপন্যাস
-
03-04-2020
-
-