কবি মোহাম্মদ রফিক এর কবিতা
গন্ধ আসে
আদিতম হনন উত্সবে
মৃত্যুই আমার উপহার,
খণ্ড দেহ, মস্তিষ্ক, করোটি,
ফুল-ফলে, সাজিয়ে থালায়,
যেন বা পুজোর উপচার,
দরগাহ্য় মোম ও লোবাণ,
চন্দনে চর্চিত মাংসঘ্রাণ;
পৌঁছে যাই, পরির প্রাসাদে,
কত যুগ পেরিয়ে, এই তো
যদি তার চক্ষু ছুঁয়ে যায়
করুণায়, আবেগে আর্দ্র বা
ঈষৎ হাসির রেখা ঠোঁটে,
হতে পারে, বিদ্রূপে বঙ্কিম;
তবু, চন্দ্রকান্তি খেলে যায়
অগ্নিদগ্ধ মল্লিকা বিতানে,
জন্মের শূন্যের শূন্য উপচে
পূর্ণ হবে, প্রাণের আরতি;
এ যে দেখি, শবের স্বদেশ,
শুধু আমি, শ্বাস নিতে পারি;
বাজছে শঙ্খ, মসজিদে আজান,
শুনি, শুনে মুচড়ে ওঠে দেহ;
তখনও বধির হু-হুঙ্কার,
লাভাস্রোত হিমানী রক্তের
ধোঁয়াকুয়াশায় মাংসঘ্রাণ;
যেন কোনো স্বর্গীয় আরক!
যাত্রা, প্রভাতিয়া
জলতরঙ্গে ভাসে-ডোবে লাশ,
বরযাত্রী, আকাশি-যাত্রায়;
ভৈরবীতে, সুর ভাঁজে ওঁম,
কোথায়, সে কবে, মৃত্যু হল,
শিশুকণ্ঠ গেয়ে ওঠে, জয়,
পাপড়ি ভেজে প্রভাতী শিশিরে,
ঠমকে, গমকে, মীড়ে, লয়ে,
মন্দ্রিত মেঘের জ্বালে হোম;
দিগ্বধূর দু’টি চক্ষু ছেয়ে
প্লাবিত আকাশ ধরণির;
এই জন্মে, অমর যাত্রায়
বরযাত্রী, স্বর্গের দুয়ারে
শঙ্খধ্বনি, সূর্যের রশ্মিতে
প্রভাতিয়া, চুম্বন বাতাসে;
আজ তবে, দু’চোখে মিলন
অন্তরীক্ষে, তোমাতে-আমাতে;
চক্ষুর চক্ষুতে সৌরলোক
রক্তধারা লাল রক্ত নীল,
এবার, আমাকে হত্যা করো,
তোমাকেও হত্যা করি আমি,
সংগমের, মঙ্গল শীৎকারে;
কালান্তর দেহান্তর কালে
দেহ, বৃষ্টিধোয়া, ভস্ম বালু,
শব্দহীন নি:শব্দের বোল
অকূলের নক্ষত্রমিনারে;
যাও পাখি, উড়ি উড়ে যাও,
পারিজাত, তড়পায় হৃৎপিণ্ডে,
হলুদিয়া মন্দির আসমানি;
ব্যর্থ নয়, বিরহ-বাসর!
তবে না
তবে না, নিজেকে মুক্ত করো
সম্পূর্ণ বিমুক্ত করে দাও,
মন্দিরে গীর্জায় গৃহে-গৃহে
আঙিনায় প্রাঙ্গনে প্রান্তরে,
যে ভাবে বনজ পুষ্পকুঁড়ি
পাপড়ি মেলে বৃক্ষে লতাগুল্মে;
তুমি ভোর, দেবির প্রতিমা,
স্তনবোঁটা চু’য়ে ফোঁটা ফোঁটা
দুধসাদা জলভরতি আলো,
নিয়ে নেয় যা-কিছু ধরণির
প্রাণবন্ত অতৃপ্ত প্রাণের
ফুল-ফল মানব-মানবী,
তোমাতেই চরম পুলকে
কামে ও ক্লান্তিতে ঘামে নেয়ে
ভারহীন অনন্ত বিহারে
ছুঁয়ে যায় সৃষ্টির প্রলয়ে
শিলাখণ্ড, অগ্নিতে ও জলে;
তুমি বধূ, আবেগে মন্থনে
অকালেই কালের রসিয়া,
চম্পাবতী, বাউলানি পাপড়িতে
এসো, স্পর্শ করি তোমাকেই
ঘুম-ভাঙা শিশির শয়ানে,
অবগাহনের বহু পূর্বে;
আমি, বৃষ্টিধারা, পদ্মকুঁড়
তুমি, তবে পদ্মের পুকুর,
তোমার শরীর ভাঙা ঢেউ
আনন্দিত শিহরণ, আমি
টালমাটাল ডূবি ভাসি, থাকি
জগতপ্লাবিত অন্য কোনো
জগতের, বিহ্বল বিথারে
থিরঅথির, মরণউৎসবে;
ত্রিভুবন, লোকে-লোকে, তুমি
সুখপাখি, নিশি- অবসানে
বিমুক্ত উন্মুক্ত, ভালোবাসা
আলোস্নাত আলো আলোকিত
পুকুরের ঢেউ জল, যথা,
মসজিদে মিনার, ক্যাথিড্রাল!
শব্দ, নি:শব্দের
শব্দ, যদি মৃত্যুঘণ্টা হয়,
তোমার হৃৎপিণ্ডে গিয়ে বাজে
এক-একটি ক্ষুব্ধ বাক প্রতিমা;
বৃষ্টিফোঁটা, ঊষর প্রান্তরে,
আষাঢ়ের প্রথম দিনের
নিবেদন, প্রণতি, অর্চনা;
রাগ-রাগিণীর মোহনায়
ঢেউ ভাঙে উথাল-পাথাল
নাগকেশরের পত্রপুষ্পে
অভিসার, কেতকি-কদমে,
অভিশাপ উজিয়ে কালের,
সে তোমার দায় নয়, নয়
কারো হাহাকার বা প্রার্থণা;
যমুনায় জোয়ার উছলায়
কালিন্দীতে ভাটার গুঞ্জন,
কালের আসন্ন কালান্তর
বিবশ মেঘের শবযাত্রা
শাওনি-পূর্ণিমায়, ছায়া-ছায়া
আবছায়া ধুপছায়া ছায়া
মুমূর্ষু আলোর রক্তফোঁটা
শব্দের অন্তিমে, ভালোবাসা;
মেঘমেদুরম ডম্বারুম
বন্দিনীর আবেগ, নিথর
কঙ্কালের, ধুলোতে গড়ায়
বেভুল প্রচ্ছদ অন্তরালে,
তুমি, তাকে জাগাবে কী করে;
কোন ঋতুমতি অলকার
কাহিনির অবশেষ হলে,
জাগে স্রোত, অলকানন্দায়!
কে কাঁদে, নরকে
কাঁদো কাঁদো কাঁদো বাংলাদেশ,
হাজার বছর, দু’হাজার
শতাব্দীর ওপারে শতাব্দী,
ক্লান্ত শ্রান্ত, ক্ষত ও বিক্ষত,
ঘুম ঘুম নিদ্রাহীন ঘুম
কোন এক অনন্ত কালের;
যদি- বা পাহাড় জেগে ওঠে
মরাস্রোত গায় ভাটিয়ালি
প্রভাতি কীর্তন বালুচরে,
মৃদঙ্গের বোল দগ্ধ তৃণে
ঊষর বিরানে, টিউ-টিউ
পাখির কঙ্কাল, জীর্ণ ডালে
শূন্য নীড় দিয়ে ওঠে শিস,
নড়েচড়ে শবের কুণ্ডলী
ভাগাড়েও জোটে নি বা ঠাঁই;
শিঙা বাজে শেষ- বিচারের,
চাঁদের পর্দায় জমে হিম
কুয়াশার আলো আস্তরণ;
বাংলাদেশ, মাতা-পিতা-ভ্রাতা,
সে-মুহূর্তে জেগেও জাগল না,
ভবিতব্য, কালের আকালে;
ঘুমের দেশের ঘুমপ্রজা
ঘুমভাঙানিয়া জাগরণী,
গুহার পাথরে প্রতিধ্বনি
বরফ-পাথারে, নিমজ্জিত;
হল হলাহল অবশেষে
কোন কাহিনির অন্ত:সার,
লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যার,
লেখা রইবে, দেয়ালে, ললাটে;
মসীলিপ্ত দাগচিহ্ন খুঁজে;
সেইদিন যদি ভাঙে ঘুম!
কবীর ভজন
শুনো ভাই সাধু
এই দেশে, মুক্ত শুধু খুনী, নিহতের লাশ;
একটি মেয়ে, পুড়ে মরে বেঁচে রইল;
অন্য মেয়ে. বেঁচে রইল মরে গিয়ে!
মা মাগো মা,
তোমাকে স্মরণ করে, আজ কাঁদি
দেবি বলেশ্বরী মা মা মাতামহুরী
প্রিয়া প্রিয়তমা ধলেশ্বরী , তোমাদের
পূণ্যতোয়া স্রোতে ধৌত বাংলাদেশ
অভিশাপ শাপ মুক্ত হলো না কিছুতে;
যেমন বঙ্গবন্ধুর রক্তস্রোতে
স্নান সেরে, বাঙালি মানুষ, বাংলাদেশে
তবু, জয় বাংলা, বাঙালির জয়
বিশ্বময়, হায় রে হায় রে, হায় হায়
কারবালায়, জাগে রে মর্সিয়া!
অধীরা অধীরায় গো
যেন মন্ত্র, যৌবনে জরার,
ঘুমদেশে তরণী ঘুমায়;
উলটো স্রোতে নাও বাই, নাইয়া
এই নদী, গহন অবধি,
তটহীন নির্জনতা, খাঁড়ি
অচিন প্রবাদ, সাগরের
মোহনাও, অলীক ধারণা;
যেমতি, অরূপে অপচ্ছায়া,
কোথাও পাহাড়, ওই ওই
সেনাই আন্দিস, হতে পারে
দূরান্তের প্রান্তদেশ ছুঁয়ে
মানব-বসতি, গাঁওগঞ্জ;
ইতিহাস, কোন আঁস্তাকুড়,
উজিয়ে ভাসিয়ে, আর্তরবে
কোন এক, আকাশ চুড়োয়,
ওড়ে, হিংস্র বাজ, ঠোঁটে নিয়ে
মাংসখণ্ড, সোনালি ঈগল
পাখনায়, টুপটাপ, ঝরে
রক্তফোটা, প্রবল ধারায়,
যেন বান ছোটে ধরান্তর,
ওরে চিল, নিতান্ত দর্শক,
ঘ্রাণ পায়, তাতেই উন্মন;
শিকার-শিকারি, হত্যাযজ্ঞে
ছুটে আসে, প্লাবন, বেবান,
রক্তরাঙা ধূম কুয়াশায়
আবর্ন আকীর্ণ চরাচর;
পাতালের ঘূর্ণিস্রোত,
বেয়ে চলো নাও, ভবিতব্য;
মুঠো, আলগা হয়ে আসে, তবু
দাঁড়, নাইয়া, ছাড়বো না কখনো,
দেখি, বইঠা, ভেসে যায় ওই
ঢেউয়ের আবর্তে, ডাইনীর বা
চুল্লি জ্বলে, হিস হিস আগুনের
শব্দ, বিদ্রূপের মারণের;
মানি না মানব না, আছি আছি
কখন কোথায় কতদুর
কোন শূন্যে শূন্যতার শূন্যে
শুনি ওই কোন কালে, বাজে
সদ্যজাত শিশুর ক্রন্দন,
ওরে কালা কালা রে রে কালা,
যেন সুরা, স্রোতে অতলের
যেন বা আয়াত, অন্তর্লোকে
বন্দেগী, মরণে জীবনের;
অস্তাচলে নাচে প্রেতযোনি,
নাচুক, ঐহি তো পৌঁছে গেছে;
মন্ত্র বাণী; মাভৈ , নাইয়া রে!
স্বপ্নের অধিক বাস্তব
অলৌকিক, না, তারও অধিক;
সে কটকায়; দু’হাজার চার;
নদী-মোহনার, তীর বেয়ে,
পুরো পরিবার, কাদাজলে
মাখামাখি, ক্রমে উঠে আসি,
তৃণের প্রান্তরে, চতুর্দিক
বিকেল তখন মৃত প্রায়;
ধূসর দৃষ্টিতে দেখি, দূরে
কিছু দূরে, বাতাবি লেবুর
গাছ, নিচে অসংখ্য হরিণ,
মাতা-পিতা সন্তান- সন্ততি;
ডালে-ডালে ত্রস্ত বানরের
পাল, ছিঁড়ে ফেলছে পাতা, যেন
সদলে হরিণ, সেরে নেয়
রাতের আহার; আনন্দিত
অধীর উল্লাসে আত্মহারা,
আমরাও যেন বা, একসঙ্গে
একাকার গোধূলি আলোয়,
টের পাই, শরীরে- মজ্জায়
হয়ে যাই, মাটি ও প্রকৃতি,
বুঁদ, বন্য মদালস ঘ্রাণে;
হঠাৎ আমার নাতি, শ্রয়,
বয়স, হবে বা, হয়তো, চার,
এক ঝটকায় বাবা-মার
হাত ছেড়ে, টালমাটাল পায়ে
হেঁটে চলল, মরে আসা ঘাস
মাড়িয়ে, হরিণের পাল, দেখে,
চেয়ে থাকে; প্রায় সকলেই
হতবাক, নড়তেও অক্ষম,
শুধু দেখছি, এক পা দুই পা
এগিয়ে চলেছে শ্রয়, দূরে
হরিণের পাল, পাতা মুখে,
থমকে যায়, তাকায়, নিশ্চুপে,
তারপর এগোয়, যে দিকে
শ্রয়, ধীরে এগোয়, পিছোয়,
যেন সন্তর্পণে, ক্রমে ক্রমে
শ্রয়র দু’পাশে, ঘিরে আসে,
ঘোরে কিছুক্ষণ, অত:পর
শুরু করে নাচ, মলিন সে
আলোয়, নাতিও হেসে ওঠে,
খলবল খল খলখল
জোয়ার ভেঙেছে মোহনায়
বাতাসে গরানে হু হু স্বর
শত কণ্ঠে গর্জিছে আকাশ;
বানর দঙ্গল, বিস্ফারিত
চক্ষু মেলে, পিছনে দর্শক;
কেউ যেন, ক্যামেরাটা হাতে
তুলে, দ্রুত লুকিয়ে ফেলেছে,
এই দৃশ্য, কোনো জাগতিক
যন্ত্রে, বন্দি হওয়ার তো কথা
নয়, রক্তেমাংসে সমুজ্জ্বল
তার যাত্রাপথ, ধমনির
উষ্ণ লালরক্তস্রোত বেয়ে
হৃৎপিণ্ড অবধি, ধরণির,
এ- মুহূর্ত, অনন্তে ভাস্বর,
স্বয়ংবরা, জীবনে জীবন;
ঘুম-ভাঙা ঘুমে, যেন স্বপ্নে,
প্রণত আলোর ভোর, শ্রয়
হাঁটুমুড়ে কাঁদে, ওরা কই !
গ্রাসিয়াস আ লা ভিদা
শব্দই, শব্দের হন্তারক,
নি:শব্দের, মধু প্রতারক,
আদি কথা, প্রলয়ে সৃষ্টির,
সৃষ্টি, প্রলয়ের অন্ত:সুর,
ধন্যবাদ হে মহাজীবন;
রক্তাক্ত ফুলের, মুখোমুখি
আগুনের স্পর্শে, জেগে উঠি,
ক্ষণিকের মূর্ছা, ভেঙেছে কি
বেহ্বলতা, অপরাধ বোধ;
ধর্ষক বা নিপীড়ক নই,
ভালোবাসি, আমি, মুখে বলি,
শব্দের বৈধতা, অবৈধতা,
টের পাই, বুকের ভিতর,
ক্রোক, ক্রোক, ডাকে কোলাব্যাঙ,
তার পিছে, সাপ, বিসর্পিল;
তবে কি শব্দই অপরাধ,
ভালোবাসা, মহাপাপ, পাপ,
মধুলতা ভোর, চেয়ে দেখি
থইঅথই আকাশ-পৃথিবী
আলোমগ্ন জলভাঙা ঢেউ,
ভাসমান বহমান ডোবে
ডুবন্ত সময়, পরিধির
স্থান, কূল, অখিল নিখিলে;
ঝটপট পালায় কুয়াশা,
রক্তের আঘ্রাণ, সহ্য নয়
সহ্য নয়, খাবলে-খাওয়া ধড়,
আমিও কি সূর্যের সন্তান;
হে ধরণি, ক্ষমা করে দাও,
মহাকাল কাল কালান্তর
স্বপ্নধ’স, বরফ আগুনে,
পুষ্পিত কোরকে, মধুহূল,
পার্বতী শরীরে, মহেশ্বর;
সাগরের ঢেউযাত্রা, শুনি
কই, মাটিমাংস ভাঙা, ডাক;
যাত্রা ছিল, বিষম সুন্দর!
*কবি মোহাম্মদ রফিক এর ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে এক গুচ্ছ প্রকাশিত হলো। শুভ জন্মদিন কবি। কক্সবাজার থেকে কবি'র পক্ষে কবিতাগুলো পাঠিয়েছেন মানিক বৈরাগী।
-
ছড়া ও কবিতা
-
23-10-2019
-
-