অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
ইউরোপের পথে পথে (নয়) -দীপিকা ঘোষ

   হোটেলের ডাইনিং রুমটি বেশ রাজকীয়। লম্বা চওড়া মিলিয়ে যেন একখানা বিরাট হলঘর। সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে গুছনো। ঝকঝকে। মাঝখানে এল প্যাটার্নের কাউন্টারের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি শেফিং ডিশ। ভেতরে খাবারের আইটেম। সকাল আটটা না বাজতেই টেবিলগুলো পূর্ণ হয়েছে হোটেলবাসীদের উপস্থিতিতে। বেশিরভাগই প্রবীন এবং প্রবীনা ককেশিয়ান মানুষজন। ফর্ম্যালিটির আবরণ যাদের আপাদমস্তকে ছড়ানো। মনে পড়লো-
     দেশাচার, লোকাচারের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই এই হোটেলের নামকরণ-‘ক্যাসল’। 
     খাদ্য তালিকায় নজর ফেললো সবাই। কন্টিনেন্টাল নয়, ফুল ইংলিশ ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা। এ্যাপরিকট, কলা, আপেল, স্ট্রবেরি, পিচ, ব্লুবেরি, অরেঞ্জের সঙ্গে আপেল, অরেঞ্জ, গ্রেপফ্রুট জুস। ডিমের নানান মেন্যু। বেকন, সসেজ। ব্রেড, বাটার, জ্যাম, জেলি, সিরাপ, দুধ, চা, কফি। প্যানকেক, কর্ণফ্লেক্স। বিভিন্ন ব্রাণ্ডের সিরিয়াল। অন্য দশজনের মতোই একটি বিশেষ ভদ্রস্থ ভঙ্গিতে বসে লোলো আর এডগার খাচ্ছে। ক্যাজুয়াল রেস্টুর‌্যান্ট কিংবা বারে বসে যে ধরনের শিথিলতা প্রদর্শন করা চলে, আলাপচারিতা চলে, এখানে নাকি সেসব বাঞ্ছনীয় নয়। বেশি মুখ ফাঁক করে গোগ্রাসে খাওয়া চলবে না। টেবিলের ওপর কনুইয়ের ভর রাখা চলবে না। শব্দ করে চিবুনো বারণ। চেয়ারে পুরুষসঙ্গীরা বসার আগে নারীদের জন্য চেয়ার এগিয়ে দেবেন। সবকিছু চলবে মেপে মেপে। একটি সুনির্দিষ্ট, মৃদু এবং অচপল ছন্দে। 
     ব্রেকফাস্ট সেরে সমস্ত দিনের জন্য আজ আমাদের বাইরে বেরিয়ে পড়া ব্রেকন এণ্ড বিকনস ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। পার্কে যাওয়ার পরিকল্পনা ডাইফ্যান দম্পতির। এডগার ওয়েলসে আসার আগেই বলেছিল-                                                       
     ওয়েলসে গিয়ে এই পার্ক না দেখলে আসল জিনিষটাই কিন্তু মিস করবে! পৃথিবীর আদিমতম যুগের পরিবেশ এখনো বজায় আছে ব্ল্যাক মাউনন্টেইনের ভৌগলিক পরিবেশে! ন্যাশনাল পার্কের প্রাকৃতিক আবহে! চারশো মিলিয়ন বছর আগে যখন উত্তর আমেরিকা আর আফ্রিকা মহাদেশ ভৌগলিকভাবে একত্রিত ছিল, তখন প্রচণ্ড চাপে জন্ম হয়েছিল এই ব্ল্যাক পাহাড়ের! যারা দেখেছে প্রত্যেকে বলেছে, অ্যাডভেঞ্চারের একটা দারুণ জায়গা সেটা!
     কিছু সময় নীরব থেকে পরে উৎসাহ নিয়ে ফের বলেছিল–
     তবে শুধু পাহাড় নয় ওখানে হাইকিং, বাইকিং, ওয়াকিংসহ পিকনিকের ব্যবস্থাও রয়েছে! ডাইনোসরদের গুহা রয়েছে! রোমান যুগের ক্যাসল রয়েছে! এমন আরও অনেক কিছুই রয়েছে যা চাক্ষুষ করলে বুঝতে পারবে! সে জন্যই ওখানে যাওয়াটা...। 
     দক্ষিণ ওয়েলসের ব্রেকন এণ্ড বিকনস ন্যাশনাল পার্কে পৌঁছুতে দুপুর হয়ে গেলো। ৫১৯ বর্গমাইলের ন্যাশনাল পার্কে পাহাড়, নদী, অরণ্য, ঝর্ণা, পশু পালনের ফার্ম, দোকানপাট, লোকালয় সবই রয়েছে। গাড়িতে বসেও বহুদূর থেকে চোখে পড়লো, ব্ল্যাক পাহাড়ের মাথায় মাথায় ঝুলে রয়েছে মেঘের ঝালর। এর সর্বোচ্চ চূড়োর উচ্চতা ২৯০৩ ফুট। ওক, এ্যাশ, বিচ, হথর্ন আর বিভিন্ন ধরনের ফার্ন ছাড়াও এখানে রয়েছে এমন কিছু গাছ, পৃথিবীর অন্যসব অঞ্চলে যেগুলো চোখে পড়ে না। প্রকৃতির আপন খেয়াল খুশিতে তৈরী অসাধারণ এর ল্যাণ্ডেস্কেপ। অসাধারণ তার সৃষ্টি পাগলামির এলোমেলো নান্দনিকতা।                                      
     এডগার এবারও যথেষ্ট আবেগ নিয়ে বকবক করার মতো করে একটানা বললো–
     কগহুয়িল ট্রেনে করে ওপরে ওঠা যায়! কিন্তু সেটা একটু রিস্কি হওয়ায় অনেকে যেতে চায় না! সেখানে না গিয়ে বরং চলো, আমরা আরও কয়েক মাইল ওয়েস্টের দিকে গিয়ে ওয়াইল্ড লাইফের জায়গাটা ঘুরে আসি। ওদিকে নদীর উঁচু পার ধরে অনেকটা হাঁটা যায়। সেখানে বহু ধরনের পাখী রয়েছে। ফ্লাইক্যাচার, গোল্ডেন প্লোভার, স্কাইলার্ক, পিপিট, বালফিনস, বার্নআউল, এমনকি ওখানে খোলা আকাশে রেড কাইটদেরও উড়তে দেখা যায়!        
     গাড়ি পার্ক করে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো নগর জীবনের যান্ত্রিক ছোঁয়া এদিকে চিহ্ন ফেলেছে অবধারিত হয়ে। বন্য জীবজন্তুর অস্তিত্ব সেভাবে লক্ষ্যগোচর হলো না। যাদের দেখা গেলো তাদের বেশিরভাগ গৃহপালিত চেহারায়। ফার্মের গাধা, শুয়োর আর অন্যান্য সব প্রাণী। বন্য প্রাণীর মুক্ত জীবনের বন্য উন্মাদনা মানুষের ব্যবস্থাপনায় আজ অনেকখানি পরিচালিত। সে কথা প্রকাশ করতেই এডগার হতাশার আবরণ সরিয়ে মন্তব্য করলো–
     এখানকার বুনো জীবজন্তুরা খুব লাজুক কিনা, তাই সহজে তাদের দেখা মেলে না! তবে আছে, বিপজ্জনক কুমীর আছে! হরিণ আছে! অটার, ব্যাজার, ডরমাউজ আরও অনেক কিছুই আছে!
     তারপরেও ভালো লাগলো চূণাপাথরের আস্তরণে গড়ে ওঠা লালচে, কালো ছোট ছোট উপত্যকা, পাহাড়, নদী, গুহা, মহাসাগরের আদিম জন্মমুহূর্তের রোমাঞ্চকর পরিমণ্ডলের কথা ভেবে। সবচেয়ে ভালো লাগলো, লোলোর মুখে এ অঞ্চলকে ঘিরে জন্ম নেওয়া আদিম গুহামানবদের জীবনকথা, ওয়েলসের সব কিংবদন্তি রূপকথা আর রহস্যময় পরীদের গল্পকথা শুনে। শুনতে শুনতে মনে হলো–
     পৃথিবীর দেশে দেশে ভাষা সংস্কৃতি যেমনই হোক, মানুষের সৃষ্টিভাবনায় পার্থক্য তেমন নেই। সেই ভূতপ্রেতের গল্প, পরীদের গল্প, রাজকুমারদের বীরত্বের কাহিনী, নরনারীর ভালোবাসা, ভয়ঙ্কর জন্তুদের সঙ্গে সখ্যতার কল্পনাগুলো একই রকম। কল্পনার বল্গাবিহীন রথের ঘোড়া একইভাবে ছুটে গিয়েছে রহস্যময়তার পথে পথে। একই রকম উপসংহারেও থেমে গিয়েছে সৃষ্টির গতিবেগ।
     লোলোর কল্লোলিত মুখরতার সঙ্গে, লক্ষ লক্ষ বছর পেরিয়ে এরপর আমার অন্তর ছুটে চললো সেই অতীতের দিকে যখন ভয়ংকর সৌন্দর্যের সবটুকু প্রবলতা ছুঁয়ে ছেনে, দুমড়ে মুচড়ে তৈরী হচ্ছিলো এই ন্যাশনাল পার্কের ভৌগলিক চেহারা। লোলোরা ঠিক করেছিল, ষোড়শ শতাব্দীর ‘ড্রাগন ইন’-এ দুটো রাত কাটিয়ে এখানকার ইতিহাস সংগ্রহের জন্য পুরো পার্কটাই বাসে করে ঘুরে দেখবে সময় নিয়ে। তিন দিন পরে ট্রেনে করে ফিরে যাবে লণ্ডনে। আমাদের আজকের গন্তব্যস্থল অবশ্য বিশেষ এক মন্দির। সব ধর্মের সমন্বয় সাধনের আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ-পশ্চিম ওয়েলসের ‘মহাকালী টেম্পল'। শ্রী গুরু সুব্রামনিয়াম এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীলঙ্কার একটি উচ্চশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে গুরুর জন্ম। শিহানী পেরেরারা বিশেষভাবে এই মহাশক্তি মন্দিরের আকর্ষণেই বার বার ওয়েলসে ফিরে ফিরে আসে।
     শিহানী বলেছিল-
     কিশোর বয়সেই গুরু চলে এসেছিলেন ইউরোপে। কারণ মাত্র সাত বছর বয়সে ভবিষ্যৎ কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে তিনি দৈব নির্দেশনা পেয়ে যান। গুরু ছিলেন সেইন্ট ফ্রান্সিস অফ এসিজি কিংবা রাজপুত্র সিদ্ধার্থের মতো! সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও যাঁদের চলে যেতে হয়েছিল সবকিছু ছেড়ে! ইউরোপের বহু দেশে ঘোরার পরে গুরু স্থায়ীভাবে চলে আসেন লণ্ডনে।
     জানতে চেয়েছিলাম-
     কিন্তু অতটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা কেন করলেন?
     প্রকৃতির নিরালা কোণে মন্দির আর আশ্রম প্রতিষ্ঠার নির্দেশ গুরুজী দৈবভাবেই পেয়েছিলেন। অত বড় জায়গা লোকালয়ের কাছে কোথায় পাওয়া যাবে? ওখানে পশু-পাখীদের জন্য স্যাংকচুয়্যারির ব্যবস্থা রয়েছে। হসপিস রয়েছে। তিনটে মন্দির রয়েছে। সুব্রামনিয়াম, ডিভাইন মাদার আর রঙ্গনাথের। সবকিছুই ওখানে ম্যাসিভ স্লাবের ওপরে লেখা আছে। গেলেই দেখতে পাবে!
     এসব দেখাশুনো কারা করেন?      নান আর সন্ন্যাসীরা তো ওই আশ্রমেরই রেসিডেন্ট। তাঁরাই করেন। রোজ পূজোআর্চাও ওঁরাই করেন। ভজন সংকীর্তন করেন। এছাড়াও কমিউনিটির সেবকরা রয়েছেন।
     লাঞ্চের পরে বিদায় দেবার মুহূর্তে যথানিয়মে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে কল্লোলিত হলো লোলো-
     মিস্টার কে ঘোষ এখানে ফ্রি বাইকের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা বাইক চালিয়ে আজ ট্রিটাওয়ার ক্যাসল দেখতে যাচ্ছি! ওটা দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরী করা হয়েছিল! এখান থেকে মাত্রই মাইল তিনেক দূরে! তারপর যাবো রিভার আস্কে। শুনেছি, ওখানে মাছ ধরার ভালো ব্যবস্থা রয়েছে! সবচেয়ে বড় কথা সেভার্নের মতো এই নদীও ব্রিস্টল চ্যানেলের সঙ্গে মিশেছে!
     মিস্টার কে ঘোষ উত্তরে বিশেষ উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলো-
     তাহলে নিশ্চয়ই এই নদীতে অনেক সি ব্যাসও থাকবে?
     হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই সঙ্গে ট্রাউট আর শ্যামনও রয়েছে প্রচুর! আর এখানকার মাছ খেতেও খুব ভালো!
     যাক ভালোই হলো, ড্রাগন ইনে এগুলোর সবই আজ তোমরা উপভোগ করতে পারবে!
     চাইলে নিঃসন্দেহে করা যাবে। তবে আমাদের আজকের মেন্যুতে সেসব থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। মেইনলি থাকছে হরিণের মাংস! রোজমেরি আর রেড ওয়াইন দিয়ে এরা নাকি ওটা খুব ভালো রাঁধে! এ্যাডের খুব পছন্দের খাবার!  
     একেবারে জনমানবহীন আরণ্যক পরিবেশের ভেতর দিয়ে বনপথের মাঝখানে লুকোচুরি খেলতে খেলতে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মাইল স্পিড অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে আমাদের যান্ত্রিক বাহনটি। এক অনবদ্য নির্জনতা আদিগন্তে বিস্তৃত। পবিত্রতম সৌন্দর্যের স্নিগ্ধ সরোবরে ডুবে যেতে যেতে দেখলাম, হিংসা, দ্বেষ, নিষ্ঠুরতা আর বিভেদ ধুয়েমুছে সহাবস্থানের প্রশান্তিতে নিমগ্ন হয়েছে চারপাশ। শান্তির পারাবারে থরে থরে ফুটে রয়েছে অনন্ত প্রকৃতির আত্মার ভাষা। সে ভাষা শুনতে শুনতে মন বললো-
     সব আত্মাই একই ভাষায় কথা বলে! এই ভাষা তাই আমার এমন করে জানা!
     অজস্র চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে, ‘Skanda Vale, Llanpumsaint, Carmarthen SA33 6JT, UK’, আশ্রমের ঠিকানায় পৌঁছে দেখি, এরই মধ্যে আশ্রমের কোচ তখনকার ট্রিপের জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার নেমে এসে জানালেন-
     একটি মাত্র আসন খালি। অতএব একজনই উঠে এসো। পরের ট্রিপে অন্যরা আসবে।
     ঘোষকেই তুলে দেওয়া হলো। তার কোমরের ব্যথাটা এখনো যন্ত্রনা দেয়। পাহাড়ের অসমান্তরাল জায়গার এক কোণে কণিষ্ককে কষ্টেসৃষ্টে সারতে হলো প্যারালাল পার্কিং-এর কাজ। তারপরেই সে বললো-
     কোচের জন্য কত সময় দাঁড়িয়ে থাকবে? আমাদের ফিরে যেতে হবে তো!
     তার জনক বিগলিত হয়ে জবাব দিলো-
     কিন্তু অত উঁচু পথে আমরা কতটা হাঁটতে পারবো পাপান?
     থেমে থেমে যাবে! কোচের ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে! দেখছো না ওরা কেউই ওয়েট করছেন না! মামণি, চলে এসো!
     ওরাও মানে, চার পাঁচজনের একটি মহিলাদল। যারা নিতান্ত বাধ্য হয়ে হাঁটা পথ অনুসরণ করেছেন। কারণ কোচের জন্য তাদেরও দীর্ঘ মুহূর্ত ধরে অপেক্ষা করার সময় নেই। কিন্তু পাঁচ মিনিট হাঁটতে না হাঁটতে গলা শুকিয়ে তৃষ্ণার্ত মরুভূমি হয়ে গেলো। বললাম-
     দাঁড়া বাবা, একটু জিরিয়ে নিই!
     মহিলাদলের একজন বললেন-
     আমার বাপু সাধ্যই নেই, আর এক পা নড়ে চলার! অত ওপরে আর উঠতে পারবো না!
     কণিষ্ক দয়াপরবশ হয়ে হাত ধরতে এলো-
     তোমরা দুজনে আমার হাত ধরে হাঁটো মামণি! তাহলে হবে তো?
     বললাম-
     তুই কী এমন বীর পালোয়ান হয়েছিস সোনা, যে দু হাতে দুটো বোঝা নিয়ে হাঁটবি?
     কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। অতএব সাধ্য অতিক্রম করেই উঠতে হলো। আর ওপরে উঠেই মনে হলো, রূপকথার এক অচেনা রাজ্যে প্রবেশ করেছি আমরা। যতদূর চোখ চলে এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ের অবাধ উন্মুক্ত বিশাল প্রান্তর। একদিকে বিভিন্ন পশু-পাখীদের অভয়ারণ্য। অন্যদিকে দেবদেবীর মন্দির। যত্নে লালিত ফুল-ফলের বাগান। তখন নির্দিষ্ট সময় মেনে মহাকালী মন্দিরে পূজোর আয়োজন চলছে। মন্দির প্রাঙ্গনে এক ঘেরাটোপ শেডের নিচে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা। পূজোর দৃশ্যপর্ব Reflection desktop প্রযুক্তিতে পর্দার ওপরে এখানেই দেখানো হবে। দেখতে দেখতে সময় উড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কাঁসর ঘন্টার সঙ্গে জলদগম্ভীর কণ্ঠে সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারিত হলো। সামনের বিস্তীর্ণ পর্দায় ভেসে উঠলো পূজাপর্বের দৃ্শ্যাবলী। দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতি মেনে গভীর নিষ্ঠাভরে চলতে লাগলো দেবী আরাধনা। পূজারি তিন জন। দুজন ককেশিয়ান। একজন ভারতীয়। পূজো শেষে যাঁরা ভজন গাইলেন, তাঁরাও এদেশীয় নান। 
     গ্রীষ্মকালে এদেশে সূর্য সহজে অস্ত যায় না। তারপরও সময়ের কথা ভেবে অনায়াসেই নেমে এলাম নিচে। ঘন অরণ্যের ভেতর থেকে পাখীর কূজন ভেসে আসছে। ডানদিকে সন্ন্যাসী আর নানদের বাসস্থান। নিচে মুমূর্ষু রুগীদের শেষ আশ্রয়স্থল হসপিস। হঠাৎ দেখি গেরুয়া পরিহিত এক তরুণ সন্ন্যাসী একটি হাতীকে তরমুজ খাওয়াচ্ছেন। এখানে ময়ূর দেখেছি, হরিণ দেখেছি, ব্রাজিলিয়ান হাইয়াসিন্থ ম্যাকোউ দেখেছি। কিন্তু তাই বলে হাতী? ভাবা যায়? জিজ্ঞেস করতেই বললেন-
     মাতৃপিতৃহারা বল্লী, শ্রীলংকা থেকে এক বছর বয়সে এসেছিল এখানে। একটি মোষের দলের সঙ্গে সে অসহায় অবস্থায় ঘুরছিল! বনকর্তারা উদ্ধার করেছেন! এখন বয়স পঁয়ত্রিশ।
     এখানে জীবজন্তু রাখা সরকার কি এলাউ করে? মিস্টার কে সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।
     এমনিতে অসুবিধে নেই। আমরা সাধারণভাবে নেগলেকটেড প্রাণীদেরই এখানে আশ্রয় দিয়ে থাকি। তবে এমন অসুখ যদি হয় যেগুলো ছোঁয়াচে, মারাত্মক! তাদের বাঁচিয়ে রাখতে দেয় না!
     কী রকম?
     শম্ভুর কথাই বলি। ফ্রিশিয়ান বুল। অনেকদিন আশ্রমবাসী ছিল। স্কিন টেস্টে বোভাইন টিবি পজিটিভ ধরা পড়ে! বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা অনেক হয়েছিল! কারডিফ হাইকোর্ট রায় দিযেছিলেন আমাদের পক্ষেই! কিন্তু ইউরোপীয়ান কনভেনশনের অধিকার রক্ষা আইনে, আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে যায়! লিথাল ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হয় শম্ভুকে!
     শেষের দিকে নবীন সন্ন্যাসীর গলার স্বরে অশ্রুর ঢেউ আভাস ফেললো। তাঁর বেদনার্ত চেহারা দেখে মুহূর্তেই উপলব্ধি করলাম, অধ্যাত্ম জগতের সঙ্গে জাগতিক দুনিয়ার ফারাক বিস্তর। আধ্যাত্মিক মানুষ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরেও তাঁদের আবেগ অনুভূতি, দুঃখ বেদনা, প্রেম ভালোবাসাকে যেভাবে ছড়িয়ে দিতে পারেন, জাগতিক মানুষের চিন্তাচেতনা সেখানে প্রবেশ করতেই পারে না। তাদের জীবনের সবক্ষেত্রেই হিসেব নিকেশের সুনির্দিষ্ট মাপকাঠিটি বড় অনড় হয়ে থাকে। 
      হোটেল ক্যাসলে ফিরে চলেছি এবার। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য ছেড়ে লোকালয়ের পথে পথে হাজারো দৃশ্যপাটে গড়িয়ে চলেছে দৃষ্টি। দুদিন উদয়স্ত ঘোরাঘুরিতে প্রায় পুরো দ্বীপটাই দেখা হয়ে গিয়েছে আমাদের। স্পষ্ট করে চোখে পড়েছে ওয়েলসের ভৌগলিক চেহারার বিপরীতধর্মিতা। এর দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলটি বিশাল সাগরবক্ষে ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো ভ্যালি-ভ্যালি। কিন্ত মধ্য এবং উত্তরভাগ কঠোরভাবে খাড়া। উত্ত্যঙ্গু পাহাড়পর্বতে পরিপূর্ণ। যেন দ্বীপের ভৌগলিক দেহগঠনে শক্তির সমস্ত উন্মাদনা এখানে এসে হঠাৎ করে বিস্ফারিত হয়েছে।  টকিং বাইনোকুলারে চোখ রেখে আটলান্টিকের হাঙর, তিমি, সিগাল আর বিশাল কচ্ছপ দেখার ইচ্ছে ছিল। অতএব ‘ফলস বে’ তে নামতে হলো ইচ্ছা পূরণের ইচ্ছায়।
     কণিষ্ক চোখ রেখেই বললো-
     মেসো এই বাইনোকুলারে দু' চোখ দিয়ে নয়, টেলিস্কোপের মতো এক চোখ দিয়ে দেখবে। বাঁদিকে ফোকাস করলেই দেখতে পাবে একটা রকি আইল্যাণ্ড রয়েছে। সেখানে অনেকগুলো সিল শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘোষ দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
     কিন্তু টকিং বাইনোকুলোর কথা বলছে না কেন?
     ওই নিচের দিককার বাটনটাকে প্রেস করো। তারপর বাঁদিকে ঘোরাও।
     বাইনোকুলারে চোখ রেখে এবার আমার অপরিমেয় বিস্ময়ের পালা। আদিগন্ত মহাসাগরের বিস্তৃত পরিসর মুহূর্তেই চলে এসেছে দৃষ্টির নাগালের মধ্যে। চোখে পড়ছে শক্তির অমিত উচ্ছ্বাস অফুরন্ত জলরাশির ভেতর আবেগে ফেটে পড়ছে! দূরে, আরও বহু দূরে, মহাকাশ আর মহাসাগরের আলিঙ্গন ছুঁয়ে সবকিছু একাকার! সবকিছু আলাদা সত্তা হারিয়ে এক বিরাটের অস্তিত্বে যেন হারিয়ে গেছে।  
     সায়াহ্নের গোধূলি রঙ ছায়া ছড়াচ্ছে চরাচরে। ঘড়িতে স্থানীয় সময় অতিক্রম করছে ডিনার টাইম। অতএব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়ি ছুটলো ভারতীয় রেস্তোরার অনুসন্ধানে। চার জোড়া চোখের সার্চলাইটে অবশেষ ধরা দিলো -রেস্টুর‌্যান্ট ‘বিরিয়ানী বোল’। রেস্টুর‌্যান্টের হাত কয়েক দূরে উদ্ধত সাজসজ্জায় কয়েক জোড়া তরুণ তরুণী অপেক্ষমান। সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছে মেয়েগুলো। পাশেই বার। সম্ভবত সেটাই তাদের গন্তব্যস্থল।
     পৃথিবীতে জীবনের প্রয়োজনে সবকিছু বদলায়। বদলে যেতে বাধ্য হয়। পরিবর্তিত সামাজ ও রাষ্ট্রীয় আইনে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই পতিতাবৃত্তি, এশিয়া এবং আফ্রিকার মতো এখন আর পেশা হিসেবে বৈধ নয়। তবুও ভিক্ষাবৃত্তির মতো এই কলুষিত বৃত্তিটিও নানা রকম পদ্ধতিতে বেঁচে রয়েছে সমাজের অবধারিত অংশ হয়েই। চলবে...

দীপিকা ঘোষ
ওহাইয়ো, আমেরিকা।