অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
হিংস্র গয়াল ও সুবেদ আলীর মৃত্যু - আবু সাইদ কামাল

ভোরের পর্ব শেষে ফাগুনের সূর্যটা সকালের আঙিনায় ঢুকেছে কেবল। তখনি সীমান্তঘেঁষা হাট গোবিন্দপুর গ্রামের ইন্নছ আলী মুন্সির বাড়িতে প্রতিবেশি বিশ্বনাথপুর গ্রাম থেকে নাতনি জরুরি একটা খবর নিয়ে এসেছে। কিশোরী সুফিয়া তার ছোট ভাই শাহ আলমকে নিয়ে ছুটে এসে খবরটা দিয়েছে। জরুরি খবরটা হলো এই, ভোর বেলায় সুফিয়ার মা জরিনা যখন লাউ গাছের মাচানে শাড়ি কাপড় শুকাতে দিচ্ছিল, তখন পাহাড়ি বিশাল এক হিংস্র গয়াল দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। গয়ালটা তার সূচাগ্র শিং দিয়ে গুঁতো দেবার সময় শাড়ি কাপড়ের ওপাশে গিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে জরিনা। তাতে শাড়ি বিদ্ধ করলে এ কাপড়ে জানয়োরটির দু’চোখ ঢাকা পড়ে এবং এ কারণেই সামান্য আহত হলেও জরিনা প্রাণে বেঁচে যায়। জরিনার আকস্মিক আর্তচিৎকারে হতচকিত হয়ে যায় গ্রামবাসী। সাথে সাথে চারদিক থেকে ছুটে আসে লোকজন। শাড়ি কাপড়ে গয়ালের দু’চোখ ঢাকা থাকায় হিং¯্র গয়াল পাল্টা আক্রমণে সুবিধা করতে পারেনি। এ সুযোগ নিয়েই সুফিয়ার বাবা সুবেদ আলী এবং প্রতিবেশী জ্ঞানেন্দ্র মারাকের নেতৃত্বে প্রায় শতেক লোক মামুলি অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে এবং একের পর এক আঘাত করে হাতির মতো বিশালদেহী গয়ালটাকে ধরাশায়ী করে। সাথে সাথে এটাকে জবাই করে মাংস কাটা হচ্ছে। স্থানীয় ডাক্তার এনে জরিনার ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ফলে সুফিয়ার মা সুস্থ আছে। এ খবর শুনে মুন্সিবাড়ির উৎকণ্ঠা কমেছে বটে, তবে মেয়ের জামাই সুবেদ আলীর বীরত্বের প্রশংসা না করে পারেনি। নানার বাড়িতে জরুরি এ সংবাদটা পরিবেশন করে সুফিয়া তার ছোটভাই শাহ আলমকে নিয়ে আবার তাদের গ্রামের বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়।

নাতি-নাতনি চলে যাবার পর নানি হাজেরা বেগম তার ছেলে মিরাজ আলীকে বলে, কি রে মিরাজ! তর বইনডারে পাহাইড়া গয়াল না কী যেনো গুঁতা দিয়া জখম করলো, কেউ তারে দেখবার গেলি না?

-যামু মা। এই- একটু পরই রওয়ানা করতেছি। হাতের কামডা সাইরা লই। 

কিছুক্ষণ পরই মিরাজ বিশ্বনাথপুরের দিকে রওয়ানা হয়। পাশের খরনই গ্রামের পরই তো বিশ্বনাথপুর। কিন্তু যখন সে খারনই গ্রামের মাঝামাঝি যায়, তখনই বহু লোকের শোরগোলের আওয়াজ তার কানে ভেসে আসতে থাকে। অরণ্যে আচ্ছাদিত চিরহরিৎ গারো পাহাড়ের একেবারে পাদদেশ এলাকার এ জনপদে অতীতেও বুনো জন্তু-জানোয়ার এসেছে। ভোর বেলায় ঘুম ভাঙার সাথে সাথে যদি পাহাড় পাদমূল ঘেঁষা কোনো গ্রামে বহু লোকের চিৎকার, স্বরগোল বা হই- হুল্লোড় শোনা গেছে, তাহলে সাধারণ মানুষ বুঝে নিয়েছে যে, পাহাড় থেকে নেমে আসা বন্যপ্রাণিকে লোকে তাড়া করছে। সাধারণত হরিণ জাতীয় বন্যপ্রাণি রাতের বেলায় অসাবধানতাবশে কিংবা বাঘের তাড়া খেয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে নিচের জনপদে চলে আসতো। ভোর বেলায় সীমান্তবর্তী এসব গ্রামের কারো দৃষ্টিগোচর হলেই ‘ধর ধর’ বলে ধাওয়া করতো। কখনো ‘ধর ধর’ এর সাথে ‘হরিণ নামছে-ধর’ কথাগুলো উচ্চারিত হলেই চারদিক থেকে গাঁয়ের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়তো। এভাবে শত শত লোকের বেড়ে পড়ে ধরা পড়তো নিরিহ হরিণ। ধৃত হরিণটা সাথে সাথে করা হতো জবাই। অত:পর উপস্থিত লোকেরা সভানভাগে ভাগাভাগি করে নিতো হরিণের মাংস। 

কিন্তু ফাগুনের কুয়াশাভেজা এদিনের ঘটনা তো উল্টো। পাহাড়ঘেঁষা সীমান্ত থেকে প্রায় দুই কিলো দূরের গ্রামে থেকে থেকে শতশত লোকের এমন শোরগোল শোনা যাচ্ছে কেনো? এমন প্রশ্ন দেখা দেয় মিরাজ আলীর মনে। গারো পাহাড় থেকে মঙ্গলেশ্বরী নদীটা দক্ষিণ দিকে নেমে এসে পুবদিকে মোড় নিয়েছে। কিছুদূর এগিয়ে খারনই গ্রাম অতিক্রম করে আবার দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়েছে। নদীর পশ্চিম দিকের গ্রামের নামই বিশ্বনাথপুর। ঐ গ্রামের মধ্যপাড়া থেকেই মুহুর্মুহু শোরগোল ইথারে ভেসে আসছে। আর চারপাশের গ্রামের উৎসুক লোকেরা বিশ্বনাথপুর গ্রামে জনরবের উৎস্স্থলের দিকে ধেয়ে চলছে। কারণ, সত্যি সত্যি যদি হরিণ জাতীয় কোনো বন্যপ্রাণি নেমেই থাকে, তা ধরা পড়ার সাথে সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে না পারলে তো মাংসের ভাগ পাওয়া যাবে না। এভাবে উৎসুক লোকেরা বিশ্বনাথপুর গ্রামে জনতার কোলাহল শুনে কেবল সেদিকে যাচ্ছেই যাচ্ছে, কেউ আর ফিরে আসছে না। গ্রামের মেঠো পথে খারনই গ্রাম অতিক্রম করে যখন বিশ্বনাথপুর গামী কাঁচা সড়কে উঠলো, তখন সেসব উৎসুক লোকের কাফেলায় মিশে যায় মিরাজ। যখন সে বোনের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলো, তখনো জবাইকৃত পাহাড়ি গয়ালটার হাড়-মাংস কেটে প্রায় শেষ করেছে। প্রস্তুতি চলছে মাংস বন্টনের। ঠিক তখনি বিশ্বনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মাধবী চিসিমদের বাড়ি থেকে আর একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ আসে। মাধবী চিসিমদের বাড়ির পশ্চিমে বিরাট জঙ্গলটিতে নাকি আর একটি বিশালদেহী গয়াল ঢুকেছে। এটাও নাকি ঐ স্কুলের দক্ষিণের খালটিতে ছিল। সকালে যখনি গ্রামের মানুষ টের পেয়ে ধাওয়া করতে চেষ্টো করেছে, ভয়ঙ্কর গয়ালটাও পাল্টা আক্রমণ করতে ছুটে এসেছে। ফলে ভয় পেয়ে কোনো মানুষ গয়ালটির কাছে ঘেঁষতে সাহস করেনি। সমবেত সমস্ত মানুষ নিরাপদ দূরে অবস্থান নিয়ে যখন সমস্বরে হুঙ্কার দিচ্ছে, তখন গায়লাটি জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে।

একটি গয়াল শিকারের সফলতায় সুবেদআলী বেশ দু:সাহসী হয়ে উঠেছে। সে জ্ঞানেন্দ্র সাংমাসহ কয়েকজন সাহসী যুবককে নিয়ে ভয়ঙ্কর এ গয়ালটাকে বধ করার পরিকল্পনা আঁটে। পরিকল্পনা মতো গয়াল শিকারের জন্য যখন বসতঘুরে ঢুকে রাম দা এবং বল্লম নিতে যায়, তখনি স্ত্রী জরিনা তাকে বাধা দেয়। বলে, আর গয়াল মারতে যাইয়েন না আপনে। আল্লাহর দোহাই লাগে- আপনে যাইয়েন না ...

কিন্তু কে শুনে কার কথা। স্ত্রী’র বাধা তোয়াক্কা না করে সুবেদ আলী যখন অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে ঘর থেকে বের হয়, তখন তার কিশোরী মেয়ে সুফিয়া এবং ছেলে আলম পিছন থেকে ডেকে বারণ করে বারবার বলে, বাজান তুমি যাইয়ো না! যাইয়ো না বাজান...

কারো কথায় কর্ণপাত করেনি সুবেদ আলী। শ্যালক মিরাজ তখন আহত বোন জরিনার শয্যাপাশে বসে ওসব শুনে যায়। মিরাজের ইচ্ছে সেও অপর গয়ালটিকে গিয়ে দেখে। কারণ, ওদিক থেকে সমবেত শত শত মানুষের কেলাহল শোনা যাচ্ছিল। বোনের কাছে বসে গল্পে গল্পে কিছুটা সময়ে কেটেছে কেবল। মিরাজ গয়াল দেখার জন্য বোনের কাছে বলে উঠি উঠি করছে, তখনি দু:সংবাদটা এলো। জরিনাদের পাশের বাড়ির চাচাত দেবর রফিক দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেলল। কেঁদে কেঁদে বললো, ভাবী গো, সুবেদ আলী ভাই গয়ালডারে বল্লম দিয়া মারতে গেছিল। অমনি গয়ালডা তার চোক্কা শিংয়ের আগায় ঢুকাইয়া পনর-বিশ হাত ওপরে ফিইক্কা মারে। সুবেদ আলী ভাই মাটিতে পড়ার লগে লগে তার বুকের মইধ্যে দানবের মতো গয়ালডা একটা পাড়া মারে। সুবেদ আলী ভাই বোধ অয় আর বাঁইচ্যা নাই গো ভাবী। চউক্ষের সামনে এইডা কী অউয়া গোলো গো ভাবী!

এ কথা শোনার পর জরিনাদের বাড়িতে শোকের আহাজারি শুরু হয়। শরু হয় গ্রাম উজার করা মরা-কান্না। গ্রামের মেয়ে-পুরষ ছুটে আসতে থাকে এ বাড়িতে। রফিক তখনো কাঁদতে কাঁদতে বলে যায়, সুবেদ আলী ভাইয়ের লগে লগে যারা গয়ালডারে মারতে গেছিল, সুবেদ আলী ভাইয়ের অবস্থা দেইখ্যা সবাই জীবন লইয়া পলাইছে। অহন পর্যন্ত অচেতন সুবেদ আলী ভাইয়ের কাছে কেউ যাওনের সাহস করতেছে না।

এ বিষয়ে ততক্ষণে খবর পাঠানো হয় এক কিলো দূরের সীমান্ত ফাঁড়িতে। শোকের কান্নায় সচকিত গ্রাম। লোকের ভীড় বাড়ছে এ বাড়িতে। রফিক বলে যাচ্ছে, সুবেদ আলী ভাইয়ের শরীলের তাজা রক্তে ঘাস-মাটি একেবারে লাল হয়ে গেছে। অথচ সুবেদ আলী ভাই একটুও নড়াচড়া করতেছে না। 

এ পর্যন্ত শুনে আহত জরিনা উন্মাদিনীর মতো তার স্বামীর কাছে ছুটে যেত চায়। তখন সবাই তাকে ধরাধরি করে আটকায়। কেউ কেউ বলে, গয়ালের কাছে গেলে কি উপায় আছে?

রফিককে তখন মিরাজ বলে,  চলেন গিয়া দেখি, কী করা যায়!

মিরাজের একথা শুনে সুফিয়া, শাহ লালম এবং জরিনাও সাথে যাওয়ার বায়না ধরে।  মিরাজ ও রফিক তখন তাদের বুঝিয়ে বলে, সেখানে ওদের যাওয়া নিরাপদ তো নয়ই বরং খুবই বিপদ জনক হবে। রফিক ও মিরাজ গয়ালের আক্রমণের মুখে পড়লে দৌড়ে কিংবা গাছে উঠে আত্মরক্ষা করতে পারবে। কিন্তু শিশু এবং নারীদের জন্য মহাবিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

এ্ভাবে ওদের প্রাবোধ দিয়ে মিরাজ এবং রফিক রওয়ানা হয়। সুফিয়াদের বাড়িতে শোকের আহাজারি চলতেই থাকে। মিরাজ এবং রফিক ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখে ততক্ষণে ঘটনাস্থলে সশস্ত্র সীমান্ত রক্ষীরা এসে পৌঁছে গেছে। অতি উৎসাহী একজন সীমান্তরক্ষী সদস্য রাইফেল তাক কের গয়াল থেকে বিশ-পচিশ গজ দূরে অবস্থান নেয়। অপর সদ্যস্যরা সামনে থেকে লোক সরিয়ে দিতে থাকে। কারণ, সামনে লোক থাকলে তো গয়ালকে লক্ষ করে গুলি করা যাবে না। 

ততক্ষণে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, পাহাড় থেকে দুটো গয়াল নেমেছে। একটা গয়াল মারা পড়েছে। আর একটা গয়াল একজন মানুষ হত্যা করে হিং¯্র মূর্তি নিয়ে জঙ্গলে অবস্থান করছে। এটাকে নিধন না করলে আরও হত্যাকাÐ ঘটাতে পারে। চাঞ্চল্যকর এ খবর শুনে চারদিক থেকে তখন হাজারো লোক জড়ো হয়েছে। এত লোকের সামনে সীমান্ত রক্ষীর জোয়ানেরা বীরদর্পে গয়ালটাকে বধ করবে।

গারো বাড়ির পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া গয়াল থেকে বিশ-পচিশ গজ দূরে অবস্থান নেওয়া অতি উৎসাহী সীমান্তরক্ষী সদস্যটি গুলি করার সিদ্ধন্ত নেয়। আর তাকে গয়ালের হামলা থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য রাইফেল তাক করে আছে আরও চারজন সদস্য। যখন সেই সদস্যটি গয়ালকে রক্ষ করে গুলি ছুঁড়লো, গুলিটা যেনো বিশাল গয়ালের দেহে সামান্য খোঁচার আঘাত দিয়েছে। আর অমনি ক্রুদ্ধ গয়ালটা এক লাফে ছুটে এসে গুলি নিক্ষেপকারী সীমান্ত রক্ষীকে পাল্টা হামলা করে কোমরে দেয় পাড়া। সাথে সাথে যখন সূঁচালো শিংয়ে আঘাত করতে চাইলো অমনি বাকি সীমান্ত রক্ষীগণ একযোগে ফাঁকা গুলি ছুঁড়লো। তখন ভয়ে গয়ালটা পিছু হটে আবার জঙ্গলের গভীরে আশ্রয় নিলো। এ সুযোগে সুবেদ আলীর লাশ উদ্ধার করে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।

আহত সদস্যকে সাথী সদস্যরা উদ্ধার করে। সে আর উঠে বসতে পারে না। এমন কি পারে না নড়তেও। আহত সদস্যকে বাঁশ ও কাঠের চাঙারি করে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। উপস্থিত হাবিলদার বুঝতে পারে রাইফেলের গুলি দিয়ে গয়ালকে ধরাশায়ী করা কষ্টকর ও অনিরাপদ হবে। তাই সীমান্ত ফাঁড়িতে এলএমজির জন্য পাঠানো হয়। 

ওদিকে মসজিদে ঘোষণা করা হয়, বাদ যোহর সুবেদ আলীর জানাজা শেষে দাফন করা হবে। তার শেষ বিদায়ের আয়োজনে লেগে যায় আত্মীয়-স্বজন। কেউ লেগে যায় কবর খননে আর কেউ মৃতের ¯œানোত্তর কাফন পরনোর কাজে। তবে নিকটাত্মীয় ছাড়া গ্রামের সবাই তখনো গয়ালটাকে ঘিরে পরবর্তী ঘটনা দেখার প্রতীক্ষায়রত। অন্য একটি কারণেও ঘটনাস্থলে প্রতীক্ষা করছে সবাই। আর তা হলো, গয়ালবধের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হলে তো-সেটার মাংসের ভাগ পাওয়া যাবে না।

কিছুক্ষণের মাঝেই এলএমজি ম্যান এসে হাজির হয়। সাথে আসে আরও এক প্লাটুন সশস্ত্র জোয়ান। ঘটনাস্থলে তারা  পৌঁছেই জনসাধারণকে নিরাপদ এক পাশে সরিয়ে দেয়। অত:পর ওরা সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেয়। এলএমজিম্যান দু’জন সহযোগী নিয়ে ট্রাইকিংয়ের ভূমিকা নিতে এগিয়ে যায় মাধবী চিসিমদের বাড়ি। মাটির দেওয়ালঘেরা একটা ঘরের জানালা খুলে এলএমজি স্থাপন করা হয়। অত:পর দুজন সাহসী লোককে গাছে উঠে গয়ালটাকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়তে বলা হয়। এতে বেশ কাজ হয়্। গয়ালটা ঢিলের তাড়া খেয়ে তার অবস্থান পরিবর্তন করে এলএমজির লক্ষস্থলে আসে। অমনি এলএমজিম্যান ব্রাশ ফায়ার চালায়। একঝাঁক গুলি দেহে বিদ্ধ হলে গয়ালটা ধরাশায়ী হয়। 

কিছুক্ষণের মাঝেই সীমান্তরক্ষী সদস্যরা সামনে এগিয়ে যায়। জনসাধারণকে আহŸান করে বিরাটকায় গয়ালকে জবাই করা হয়। তারপর সেটাকে টেনে বিশ্বনাথপুর স্কুলের ফাঁকা মাঠে নেওয়া হয়। তারপরই শুরু হয় চামড়া খসানোর কাজ। পচিশ-ত্রিশজন লেগে যায় চামড়া ছাড়ানোর কাজে। গ্রাম থেকে কলাপাতা সংগ্রহ করতে পঞ্চাশ-ষাটজন লোক চলে যায়। প্রথম গয়ালের মাংস আগে বন্টনের কথা থাকলেও সুবেদ আলীর মৃত্যুর কারণে তা স্থগিত করা হয়। পরে ঘোষণা করা হয় যে, দুটি গয়ালের মাংস একত্রে জড়ো করে একই সাথে বন্টন করা হবে। তাই সেই গয়ালের মাংস আনার কাজেও নিয়োজিত হয় অনেক লোক। মাংস যাতে কোনোভাবে কারচুপি না হয় সেদিকে রাখা হয় কঠোর নজরদারি। এভাবে সমবেত হাজারো লোক নিয়োজিত হয় দুটি গয়ালের মাংস প্রক্রিয়াজাত করণের কাজে। ওদিকে মসজিদে জোহরের আজান ধ্বনিত হয়। ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ছাড়া গ্রামের কোনো মানুষের সেদিকে খেয়াল নেই। নামাজ শেষে নিহত সুবেদ আলীর দাফনকার্য সম্পন্ন হবে বলে বারবার ঘোষণা দিয়ে জানাজায় অংশ গ্রহণের জন্য সমবেত লোকদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু গয়ালের মাংস বন্টনের ভাগ থেকে বঞ্চিত হয় সে কারণে কেউ আর জানাজায় অংশ নিতে যায়নি।

জোহরের নামাজ শেষে স্বল্প ক’জন মুসল্লি এবং নিহত সুবেদ আলীর নিকটাত্মীয়-স্বজনেরাই জানাজায় অংশ নিয়ে তার দাফন সম্পন্ন করে। গ্রামের বাকি লোকেরা তখনো ঘটনাস্থলে।

যার দু:সাহী বীরত্বে সকালে প্রথম গয়ালটি ঘায়েল করা হয়েছে, শতশত লোক মাংসের ভাগ নিতে এসে যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে, সেই বীরের দাফনকার্যে স্বল্প সংখ্যক লোক উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি মিরাজের মনে ভীষণ দাগ কাটে।

ভারাক্রান্ত মনে হাজার লোকের কোলাহলমুখর বিশ্বনাথপুর স্কুলের মাঠে যায়। সেখানে যাওয়ার পর তার কেমন যেনো দৃষ্টিভ্রম হয়। সে দেখতে পায়, স্কুলমাঠে গয়ালের দেহটাকে ঘিরে শতশত নয়; হাজারো মাংসখেকু শকুনের ভীড়।

আবু সাইদ কামাল । ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ