অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
ফেলে আসা দিনগুলি (পনেরো পর্ব) -হুমায়ুন কবির

য়েকদিন হলো আব্দুর রহিম গ্রামের বাড়িতে গেছে মেয়েকে দেখতে। অনেকদিন পর মেয়ে স্বামীর বাড়িতে গেছে। যে কারণে চয়ন আব্দুর রহিমকে ছুটি দিয়েছে। বেতন ছাড়া কিছু বাড়তি টাকাও দিয়েছে। যাতে মেয়ের বাড়িতে মিষ্টি ও পছন্দ মতো কিছু কিনে নিয়ে যেতে পারে। ছেলে বেলা থেকেই চয়ন খুব মানবিক। অন্তর দৃষ্টি দিয়ে মানুষের ভিতরটা দেখে নিতে পারে। মানুষের কষ্ট চয়নকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করে। চয়নের কেবলি মনে হয়, "আহা! পৃ্থিবীর একজন মানুষেরও যদি কোন কষ্ট না থাকতো?  তাহলে কি-যে ভালো লাগতো"! মানুষের এতো কষ্ট দেখতে আর ভালো লাগেনা। 

টিভি অন করতেই দেখতে পেলো, মিরপুরের একটি বস্তি আগুনে পুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। দমকল বাহিনী যখন আগুন নেভালো তখন পুড়ে যাওয়ার মতো আর কিছুই বাকী নেই। চারদিক খাঁ খাঁ করছে। শুধু ছাই আর ভস্ম। এক একটা পরিবারের মানুষের সবকিছুর সঙ্গে সব স্বপ্ন, আশা আকাঙ্ক্ষা মুহূর্তেই ছাই হয়ে আকাশে উড়ে গেলো। একজন মহিলা হাউ মাউ করে কাঁদছেন।
-" আমার তো আর কিছুই নেই। টাকা, আসবাবপত্র, সংসার সব পুড়ে গেলো। আমি অহন থাকুম কই? খামু কি?"

চয়ন নির্বাক হয়ে গেলো। দুঃখী মানুষগুলির জীবনে এ-কী ঘটে গেলো। এভাবে আর কতদিন সবহারানো মানুষগুলো নিঃস্ব হবে? আর তাদের হাহাকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে বেদনার গহীন অতলে স্বপ্নগুলো তলিয়ে যাবে? জীবনের সব হাসি-আনন্দ আর চাওয়া-পাওয়া গুলো হারিয়ে যাবে বিশাল শূন্যতায়?" 

চয়ন টিভি বন্ধ করে দিলো। আজকে অফিস নেই। আব্দুর রহিম দুই থেকে তিন দিনের খাবার রান্না করে রেফ্রিজারেটরে রেখে গেছে। শুধু ওভেনে গরম করে নিলে খেতে পারবে। তবুও খেতে ইচ্ছে করছেনা। মনটা কেমন বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। রেবেকা গত সপ্তাহে বলেছিলো আজকে অদ্বিতের থেরাপী বিদ্যালয়ে নিয়ে যাবে, দেখাতে। কিভাবে অটিস্টিক শিশুদেরকে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। শেখানো হয় সামাজিক যোগাযোগের পন্থা। অদ্বিতের বিদ্যালয়ে গেলে হয়ত ভালো লাগতে পারে। শিশুদের সান্নিধ্য মানে অনেক কিছু। এক একটা শিশু যেনো এক একটা দেব-দূত, ফেরেস্তা! চয়ন সিদ্ধান্ত নিলো অদ্বিতের বিদ্যালয়েই যাবে।

অদ্বিতের বিদ্যালয় খুব বেশি দূরে না।  রিক্সা করেই যাওয়া যায়। যদিও চয়ন এর আগে কখনও যায়নি। বিদ্যালয়ের নাম 'অনুভূতি'। রিক্সাওয়ালাকে বিদ্যালয়ের নাম বলতেই চিনে ফেললো। অল্প সময়ের মধ্যেই 'অনুভূতিতে' চলে এলো চয়ন। চমৎকার বিদ্যালয়টি। ট্রিপল এক্স ডিজাইনের একটি বাড়ি। সামনে ছোট এক টুকরো বাগান। থোকা থোকা রঙ্গন, টগর, হাসনাহেনা, মাধবীলতা আর নয়ন তারা ফুটে আছে। ঢুকতেই রঙিন ফুলের সৌরভ আর সৌন্দর্যে মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। 

সামনেই অভিভাবকদের বসার জায়গা। রেবেকা সহ আরো কিছু অভিবাবক বসে আছে সেখানে। চয়নকে দেখে রেবেকা উঠে দাড়ালো।
-আপনি? কখন এলেন?
-এইতো, এইমাত্র এসেছি।
-আমাকে বললে আমি আমার গাড়িতে করে আপনাকে নিয়ে আসতাম।
-আরে না। রিক্সায় করে এসেছি। বিকেলের নরম বাতাস আর পরিচ্ছন্ন পথ ধরে আসতে বেশ ভালো লেগেছে। সবুজ প্রকৃতি সমস্ত পথই আমাকে সংগ দিয়েছে। অদ্বিত ক্লাসে?
-জি। আপনি যাবেন অদ্বিতকে দেখতে?
-অবশ্যই। অদ্বিতকে দেখতেইতো এসেছি।
-তাহলে চলেন, দেখে আসি অদ্বিতের শিক্ষার ব্যবস্থা। 

শ্রেনী কক্ষের সামনে যেতেই শুনতে পেলো, একজন শিক্ষক সুরে সুরে গাইছে,
-" ওপেন টু বাইস্কোপ। নাইন-টেন টেস্কোপ। সুলতানা-বিবিয়ানা। সাহেবের বাবুর বৈঠক খানা। লাট বলেছে যেতে। পান-সুপারি খেতে। পানের আগায় মরিচ বাটা। ইস্কাবনের ছবি আঁকা। যেতে হবে কলকাতে। কলকাতা--।"
ছোট ছোট শিশুরাও শিক্ষকের সংগে সুর মিলিয়ে এক সঙ্গে গাইছে। 
-" ওপেন টু বাইস্কোপ। নাইন-টেন, টেস্কোপ। সুলতানা-বিবিয়ানা। সাহেবের বাবুর বৈঠক খানা। লাট বলেছে যেতে। পান-সুপারি খেতে। পানের আগায় মরিচ বাটা। ইস্কাবনের ছবি আঁকা। যেতে হবে কলকাতে। কলকাতা--।" 

ভীষণ ভালো লাগলো। নিস্পাপ অটিস্টিক শিশুদের এই ভাবে শিক্ষদানের ব্যবস্থা। সত্যিই প্রশংসা করার মতো। গান শেষ হলে রেবেকা বললো,
-সালাম আপা। ভিতরে আসবো? 
-শিক্ষক মহিলাটি মিষ্টি করে হেসে দিয়ে বললেন,
-সালাম। জি, অবশ্যই। আসুন। ভিতরে আসুন।
-ধন্যবাদ আপা।
-ধন্যবাদ।

বাচ্চারা তখনও মহা আনন্দে খেলায় মশগুল। ফুটফুটে অসাধারণ শিশুগুলি অবাক বিস্ময়ে চয়নের দিকে তাকালো। রেবেকাকে দেখে অদ্বিত,  মা, মা, বলে ছুটে এলো।  দু'হাত দিয়ে গভীর মমতায় রেবেকাকে জড়িয়ে ধরলো। রেবেকা অদ্বিতকে বুকে জড়িয়ে কপালে, গালে চুমু খেলো। অদ্বিত রেবেকার বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। রেবেকা অদ্বিতের চিবুক স্পর্শ করে ডাকলো,
-অদ্বিত, দেখো তোমার চয়ন আংকেল এসেছে। 
 অদ্বিত চয়নের দিকে তাকালো। চয়ন মিষ্টি করে হাসলো। 
-তুমি ভালো আছো অদ্বিত?
-জি, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
-আমিও ভালো আছি।

চয়ন ব্যাগ থেকে চকলেটের পাকেটে বের করে সবগুলো বাচ্চাকেই মুঠো মুঠো চকলেট খেতে দিলো। প্রায় সবগুলো বাচ্চাই সমস্বরেরে বললো ,
-থ্যাঙ্ক ইউ। 
-ওয়েলকাম।

বাচ্চারা মুহূর্তেই চকলেট খেতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। খুব ভালো লাগছে দেখতে। শিশুদের এমন হাসি ভরা মুখ আর খুশি দেখে চয়নের মনের আকাশে যেটুকু মেঘ জমেছিলো তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। মন ভালো হয়ে গেলো। 
অটিস্টিক শিশুগুলি তাদের অফুরন্ত হাসি আর আনন্দের  সংগে  মুহূর্তেই চয়নকে নিয়ে গেলো অফুরান প্রশান্তির ভূবনে। চয়নের কাছে কি-যে ভালো লাগছে, তা বলে বুঝাবার নয়। 

'অনুভুতির' প্রধান শিক্ষকের কাছে চয়ন জানতে চাইলো,
-আপা, আমি দেখলাম প্রায় সবগুলি শ্রেণীতেই শিশুদের কোন খেলার উপকরণ ছাড়াই খেলার মাধ্যমা পাঠদানের চেষ্টা করা হচ্ছে। কেন? এখনতো, এই ইন্টারনেটের যুগে এতো এতো ডিভাইস, প্রযুক্তি আর খেলার উপকরণ আছে। এসব থাকতেও কেন সেই পুরনো দিনের আমলের উপকরণহীন খেলাগুলিকেই  আপনারা প্রাধান্য দিচ্ছেন? এই ব্যাপার আমাকে কিছু বলবেন?
-জি, অবশ্যই। আসলে এটাকে আপনাদের কাছে খেলা মনে হলেও আসলে এটাই 'অনুভূতি' শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের মূল পদ্ধতি। কেননা এর মাধ্যমেই শিশুরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে। আর পারস্পরিক যোগাযোগ করতে পারলেই তাদের মধ্যে অনুভূতি সৃষ্টি হবে। নিজেদের প্রয়োজনেও একজন আর একজনের সহযোগিতা পাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করবে। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে সামাজিক ভাবে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি অর্জন করতে পারবে। আমরা আন্তরিক ভাবে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। 

কথাগুলি শুনে চয়নের কাছে বেশ ভালো লাগলো। আসলেই মানুষের সঙ্গে মানুষ যথাযথভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। সঠিক যোগাযোগের অভাবে  একজন মানুষ আর একজন মানুষের কাছ হতে দূরে সরে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে  বহুদূরে। যেহেতু অটিস্টিক শিশুরা বুদ্ধি ও শারিরীক প্রতিবন্ধী। যে কারণে সবার আগে পারস্পরিক যোগাযোগ তৈরি করাই প্রধান কাজ। এছাড়াও ছবি আঁকা, হাতের কাজ, গান ও কবিতা আবৃত্তি এর সবকিছুই শেখানোর চেষ্টা করা হয় এখানে।    

'অনুভুতির' সবকিছুই অসম্ভব ভলো ও যুগোপযোগী। খুব ভালো লাগলো চয়নের কাছে।
"তোমাকে অভিবাদন অনুভূতি! শুভকামনা আর স্যালুট তোমার জন্যে।" 

বিদ্যালয় ছুটির পর রেবেকা গাড়ি করে চয়নকে বাসায় পৌছে দিয়ে গেলো। চয়ন অদ্বিতের চুল এলো মেলো করে দিয়ে আদর করে দিলো। অদ্বিত ভীষণ ভীষণ খুশি হলো। 
-অদ্বিত বাবা, আমি আসি?
-জি। আমার স্কুলে আবার এসো। আমি তোমাকে রং-বেরঙের বেলুন কিনে দিবো। তুমি এসো কিন্তু আংকেল! 
-অবশ্যই আসবো বাবা। 
-তুমি ভালো থেকো। টাটা।
-টাটা। রেবেকা তুমিও ভালো থেকো। 
-আপনিও ভালো থাকবেন ভাই। 
-জি। অবশ্যই। সালাম রেবেকা। 
-সালাম ভাই। 

রেবেকার গাড়ি চলতে শুরু করলো। চয়ন দাঁড়িয়ে আছে। অদ্বিতও চয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। আজকের দিনটা চয়নের ভীষণ ভীষণ ভালো কাটলো। 

চয়ন এখনও শুনতে পাচ্ছে, কতগুলো দেব-দূতের মতো অসম্ভব সুন্দর শিশুরা শিক্ষকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইছে, "ওপেন টু বাইস্কোপ। নাইন টেন-টেস্কোপ। সুলতানা বিবিয়ানা। সাহেব বাবুর বৈঠক খানা। লাট বলেছে যেতে। পান-সুপারি খেতে। পানের আগায় মরিচ বাটা। ইস্কাবনের ছবি আঁকা। যেতে হবে কলকাতা। কলকাতা--।" চলবে...

হুমায়ুন কবির । বাংলাদেশ