অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
যন্ত্রণা - শিবব্রত গুহ

মার নাম মিষ্টি দাস। আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার এক অখ্যাত গ্রাম কুমকুমপুরে। আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ -এর আলো এখনো এসে পৌঁছায়নি। আমাদের গ্রামটি বেশি বড় নয়। এখানে ৫০ ঘর লোক বাস করে। সবারই পদবি এখানে দাস। তাইজন্য, অনেকে এই গ্রামকে দাসপাড়া বলেও ডাকে।

ছোটবেলা থেকেই আমি খুব সুন্দরী। গ্রামের লোকেরা বলতো, আমি নাকি এই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। তবে, সুন্দরী বলে কখনো আমি গর্ব করতাম না। আমি সবসময় নিজেকে একজন সাধারণ নারী বলেই মনে করতাম। আমার বাবা নেই। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন এক কঠিন অসুখে আমার বাবা মাধব দাস মারা যান।

তারপর থেকে আমার মা সাবিত্রী দাস আমাকে অনেক কষ্টে তিলতিল করে বড় করে তোলে। ছোটবেলা থেকেই আমি পড়াশুনোয় ভালো ছিলাম। বিদ্যালয়ের দিদিমণিরা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তারা আমাকে সবসময় ভালোভাবে পড়াশুনা করতে সাহায্য করতেন। আমি পরীক্ষায় বরাবরই প্রথম হতাম।

ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হওয়ার। সেইমতো নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। আমার মা আমাকে এই ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিতেন। আমি মন দিয়ে পড়াশোনা করতে লাগলাম। কিন্তু, মানুষ ভাবে এক, আর ঘটে আর এক।

আমি তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ভাবে পাশ করে কলেজে ভর্তি হবার জন্য তোড়জোড় করছিলাম। হঠাৎ করে, আমাদের এক আত্মীয় আমার জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ নিয়ে এল। আমার মা এতে প্রথমে একদম রাজি হয়নি। কিন্তু, আত্মীয়স্বজনের পীড়াপীড়িতে শেষপর্যন্ত রাজি হন। আমি তো প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করছিলাম।

একদিন রাতে, আমার পাশে শুয়ে আমার মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, " তোকে একটা কথা বলবো মা?"
"কি বলো?" - বলি আমি।
" তুই, এই বিয়েতে রাজী হচ্ছিস না কেন? ওদের তোকে খুব পছন্দ।" - বললো মা।
" আমি এখন বিয়ে করবো না, মা। " - বলি আমি।
" কেন? মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস, তখন আজ না কাল, বিয়ে তো তোকে করতেই হবে,সেটা মানিস তো?" - বললো মা।
" সেটা জানি।" - বলি আমি।
" সবই যখন জানিস, তখন আপত্তি করছিস কেন?" - বললো মা।
" আমি আগে শিক্ষিকা হবো। তারপর বিয়ে করবো, তার আগে নয়।" - বলি আমি।
" দেখ, ছেলে ও ছেলের পরিবার খুব ভালো। ওরা তোকে বিয়ের পরও পড়াশোনা করাবে। তোর কোন চিন্তা নেই। এত ভালো সম্বন্ধ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। তুই রাজি হয়ে যায়।" - বললো মা।
" তা হয় না মা, বিয়ের জন্য আমি আমার এতদিনকার স্বপ্নকে শেষ করে দেবো চিরকালের মতো? তা আমি পারবোনা।" – আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলি আমি।
" তবে, তোর যা ইচ্ছা তাই কর, মা হয়ে কি তোর অমঙ্গল চাইবো আমি? এত অবিশ্বাস তোর আমার ওপর! আমি ওদের পাকা কথা দিয়ে দিয়েছি। তুই, যদি এখন রাজি না হোস, তবে আমার মান - সন্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে যাবে। তখন, তুই আমাকে কিন্তু চিরদিনের মতো হারাবি। তুই কি তা চাস? " - রাগের সাথে বললো মা।
"এসব কি বলছো মা তুমি? তুমি ছাড়া এই দুনিয়াতে আমার আর কেইবা আছে? " - উদাস সুরে বলি আমি।
" তাহলে তুই রাজী তো? " - কড়া সুরে বললো মা।
" তাহলে আমার স্বপ্ন?"- জানতে চাই আমি।
" স্বপ্ন তোর বিয়ের পর সফল হবে। দেখ, তোর বাবা নেই। আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তখন তোকে দেখবে কে? এই সমাজটা বড় হিংস্র মা। একা মেয়েকে এরা কখনোই ছেড়ে দেয় না। এই সমাজে মেয়েদের পদে - পদে বিপদ। আমি বেঁচে থাকতে থাকতে যদি তোর বিয়েটা দিয়ে যেতে পারি। তবে আমার শান্তি। নাহলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না।" - হতাশার সুরে বললো মা।
" আমি রাজি, রাজি, রাজি মা এই বিয়েতে। দোহাই তোমায়, আর তোমার মৃত্যুর কথা আমার সামনে বলো না। আমি সহ্য করতে পারবো না মা, কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না।"- হাউহাউ করে কেঁদে আমি মাকে জড়িয়ে ধরি।

ছোটবেলা থেকে, তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নকে চিরকালের মতো জলাঞ্জলি দিয়ে, আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লাম। আমার বরের নাম গণেশ চৌধুরী। ও একজন উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসার। মোটা টাকার মাইনের চাকরি। দেখতে- শুনতে বেশ ভালো। বাবা – মায়ের একমাত্র ছেলে। একেবারে আলালের ঘরের দুলাল যেন। ওর বাবা সমরেশ চৌধুরী একজন সুপ্রিম কোর্টের উকিল। বিরাট নামডাক ওনার। ওর মা কমলিকা চৌধুরী একজন সমাজসেবিকা। উনি একটি এনজিও চালান।

গণেশদের বাড়ি হল কোলকাতার যাদবপুরের ইব্রাহিমপুর রোডে। ওকে বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলা ভালো। অনেকটা জায়গা জুড়ে ওদের বাড়িটা। বাড়ির সামনে আছে বাগান। বাগানে ফুটে আছে নানা রংবেরং এর জানা অজানা কত ফুল। দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যায়। ওদের দুটো বড় গাড়ি আছে। একটা আমার স্বামী ব্যবহার করে। অন্যটা ব্যবহার করে আমার শ্বশুর - শাশুড়ী।

এই বাড়িতে চাকর, বাকর - কোন কিছুরই অভাব নেই। আমি গরীব ঘরের মেয়ে। ছোটবেলা থেকে দারিদ্র‍্যের সাথে কঠিন লড়াই করে বড়ো হয়েছি। এই ধনসম্পদের, বিলাস - বৈভবের প্রাচুর্য দেখে আমি প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম। পরে, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে থাকলাম। অবশ্য, মানিয়ে তো নিতে হবেই, কারণ, মা বলেছিলেন, মেয়েদের সবপরিবেশে মানিয়ে চলতে হয়।

ফুলশয্যার রাত, প্রত্যেক নারী - পুরুষের কাছে এক আনন্দের বার্তা বহন করে। সেই, ফুলশয্যার রাতে, আমি বাসরঘরে, অপেক্ষা করে আছি অধীর আগ্রহে আমার পতিদেবের জন্য। তিনি তো আর আসেন না কিছুতেই। আমি খানিকটা অবাকই হলাম এসব দেখে। আমার যখন বসে থেকে থেকে চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে যায়, তখন হঠাৎ এক অজানা স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তাকিয়ে দেখি, আমার পতিদেব। ওনার চোখ দুটো জবাফুলের মতো টকটকে লাল। আমার মুখের কাছে উনি ওনার মুখটা নিয়ে আসতেইএকটা বিশ্রী গন্ধ আমার নাকে আসলো। এটা কিসের গন্ধ? আরে, এটা যে মদের গন্ধ।
" আপনি মদ খেয়েছেন?" - রেগে বললাম আমি।
" না মানে, আমি খেতে চাইনি। আমার বন্ধুরা জোর করলো তাই। ওরা বললো, ভাই, আজ নতুন বউয়ের সাথে ফুলশয্যা করবে, একটু মদ না খেলে কি চলে? তাই আর কি....." - মাথা চুলকে বলে আমার স্বামী।
" বন্ধুরা বললেই, মদ খেতে হবে, আপনার নিজের মাথায় কোন বুদ্ধি নেই?" - রাগত স্বরে বললাম আমি।
" এই আপনি, আপনি কোরো না তো। আমি তোমার স্বামী। আমাকে তুমি বলবে সবসময়। একটু মদ খেয়েছি বলে এতো রাগ কেন করছো গো?" - জিজ্ঞাসার সুরে বলে আমার স্বামী।
"সেটা ঠিক আছে। তবে, আমি মদের গন্ধ একদম সহ্যই করতে পারি না।" – বিরক্তির সুরে আমি বললাম।
" ও তাই বুঝি, এই তোমার গা ছুঁয়ে আমি আজ দিব্যি করছি, যে, আজকের পর থেকে আর মদ ছোঁব না।" - আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো আমার স্বামী।
" মদ ছাড়া কি অতই সোজা? " - জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
" আমি পারবো দেখো, ঠিক পারবো। আর রাগ কোরো না প্লিজ।" - একথা বলে আমার স্বামী আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। আমিও স্বামীকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ পরে, এক নাক ডাকার শব্দ পেলাম। বুঝলাম, আমার পতিদেব মদের নেশায় চুর হয়ে ফুলশয্যা করতে এসে নেশায় বেহুঁশ হয়ে শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তার পাশে চুপ করে বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে লাগলাম। আমার চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো। আমার স্বপ্নের রাত নিমেষের মধ্যেই হয়ে উঠলো আমার কাছে দুঃস্বপ্ন।

আসলে, আমার স্বামী মানুষটি পুরোপুরি মাতাল। মদ তার নিত্যদিনের সাথী। মদ না খেলে তার ঘুম হতো না। আমি আবার মদ ও মাতালদের একদম পছন্দ করি না। আর আমার ভাগ্যেই শেষে জুটলো কিনা একজন মাতাল স্বামী। হায়রে, পোড়া কপাল আমার!

ফুলশয্যার রাতে, আমার স্বামী যে কথা, আমাকে দিয়েছিল, সেই কথা, সে রাখতে পারেনি। প্রায় প্রতিদিন সে গলা অবধি মদ পান করে বাড়ি ফেরে। আমার গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করতো। কিন্তু, তা আর পারতাম কই! জীবনটা আমার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। আমি আমার মাকে সব জানালাম। মা প্রথমে দুঃখ করলেও, পরে সবকিছু মানিয়ে সংসার করার সুপরামর্শ দিলেন। আমি কাকে নিয়ে সংসার করবো? একটা মাতালকে নিয়ে? যার কাছে একজন নারীর কোন মূল্য নেই। স্ত্রী কি চায়? কি ভালোবাসে? সেসব জানার কোন দরকার নেই তার কাছে। তার বিয়ে করার দরকার ছিল বাবা - মাকে খুশি করার জন্য। তা সে করেছে। এবার আর তার কোন দায়িত্ব নেই। সে ভালোবাসে মদকে। মদ হল আমার অলিখিত সতীন।

দেখতে দেখতে তিনটি বছর কেটে গেল। আমার একটা ছেলে হল। তার নাম রাখা হল সুন্দর চৌধুরী। নামের মতো দেখতেও সে সুন্দর। বিয়ের আগে, আমাকে পড়াশোনা করানোর যে প্রতিশ্রুতি আমার স্বামী ও তার পরিবার আমার মাকে দিয়েছিল, বিয়ের পরে, তা তারা মোটেই পালন করেনি। আমি ছিলাম ওইবাড়ির চাকরানি। বাড়িতে চাকর - বাকরের অভাব না থাকলেও, আমাকে বাড়ির সব কাজ নিজে হাতে করতে হত। আমি গরীব ঘরের মেয়ে বলে, আমার শ্বশুর - শাশুড়ী আমাকে নীচু নজরে দেখতো। আসলে, আমার মতো এক গরীব ঘরের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে আমার শাশুড়ী সমাজসেবিকা হিসাবে সমাজের বুকে তার নাম উজ্জ্বল করলেন। বলির পাঁঠা হলাম আমি। আমাকে ওরা ঠিকমতো খেতে দিত না। যার ফলে, আমার সুন্দর শরীর কুৎসিত হয়ে গেল। আমার স্বামী আমার কোন কথাই শুনতো না। তার মদ খাওয়া ছাড়ানোর আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু, কোন চেষ্টাই সফল হয়নি। এই মদ খাওয়ার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার স্বামীর হাতে আমি যে কত মার খেয়েছি, তার ঠিক নেই। আমার সারা গায়ে কালশিটে দাগ। এরথেকে, আমি আমার মায়ের কাছে অনেক অনেক ভালো ছিলাম। ওখানে অভাব থাকলেও, মানসিক শান্তি ছিল। যেটা এখানে আমি কোনদিনও পাইনি।

সেদিনটা ছিল রবিবার। মদ খাওয়া নিয়ে আমার স্বামীর সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হয়। আমার ছেলের সামনে আমার স্বামী আমাকে খুব মারছিল। আমার ছেলে চিৎকার করে কাঁদছিল। মারের চোটে আমি কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। আমার ঠোঁট কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছিল। এমন সময়, হঠাৎ করে, সেখানে, আমার মা এসে উপস্থিত হয়। আমার অবস্থা দেখে মা কেঁদে ফেলে। মায়ের মন সন্তানের জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। মা আর আমাকে এই পাষন্ডদের কাছে না রেখে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। আমার ছেলেকে ওরা ওদের কাছে রেখে দিল জোর করে। আমার সোনামানিক কাঁদছিল "মা মা" করে।

তারপর, থেকে, আমি আমার মায়ের কাছেই থাকি। আমি এখন একটা স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে কাজ করি। আমি আগের থেকে অনেক ভালো আছি। তবে, স্বামীর ঘর না করতে পারার যন্ত্রণা, আমার একমাত্র ছেলেকে হারানোর যন্ত্রণা আমাকে এখনো কাঁদায়, কাঁদায়, শুধু কাঁদায়।

শিবব্রত গুহ । কোলকাতা, ভারত