ফেলে আসা দিনগুলি (৩য় পর্ব) – হুমায়ুন কবির
বৈশাখ মাস। অথচ বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলো বৃষ্টি হচ্ছেনা। আস-পাশের পুকুরের পানিও কমে গেছে। অবশিষ্ট যা আছে তা দিয়েই গায়ের মানুষগুলো তাদের প্রয়োজন মিটাতে চেষ্টা করছে। তবে খাওয়ার পানি নলকুপ থেকে সংগ্রহ করেছে। সব বাড়িতে আবার নলকূপ নেই। প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সামান্য। চয়নদের টিউবওয়েলে ভিড় লেগেই আছে।
গায়ে বিদ্যুৎ নেই। প্রচন্ড গরম। মানুষ গাছের ছায়ায় বসে বসে শিতল হওয়ার চেষ্টা করছে। বৃষ্টির জন্য, পানির জন্য ভীষণ হাহাকার। দুপুরবেলা দশ-বারো জন কিশোর-কিশোরীর একটি দল চয়নদের বাড়ির দিকে আসছে। পিছনে পিছনে আসছে রানু, মিনি, লালু আরও অনেকে।
সবাই-ই বাহারি রঙের কাপড় পরেছে। তবে মুখ রাংগিয়েছে কালো কালি দিয়ে। সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। রানু এসে বললো,
-এরা মেঘ নামানীর দল। মেঘ নামাবে।
চয়ন ভিশন অবাক হলো। বাশ নাচানীর দল এলো। আজকে আবার মেঘ নামানীর দল! খুব আনন্দ হচ্ছে।
-এরা মেঘ নামালে কি মেঘ নামবে?
- হ্যাঁ নামবে।
চয়ন খুব অবাক হলো।
-এ কি করে সম্ভব?
মিনি বললো,
-সম্ভব।
এর পর চয়নদের বাড়ির কাজের মহিলা করিমনের মা, মাটির কলসিতে করে পানি আনলো। মেঘ নামানীদের দলের একজন মেয়ে একটি বেত ও বাশের তৈরী কুলা মাথায় নিয়ে মাঝখানে দড়ালো আর অন্যরা সবাই মেয়েটির চারপাশ দিয়ে ঘুরে গোল হয়ে দাড়ালো। মিনি বললো,
-মাঝের মেয়েটি এক মায়ের এক ঝি।
চয়ন বললো,
-মানে?
-ওর আর কোন বোন নেই। ও একা। তা-ই ওকে এক মায়ের এক ঝি বলে। আর মেঘ নামাতে এক মায়ের এক ঝি লাগে। ওর নাম নারানী। ওইতো কুমার পারার মেয়ে।
চয়নদের বাড়ির কাজের মহিলা করিমনের মা মাটির কলসির সবটুকু পানি নারানীর মাথায় রাখা কুলায় ঢেলে দিলো। নারানী সেই পানি ঘুরে ঘুরে চারদিক বৃস্টির মতো করে ছড়িয়ে দিলো। চার পাশের ছেলে মেয়েরা এক সংগে গেয়ে উঠলো,
" আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই। আল্লাহ মেঘ দে। আসমান হইলো টুটা টুটা, জমিন হইলো ফাটা। মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিবো কেডা। আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ মেঘ দে"।
সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য! ভালো লাগায় মন প্রান ভরে গেলো।
সেদিন মেঘ নাচানীদের গান আল্লাহ শুনতে পেয়েছিলো কিনা জানিনা। তবে বিকাল হতেই কালো কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেলো। সন্ধ্যা হতে না হতেই শুরু হলো কালবৈশাখী। সংগে বৃস্টি। কিজে বৃস্টি! টিনের চালের বৃস্টির রিম-ঝিম সব্দ অসাধারণ আনন্দ ছড়িয়ে দিলো চারদিকে। এতো ভালো লাগা আর আনন্দ গায়ে আছে চয়ন গায়ে বেড়াতে না এলে তা বুঝতেই পারতো না।
আজো কান পাতলে চয়ন দেখতে পায় মেঘনামানী দলের সেই অবাক করা নৃত্য। আর শুনতে পায় তাদের গাওয়া অপুর্ব গান।
" আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই "।
*****
সকাল হতেই একজন মাঝ বয়সী লোক গলায় ঢোল ঝুলিয়ে অনবরত বাজাচ্ছে আর জোরে জোরে বলছে,
-গলিয়া-গলিয়া-গলিয়া। আজকে দুপুরে হতে ডাক্তার বাড়ির সামনের মাঠে গলিয়া বসবে।
গলিয়া শব্দটার সঙ্গে এর আগে চয়নের পরিচয় ছিলোনা। গলিয়া কি জিনিস তা চয়ন কখনো জানেনি। গায়ের অনেক কিছুই চয়নের কাছে নতুন। এতে চয়নের কোন আসুবিধা হচ্ছেনা। মিনি, রানু, লালু এরাই চয়নকে বুঝিয়ে দেয় সব কিছু। চয়ন রানুর কাছে জানতে চায়,
-গলিয়া কি জিনিস?
-গলিয়ে হচ্ছে মেলা, আড়ং। তোমরা শহরে যাকে মেলা বলো, গ্রামে তাকে গলিয়া বলে।
চয়নের কাছে খুব ভালো লাগলো। মিনি বললো,
-এই পপের মা, তুই যাবি গলিয়ায়?
-যাবো।
চয়নকে বললো, -চয়ন যাবা?
-জ্বি, আমিও যাবো।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে রানু, মিনি, লালু আর চয়ন চললো ডাক্তার বাড়ির গলিয়া দেখতে। পথে যেতে যেতে দেখলো ছেলে বুড়ো ও তাদের বয়সী আরও অনেকেই দল বেঁধে মহা উল্লাসে গলিয়া দেখতে ছুটছে। চয়ন কি যে রোমাঞ্চ অনুভব করছে !, তা বলে বুঝানোর মতো নয়। গলিয়াতে এসে আরো ভালো লাগলো! কত রকমের দোকান বসেছে। মুরি, মুরকি, মিস্টি , বাচ্চাদের খেলনা, মৃৎ শিল্প, বাঁশের বাশি, তালপাতার বাশি, বিন্নি ধানের খৈ সহ আরো কতো কি! মিনি রানুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-এই পপের মা, চয়ন কে কি খাওয়াবো?
চয়ন বললো,
-আজকে আমি তোমাদের খাওয়াবো।
রানু বললো,
-আরে না, তা হয়না। তুমি গ্রামে এসেছো। আমাদের মেহমান। আজকে আমরা তোমাকে খাওয়াবো।
লালু তাতে সায় দিলো। কেনা হলো বিন্নি ধানের খৈ আর দানাদার। চয়ন বিন্নি ধানের খৈ এর আগে কখনো দেখেনি। কি অপূর্ব দেখতে! নিশ্চয়ই খেতে খুব ভালো লাগবে। একটা মাটির তৈরী পাত্রে খৈ আর দানাদার রাখা হলো। রানু চমৎকার করে মাখালো। একটা গাছের ছায়ায় চারজন এসে বসলো। ছোট ছোট কচি কোমল হাত দিয়ে রানুর মাখানো খৈ আর দানাদার খেতে থাকলো। গলিয়া সন্ধায়ই শেষ হয়ে গেলো। ফেরার সময় চয়ন তাল পাতার বাঁশি আর ছোট বোনের জন্য একটা মাটির তৈরী অপূর্ব রঙ করা পুতুল কিনলো।
বাচ্চারা বাঁশি বাজিয়ে বাড়ি ফিরে চলছে। চারদিকে থৈ থৈ আনন্দ। ছোট একটা গলিয়া গায়ের এই সহজ সরল মানুষদের এতো আনন্দ দিতে পারে, গলিয়ায় না এলে চয়নের কাছে সেটা অজানাই থেকে যেতো। আহা! গলিয়! কি সুন্দর নাম! আজো শহরের কোন মেলায় গেলে চয়নের সেই সেদিনের ডাক্তার বাড়ির গলিয়ার কথা খুব মনে পরে।
দেখতে পায় একজন মাঝ বয়সী মাঝারী গরনের ঝাঁকড়া চুলের লোক ঢোল বাজিয়ে চলছে আর জোরে জোরে বলছে,
-গলিয়া-গলিয়া-গলিয়া। ডাক্তার বাড়ির সামনের মাঠে আজকে দুপুর থেকে গলিয়া বসবে।
*****
বিজয়া দশমীর দিন সকাল থেকেই কুমার পারা থেকে ঢোল ও কাশির আওয়াজ ভেসে আসছে। দুপুরের পর পরই সুপান্ত এসে বললো,
-কুমার পারা ঠাকুর দেখতে যাবা? আজকে ওখানে অনেক আনন্দ হবে।
চয়ন মুহূর্তেই রাজি হয়ে গেলো। বললো,
-যাবো।
পরে দুই জন মিলে হেটে হেটে কুমার পারার দিকে যাত্রা শুরু করলো। চয়নদের বাড়ি থেকে কুমার পারা বেশি দূরে না। এক কিলো মিটার হয়তো হবে। পথে যেতে একটা ফাঁকা জায়গা পড়লো। ছোট একটা খালের পাশে বিশাল এক বাঁশ বাগান। সুপান্ত বললো,
-এই বাঁশ বাগানে রাতে ভুত থাকে। বেশি রাতে এখান দিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যায়।
চয়ন অবাক হোল। বললো,
-সত্যি?
-জ্বি। সত্যি। অনেকেই দেখেছে।
চয়নের মনের ভিতর কেমন একটা রোমাঞ্চ খেলা করে উঠলো। আজকে হয়তো সত্যি সত্যি ভুত দেখা যাবে। একটু ভয়-ভয়ও লাগলো। সে যাই হোক, সত্যি কারের ভুত দেখাও কম ভাগ্যের ব্যাপারনা। কুমার পারা ঠাকুরের মন্ডপে ছেলে বুড়ো সবাই ভিড় করে আছে। একজন বামুন মন্ত্র পড়ছে। সবাই প্রনাম জানাচ্ছে। এর আগে এতো কাছ থেকে ঠাকুর দেখা হয়নি। মন্ত্র পড়া শেষে ঠাকুর নিজ হাতে প্রসাদ বিতরণ করলো। চয়নকে দিতে গেলো। চয়ন বললো,
-আমি মুসলমান।
-তাতে কি? নাও। শুধু ফল।
চয়ন হাত বাড়িয়ে প্রসাদ নিলো। সুপান্ত মিস্টি করে হেসে বললো,
-খাও। প্রসাদ। খুব ভালো লাগবে।
চয়ন খাওয়া শুরু করলো। আপেল, কমলা, কলা, পেপে, এই সমস্ত ফল মিলিয়েই প্রসাদ তৈরী করা হয়েছে। খেতে বেশ লাগলো। চয়নের ধর্ম ইসলাম। ইসলামের প্রতি চয়নের বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা অনেক গভিরে। কিন্ত অন্য ধর্মের প্রতিও চয়নের কোনরকম অশ্রদ্ধা নেই। মিশন স্কুলে যখন পড়তো, তখন এলিজাবেধ ডি কস্টা মেম বলতেন,
-"মানুষকে মানুষ ভাববে। ধর্মের দিক দিয়ে কাউকে আলাদা ভাববেনা। ছোট করে দেখবেনা। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই"।
আজকে বিজয়া দশমীর দিন এলিজাবেধ মেমের কথা খুব মনে পরলো। এই দিনটাতে মেম ফরিদপুর কুমার নদের উপরের ব্রিজে দাঁড়িয়ে আরোতি ও প্রতিমা বিসর্জন দেখতে যেতেন। বড় হওয়ার পর চয়নও বেশ কয়েকবার সেখানে গেছে।
কুমার পারা থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো। সেই বাঁশ বাগানের কাছেকাছি আসতেই চয়ন দেখতে পেলো দূর থেকে একটা গোল আগুন অনেকটা জায়গা আলোকিত করে বাঁশ বাগানের দিকে ধির গতিতে এগিয়ে আসছে। চয়ন মনে মনে দোয়া পড়তে থাকলো। বুকেও ফু-দিলো। সুপান্ত বললো,
-কি, তুমি ভয় পাচ্ছো?
-জ্বি-না, ভয় পাচ্ছিনা।
-আসলে এরা তেমন কারো ক্ষতি করে না। তবে এদের ক্ষতি করতে চাইলে হয়তো করে। তবে আমি এখন পর্যন্ত কাউকে ক্ষতি করেছে বলে শুনিনী। মানুষের মধ্যে যেমন ভালো-মন্দ আছে, তেমনি এদের মধ্যেও ভালো-মন্দ আছে।
সুপান্তের কথা শুনে চয়নের ভিতরে আরো বেশি সাহস তৈরী হলো। বললো,
-আরে না, আমি ভয় পাচ্ছিনা। বেশ মজাই লাগছে। আজকে ভুত সম্পর্কে বরং একটা বাস্তব ধারনা হোল। আগুনটি চয়নদের মাথার উপর দিয়ে আস্তে আস্তে করে বাঁশ বাগানের মাথায় নামতে থাকলো। চয়ন সমস্ত ব্যাপারটাই নিজের চোখে দেখতে পেলো। ভয়, আনন্দ আর রোমাঞ্চ মিলে এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা!
বাড়িতে এসে দেখলো বেশ কিছু লোক চয়নদের বাড়িতে জড়ো হয়েছে। চয়ন ভাবলো কোন সমস্যা হয়তো হয়েছে। কাছা-কাছি এসে দেখলো, একজন মাঝ বয়সী পুরুষ লোক চেচাচ্ছে। লোকটি করিমনের বাপ। করিমনের মাকে নিতে এসেছে। কিন্ত করিমনের মা যেতে চাচ্ছে না। চয়নের দাদি অনেক বুঝালো, কিন্ত করিমনের মা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। অনবরত কান্না করছে। নাকের পানি আর চোখের পানিতে একাকার। করিমনের মা বললো,
-হ্যায় আরেকটা বিয়া করছে। আমি কিছুতেই হ্যার লগে যামুনা। আমি হ্যার ভাতও খামুনা।
করিমনের বাপ বললো,
-অরে আমি তাড়াইয়া দিছি। তুই আমার লগে লো-যাই?
-না। আপনে যান-গা। আমি যামু না। এই বাড়িতে আমি অনেক শান্তিতে আছি।
-তরে আমি আর কস্ট দিমু না। আমারে তুই মাফ কইরা দে।
করিমনের বাপের এমন আকুতি ভরা কথা শুনে করিমনের মায়ের খুব মায়া লাগলো। করিমনও কাছাকাছি ছিলো। করিমনের বাপ মেয়েকে কাছে পেয়ে গভির মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরলো। কোলে তুলে নিয়ে ভিশন আদর করতে থাকলো। করিমনও অনেকদিন পর বাবাকে কাছে পেয়ে ভিশন খুশি হয়েছে। সব দেখে দাদি বললো,
-যা- করিমনের মা। দেখ, করিমন বাপকে পেয়ে কত খুশি হয়েছে।
কি আর করা। তারপর আঁচলে চোখের পানি মুছে। দাদির পা ছুয়ে ছালাম করলো। বললো,
-যাই আম্মা।
-যাওন নাই। আবার আসিস।
-জ্বি আম্মা, আসুম।
করিমনের মা চয়নের কাছে এসে দাড়ালো। দুহাতে মুখ জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো। বললো,
আমি যাই। তুমি আবার গ্রামে আসলে আমার বাড়িতে আইসো। তোমাকে আমি বিন্নি ধানের খৈ আর চিরা খেতে দিবো।
চয়নের কিযে ভালো লাগলো! তা বলে বুঝানোর মতো নয়। এতো মমতা! এতো ভালোবাসা! গায়ে ছাড়া আর কোথাও মিলবেনা।
চয়ন বললো,
-আমি আবার যখন গায়ে বেড়াতে আসবো, তখন তোমাকে দখতে যাবো।
করিমনের মা চলে গেলো। সুপান্ত অনেক আগেই বিদায় নিয়ে চলে গেছে। দাদি আর চয়ন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলো, করিমন, বাবার কাধে চড়ে আর করিমনের মা হারিকেনের আলোতে পা ফেলে ফেলে করিমনের বাপের পিছে পিছে এগিয়ে যাচ্ছে আপন ঠিকানায়।
আজ অনেক দিন পর চয়ন সেই ছেলেবেলার করিমনের মা'কে দেখতে পেলো। যেনো চয়নের কপালে গভির মমতায় চুমু খাচ্ছে। শুনতে পেলো করিমনের মায়ের বলা সেই কথাগুলো,
-"তুমি আবার গ্রামে আসলে আমার বাড়িতে আইসো। তোমাকে আমি বিন্নি ধানের খৈ আর চিরা খেতে দিব।" চলবে...
হুমায়ুন কবির
ঢাকা, বাংলাদেশ।
-
গল্প//উপন্যাস
-
29-04-2019
-
-