বিদগ্ধা আরাত্রিকা - সজল কুমার পোদ্দার
সংসারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে আরাত্রিকা অনেক বার সাহস দেখিয়েছে মরার, কিন্তু মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দুঃসাহসী হতে পারেনি সংসারে ফেলে আসা একমাত্র সন্তানের মুখের প্রতিচ্ছবি প্রস্ফুটিত হওয়ায়। মৃত্যুর মধ্যে মুক্তি দেখেও ফিরে এসেছে জাগতিক যন্ত্রণা নিয়ে। সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও সুখ তাঁর কাছে সাহারা। মরুদ্যান বলতে কেবল সংসারে একমাত্র সন্তান বাপ দে দেন। তাঁর দিকে চেয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাই। সংসার একান্নবর্তী হোক আর পৃথকান্নবর্তী হোক, বিবাহিত নারীর সুখ তাঁর স্বামী। পরিবারের সকলে যতই ভালোবাসুক কিন্তু স্বামী যদি হয় বিমুখ তাহলে সে নারীর সুখ চন্দ্রবিন্দু। তারপর সে-বিয়ে যদি হয় ভালোবাসার, তাহলে তো কোনো আক্ষেপের জায়গা থাকে না। আক্ষেপ যদি করতেই হয় সে কেবল মৃত্যুর কাছে।
উচ্চশিক্ষিতা সুন্দরী আরাত্রিকা জীবনসঙ্গী খুঁজতে ভুল করেছিল না কলেজ লাইফে। পড়তে পড়তে প্রেম। প্রেম করতে করতে ভালোবাসার সুদর্শন মানুষটির মর্যাদা সম্পন্ন কর্ম। যোগ্য পাত্র বলে আরাত্রিকার পরিবার তাঁদের বিয়েতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাঁর বাবা যোগ্য পাত্রের যোগ্য মর্যাদা দিয়ে আড়ম্বরের সহিত বিবাহ কার্য সুসম্পন্ন করে তাকে পাঠিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি, আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে। প্রেমের ঘোরে কেটে যায় আরাত্রিকার দাম্পত্যের প্রথম পাঁচটি বছর। তারপরই সম্পর্কের মধ্যে মরিচা পড়তে থাকে দিনে দিনে। তিলে তিলে বাড়তে থাকে ঘনিষ্ঠতা পরিবারের অন্যদের সাথে। শ্বশুর শ্বশুড়ি আর একমাত্র ননদের ভালোবাসার নিবিড়তা আরাত্রিকাকে করে তুলেছিল আরো বেশি দায়িত্বশীল এবং কর্তব্য পরায়ন। স্বামীর ক্রম অপব্যবহার সত্তেও তাঁদের থেকে আরাত্রিকা দূরে সরে থাকতে পারেনি। তাছাড়া সে তাঁর আভিজাত্যে পুষ্ট মায়ের কাছ থেকে শিখেছিল, 'এ সংসারে প্রতিটা সম্পর্ক একটা স্তম্ভ,কারোর দায় কারোর উপরে চাপানো যেমন অশোভনীয়, তেমনি সম্পর্কের ভালো-মন্দ অন্য সম্পর্কের উপর বর্তানোও ঠিক নয়। যারা এমন করে তারা আসলে কর্তব্য-দায়- দায়িত্ব থেকে এড়িয়ে যাওয়ার বাহানায় করে।' মায়ের শিক্ষা অনুযায়ী স্বামীর বঞ্চনা-লাঞ্ছনা সত্বেও আরাত্রিকা স্বামীর বোন-বাবা-মা বলে তাঁদের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি। স্বামির পরিচয় বাদ দিয়ে তাঁদের সঙ্গে সে ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্তম্ভ করে এগিয়ে চলেছিল সংসারের পথে। তাঁর হাতে ননদের বিয়ে হয়েছে, তাঁর হাতের জল গ্রহণ করেই শ্বশুর শ্বাশুড়ি স্বর্গ লাভ করেছেন। একমাত্র ছেলেকে নিজের আদর্শে মানুষ করেছে। ছেলে বাপন এখন পড়ার সুবাদে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। সংসারের কলেবর তিল রূপ ধারণ করেছে।
স্বামীকে নিয়ে আরাত্রিকা আর বেশি ভাবতে চায়না। যত কাছে যেতে চায় তত বেশি ব্যথা পাওয়ার ভয়ে ফিরে আসে। মনের কথা কারোর কাছে শেয়ার করতে পারে না।
ছেলে যতদিন কাছে ছিল সময় কেটেছে ভালো-মন্দে। চার বছর আগে ছেলে যেদিন গৃহের বাইরে পা রেখেছিল ডাক্তারি পড়তে ব্যাঙ্গালোরে, সেদিনই এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে আরাত্রিকা বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল স্মৃতির ধুলো মাখা পুরানো ডাইরিটা। কৈশোরের ছড়া আর যৌবনের সূচনায় মনের মানুষ খোঁজার আত্মিক লেখনীর পড়ে আরাত্রিকার চোখের কোনে জল আসে। সেজল কলমের কালি হয়ে ঠিকরে পড়ে মোটা ডাইরির অসমাপ্ত পৃষ্ঠায় ছন্দবিহীন ছন্দে, রস বিহীন নিরস বাস্তবে। একটা সময় ছিল আরাত্রিকার, প্রেম থেকে শুরু করে দাম্পত্যের প্রথম জীবনে,যখন দিন-রাতের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ অভিমান! কেন দিন রাত যায় নিমিষে পলকে হারিয়ে। পাঁচ বছর আগেই আরাত্রিকা ভেবে রেখেছিল এই 'সময়'টাই তাঁর বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ছেলে বিহীন এই সংসারে এক একটা দিন হবে এক একটা বর্ষ। জীবনকে করে তুলবে দুর্বিষহ। বুদ্ধিমতী আরাত্রিকা তাই সময়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য ফিরে গেছে তাঁর পুরানো ডাইরিতে। এখন আরাত্রিকার ফেলে আসা দিনের মত সময়ের বড় অভাব। ছোট সংসারে অল্প কাজ,তারপরে একজন কাজের পরিচারিকা। সারাদিন সে লেখায় মশগুল থাকে। তারপরে আবার ফেসবুকের তিন-চারটে সাহিত্য গ্রুপকে পরিচালনা করতে হয় পাকা হাতে। আরাত্রিকার প্রাণবন্ত লেখা ফেসবুকের পেজ-এ আধিপত্য বিস্তার করেছে যথেষ্ট, আশ্রয় পেয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। বদ্ধ ঘরে বসে বন্ধুত্ব করেছে হাজার হাজার। তাঁর লেখাপড়ার জন্য মুখিয়ে থাকে ফেসবুক ফ্যানেরা। মাঝে মাঝেই ঘরের দরজায় টোকা দেয় নামিদামি প্রকাশকরা। খ্যাতি তাঁর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে নীল আকাশের মত। গল্প-কবিতার মাঝে নিজের অভিব্যক্তিকে ব্যক্ত করে অতীতের যন্ত্রণাকে ভুলে থাকে নতুন জগৎ নিয়ে। এখন আর তাঁর কষ্ট হয় না স্বামীর ব্যভিচারীতার জন্য। একটা সময় ভীষণ কষ্ট হতো। হওয়ারই কথা। নারীত্বের সহজাত প্রবৃত্তি,নারী তাঁর স্বামীকে বাঘের মুখে দিতে রাজি আছে কিন্তু পর নারীর মুখে নয়। 'এ যে কত বিষম যন্ত্রনা, যে না-পেয়েছে তাকে বলেও বোঝানো যাবে না।' আরাত্রিকার নারীত্বের অবমাননা আর অপমানের যন্ত্রনায় বিগত পনেরোটা বছর কাটিয়েছে নিঃসঙ্গ মরুর মাউন্ট আবুর মত। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে নিজেই খুঁজেছে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সবুজ পথ। নিজ প্রচেষ্টায় মরা পাহাড়ে ফেলেছে সবুজের আচ্ছাদন। তাঁর লেখা পড়ে অর্কিড মাথা তুলেছে অস্তিত্বের দাবি নিয়ে। সোহাগী হয়েছে ঝর্ণাধারা, রংবেরঙের পাহাড়ি বিহঙ্গ সুর তুলেছে আপন মহিমায়। পথিকের পায়ে রচিত হয়েছে পাকদণ্ডী। নিজের মধ্যে রচনা করেছে এক অলীক বাস্তুতন্ত্র। সেখানে সুখ-দুঃখ-তাপ,মায়া-মোহ,ভালোবাসা সব আছে। নেই শুধু স্বামীর স্থান। তাকে যে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে গেরুয়া মোড়কে মুড়ে চিরতরে রেখেছে সংসারের এক সন্ন্যাসিনী করে।
এখন স্বামী তাকে ভালবাসতে চাইলেও মন আর তাতে সায় দেয় না। যৌবনেই যে যোগিনী হতে বাধ্য করেছে, কামনার নিঃসৃত রতি নোনা জল রূপে চক্ষু বিদীর্ণ করে কপোল ভিজিয়েছে আর তা জিভ দিয়ে চেটে চেটে ক্ষুধা মেটাতে বাধ্য করেছে, তাঁর ভালোবাসা গ্রহণ করা এবং ক্ষমা করা দুইই পাপ।
স্বামীর থেকে আরাত্রিকা মনটাকে সরিয়ে নিয়েছে বিয়ের পাঁচ বছর পরেই,ভোগের পশরা হিসাবে আরো পাঁচটি বছর দেহটাকে রেখেছিল স্বামীর শয্যাপাশে মিশরের মমির মতন। যদি স্বামী তাঁর নিজের ভুল শুধরে আবার ভালোবাসে, যদি দেহে আবার সহৃদয়-প্রাণ ফিরে আসে তাই। কিন্তু হতভাগিনী আরাত্রিকার জীবনে সে আশার বাতি আর কোনদিন জ্বলেনি। বাইরের থেকে বাড়িটার দিকে তাকালে আরাত্রিকা মনে হয় পিরামিড। বাধ্য হয়ে স্বামীর শয্যা ত্যাগ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে দোতলার দক্ষিণ পশ্চিম মুখী ব্যালকনি ওয়ালা সাজানো-গোছানো ঘরটায়। সেখানেই আরাত্রিকা আলাদা শয্যায় রাত যাপন করে। সেখানেই চলে অবলীলায় আরাত্রিকার সাহিত্য চর্চা। তবে এখনো স্বামীর প্রতি প্রাত্যহিক কর্তব্যগুলো কাঠের পুতুলের মত করে যায়। পরিচিত মহলে আরাত্রিকার দাম্পত্য জীবন মধুর বলেই জানে।
ইদানিং আরাত্রিকার স্বামী তাঁর ওপরে অতি স্ত্রৈন মনোভাব ব্যক্ত করতে থাকে। স্বামীর প্রাত্যহিক দায়িত্ব পালন করতে গেলে গায়ে পড়ে অনেক কথাই ছুড়ে মারে। মাঝে-মধ্যে আরাত্রিকা তাঁর কথার প্রতুত্তর দেয় এক-দু শব্দে উপহাসের সুরে, অথবা কটাক্ষের সুরে। পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব পুরুষের স্ত্রীর প্রতি দুর্বল মনোভাব প্রকাশিত হয় কেবল দীর্ঘ দাম্পত্যের জন্য নয়, শারীরিক দুর্বলতার জন্যও বটে। আরাত্রিকা বুঝতে পারে তাঁর স্বামীর যৌবনের দম্ভ অবদমিতের পথে বয়সের ক্রম ভারে। তাই গায়ে পড়ে তাঁর এই আদিখ্যেতা। আরাত্রিকার স্বামী আরাত্রিকার কাছ থেকে আশানুরূপ ব্যবহার না পেলে মাঝে মাঝেই অনধিকার চর্চা করে। যেটা আরো বেশি গাত্রদাহ আরাত্রিকার কাছে।
সেদিন কোজাগরী রাতে আকাশ জুড়ে ভাঙ্গা মেঘ আর চাঁদের খেলা। তারই আলো-ছায়া আছড়ে পড়েছে ব্যালকনি পেরিয়ে আরাত্রিকার আলগোছা কবি-শয্যায়। ছেলের সাথে ফোনে কথা বলার পরে আরাত্রিকা তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের নিটোল শরীরটাকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিছানায়, দীর্ঘ দিন আলমারিতে থাকা অব্যবহৃত ভাঁজ না ভাঙ্গা নতুন কাপড়ের মত। আকাশের চাঁদ আরাত্রিকার চোখে হাতছানি দেয় নীল নেশা নিয়ে। চোখ জুড়ে মোহময়ী আলো, হৃদয় জুড়ে মর্ম স্পর্শ কারী মন্তব্য করা ফেসবুক বন্ধুদের কভার পিকচারের ভিড়। স্বভাবি-কবি মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার জন্য কলম তার হয়ে ওঠে দশমাসের পোয়াতি। হেলে পড়া সূর্যে দেহ পোড়ানোর তীব্র বাসনা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। 'দহন' কবিতা লেখা প্রায় শেষ। একটা লাইন মাত্র বাকি। শয্যার ওপর উপুর করা দেহটার ভার ঢেলে দিয়েছে বাম কনুইয়ের ওপর। ডান হাতের কলমটা আশ্রয় নিয়েছে দাঁতের ফাঁকে। সদ্য প্রসবা প্রসূতির মত আরাত্রিকা চোখ বোলাতে থাকে ভূমিষ্ঠ কবিতার দিকে। এমন সময় পিছন থেকে কে যেন তাকে জড়িয়ে ধরেছে বাহুডোরে। আরাত্রিকা চকিত বিজলির মত দেহটাকে তুলে চোখ ফেরালো পিছনে। দেখল একটা হাঁটু খাটে তুলে মহিষাসুরের মতো দাঁড়িয়ে কালপুরুষ! সেপুরুষ আর কেহ নয়, তাঁর স্বামী! জীবনের প্রথম দেখা অচেনা দুর্বৃত্ত পুরুষের স্পর্শে যেমন আঁতকে ওঠে নারী, তেমনি আরাত্রিকা আতঙ্ক ভরা কম্পিত কন্ঠে বলল-----
-----কি চাই এখানে?
-----কিছুই চাই না।
-----তাহলে এখানে?
-----তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।
-----কথা বলার জন্য স্পর্শ করার কি কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে?
------স্পর্শ করে কি ভুল করেছি?
বুকের সমস্ত ক্ষোভ-দুঃখ একসঙ্গে দমকা হওয়ার মত বের হতে গিয়ে সরু কণ্ঠদেশে আটকে গেল আরাত্রিকার। সে কোন কথা বলল না। শুধু কসাই-খানার বাঁধা শিশু ছাগের মত অসহায় ভাবে স্বামীর দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে চোখটা ফিরিয়ে নিল উত্তর দেওয়াল ঘেঁষে রাখা ডাইনিং টেবিলের আয়নার দিকে। আরাত্রিকার স্বামী খাট থেকে হাঁটু নামিয়ে বড় গলায় বলল----
-----উত্তর দাও।
-----বড় প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া যায় না
-----তাহলে বড় করেই দাও
-----সময় নেই
-----সময় তোমার হাতে আছে। আসলে কথা বলার ইচ্ছেটাই নেই। আরাত্রিকা তুমি কিন্তু আমার প্রতি অনেক অবিচার করছো।
----যেমন?
-----তুমি অনেক আগেই আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছো, শুধু তাই নয় ছেলেকেও আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে নিজ আদর্শে মানুষ করেছ।
----যাক, তাহলে স্বীকার করলে যে ছেলেকে আমি মানুষ করেছি। আর ছেলে যদি তোমার থেকে দূরে থেকে থাকে তাহলে সে দোষ আর কারো নয়, সেটা তোমার। পিতৃস্নেহ দিয়ে তুমি তাকে কাছে রাখতে পারোনি।
-----তাহলে আমি যদি বলি, আমি অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলাম তার জন্য তুমি দায়ী। তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমাকে আগলে রাখতে পারোনি।
----তার মানে তুমি বলতে চাইছো, এখন কোনো নারীর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক নেই। অবশ্য না থাকারই কথা, রক্তমাংসের জোশটা কমেছে তো।
----সে খবরটা রাখার তোমার সময় নেই।
----সময় আছে যথেষ্ট কিন্তু প্রয়োজনীয়তা নেই।
----প্রয়োজনীয়তা না থাকারই কথা, আমার বিকল্প জগত তুমি খুঁজে পেয়েছো।
----খুঁজতে তুমি আমাকে বাধ্য করেছ।
----তুমিও আমাকে ঘরের বাইরে পা বাড়াতে বাধ্য করেছিলে।
----কেমন করে?
----বিয়ের আগে তুমি আমায় যেভাবে সময় দিতে এবং ভালবাসতে,তুমি বলো, বিয়ের পরে তুমি আমার জন্য কতটা সময় দিয়েছো?
----বিয়ের আগে দীর্ঘ তিন বছর তোমার সঙ্গে প্রেম করেছি। তখন শুধু তোমায় আমি ভালবাসতাম, তুমি আমার কাছে যতটা সময় চেয়েছো, তার চেয়ে বেশি সময় দিয়েছি। কলকাতার অলিগলি রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে এমন কোন পার্ক নেই যেখানে তুমি আমি যাইনি। কিন্তু বিয়ের পরে তোমার সংসারে মা-বাবা-বোন তাঁদের সকলের দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে আমি তোমার ভালোবাসা চেয়েছিলাম আর তোমার মন পেতে চেয়েছিলাম। তোমার সেবা-যত্ন নিজের হাতে করার জন্য বাড়ির পরিচারিকাকে পর্যন্ত বাদ দিয়েছিলাম, নিজের হাতে তোমায় ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াবো বলে রান্নার মাসিকেও বাদ দিয়েছিলাম। আমি তো এর মধ্যে দিয়ে তোমাকে চেয়েছিলাম। আমি মনে করি বিয়ের পরে প্রত্যেকটা মহিলার এমনটাই করা উচিত। আর আজ যে দাবি নিয়ে কথাগুলো আমাকে বলতে এসেছো, সে কথাগুলো বলার দিন অনেক বছর আগেই চলে গেছে। তাছাড়া সেই সময়ে সংসারে আমার ভূমিকায় তুমি কোনদিন বাঁধা দাওনি বরং আমার কাজে তুমি বাহবা জানিয়েছ।
-----আমি বলিনি, তুমি তো বলতে পারতে।
-----আমি যখন সবকিছু জানতে পেরেছিলাম তখন অনেকটা সময় গড়িয়ে গিয়েছিল।
-----যখন তুমি জানতে পেরেছিলে কোন নারীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক।তুমি তো কখনো নিষেধ করনি। আর তাছাড়া অনেক পুরুষই এমনটা করে থাকে,ভুল স্বীকার করলে তাঁদের স্ত্রীরা কি তাঁদের মেনে নেয় না?
-----তোমার মত ভুলটা যদি আমি করতাম,! তুমি আমাকে মেনে নিতে? তুমি যদি অবিবাহিত কোন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে, আমি কষ্ট পেলেও সতীনের ঘর করতাম।
----তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমি কোন বিবাহিত নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম?
-----শুধু সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলে না, তোমার ভালোবাসার মহিলার স্বামীর মৃত্যুর কারণ তুমি!
----এসব কথা তোমাকে কে বলল?
----ভদ্রলোক আত্মহত্যা করার আগে সুইসাইড নোট আমাকে পোস্ট করেছিলেন!
-----আমাকে তো কোনোদিন বলোনি একথা!
----কেন বলিনি জানো? আমি অশান্তি করলে হয়তো তুমি ফিরে আসতে। কিন্তু তুমি যদি ফিরে আসতে তাহলে স্বামীহীনা অসহায় মহিলাটা তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পথে পথে ভেসে বেড়াতো।
----তার জন্য তুমি তোমার ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিলে?
----আমার ভালোবাসার বিশ্বাস ভঙ্গ করে তুমি পর-দ্বারে নিজেকে সঁপে দিয়েছো, এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মৃত্যু হয়েছিল! তোমার প্রতি জন্মেছিল আমার ঘৃণা! যে ঘৃণা তোমাকে ভুলে থাকতে সাহায্য করেছে।
----তার মানে তুমি বলতে চাইছো তোমার জীবনে আমার কোন স্থান নেই
----নো নো নো, নেভার এ জীবনে আর কখনোই না!
----তোমার লেখার মধ্য দিয়ে তুমি যে খ্যাতি অর্জন করেছ তাঁর পিছনে কি আমার কোন অবদান নেই?
-----একদমই না!
-----যদি বলি আমি তোমাকে আঘাত করে ছিলাম বলেই তুমি এত বড় লেখিকা হতে পেরেছো।
----যখন তুমি আঘাত করোনি তখনও তো আমি লিখতাম।
----তখনতো আমার ভালোবাসা নিয়ে লিখতে,তোমার লেখার প্রাণপুরুষ ছিলাম আমি।
-----আমি লিখতাম আমার মানসলোকে পোষিত মানসপুত্রকে নিয়ে।
----সে তো আমিই ছিলাম।
----তখন আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু যখন তুমি আমার জীবনে এসেছিলে না, তার আগেও তো আমি অনেক লিখেছি শিশু গল্প-কবিতা। বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণায় আত্মহত্যা করতে পারতাম। আমি বাঁচার জগত নিজে হাতে তৈরি করতে পারব বলেই মরিনি।
-----একথা আমি বিশ্বাস করি আরাত্রিকা।
তবে একথা মুখে তুমি স্বীকার না করলেও তোমার অন্তর জানবে আমার ভালোবাসা এবং আমার আঘাত দুই তোমার খ্যাতির মূল।
-----তোমার কোন কথা আমি আর শুনতে চাই না। শুধু একটা কথা বলতো তুমি কি চাইছো ?
-----আমি চাই আবার পুরোনো দিনে ফিরে যেতে।
আরাত্রিকা মুখে কোন কথা বলল না, শুধু তাঁর দৃষ্টিবাণে বুঝিয়ে দিল,তা আর কখনোই সম্ভব না।
আরাত্রিকার স্বামী তাঁর মুখের থেকে চোখ নামিয়ে বিনয়ী সুরে বলল----
-----আরাত্রিকা তুমি পারো না আমাকে ক্ষমা করে কাছে টেনে নিতে?
হাজার প্রশ্নে আরাত্রিকার বুক ভারাক্রান্ত, যার কোন উত্তরই কোনদিন পায়নি সে। তারই সামনে কি না তাঁর স্বামী জীবনের মর্মান্তিক প্রশ্নটা করল! যার কোন উত্তর আরাত্রিকা কাছে নেই। বুকের কাঁপুনিটা বুকের বসনের নিচে চাপা পড়ে গেল। পাথর বুকে যে কথাটা নিভৃতে কেঁদে উঠলো, 'ক্ষমা চাওয়াটা সহজ কিন্তু ক্ষমা করাটা যে কত কঠিন, এই সংসারে যে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-প্রতা- রিত না হয়েছে সে ছাড়া কেউ বুঝবে না।'
আরাত্রিকা কোন উত্তর দিল না। তাঁর স্বামী মোবাইলটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল আরাত্রিকার কাছে। বলল----
-----তোমার ফেসবুক প্রোফাইলে দেখেছি, হাজার বন্ধুরা জানতে চেয়েছে,আরাত্রিকা দেবী আপনার লেখনীর পিছনে কে অনুপ্রেরণা? কে সেই মানসপুত্র? এই দ্যাখো আরাত্রিকা তোমার আমার ছবিটা।
আরাত্রিকার দিকে তাঁর স্বামী মোবাইলটা তুলে ধরল। আরাত্রিকা দেখল বাসররাতের সেই ছবি। ছবিটা দেখে তাঁর চোখে জল এলো কিন্তু কোন কথাই বলতে পারল না। একটু কাছে এগিয়ে এসে আরাত্রিকার স্বামী বলল----
-----আরাত্রিকা এই ছবিটা পোস্ট করে দাও ফেসবুকে,সবাই জানুক বিদগ্ধা লেখিকা আরাত্রিকাদেবীর ভালোবাসার মানুষটিকে।
-----এত বড় মিথ্যা পোস্ট আমি করতে পারবো না।
-----তাহলে বলো তোমার লেখার অনুপ্রেরণা কে?
-----আর যেই হোক, তুমি নও একথা বলতে পারি।
-----তারমানে আমার অন্তরালে তোমার জীবনে কেউ এসেছে নিশ্চয়ই?
-----সে কথা তুমি ভাবতে পারো। কিন্তু তাতে কিছু আমার যায় আসে না।
-----সত্যটাকে তাহলে মেনে নিলে?
-----না।
-----কেন?
-----মিথ্যা বলে।
-----তুমি যদি না পারো, তাহলে মিথ্যাকে সত্যে প্রতিপন্ন করার জন্য আমি আমার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে এই ছবিটা পোস্ট করে দেবো, যার ক্যাপশন থাকবে, 'বিদগ্ধা লিখিকা আরাত্রিকার সুনিপুণ শিল্পী ধিমান।'
কথাটা বলেই আরাত্রিকার স্বামী ধীমান মোবাইল হাতে বেরিয়ে গেল। আরাত্রিকা উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো খোলা চাঁদের দিকে চেয়ে। ধীমানের কিছু বাক্য আরাত্রিকা কর্ণকুহরে জীবনের শেষ গির্জার ঘন্টাধ্বনি তুললো। স্বামী ধীমানের জন্য সে বিখ্যাত হয়েছে। কথাটা গলধঃকরণ করলেও হজম করতে পারছেনা আরাত্রিকা। তাই গবাদি পশুর মত কথাগুলো উগরে জাবর কাটতে থাকে। জীবনের সমস্ত কিছু শেষ করে দিয়ে এমন দুঃখের কবি হতে চায়নি। যার দুরাচারের জন্য জীবনপাত করে পাথরে ফুল ফুটিয়েছে, সে যদি সেই প্রস্ফুটিত ফুলের ভাগিদার হয়! এই আত্মগ্লানির বিষম যন্ত্রণা সহ্য করার মত বুকের পাটা তৈরি করতে পারেনি আরাত্রিকা। সকাল হতেই লেখিকা রাত্রিকার মিথ্যা বাসররাতের সত্যি ছবিটা দেখতে পাবে। কারণ তাঁর স্বামী ধীমান ভীষণ একগুঁয়ে! যা বলে তা করেই ছাড়ে। সে নির্ঘাত ছবিটা পোস্ট করবে। তাছাড়া তাঁর পবিত্র চরিত্রের উপরে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে গেছে। তাই এমন মিথ্যার বোঝা নিয়ে আরাত্রিকা এপৃথিবীতে থাকতে চায়না। আরাত্রিকা ঘরে এসে তার সারা জীবনের লেখা ডাইরিগুলো এক জায়গায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিলো এবং সেই অগ্নিকুন্ডে দাঁড়িয়ে পড়ল সীতার মত। কিন্তু সীতার মত অক্ষত থাকতে পারেনি আরাত্রিকা। মানবী আরাত্রিকা নিজেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। ক্ষণিকের মধ্যে লুটিয়ে পড়ল বাসররাতের শেষ শয্যায়। মৃত্যুর আগে তাঁর ছেলেকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে গেছে, 'তোমার বাবা আমাকে বাধ্য করেছে আত্মাহুতি দিতে। তোমার মা মরে কী প্রমাণ করতে চাইছে, সে প্রশ্নের উত্তর তোমাকেই দিতে হবে। সাহিত্য মহলে আমার মৃত্যু থাকবে রহস্যে আবৃত। তোমার শোকাহত হৃদয় হয়তো বলবে, 'অগ্নিদগ্ধা মা!' পত্র- পত্রিকায়, ফেসবুক-পেজের শোক বার্তায় হয়তো লিখবে, 'বিদগ্ধা আরাত্রিকা!'
সজল কুমার পোদ্দার । কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
15-02-2020
-
-