ফিরে পাওয়ার গল্প - শর্মিষ্ঠা গুহ রায়
আমি হলাম একটা বেশ বড় লালটুকটুকে স্নান গামলা। কর্তামশাই আমাকে খুব বড় একটা দোকান থেকে নিয়ে এসেছেন তাঁর নবজাত শিশুপুত্রের জন্য। বাড়িতে আনতেই বেশ একটা হইহই পড়ে গেল। কেউ একজন বলল আমি বিদেশজাত। আমার গায়ে সাঁটা কাগজে আমার জন্মস্থানের নাকি উল্লেখ রয়েছে। আমার গায়ে বিভিন্ন নকশা দেখে সবাই তো একেবারে হাঁ!
আমার তো গর্বের সীমা থাকল না। কর্তামাও বড়ই খুশী। তিনি কাউকে ধরতে দেন না আমাকে। শুধু নিজে হাতে করে জল এনে আমার কোলে ছোট্ট সোনাকে রেখে স্নান করান। সে এক মজার সময়, চারপাশে আর কত বাচ্চা এসে ভীড় জমায় তখন। সবাই ছোট্ট সোনাকে স্নান করাতে চায়।
কর্তামা ভীষণ রেগে যান। বলেন-'বলেছি না কেউ গামলা ধরবে না, শুধু দূর থেকে দেখবে। 'আমিও যারপরনাই বিরক্ত হয়ে উঠি।সবাই কেন ধরবে? আমি শুধু কর্তামার আদরের গামলা হব। ধাক্কাধাক্কি করলে যদি আমার রঙ চটে যায়! এইভাবেই দিন কেটে যায়।
খোকা এখন একটু বড়। আমার কোলে বসে ছপাৎ ছপাৎ করে জল নিয়ে খেলে। আমি খুশী মনে চেয়ে থাকি।
খোকা এখন হাঁটতে শিখেছে। গামলায় বসে সে আর স্নান করেনা। কর্তামাও রোজ আমায় ধুয়েমেজে রাখেননা। বারান্দার এক কোণায় আমি থাকি। মাঝে মাঝে জামাকাপড় ধোয়ার জন্য ঝি দিদি আমায় নিয়ে যায়।
খোকা এখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। দৌড়ে দৌড়ে কেমন ব্যাগ পিঠে নিয়ে স্কুলে যায়। আমি চেয়ে রই। দিনগুলো আমার কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে।
সেদিন দেখি উঠোনে একটা লোক,-'ভাঙাচোরা লোহাটিন কাগজ কিছু আছে নাকি?-বলে চিৎকার করছে। কর্তামা অনেক কিছু জিনিস লোকটিকে দিলেন, আর সব শেষে---সবশেষে আমাকেও ঐ ভাঙা জিনিস গুলোর সাথে বস্তায় ভরে দিয়ে দিলেন। আমি ভগ্ন হৃদয়ে কর্তামার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আমি এখন জঞ্জাল, পুরানো বস্তু। আমার আর কোনো কদর নেই। বস্তা এনে লোকটা একটা জায়গায় সব ঢেলে রেখে দিল। তারপর কী মনে করে আমাকে বের করে এনে কোথায় যেন নিয়ে চলল। কিছুক্ষণ পরে দেখি একটা ভাঙাজরাজীর্ণ বাড়িতে ঢুকে লোকটা চিৎকার করে বলল-'পুঁচির মা দেখ, কেমন একটা গামলা পেয়েছি, আমাদের পুঁচিকে এইটাতেই চান করিও।'
পরম যত্নে পুঁচির মা আমায় হাতে তুলে নিল। রঙহীন ঘরটার এক কোণায় ছোট্ট এক দোলনায় তখন ছোট্ট পুঁচি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল। আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। ছোট্ট খোকা আর পুঁচির মধ্যে আমি কোনো তফাৎ খুঁজে পেলাম না। আমি পরম শান্তিতে অনেক দিন পর একটা নিজের ঘর খুঁজে পেলাম।
শর্মিষ্ঠা গুহ রায়
শিলিগুড়ি, দার্জিলিঙ, ভারত
-
গল্প//উপন্যাস
-
19-01-2020
-
-