অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
দুর্ভাগ্য - সুজিত বসাক

ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে একেবারে হন্তদন্ত হয়ে যে মেয়েটি তার সামনে এসে দাঁড়াল, বেশ কিছুটা সময় অপলকভাবে না তাকিয়ে থাকতে পারল না রকেট। অসম্ভব সুন্দরী না হলেও চোখে মুখে এক অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে, যা তাচ্ছিল্য করা দুষ্কর। অন্তত রকেটের কাছে তাই মনে হল।

“এক্সকিউজ মি...এটা নিশ্চয়ই বি টু ...তাড়াতাড়ি করে তো উঠে পড়লাম। কে জানে ভুল হল কিনা।” 

আন্তরিকভাবে হাসল মেয়েটি রকেটের দিকে তাকিয়ে। রকেটও আন্তরিক হবার চেষ্টা করল – “না না আপনি ঠিক কামড়াতেই উঠেছেন। আপনার সিট নম্বর কত?”

“থার্টি এইট।“ 

“মিডল বার্থ ... আমার ঠিক ওপরেই। আমার লোয়ার বার্থে।“

“ভালই হল। ব্যাগটা আপাতত সিটের নীচে রাখছি ...কেমন?”

“রাখুন না। আমার ব্যাগটা কোনাতে আছে।“

     ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করল রকেট। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। তবে বুঝতে পারল নিউ কুচবিহার স্টেশন থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। মেয়েটা জিনিসপত্র গোছগাছ করে একধারে বসল। গুটিসুটিভাব। রকেটই আগ বাড়িয়ে বলল, “কোথায় যাবেন?”

“শিয়ালদা ... কলকাতা।“

রকেট বুঝতে পারল মেয়েটা এদিকেরই। কথায় উত্তরের টান।

“একাই যাচ্ছেন?” 

“হ্যাঁ। বাবার যাওয়ার কথা ছিল। টিকিটও কনফার্ম ছিল। শেষ মুহূর্তে ক্যানসেল করতে হল। হঠাৎ করে শরীর খারাপ ...বুকে ব্যথা। তবে এখন একটু ভাল“

“খুব জরুরি কাজে যাচ্ছেন নিশ্চয়।“

“তা বলতে পারেন। চাকরির একটা ইন্টার্ভিউ আছে। চাকরিটা আমার খুব দরকার। বাবা ছ মাস হল রিটায়ার করেছেন। যা টাকা পয়সা পেয়েছিলেন তার অনেকটাই খরচ হয়ে গেছে। মা অসুস্থ, ভাই পড়াশুনো করছে, সব মিলিয়ে খরচ তো কম নয়। আমি একটা চাকরি পেলে সংসারে অনেকটা সুরাহা হবে।“

“কলকাতার কোথায় ইন্টার্ভিউ আপনের?”

“শেক্সপিয়ার সারনীতে। কাল বারোটার মধ্যে হাজির হতে বলেছে।“

“উঠবেন কোথায়?”

“ঢাকুরিয়াতে আমার এক মাসির বাড়ি আছে ... ওখানেই উঠব।“

     কিছুটা সময় দুজনেই চুপ। কিছু দেখতে না পেলেও রকেট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। জানালার কাঁচে মেয়েটার প্রতিবিম্ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ... আসলে রকেট সেটাই দেখছিল। মেয়েটার মধ্যে আলগা কোন চটক নেই, কিন্তু মুখে এক ম্যাগনেটিক আকর্ষণ। সেটা তাকে টানছে, বেশ বুঝতে পারছে রকেট। বহুদিন পর একটা নারী মুখ টানল তাকে। কিন্তু সব টানে তো সাড়া দেবার সুযোগ থাকে না। কাল সকালেই দুজনে অন্য পৃথিবীর মানুষ!

“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” এবার মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।

“বাড়ি ... মানে কলকাতা।“

“এখানে কোথায় এসেছিলেন?”

“ব্যবসার কাজে এসেছিলাম। আমাদের একটা ওষুধ ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি আছে। আমি মার্কেটিঙটা দেখি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। বছরে চার পাঁচ বার কুচবিহারেও আসি। আমাদের কয়েকটা প্রোডাক্ট এখানে দারুন চলে। হোটেলে উঠি ...দু তিন দিন থেকে কাজ সেরে চলে যাই।“

     মেয়েটা ফিক করে হাসল। রকেট হাসির কারণটা বুঝতে না পেরে গম্ভীর হয়ে গেল। মেয়েটা বলল, “সরি ... আসলে আমি প্রথমে আপনাকে কোন বড় অফিসার ভেবেছিলাম। আপনাকে দেখে সেরকমই লাগে। তবে মেডিকেলের লোকেরাও অনেকে দারুন সুন্দর হন“

     রকেট কী বলবে কিছু ভেবে পেল না। আকর্ষণ করছে এমন একটা মেয়ের মুখ থেকে হ্যান্ডসাম কথাটা শুনতে ভালই লাগল। প্রশংসায় কাবু হয় না এমন লোক পৃথিবীতে কমই থাকে। চা নিয়ে একজন হকার যাচ্ছিল। রকেট তাকে দাড় করিয়ে বলল, ”দুটো  দিন“

মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, ”না না আমি চা কফি খাই না। আপনি খান।“

রকেট কফির কাপটা নিতে নিতে একটু মস্করা করে বলল, ”অপরিচিত কারও কাছ থেকে কিছু নিতে নিষেধ করে দেয়নি তো বাড়ি থেকে? একা একা যাচ্ছেন ...।“

মেয়েটা লজ্জা পেল, ”না না সেরকম কিছু না। আমি আসলেই চা কফি খাই না। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয়।“

“জাস্ট জোকিং।“ রকেট কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল।

     আবার কিছুটা সময় চুপচাপ দুজনে। দেখতে দেখতে সামনের স্টেশন এসে গেল। ফালাকাটা। স্টেশনে লোকজন বিশেষ দেখা গেল না।

এখানেই রকেটদের রো-র আপার বার্থের প্যাসেঞ্জার উঠল। কুড়ি একুশের একটা ছেলে। ছিপছিপে, লম্বা, দোহারা চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কানে এয়ার ফোন গোজা। কাঁধে একটা লাল রঙের ব্যাগ। সিটটা দেখে নিয়েই সে আর নীচে রইল না। সোজা আপারে উঠে গেল। পাঁচ মিনিটের হল্ট। আবার চলতে শুরু করল ট্রেন।

রকেট জিজ্ঞেস করল ”আপনার বাড়ি কোথায়? কুচবিহারেই?”

“না। আমার বাড়ি দিনহাটায়। কুচবিহারের একটি সাব- ডিভিশন শহর। আপনি গেছেন কখনো?

“না, যাওয়া হয় নি। আসলে আমার কাজ মূলত কুচবিহার শহরেই থাকে ...সময় হয়ে ওঠে না। কমপ্যাক্ট প্রোগ্রাম।“

“কক্ষনো ঘুরে দেখেননি আমাদের নর্থবেঙ্গল“

“তা দেখেছি। দারজিলিং, কালিংপঙ, লাভা, ললেগাও, গরুমারা, হলং, পাহাড় জঙ্গল অনেককিছুই দেখেছি। আপনারা সেই অর্থে প্রাকৃতিক স্বর্গে বাস করেন। বাংলার এই রুপ তো আমাদের সবার গর্ব ...এসব না দেখলে চলে?”

     হাসি ফুটে উঠল মেয়েটার মুখে। স্নিগ্ধ হাসি। মনে মনে আবার মুগ্ধ হল রকেট। এই হাসি একটু সময় নিয়ে দেখলে ভাল লাগত, কিন্তু উপায় নেই।

কি ভাববে মেয়েটা? চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রকেট বলল –“আপনার নামটাই জানা হল না ...।“

“আমি শ্যামলী ...শ্যামলী বসু ...আপনি?”

“আমি রকেট সেন। নামটা শুনে অনেকে হাসে ... আন কমন নেম। আমার মামা রেখেছিলেন। আমার জন্মের কয়েক বছর পরেই তিনি মারা যান। কি ভেবে তিনি নামটা রেখেছিলেন তিনিই জানেন। বাবা চেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন ...মা দেননি। এইসব নাম বহন করা খুব কষ্টকর ...বহু বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়।“

শ্যামলী হাসল– “এটা নিয়ে আপনি একটু বেশি ভাবেন মনে হচ্ছে। এখন তো এরকম নাম অনেকেরই থাকে।“

     শ্যামলীর সমর্থনটুকু ভাল লাগল রকেটের। বেশ স্পিডে চলছে ট্রেন। এসি কামড়া হলেও লোকজনের ভিড় লেগেই আছে। রানিনগর এসে গেল। এখানে কিছুটা দাঁড়াবে ট্রেন, জানা আছে রকেটের। রানিনগরের ভাপা পিঠে বিখ্যাত। স্টেশনেই সার দিয়ে দোকান। প্রতিবারই পিঠে কেনে, এবারও কিনল রকেট। অন্য বারের চেয়ে একটু বেশিই। নিজের সিটে এসে বসে বলল –“এটা কিন্তু খেতেই হবে। না করতে পারবেন না।“

শ্যামলীর চোখ দুটো চকচক করে উঠল –“রানিনগরের ভাপা পিঠে? আমার ভীষণ প্রিয়। সুতরাং না করার প্রশ্নই আসে না।“

     আনন্দ সহকারে খেল শ্যামলী। রকেট প্রথমে ভেবেছিল চায়ের মতো এটাতেও এড়িয়ে যাবে মেয়েটা। এখন মনে হল ওর প্রাথমিক সংকোচটা স্বাভাবিক ছিল। দেরিতে হলেও বিশ্বাসটা অর্জন করতে পেরেছে রকেট। একা একটা মেয়ে কলকাতা চলেছে, এই বিশ্বাসটুকু দিতে পেরে ভাল লাগল। ক্ষণস্থায়ী হলেও এই টুকরো টুকরো ভাল লাগাগুলোকে ভালবাসে রকেট। মেয়েটাকে ভাল লেগে গেছে তার। ওর সান্নিধ্যটুকু ভাল লাগছে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। যদিও জানে এসবের স্থায়িত্ব কাল সকাল পর্যন্ত, হয়তো এ জীবনে আর মেয়েটার সাথে দেখা নাও হতে পারে।

জল খেয়ে শ্যামলী বলল –“কলকাতা আমি সেভাবে চিনি না, তাই ভেতরে ভেতরে একটা টেনশন কাজ করছে রকেট দা। আপনাকে এখন আর বলতে লজ্জা নেই।“

“বেশ তো আমার ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখ, কোন অসুবিধা হলে জানাবে ... আশা করি তোমাকে সাহায্য করতে পারব। কলকাতার সব পার্টেই আমার কম বেশি বন্ধু আছে। এই যা ... তুমি বলে ফেললাম তোমাকে।“

“এতে আপত্তির কিছু নেই। আপনি আমার চেয়ে বড়, তুমি বলতেই পারেন।“ অন্য মনস্কভাবে বলল শ্যামলী।

“তোমার বাবা কী চাকরি করতেন?”

“স্কুল টিচার ছিলেন। বেহিসাবি মানুষ ... টিউশনির প্রতিও কোনদিন ঝোঁক ছিল না। এখন আমাকে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু আমারও জেদ চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াব, তারপরে বিয়ে।“

“মেয়েদের এই স্পিরিটটা ভাল লাগে। কাজের মধ্য দিয়েই মানুষের ব্যক্তিত্ব বেড়িয়ে আসে। অনেক মেয়েই অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু কিছুটা সমাজ, কিছুটা নিজেদের দোষে সেটা আর হয়ে ওঠে না। তোমার যখন এত ইচ্ছে ... তখন তোমার বাবার তোমাকে অবশ্যই এনকারেজ করা উচিত।“

শ্যামলী বলল –“আমাদের ফ্যামিলি আগাগোড়াই রক্ষণশীল। জেঠু তো মেয়েদের চাকরি বাকরি করার ঘোরতর বিরোধী। বাবা অতটা না হলেও, মন থেকে বোধহয় মানতে পারেন না ... কি আর বলব বলুন“

     রকেট একথার কোন জবাব না দিয়ে মৃদু হাসল শুধু। ওদের সামনের সিটে দুজন বয়স্ক দম্পতি ওঠার পর থেকেই চুপচাপ শুয়ে আছেন। দুজনেই অসুস্থ। ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছেন কলকাতা। ওপাশে সাইড লোয়ারে দুজন মধ্য বয়স্ক লোক গল্পে মশগুল। একজন আড়চোখে বারবার দেখছিল ওদের। দৃষ্টি শ্যামলীর দিকে। রিপুর তাড়না চোখে স্পষ্ট। ইচ্ছে করেই রকেট শ্যামলীকে আড়াল করে বসল। লোকটা একটু অপ্রস্তুত হল।  

“আপনি কি বিয়ে করেছেন?”

শ্যামলীর প্রশ্ন শুনে ঘুরে তাকাল রকেট– “না... এখনও হয়নি। তবে বাড়িতে মা যেভাবে চাপাচাপি শুরু করেছে ... এবার বোধহয় করতেই হবে। আমি বড় কিনা। ভাই চার বছরের ছোট।“

“মায়ের চাপাচাপিটা যথেষ্ট সঙ্গত। আপনি প্রতিষ্ঠিত... মায়ের কথাটা রাখা উচিত।“

শ্যামলী গম্ভীর মুখে বলল কথাটা। হেসে ফেলল রকেট। মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল –“আরে বাবা সেরকম মেয়ে না পেলে বিয়েটা হবে কেমন করে?”

“সে কি, কলকাতা শহরে একটা মেয়ে জুটল না মনের মতো? না কি পছন্দের কাউকে বাড়ি থেকে মানতে চাইছে না?”

“না না সেরকম কিছু নেই। আমার বাবা মা একটু বেশিই লিবারেল। এসবে ওদের কোন আপত্তি নেই। মেয়েটা একটু ভদ্রস্থ হলেই চলবে ওদের। আমারই মনে ধরে নি কাউকে, দোষটা আমারই।“

“কে...ন...?” কেনটা বেশ টেনে বলল শ্যামলী।

রকেট হেসে বলল– “এই কেনর কোন উত্তর হয় না। কক্ষনো কোন মেয়েকে যে ভাল লাগেনি তা নয়। কিন্তু সব ভাললাগাকে তো সম্পর্ক পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না। যেদিন সেরকম কাউকে পেয়ে যাব সেদিন বিয়ে হতে দেরি লাগবে না।

     শ্যামলী হঠাৎ চুপ করে গেল। রকেটের দৃষ্টিও বাইরে। রকেটের মনে হল, কথাগুলো বোধহয় একটু বেশিই ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে। সেটা বুঝেই কি শ্যামলী হঠাৎ চুপ করে গেল? কতটুকু সময়ের আর পরিচয়, এর মধ্যেই অনেক ব্যক্তিগত বিষয় ঢুকে পড়েছে। আর বোধহয় এগোনো ঠিক নয় ভেবে রকেটও চুপ করে রইল।

     কিছুখনবাদেই ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ঢুকল। মিনিট কুড়ি পচিশ দাঁড়াবে এখানে। রকেট নিচে নেমে একটু দূরে গিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। শ্যামলী চুপচাপ নিজের জায়গাতেই বসে আছে। অন্যমনস্ক চাউনি। মানুষের মনটা যদি দেখা যেত! আপন মনেই হাসল রকেট। কেমন জানি মায়া হল। একটু হেল্প করলে কি আর এমন এসে যাবে? একজন মানুষ হিসাবে এটুকু করা যেতেই পারে। দু চারটে ব্যক্তিগত কথা হচ্ছে, হোক না, কতটুকু সময় আর হবে? একটু বাদেই সবাই খেয়ে দেয়ে যে যার মতো বিছানা বিছিয়ে শুয়ে পড়বে। এক ঘুমে রাত কাবার। একটু পায়চারী করে, দুটো জলের বোতল কিনে আবার ট্রেনের ভেতরে এসে বসল রকেট।

“তোমার কিছু লাগবে? “সৌজন্যর খাতিরেই বলল রকেট, জানে ওর কাছে সবকিছুই আছে।

“না, জল টল বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছি। “সংক্ষিপ্ত জবাব দিল শ্যামলী।

“তুমি কি কালকের ইন্টার্ভিউ নিয়ে খুব টেনশনে আছো?”

“হঠাৎ একথা বলছেন কেন“ শ্যামলী হাসল।

“না... হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছ... তাই বললাম।

“ইন্টার্ভিউ নিয়ে টেনশন করছি না। যা হবার হবে। মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে, আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। যাকগে আপনার ফোন নম্বরটা দেবেন বলছিলেন...

পরে আবার ভুলে যাব ...আমার যা ভুলো মন!

“ঠিক।“

     রকেট নিজের ফোন নম্বরটা দিল। শ্যামলী ব্যাগের পকেট থেকে কাগজ পেন বের করে লিখে নিতে নিতে বলল –“একটু পরে সেভ করে নেব। এটা আমার বদ অভ্যাস। এখনও এসব ব্যবহার করি।“

“ভালই তো। তুমি রেয়ার মানুষদের একজন।“

“মোটেও ভাল না। এটা বয়স্ক মানুষরা করেন। এজন্য আমার বন্ধুরা অনেকেই আমাকে দিদিমা বলে। কী লজ্জা! আবার ছাড়তেও পারি না। আসলে তাল মেলাতে আমার একটু সময় লাগে। স্মার্ট ফোন সাথে একটা আছে বটে, কিন্তু নিজেই স্মার্ট হতে পারিনি।“

     রাতের খাবার হোটেল থেকেই প্যাক করে দিয়েছিল। প্রতিবারই দেয়। তিনটে রুটি আর পনিরের ডালনা। সঙ্গে দুটো সন্দেশ।

“তুমি খাবে না?” খাবারগুলো বের করতে করতে বলল রকেট।

“এই তো ...বের করছি। আপনি শুরু করুন।“

“আমি রাতে খুব কম খাই। বিশেষ করে জার্নি করার সময়। একটা সন্দেশ নেবে?”

“দিন।“

     খাওয়ার পর্ব চুকে যাওয়ার পর হঠাৎ শ্যামলী বলল –“একটা জিনিস আপনাকে মুখে দিতেই হবে। আমার মায়ের হাতের বানানো নাড়ু। আমার মা বলে বলছি না, একবার খেলে আপনাকে বহু দিন মনে রাখতে হবে। যে খায় সেই বলে।“

“তাই নাকি? তবে তো খেতেই হবে।“

“মাসির জন্য করে দিয়েছে মা। সেখান থেকে একটা দিচ্ছি ... চেখে দেখুন।“

     ব্যাগ থেকে একটা কৌটো বের করল শ্যামলী। কৌটো খুলে একটা নাড়ু দিল রকেটের হাতে। রকেট খেয়ে বলল –“ফ্যানটাসটিক ...সত্যি দারুণ।“

“আর একটা দেব?”

“দাও। মিষ্টিতে আমার অরুচি কম। ভালই লাগে।“ 

     এবার শোবার পালা। মিডিলের সিটটাকে টেনে খুলে সেট করে দিল রকেট। তারপর বলল– “ইচ্ছে করলে তুমি লোয়ারে শুতে পার।“

“না না তার দরকার নেই। মাঝেই আমার বেশি স্বাচ্ছন্দ্য।“

     পরের দিন সকালে রকেটের ঘুম ভাঙল অসহ্য একটা মাথার যন্ত্রণা নিয়ে। কোনরকমে উঠে দেখল ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে দাড়িয়ে। প্রায় বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জার নেমে গেছে। যারা আছে তাদের মধ্যে শ্যামলী নেই। তবে কি শ্যামলী আগেই নেমে গেছে? হঠাৎ রকেটের খেয়াল হল তার গলার মালা, হাতের আংটি, ঘড়ি কিছুই নেই। তাড়াতাড়ি করে সিটের নিচে তাকিয়ে দেখল, ব্যাগটাও উধাও। এবার মাথা ব্যথার কারণটাও বুঝতেও অসুবিধা হল না।

এমন ঘুম কোনদিন ঘুমোয় নি রকেট। তার মানে শ্যামলীর নাড়ুর মধ্যেই মাদক জাতীয় কিছু মেশানো ছিল। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না রকেটের। এমন নিখুঁত অভিনয় দক্ষতা!

     কথাটা চাউর হতেই একজন প্যাসেঞ্জার এগিয়ে এসে বলল –“ভোরের দিকে মেয়েটা আর ওপরের ছেলেটা তড়িঘড়ি নেমে গেল। আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েটা আপনার আত্মীয়। যেভাবে চেনা লোকের মতো কথা বলছিল আপনার সাথে ...। অন্য একজন বলল –“আপনি থানায় একটা অভিযোগ করুন ...সব নিয়েছে? ...কি দুঃসাহস দেখুন ...প্রায় সবার চোখের সামনেই কাজ হাসিল করে চলে গেল ...কেউ বুঝতেই পারল না। শুনেছিলাম এরকম একটা চক্র আছে ...মেয়েটাকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে যে ওরকম? তবে আপনার আর একটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল ...অচেনা কারো সাথে ওভাবে ...।“

     রকেট বুঝতে পারল এসব কথাবার্তা চলতেই থাকবে। এখন জনে জনে এসে উপদেশ দিতে থাকবে। ভুল তো একটা হয়েই গেছে... নিঃসন্দেহে বিরাট ভুল।

এরকম ভুল রকেট আগে কক্ষনো করেনি। কথা না বাড়িয়ে ওখান থেকে সোজা চলে এল থানার সামনে। মোবাইলটা ভেতরের পকেটে ছিল বলে নিতে পারেনি বোধহয়। কিংবা ইচ্ছে করেই এই দয়াটুকু দেখিয়েছে! রকেট মোবাইল চালু করে দেখল শ্যামলীর ছবিটা রয়ে গেছে। ওর অজান্তেই এক সময় তুলেছিল আড়াল করে, স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে রাখার জন্য। এখন এটা শ্যামলীর মরণ বাণ হতে পারে। এই ছবি পেলে পুলিশ ওকে ঠিক খুঁজে বের করবে।

     হঠাৎ মনটা পালটে গেল রকেটের। মনে হল মেয়েটা যেমনি হোক, একটু হলেও একটা ভাললাগা তো উপহার দিয়েছিল তাকে। মেয়েটাকে শাস্তি দিতে গিয়ে ভালোলাগা টুকুর অপমৃত্যু সে ঘটাতে পারে না। অর্থের ক্ষতি একদিন পুষিয়ে যাবে। হোক না ক্ষণস্থায়ী, তবুও এইসব টুকরো টুকরো ভাল লাগাকে ভালবাসে রকেট।

     থানায় আর ঢোকা হল না। স্টেশন থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ি যাওয়ার ট্যাক্সি ধরল রকেট। ট্যাক্সিতে উঠে বির বির করে আপন মনেই বলে উঠল-“তুমি আরও বড় ক্ষতি করতে পারতে শ্যামলী ...সেটা আর পারলে না ...তোমার দুর্ভাগ্য ...।

সুজিত বসাক । দিনহাটা, কুচবিহার