অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
থ্রী সিস্টার্স – বন্যা হোসেন

বাবা ও বাবা, একটু আস্তে হাঁটো না! 

বাবা! তুমি আমার আঙ্গুলটা ছেড়ে দিলে কেন বাবা! 

বাবা! ভাইয়া কেন আমাদের সাথে হাঁটতে আসে না! 
বাবা, ঐ যে কি সুন্দর নীল ফড়িং! একটু ধরে দাও না বাবা! 

বাবা! মা এখন কি করছে বলতো? বাবা জানো, পিংকি আর আমি একসাথে স্কুলে যাবো এখন থেকে!  মা বলেছে। 

 ঐ ছেলেটার পায়ে স্যান্ডেল নেই কেন? ওর কি খালি পায়ে হাঁটতে ব্যাথা লাগে না! 

বাবা জানো, ভাইয়া আমাকে ঘুড়ি ওড়ানো শেখাবে কাল স্কুল থেকে ফিরে! 

বাবা! আমাকে প্লিজ লজেন্স কিনে দাও! আর একটা ভাইয়ার জন্য! 

--টুম্পা, এই টুম্পা!  টুম্পা, কি ভাবছিস? 

পিংকির ডাকে ভাবনাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে গরম স্যুপের উষ্ণ ধোঁয়ায়। সম্বিত ফিরে পেলেও কানে  রিনরিন করে বেজে চলেছে ছেলেবেলার কিচিরমিচির। এই ছোট্ট ক্যাফেতে বসে আলো আঁধারি আর হালকা সুরের মুর্ছনায় অন্য জগতে চলে গিয়েছিলাম!

 চারদিকে রকি পর্বতমালায় বেষ্টিত এই ছোট্ট শহরটির সৌন্দর্যের সাথে হয়তোবা  স্বর্গের তুলনা করা যায়! ক্যালেন্ডারের পাতার নৈসর্গিক দৃশ্য যেন চোখের সামনে। পিংকির মানসিক ধকল কাটানোর জন্যই  শুধু দু'টি দিনের জন্য সভ্যতা থেকে প্রকৃতির কাছে এসেছি। প্রকৃতিরও  নিস্তার নেই, মানুষে মানুষে সয়লাব  এই ছোট্ট শহরটি। 

নীল নীল পাহাড়ের সুউচ্চ শৃঙ্গে সাদা গ্লেসিয়ার রৌদ্রকিরণে ঝকঝকে হীরক খন্ডের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। অপার্থিব সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে কেন যে জীবনের কালিমাময় ছবিগুলো চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়!
 “থ্রী সিস্টারস “ নামের এই ক্যাফেটি মূল শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটু ঘোরানো আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আসতে হয়। আজ ভোরে হোটেল থেকে  বেরিয়ে পাহাড়ের  আশেপাশে খানিকটা  হেঁটে এলাম। 

পিঙ্কির ইচ্ছে ছিল হাইকিংয়ের। সরঞ্জামাদি সঙ্গে নেই, তাই বেশী ঝুঁকি নিতে চাইনি। তবে বাইক ভাড়া করে মাউন্টেইন বাইকিংয়ে গেলাম একটা গ্রুপের সাথে। পিংকি ফিরতে চাইছিলো না। ওর দুর্ণিবার আকর্ষণ এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ্ম প্রস্তর পেরিয়ে বাইক চালানোর প্রতি যতটা, ততটা নয় সমতলে নেমে আসার প্রতি।

এদেশে পড়তে আসার পর পরই শিখেছিলাম মাউন্টেইন বাইকিং সেই ১৮ বছর আগে। আমি আর পিংকি  ঢাকায়  বনানীর বাসার সামনের রাস্তায় সাইকেল চালাতাম। দেশে সেই সময়ে রাস্তায় বড়  মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে কোথাও যেতে পারতো না। 
বাসা থেকেও অনুমতি ছিল না। 

আমার অবশ্য তেমন অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। যেগুলো করার জন্য আমাকে নিষেধ করা  হতো,  তাতেই আমার দুর্ণিবার আকর্ষণ। 

এদেশে এসে আর কোন নিষেধাজ্ঞা  রইলো না। ভ্যানকুভারে এসে বন্ধুরা যখন ছুটি পেলেই চলে যেতো বিভিন্ন দিকে পাহাড়ের  আনাচে কানাচে, আমরাও দাঁতে দাঁত চেপে একবার একটা গ্রুপে নাম লিখিয়ে চলে গেলাম প্রশিক্ষণ নিতে। 

পরের কাহিনীটা ইতিহাস। বহুবার পড়ে, হাত পায়ের চামড়া ছিলে রক্তাক্ত অবস্থা হতো দিনের শেষে। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই এই ভয়ংকর এডভেঞ্চার নেশায় পরিণত হলো। কথা নেই, বার্তা নেই দুজনে ফাঁক  পেলেই ছুটে যেতাম পাহাড়ী সাইকেল চালানোর অদম্য বাসনা পূরণ করতে। আজ এখন এই ৩৬ বছর বয়সে হাত,পা ভাঙ্গার ভয় আছে। কিন্তু স্বভাব যায় না, না মরিলে! 

তবে, এবারে  পিংকিকে স্বতস্ফুর্ত রাখাই আমার  একমাত্র উদ্দেশ্য। 

সেপ্টেম্বর মাস শেষ হতে চলেছে ,বাতাসে শীতের আগমনী ধ্বনির আভাস। এসময়ে আমার কাজের চাপও  থাকে প্রচুর। অফিস থেকে বহুকষ্টে  ৪ দিনের ছুটি নিয়ে ভ্যানকুভার  থেকে ক্যালগেরি এসেছি। 

পিঙ্কির বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পর ছ’মাস পেরিয়ে গেছে, মানসিক ধাক্কা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছিল। ইদানিং ওর বর প্রবালের সংগে একেবারেই বনছে না, পিংকি সেপারেশনের  কথা ভাবছে। ওদের ছেলেটার সাতমাস বয়স হয়েছিলো…গাড়ী দুর্ঘটনায় বাচ্চার প্রাথমিক  কোন ক্ষতি না হলেও  মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে বাচ্চাটা  মারা যায় আকস্মিকভাবে।

আমাদের বন্ধুভাগ্যে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হন। ছোটবেলার বন্ধুত্ব, এক পাড়ায় বড় হওয়া, এক স্কুল-কলেজে পড়া, অবশেষে কানাডায় একসাথে এলাম পড়তে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। কিছুটা বিচ্ছিন্ন হতে হলো, এক শহরে এক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও দুজনের বিষয় ছিল ভিন্ন।

 প্রবালের সাথে পিঙ্কির যোগাযোগ ছিল দেশ থেকেই...প্রবালও চলে এলো, পড়ার পাট চুকোলে বিয়ে করে চাকুরীসুত্রে বিভিন্ন শহর ঘুরে ক’বছর হলো ক্যালগেরিতে থিতু হয়েছে ওরা। ওদের একটি মেয়ে আছে, ৬ বছরের আনুশা। 

এক্সিসেডেন্টের সময় গাড়ীতে ওরা সবাই ছিল, গাড়ী ভেঙ্গেচুরে গেলেও  সবাই ছিল অক্ষত। সাতমাস বয়সের অনল দুর্ঘটনার দুদিন পর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়। পাঁচদিন ধরে যমে মানুষে টানাটানি চলে…বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।  

পিংকির বদ্ধমূল ধারণা, প্রবালের অতিরিক্ত স্পীডে গাড়ী চালানোই এর জন্য দায়ী। ওকে যতই বোঝাই না কেন, এটা দুর্ভাগ্য বা প্রবাল নিজেও কষ্ট পাচ্ছে সন্তান হারিয়ে। 

কে শোনে কার কথা! মায়ের মন বড্ড অবুঝ, অভিমানী। কাউকে দোষারোপ করতে পারলে নিজের মনে শান্তি পায় মানুষ। কাউন্সেলিংয়ের পর মেজাজ কিঞ্চিত ঠিক হলেও প্রবালের উপর রাগ যায়নি। 

--টুম্পা, প্লিজ! পিঙ্কিকে বোঝা! আমার সংসারটা শেষ হয়ে যাচ্ছে! কোত্থেকে কি হয়ে গেলো! তুই ছাড়া কেউ ওকে সামলাতে পারে না! প্লিজ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে আয়। আমাদের বাঁচা বোন!
প্রবালের ডাকেই অগত্যা ছুটে এলাম।
থ্রী সিস্টারসে লাঞ্চ করতে এসে প্রসঙ্গ তুলেছি মাত্র। 

পিঙ্কি রক্তচক্ষু মেলে আমার দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে যা  বললো তা শুধু একজন অপ্রকৃতস্থ মানুষই বলতে পারে! 

---তুই কেমন করে বুঝবি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের কথা, বাচ্চা হারানোর কষ্টের কথা! তোর বর থেকেও নেই…বিয়ে করবো না করবো না করে যাকে বিয়ে করলি সে  কিনা গোটা দুনিয়ার কল্যাণ করছে, আজ জাপান তো কাল নাইজেরিয়া,পরশু হনলুলু এর পরদিন জর্ডান বা অস্ট্রেলিয়া…নিজের সংসারের কল্যাণের বেলায় সে বড্ড হিসেবী! ৩৬ বছর বয়স তো হয়ে গেলো  তোর, এখনও বাচ্চা নিচ্ছিস না কেন?? অন্যকে হেন-তেন উপদেশ বর্ষণ করার আগে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ! স্টীভ বিদেশী ছেলে হয়েও এতটা সহ্য করছে সেই দশ বছর ধরে…বিয়ের আগেও কত নাকানি চুবানি খাইয়েছিস! আমি কখনও তোদের দু'জনের মাঝে কথা বলেছি?

 তোর ব্যক্তি স্বাধীনতায় কখনও হস্তক্ষেপ করিনি, তাহলে আজ কেন তুই আপত্তি করছিস! প্রবালের হয়ে কথা বলিস, তুই কতটুকু জানিস? প্রবাল আজকাল আমাকে ছুঁয়ে দেখে না, জানিস? আনুশকে নিয়ে আলাদা শোয়? হু হু আমাকে চেনোনি বাছা, আমিও ওর পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছি! সব গুমোর ফাঁস করে দেবো। 

আমি হাঁ করে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সামনে বসা সুন্দরী নারীটির দিকে! একে কি আমি চিনি? আশৈশব যাকে চিনি সে যদি অচেনা হয়ে যায়, এই মুহূর্তে প্রলয় ঘটে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই! এক্ষুণি ভালো চিকিৎসা না হলে মানসিক বৈকল্য ঘটতে সময় লাগবে না। পিঙ্কি তখনও থামেনি, সে বলেই চলেছে। মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছি।

 ---তুই জানিস প্রবাল কতো স্বার্থপর, আজ পর্যন্ত আমার কোন ইচ্ছে পূরণ করেছে? আমাকে বকেনি, মারেনি, গায়ে হাত তুলানি তা-তে কি হলো? এত টাকা আয় করে, সেগুলো কোথায়? তোকে এসব বলেই বা লাভ কি ? তুই তো হয়েছিস তোর  মায়ের মতই স্বার্থপর, লোভী। তোর মা তো  টাকার লোভে তোকে ছেড়ে চলে গেলো! 
আমিও ভেবে পাইনি সারাজীবন,  আঙ্কেল মানে তোর বাবা কেনইবা একজন বাচ্চাসহ মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন সেই বয়সে! আম্মুর কাছে শুনেছি, আংকেলের  টাকার জন্যই  উনি নাকি বিয়ে করেছিলেন। মাঝখান থেকে তুই এসে যাবি এটা উনি বুঝতে পারেননি। আমার তো মনে হয়, তুইও টাকার লোভে স্টিভকে বিয়ে করেছিস!

আর সহ্য হলো না আমার! ওকে আজ থামাতেই হবে!   অর্থহীন প্রলাপের দিন শেষ হয়েছে। এতো এলোমেলো ভাবনা ওর মাথায়, নিজের পরিবার বা নিজের মা সম্পর্কে সত্যিগুলি জানার সময় এসেছে। 

অন্ধবিশ্বাসের  মূলে করাঘাত করতে হবে!  গোপন কথার বোঝা  আমার ঘাড়েই বা কেন! একা কেন বইবো বোঝা! পিঙ্কিও কিছুটা ভার নিক। 

পৈশাচিক আনন্দ হলো আমার এই ভেবে যে, সব সত্যিগুলো জানার পর ওর মুখের রঙ বদলের খেলা খুব কাছ থেকে অবলোকন করতে পারবো। পরে হয়তো পস্তাবো, আগে তো হালকা হই। 

----তুই আমার মায়ের কথা বলছিস, তুই নিজের মায়ের কথা কতটুকু জানিস? তোর মায়ের জন্যই যে আমার মায়ের জীবন ধ্বংস হয়েছে সে কথা জানিস? কিভাবে সারা জীবন তোদের দু'বোনকে ঠকিয়ে আন্টি বাবার সাথে সম্পর্ক রেখেছে সেটা কি তোরা জানিস?? 

 বিচিত্র রঙের খেলা পিঙ্কির মুখে।  বিস্ময় থেকে শুরু করে ক্ষোভ, রাগ, বেদনা, হতাশা মর্মান্তিকভাবে  এক লহমায় ফুটে উঠলো ওর মুখে। ওর জন্য মায়াও হচ্ছে, বেচারা সত্যিই জানতো না, আমি জানি।

 পিঙ্কিটা খুব সহজ, সরল, নিষ্পাপ --- নিজের মায়ের বুদ্ধিমত্তার সংগে ও কোনদিন পেরে ওঠেনি। ওর ছোটবোন রিঙ্কিটা অবশ্য বেশ বুদ্ধি রাখে মাথায়। সে অনেক আগেই জানে, বুঝতে পেরেছে নিজের মায়ের জীবনের অকথিত সত্য। একবার একটা ই-মেইল করেছিল। আমার বক্তব্য শুনে আর কোন উচ্চবাচ্য করেনি। 

স্খলিত, ভঙ্গুর গলায় পিঙ্কি বলছে,
--টুম্পা, টুম্পা! এসব তুই কি বলিস? তোর মনে এতো বাজে সন্দেহ আছে আম্মুকে নিয়ে? আর আঙ্কেলের মতো মানুষকে ছোট করেই বা তোর কি লাভ?  

---আমি কাউকে ছোট বা বড় কিছুই করছি না! তোকে শুধু সত্যিগুলো জানতে দিচ্ছি, নিজেকে বোঝার জন্য এই সত্যিগুলো জানা খুব জরুরী। 

---তুইই বা কি করে জানলি? 

----আমার মা-কে বাবা ডিভোর্স করে তার পুরনো প্রেমিকার জন্য…  জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য জানতে হয়েছে পিঙ্কি! জেনে, একটুও সুখ হয়নি, জ্বালা অনেক বেড়েছে। 

---আর আব্বু?? আব্বু কি জানতো না? যত সব গাঁজাখুরি গপ্প? 

---আঙ্কেল জানতো কি জানতো না তা আমার জানা নেই! আঙ্কেল জীবিত নেই, জানার সুযোগও  নেই! তুই মরার পর স্বর্গে গিয়েই জেনে নিস!

---টুম্পা, তুই আর কি জানিস? আমাকে প্লিজ বল! 

পিঙ্কিকে বলতে গিয়ে স্মৃতির পাতায় একের পর এক নানা ছবি ভেসে উঠছে। বাবার সাথে যখন হাঁটতে যেতাম বিকেলে অনর্গল কথা বলতাম। অনর্গল, অবিন্যস্ত, অসংলগ্ন শব্দের কথামালা ঝির়্ঝিরে বাতাসের মতো  ভেসে বেড়াতো। আমি সাদা কালো ছবির এলবামে পাঁচ বছরের  মেয়ে  হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি,  বাবার ডান হাতের কড়ে আঙ্গুলটি শক্ত করে ধরে। গোলাপী ফ্রক, টুকটুকে গাল, মাথার দুপাশে দুটি ঝুঁটি কথা বলার সময় ঘোড়ার লেজের মত নড়ছে এপাশ ওপাশ! বাবা বাদাম কিনে দিতো, নাবিস্কো বিস্কুট কিনে দিতো, জলখাবার মিষ্টির দোকানে নিয়ে মিষ্টি খাওয়াত। পিঙ্কিও যেত মাঝে মাঝে আমাদের সাথে।

 কখনো মা বা ভাইয়াকে নেয়া হতো না! মনে পড়ে, একবার প্রচন্ড চেঁচামেচির মধ্যে ঘুম ভেঙ্গে যায়।  গুটিগুটি পায়ে মায়ের ঘরে ঢুকে দেখলাম, আমার অতি প্রিয় বাবা মায়ের চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বিছানার উপর ফেলে, প্যান্টের বেল্ট খুলে পেটাচ্ছে। বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ, তারপরই আর্তনাদ করে কেঁদে উঠি। 

পরদিনই মা ভাইয়াকে নিয়ে বাড়ী ছেড়ে চলে যান। 

আমাকে মা নিয়ে যায়নি বলে যে অপব্যাখ্যা দিলো পিঙ্কি…বাবা আমাকে নিয়ে যেতে দেননি তার অধিকার ফলিয়ে। সব জেনে, বুঝে, মেনে নিয়েছি নিঃশর্তে বাবার আধিপত্য আর অবৈধ সম্পর্ক পিঙ্কির মায়ের সাথে। দেশ ছাড়ার আগে মায়ের সাথে দেখা করেছিলাম----  ১২ বছর পর! 

 ভাইয়া ছিল মায়ের প্রথম বিয়ের সন্তান! বিধবা হওয়ার পর বাবার অফিসে মা জুনিয়র ক্লার্ক হিসেবে চাকরী শুরু করেন। বাবার দৃষ্টিতে পড়েন আমার রূপসী মা। যথারীতি বিয়ে এবং আমার জন্ম। 

 এই বিয়েটা ছিল সম্পূর্ণ মুখোশ, কিছু সত্যকে আড়ালে রাখতেই বাবা এ বিয়ে করেছিলেন। পিঙ্কির মা রিনি আন্টিকে বাবা ভালোবাসতেন। পরিবারের অমতে বিয়ে করতে পারেননি  কিন্তু নিজেদের মধ্যে  বোঝাপড়া করে নিয়েছিলেন যাতে সমাজের চোখে তারা দোষী সাব্যস্ত না হন। মায়ের চোখে এই ফাঁকি ধরা পড়লেই লঙ্কাকান্ড  বাঁধে। 

  সব শুনে পিঙ্কি বোবা হয়ে বসে আছে।  জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে পর্বতের গুরুগম্ভীর রূপ আর মেঘমালা দেখছি আমি। 

পুরোটা জানাইনি এখনো পিঙ্কিকে। 

রিঙ্কি অনেক দিন ধরেই  তাড়া দিচ্ছিলো ওকে সত্যিটা জানতে দেয়ার জন্য। আজই কি সব বলে দেব? সইতে পারবে তো? মানসিক অবস্থাও তো সুবিধের নয়! ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রিঙ্কিকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে  দিলাম। 
রিঙ্কি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানাল "একটু পর ফোন করছি"!

প্রার্থণা করছি, সত্যটা যেন সহজ হয় পিঙ্কির জন্য। পর্বতমালার শহরটিতে এত টুরিষ্টের আনাগোনা অথচ সবাই কেমন গম্ভীর, মনের ভুলে আভিজাত্য হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে সদাসতর্ক। পর্বতমালার বিশালত্ব আর উদারতার কথা মাথায় রেখে ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। কোলাহল নেই, আপনমনে চলেছে সব নিজ নিজ গন্তব্যে, প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার বাসনা নেই। 

রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের ঝলমলে আলোতে পাহাড়ের চূড়ায় ঝিকমিক করছে শ্বেতশুভ্র গ্লেসিয়ার, অনির্বচনীয় সত্যের মতো যাকে খন্ডানোর সাধ্য কারো নেই। ঝকঝকে নীল আকাশের ফাঁক গলে পরিস্কার দেখা  যায় একসাথে বেড়ে ওঠা পর পর তিনটি পাহাড়ের  চূড়া যার নাম 'থ্রী সিস্টারস'। 

 রিঙ্কির ফোন আসছে মেসেঞ্জারে। তিন সহোদরার মিলনের ক্ষেত্র এভাবেই মিলিয়ে দিলেন কি করে সৃষ্টিকর্তা! যা শ্বাশত, চিরন্তন, অনিবার্য---- তাকে উপেক্ষা করে কার সাধ্য!? 

বন্যা হোসেন । অটোয়া, কানাডা