এসো হে বৈশাখ - সিরাজুল ইসলাম
"আমি সইতে নারি,কইতে না পারি
আমার মন মেতেছে আজ লিলুয়া বাতাসে...! "
না না! আজ আমি লিলুয়া বাতাসের গান গাইতে আসিনি!
ধোপদুরস্ত ধূতি-পাঞ্জাবী পরে, লাল শালুতে মোড়া খেরোখাতা হাতে নিয়ে
আজ আমি বৈশাখের কথা বলবো বলে এসেছি।
পাললিক সভ্যতার জন্ম ইতিহাসে আমরা বাঙালী।
চৈত্রের কঠিন খরায় আমাদের বসবাস :
কালোকালো দেহে শীর্ণ করতলে ঝাঁপটা মারে লোনাঘাম!
আমাদের উদয়াস্ত পরিশ্রমে আকন্ঠ তেষ্টা ঝরে পড়ে, বুক কাঁপে তিরতির।
কচ্ছপ খোলসের আবরনে এ এক যাপিত জীবন,
খরায় ফেটে বসুধা হেঁকে যায়ঃ,"জল দাও জল দাও!"
ক্রন্দনের সে বাস্পধোঁয়া সাপের ফণার মত লেলিহান শিখায় দোলে!
ধানকলের চিমনীর মতই ঝরে পড়ে কালোধোঁয়ার দীর্ঘশ্বাস!
লোমওঠা কুকুরকুন্ডুলী মেরে পড়ে থাকে ঝিমমারা দুপুর, বিলম্বিত বিকেল-
উত্তুরে জনপদ বিরাণ মরুভূমি হয়ে যায় মঙ্গায়!
দখিনের দুয়ার খুলে অখ্যাত কোন গ্রাম শিমুলীয়া, জলেশ্বর-
সে গাঁয়েরই দুরন্ত কিশোর দল রাজা সন্তু বুবাই হাবু,
মিম্মা নেহা যারীণ টুকটুকি আর সুইটির মত কিশোরীর কলোহাসি
গাজনের মেলার ঢাঁকের শব্দের প্রতিক্ষায় উন্মুখ চেয়ে থাকে!
মরে হেঁজে যাওয়া ক্ষীণকায়া শরীরে কাস্তের মত বাঁক খাওয়া,
নাব্যতা হারানো বংশীনদীর ধারে , ঝুরি নামানো বয়সী বটের নীচে দীঘির পাড়ে
আবহমান বাঙালী প্রথায় জমে উঠবে সেই মেলা!
পাতার বাঁশী, টিনের সেপাই,শোলার পাখি,বিন্নিধানের খৈ, হুড়ুম ভাঁজা, গুড়কদমার রসে চপচপে মুখ!
কচি বয়সের আপ্রাণ চেষ্টায় ফোলানো বেলুন, আহা! কী যে সুখ!
রাত জেগে বসে দেখা গাজনের নাচ-
পলান তপন পল্টুরা রং মেখে সং সেজে
মাদল বাজিয়ে নেচে যায় অবিচল।
উলুধ্বনীতে মুখরিত গোটা গ্রাম!
লাল সিঁদুরে নববধূঁ শঙ্খধ্বনী শেষে,মাখন সাদা লালপেড়ে শাড়ী পরে
শাঁখা পরা সুডৌল হাতে বিলোয় পুজোর প্রসাদ!
অফুরন্ত প্রতিক্ষায় হৃদয় কোটরে খুব সঙ্গোপনে তুলে রাখা ছবি-
রংচটা টিনের তোরঙ্গে ভাঁজ করে রাখা,
ন্যাপথলিনের গন্ধ ছড়ানো মায়ের পুরোনো শাড়ীর মতই বিবর্ণ!
হিজল জারুল আর ফাঁটা শিমুল তুলোয় ভরানো সুখ,
দিগন্তজোড়া মাঠের বুকে সময় গড়িয়ে যায় ঢিমেতালে!
অবারিত বিস্তৃত নীলাকাশে সকরুণ অবহেলায় মেঘ বালিকা ভেসে যায় বড্ড আনমনে-
ধীরলয়ে, অভিমানী গ্রাম্য কিশোরীর মত সলাজে।
বাতাসের ফিসফাস চাপা আতঙ্কে তক্ষকসাপের চোখে চোখ রেখে, ভাবলেশহীন!
যেন সুরের মূর্চ্ছনা থেমে যাওয়া নিঃস্প্রাণ জীবন!
দখিনা বাতাস নিয়ে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস
মুকুলিত আমের বনে দোলা দিয়ে যায় অফোঁটা কুঁড়ির মুখে সোহাগী শ্বেত-চুম্বন।
অনাবিল উচ্ছ্বাসে জেগে ওঠে প্রাণ, এসো হে বৈশাখ!
দুরস্ত বৈশাখের উড়ন্ত বাতাসে ঘোচে মনস্তাপ ;
বাউলের একতারায় বেজে ওঠে আগমনী কোন সুর!
কালোচুলের আয়েশী অলস মেঘবালিকার কাছে প্রত্যাশার কালক্ষেপন,
সোঁদা সোঁদা মিঠে ঘ্রানে সবুজের গালিচায়
পেঁজাতুলোর মতন নিয়ে এসো জীবনের হাসি গান!
এসো হে বৈশাখ! এসো, এসো!
সিরাজুল ইসলাম । পাবনা, বাংলাদেশ
-
ছড়া ও কবিতা
-
30-03-2020
-
-