অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
শোকসভা - আলম তৌহিদ

বৃষ্টি হটাৎ করে বেড়েছে। অনেকক্ষণ ধরে ঝির ঝির ঝরছিল। এখন মুষলধারে অর্থাৎ ঝুম বৃষ্টি। আকাশ ক্রমশ অন্ধকার হয়ে এলো। আরও মেঘ এসে ঘনীভূত হল। ফ্ল্যাশ লাইটের মতো মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছিল বিজলীর আলো। একটু পরপর দূর থেকে ভেসে আসছে বজ্রপাতের শব্দ। ঘড়িতে এখন ৫টা বাজে। বৃষ্টিভেজা বিকেলকে অনেকের সন্ধ্যা বলে ভ্রম হতে পারে। মকবুল সাহেব বারবার ঘড়িতে সময় দেখছেন। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এখন বিকেল। তার চোখে মুখে বিরক্তি ও উদ্বেগের চাপ। 

ছোট্ট যাত্রি ছাউনির ভিতর গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক। রাস্তায় পানি জমেছে বলে যানবাহন কমে গেছে। রিক্সা-সিএনজি-র দেখাও তেমন মিলছে না। অগত্যা বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। এর মধ্যে একটি কম বয়সী ছোকরা মকবুল সাহেবকে দু’বার পাড়া দিল। তিনি কটমট করে তাকিয়ে বললেন-এই ছোকরা চোখে দেখ না! 

ছেলেটি মুখের উপর জবাব দিল-দেখমু ক্যামনে, এতো গ্যাঞ্জামে কি নিচের দিকে তাকন যায়? সে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মকবুল সাহেব চোখ লাল করে কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করলেন। চাকরি থেকে রিটায়ার্ডের পর তিনি অল্পতে রেগে যান। অবশ্য পূর্বে এই স্বভাবটা তার ছিল না। তিনি ছিলেন খোশ দিলের মানুষ। গল্প-গুজবে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। অফিসে তো কাজের চেয়ে গল্পেই ডুবে থাকতেন বেশি। তার ধারণা সরকারি অফিসে কাজের চেয়ে কথার গুরুত্ব বেশি। কথা বলতে জানলে আর কোন সমস্যা থাকে না। তাই মন্ত্রীরা বেশি বেশি কথা বলেন। প্রয়োজন না থাকলেও সমানে কথা বলে যান। জনগণ জানেনা মন্ত্রীরা কী কাজ করেন। ঘুষ নিয়ে মকবুল সাহেব খোলাখুলি কথা বলেন। তার মধ্যে কোন রাখঢাক নেই। তিনি মনে করেন ঘুষ প্রথা বন্ধ হয়ে গেলে অফিস আদালতের কাজকর্মে স্থবিরতা চলে আসবে। ঘুষ নাকি ফাইল-পত্রকে গতি দান করে। তাছাড়া তিনি ঘুষ বলতেও নারাজ। তার মতে সেটা উপরি আয়। 
এই উপরি আয়ের বদৌলতে তিনি মফস্বল শহরে এক ভিঘা জমির উপর বানিয়েছেন একটি আলিশান বাড়ি। বাড়ির সামনের অংশে বিরাট লন। পিছনের দিকে একটা সুইমিং পুল করার পরিকল্পনা ছিল; পরে সেটা বাদ দিয়ে পুকুর কেটেছেন। তার ইচ্ছা মৎস্য চাষ করবেন। তেলাপিয়া মাছের কিছু পোনা পুকুরে ছেড়েছেন। দিন দিন পোনাগুলো বড় হচ্ছে। তিনি যখন মাছকে খাবার দেন সেই সময় তার মধ্যে একটা খুশি খুশি ভাব চলে আসে। তখন তার স্ত্রী শর্মিলা পাশে থাকেন। মাছকে খাবার দেয়ার কাজটি তারা খুবই উপভোগ করেন। অন্যসময় একঝাঁক বিষণ্ণতা তাদের মনের আকাশ ঘিরে রাখে। 

তাদের বিষণ্ণতা অমূলক নয়। সন্তানরা কেউ কাছে নেই। বড় ছেলেটা থাকে জার্মানিতে; ছোটটা অস্ট্রেলিয়ায়। মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন এক প্রবাসী ছেলের সঙ্গে। ওরা থাকে কানাডা। তারা কেউ দেশে আসতে চায় না। একবার প্ল্যান করে সবাই দেশে এসেছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের একটা নাক সিটকানি স্বভাব হয়েছে। তারা বলে আবর্জনার দেশ। সন্তানদের কথা শুনে মকবুল সাহেব খুব হতাশ হতেন। বলতেন- ‘মোহ’! বুঝলি, তোরা সবাই মোহে মজে গেছিস। মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শিক্ষা নিস নাই। 
ছোট ছেলেটার চটাং চটাং কথা বলার স্বভাব। সে বলে উঠল- বাবা, মাইকেল জ্যাকসনের নাম শুনেছি। মাইকেল মধুসূদন নতুন কোন সিঙ্গার নাকি? 

মকবুল সাহেব একদম চুপ। তবে একবার আড়চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। মনে মনে ভাবলেন-উলুবনে মুক্তা ছড়িয়ে লাভ নেই। এরপর সন্তানরা বিদেশে ফিরে গেল আর দেশে আসেনি। মাঝে মাঝে মা-বাবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলে। এইটুকু সান্তনা নিয়ে এখন মকবুল সাহেবের দিন কাটে। 

বৃষ্টি কমে এসেছে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিকে মানুষ তোয়াক্কা করেনা। রাস্তায় এখনো হাঁটুপানি জমে আছে। মানুষ ছুটছে আপন গন্তব্যের দিকে। মকবুল সাহেব লক্ষ্য করলেন যাত্রী ছাউনিতে তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ইতস্তত করছিলেন; কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না রাস্তায় নামবেন কিনা। এমন সময় রাস্তার পানিকে দু’ভাগ করে একটা সিএনজি অটো এসে থামল যাত্রী ছাউনির সামনে। চালক পর্দা সরিয়ে বলল-স্যার যাইবেন নাকি? মকবুল সাহেব কোন কথা বললেন না। দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলেন। 

সন্ধ্যা নাগাদ তিনি বাড়িতে এসে পৌঁছলেন। দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এই সময়ে পাখিদের মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা যায়। মকবুল সাহেব ব্যাপারটা প্রায় লক্ষ্য করেন। সাঁঝের মায়া বলে যে একটা কথা আছে, পাখিদের উপর কী তার কোন প্রভাব আছে ; নাকি পাখিদের অন্ধকার ভীতি আছে? তিনি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। এদিকে শর্মিলা আগে থেকেই স্বামীর উপর বিরক্ত হয়ে আছেন। তার ধারণা জীবিত মানুষের শোকসভা হতে পারে না। এটা উদ্ভট চিন্তা। মানুষকে তামাশা দেখানো ছাড়া আর কিছু না। তিনি বললেন-এসব আজগুবি চিন্তা মাথা থেকে নামিয়ে ফেল। এ বাড়িতে কোন শোকসভা হবে না। 
মকবুল সাহেব ঘাড় বাঁকা করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তোমার সমস্যা কী?
সমস্যা অনেক। জীবিত মানুষের শোকসভা হয় আমি কখনো শুনিনি। লোকজন হাসি-ঠাট্টা করবে। 
করুক! অ্যাই ডোন্ট কেয়ার! আমি কেবল দেখতে চাই আমার মৃত্যুর পর কার কেমন ফিলিংস হবে তা। 
তোমার তো মৃত্যু হয় নাই। তাহলে ফিলিংসটা আসবে কোত্থেকে? 
তুমি কালো শাড়িটা পরবে। কালো হচ্ছে শোকের রঙ। এ থেকে তোমার অর্ধেক ফিলিংস চলে আসবে। বাকিটা পাবে পরিবেশ থেকে। শোকসভার দিন শোকের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। কোরআন খতম হবে। দশজন মৌলভিকে আসতে বলেছি। 
শর্মিলা চুপ হয়ে গেল। আর কথা বাড়াল না। তিনি জানেন কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ হবেনা। স্বামীকে নিবৃত করার মতো শক্তি তার হাতে নেই। নির্লিপ্ত হয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।

পরদিন সকাল ১০টার দিকে উদয়ন ক্লাবের সভাপতি ও সেক্রেটারি এলো মকবুল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। শোকসভা আয়োজনের পুরো দায়িত্ব তাদের উপর। এখনও অনেক কাজ পড়ে আছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলাপও সেরে ফেলা দরকার। মকবুল সাহেব সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন- কাজ কতোদূর এগোল হারুন?
প্রায় গুছিয়ে এনেছি মকবুল ভাই। তবে ছোটখাট কিছু কাজ বাকি আছে। আশা করছি তা দু’দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। 
শুক্রবার বাদ জুমা অনুষ্ঠান। মাঝখানে দুটো দিন সময় আছে। তোমরা গুছিয়ে নিতে পারবে? 
পারব। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমাদের কাজে কোন ফাঁক থাকবেনা। আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারি মাসুদ আজ ঢাকা চলে যাবে। কাল ব্যানার নিয়ে ফিরবে। আপনার এক কপি ছবি দরকার। 
ছবি দিয়ে কী হবে? 
ব্যানারে দেব। ডিজিটাল ব্যানারে ছবি থাকলে গর্জিয়াস দেখাবে। 
কিন্তু ছবি তো তোলা নেই। 
সঙ্গে সঙ্গে মাসুদ বলে উঠলো-এইটা কোন সমস্যা না। আপনি সোজা হয়ে বসেন। আমি মোবাইলে ছবি তুলে নিচ্ছি। এতেই কাজ চলবে। 
হারুন কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল-বৃষ্টি নিয়ে আমার খুব টেনশন হচ্ছে মকবুল ভাই। ঐ দিন বৃষ্টি হলে লোকজন তেমন আসবেনা। 
হ্যাঁ, বৃষ্টি একটা সমস্যা বটে। এক কাজ করো ওয়াটার প্রুভ সামিয়ানার ব্যবস্থা করো। এতে যারা আসবে তাদের আর বৃষ্টিতে ভেজার ভয় থাকবে না। 
হারুন মাথা ঝাঁকাল। ভালো আইডিয়া তাই করতে হবে। আরেকটা কথা......
কী কথা? 
এমপি সাহেব জীবিত ব্যক্তির শোকসভায় আসতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। 
তাই নাকি! এমপি বাদ। অন্য কাউকে খুঁজে বের করো। 
পৌর মেয়রকে দাওয়াত দিয়েছিলাম, তিনিও রাজী না। শেষমেশ আলী নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব রাজী হলেন প্রধান অথিতি হতে। 
যাক, একজন প্রধান অথিতি পাওয়া গেল। তোমরা এখন যাও, বাকি কাজগুলো শেষ কর। আমি এখন মাছকে খাবার দিতে যাব। ভাবছি পুকুরটা আরও বড় করে কাটাব। 

আজ শুক্রবার। টানা ৫দিন বৃষ্টির পর সূর্যের দেখা মিলেছে। বৃষ্টি ধোয়া আকাশকে আরও বেশি গাঢ় নীল দেখাচ্ছে। বৃষ্টি হওয়ার মতো মেঘও জমা নেই আকাশে। তবুও বর্ষার আকাশকে বিশ্বাস কী? যে কোন মুহূর্তে বদলে যেতে পারে। কাল সারারাত টেনশনে ঘুমাতে পারেননি মকবুল সাহেব। 10mg ইনক্ট্রিন খেয়েও তার ঘুম আসেনি। কিন্তু সকালের ওয়েদার তার মনে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। তিনি বেলকনিতে এসে দাঁড়ালেন। বাড়ির লনে বিরাট প্যান্ডেল করা হয়েছে, স্টেইজের কাজও শেষ। এখন সাউন্ড সিস্টেম বসানোর কাজ চলছে। প্যান্ডেলের এক কোণে কার্পেট বিছানো হয়েছে। কার্পেটের উপর রাখা হয়েছে কয়েকটি বালিশ। এখানে হবে কোরআন পাঠের আসর। মকবুল সাহেব লক্ষ্য করলেন শর্মিলা নির্লিপ্ত হয়ে শুয়ে আছেন। যেন এ বাড়িতে কিছুই হচ্ছেনা এমন একটা ভাব ধরেছেন। মকবুল সাহেব স্ত্রীকে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। ভাবলেন এখন কিছু বলা ঠিক হবেনা। একটু পর মাইকে একজন লোকের গলা শুনা গেল। লোকটি বলছে- শব্দযন্ত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে; এক, দুই, তিন............।
আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল শোকসভা চলাকালীন মকবুল সাহেব ঘর থেকে বের হবেন না। কারণ তাকে কেউ দেখে ফেললে শোকসভার ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হবে। তিনি ঘরের অন্দরে প্রবেশ করলেন। স্ত্রীকে বললেন-শর্মিলা কালো শাড়িটা পরে নাও। শর্মিলা দৃঢ়ভাবে জবাব দিল- না। 

বাদজুমা অথিতিরা আসতে শুরু করলো। অনেকে কৌতূহল বশত বিনা দাওয়াতে এসে পড়ল। মৌলভিরা এসেই কোরআন তেলাওয়াত শুরু করে দিল। খতমে কোরআনের পর ১মিনিট নীরবতা পালনের পর শোকসভার মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। কোরআন তেলাওয়াত শেষ হলে মকবুল সাহেবের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হল। এবার শুরু হল মূল অনুষ্ঠান। ১মিনিট নীরবতা পালনের জন্য সবাই দাঁড়িয়েছে। তখনই ঘটল ঘটনাটা। একদল লোক লাঠি হাতে স্লোগান দিতে দিতে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করলো। তাদের স্লোগানের ভাষা ছিল এরকম-‘জীবিত ব্যক্তির শোকসভা করা, চলবে না চলবে না’। ‘শরিয়ত বিরোধী কাজ, মানি না মানবো না’।
পলকে সভাস্থল কুরুক্ষেত্রে পরিণত হল। কোরআন তেলাওয়াতের জন্য যে দশজন মৌলভি এসেছিল তারা পবিত্র কোরআন ফেলে পালিয়ে গেল। ক্লাবের ছেলেরা হাতের কাছে যা পেয়েছে তা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দাড়িয়েছিল। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে তারাও চম্পট দিল। অথিতিরা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছিল। মিছিল নিয়ে আগত লোকেরা হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে উদাও হয়ে গেল। 
মকবুল সাহেব সভাস্থলের ধ্বংসস্তূপের মাঝে এসে দাড়ালেন। তার ভেতরে একটা চাপা ক্ষোভ ঘনীভূত হচ্ছিল। তিনি একবার চতুর্দিক দেখে নিলেন। বুঝতে পারলেন অনেককিছু চুরি হয়ে গেছে। তারমধ্যে দামী কার্পেটটাও খোয়া গেছে। পবিত্র কোরআন গুলো বিক্ষিপ্তভাবে মাটিতে পড়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে তার কিছুটা মায়া হলো। এমন সময় একটি লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়িতে করে একদল পুলিশ এলো। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন-মকবুল সাহেব কোথায়?
মকবুল সাহেব ভ্রূ-কুচকে বললেন- আমি! 
অফিসার সঙ্গে সঙ্গে বললেন- ইউ আর আন্ডার এরেস্ট! 

আলম তৌহিদ 
কবি-প্রাবন্ধিক-গল্পকার 
বাংলাদেশ।