জীবনের বাঁক - আরিফা আশরাফ তামান্না
রীতিমতো আজও পিচ্চিগুলোর ফিসফিসানি সুষমার কানে বাজলো৷ বিকেলবেলা ছাদের উপর বসে খবরের কাগজ বা বই পড়ার অভ্যাস তাঁর নিত্যদিনের৷ পাশের কলোনির বাচ্চাগুলো তখন নিচে থেকেও যেন তার সঙ্গী হয়৷ ওদের আকর্ষণ সুষমার সৌন্দর্য, যেন ও বিশ্ব সুন্দরী! ছোট মানুষ বলে ওদের কানাকানি করার অভিজ্ঞতা কমই থাকার কথা৷ তাই তাদের স.....স.....শ.... ধরনের শব্দের সঙ্গে মাঝে মাঝে যেসব গলাভাঙ্গা বাক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তা থেকে পিচ্চিদের ধারণা সম্পর্কে সুষমা পোক্ত হয়৷
আজ ওদেরকে লক্ষ্য করার সময় ওদেরই বয়সী নতুন একটি ছেলে তার দৃষ্টিগোচর হলো৷ নতুন বাসায় উঠেছে আজ প্রায় দু'সপ্তাহ হলো৷ অন্যদেরকে প্রতিদিন দেখলেও আজ ছেলেটি তার চোখে নতুন৷ ও এখানে মেহমান কি না জানতে চাওয়ার জন্য সবার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলো ; যদিও এতদিন ওদের সঙ্গে শুধু হাসি বিনিময়-ই করেছিলো৷ প্রত্যেকের নাম জানার পর সুষমা জানতে পারলো সুমন মিয়া নামের নতুন ছেলেটির বাস এখানে বহু পুরনো৷ প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার পরই খাবার খেয়ে পাশের চায়ের হোটেলে কাজে চলে যায়৷ এখানে উপস্থিত ছেলে-মেয়েদের বয়স ৯-১১ বছরের মধ্যে হবে৷ তাই সুমন মিয়ার বিষয়ে জেনে সে অবাক হতে গিয়েও অবাক হলোনা৷ কারণ শিশুশ্রমিক এ যুগে নতুন কিসের? তবে ছেলেটির জন্য খুব মায়া হলো ওর৷ সে ওদের সংখ্যা হিসেব করে প্রত্যেকের জন্য একটি করে চকলেট ছুঁড়ে দিলো৷ ওদের খুশি দেখে তার ইচ্ছে হলো আরো দিবে, কিন্তু প্রতিদিন ওদের জন্য চকলেট বরাদ্দ রাখবে বলে আর এগোয়নি৷ দিন দিন ওদের জন্য ভালোবাসা তীব্রতর হতে থাকলো৷ তা হবেই বা না কেন৷ সন্তানহীনা, সংসারে একা৷ দুটি ছোট ভাই-বোন ছিল৷ আদরের ভাইটি ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে অকালে প্রাণ হারায়৷ আর মা-বাবা, বড় ভাই-বোনের যত্ন-ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা বোনটি ফেসবুকে প্রেম করে আপন পরিবারকে ভুলে অপরিচিত ছেলেটির হাত ধরে পাড়ি জমায় বিবাহিত জীবনে৷ সেই থেকে পরিবারের কারো ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই৷ মেয়েটি বাঁচলো কি মরলো সে বিষয়ে জানার আগ্রহ কারো হয়নি৷ হ্যাঁ, হয়েছিল মায়ের; কিন্তু পরিবার, সমাজ কারো কাছেই মূল্য পায়নি তার আগ্রহ৷ কিন্তু চাপা কষ্টে ভুগছিল পরিবারের সবাই৷ পরিবারের দুই সদস্য হারানোর কষ্ট ওই পরিবার বৈ কে বুঝবে? মা-বাবা দু'জন-ই দিন দিন বিছানার জীবনকে আপন করে নিলেন একে একে৷ বার্ধক্যের আলিঙ্গনে বিদায় নিলেন বাবা৷ শয্যাশায়ী মাকে নিয়ে বাধ্য হয়ে ভালো থাকতে হলো সুষমাকে৷ অর্থ-সম্পত্তির অভাব ওর কোনোদিনের ই নেই৷ কিন্তু দেখা মেলেনি শান্তির৷ স্বামী বেঁচে থেকেও দূর প্রবাসে৷ আপনজন বিয়োগে এত একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতার মাঝে কে কতদিন নিজেকে ভালো রাখতে পারে? সুষমা অনেকটা ভালো আছে কেবল স্রষ্টার অপার নিয়ামত ধৈর্য আর স্বামীর অনুপ্রেরণাকে সঙ্গী করে৷ এবার বোধ হয় তার কিছু সঙ্গী জুটলো৷ পোলাপানগুলোকে পেয়ে এমনই রূপান্তর হয়েছে সুষমার৷ আর পিচ্চিগুলোও যেন পেল তাদের ভালো সঙ্গী৷ উপর-নিচে অবস্থান করে চলে তাদের আড্ডা৷
জীবনের গল্প ভিন্ন পথে কোথা থেকে কোথায় গিয়ে নতুন বাঁক নেয়, জীবনকে আরও গল্পময় করার জন্য, তা কার-ই বা জানা? ঠিক এই বৈশিষ্ট্য ধরেই সুষমার ছোট্ট বন্ধুরা সুষমার অভাব বোধ করছে দু' তিনদিন ধরে৷ওদের মন খুবই বিষণ্ণ৷ একদিকে চকলেটের অভাব, অন্যদিকে ভালো বন্ধুরও৷ দিন চারেক পর ওরা সকলে মিলে সুষমার বাসায় যাওয়ার পথ খুঁজে বের করলো৷
নিরিবিলি বিকেল৷ বাসার ফটকের সামনে উকিঝুঁকি মেরে ওরা বুঝতে চাইলো পরিস্থিতি৷ কিন্তু মন্দ কপাল ওদের৷ পাহারাদার ওদের দুষ্টুমি সম্পর্কে খুব অভিজ্ঞ৷ সেই জ্ঞানকে মূল্যায়ন করার সুযোগ হাতছাড়া না করে লাঠিচার্জের আফসোস মেটালো সে৷ পিচ্চিগুলোর ভোঁ-দৌড় দেখে কে!
সপ্তাহ খানিক কেটে গেলো৷ সুষমার বন্ধুরা ভুলতে থাকলো তাকে৷ খেলাধুলায় কেটে যায় ওদের পুরোটা বিকেল৷ সুষমার সঙ্গে সুমনের দেখা খুব কম-ই হতো, সুমনের ব্যস্ততার কারণে৷ কিন্তু বন্ধুদের মাধ্যমে সুষমার সম্পর্কে অনেক দিন থেকে জেনে আসছে৷ সেজন্য তার মন খুব-ই খারাপ৷ কেন যেন ওই খালাটার প্রতি তার আন্তরিক একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, ছোট বলেই হয়তো কারণ বোঝার চেষ্টা করে না৷ মা বলেছে নিজ খালার মতো সুষমাকেও যেন খালা ডাকে৷ কিন্তু আজ সুমন যাবেই ওর বাসায়৷ দেখবে ওরা এখান থেকে চলে গেল কি না৷ বন্ধুদেরকে ডাকতে গিয়ে ওরা দারোয়ানের লাঠির আকৃতি দেখিয়ে ভয় দেখায়৷ ভয় পেলো সুমনও৷ অন্যদিন মায়ের কথায় সে গেলো সুষমার বাসায়৷ ফটক খোলা, কেউ নেই; আরও দুই পা এগোতেই দেখলো দারোয়ান গভীর মনোযোগে পত্রিকার খবরগুলো পড়ছে, যেন অন্যমনস্ক না হওয়ার মনস্থ করেছে৷ দারোয়ানের তুলনায় নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে ঘরের দরজার দিকে এগোতে লাগলো৷ গোছানো বারান্দা দেখেই তার চোখ ছানাবড়া অবস্থা! একটি বড় বুকশেলফ, আকর্ষণীয় আরামকেদারা, টেবিল সব মিলে পুরো একটা বৈঠকখানা৷ এমন দৃশ্য সে তার বাপের জন্মে দেখেনি, কেবল সিনেমায় ছাড়া৷ চারদিকে কেবল বইয়ের ছড়াছড়ি৷ অনেক বইয়ের মধ্যেই 'সুষমা সরকার' নাম লেখা৷ আরও এক ধাপ অবাক হলো সুমন৷ এটা সুষমার নাম-ই হবে! ও নিজের বাসায়ও কোন বইয়ের প্রচ্ছদে এই নাম দেখেছে৷ খালা কী তাহলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো কবিতা লেখে! ভাব এমন হলো যে রবীন্দ্র-নজরুলকে সরাসরি দেখতে পেলো৷ টেবিলের ওপর রাখা একটি বইয়ের প্রচ্ছদে ছোট্ট শিশুদের কার্টুনচিত্র দেখে যেই সুমন বইটি আনতে গেল, সেই ধাক্কা খেয়ে একটি চেয়ার দৌড়ে গিয়ে আলমারির সাথে লেগে শব্দ করলো৷ সে তখন বুঝে নিল এটা সিনেমায় দেখা চাকাওয়ালা চেয়ার৷ কিন্তু ততক্ষণে সে ঠিক-ই বুঝে নিল দারোয়ানের দৌড় কতদূর! তার পাশে এসে দাঁড়িয়েই থানায় ফোন করলো৷ পুলিশ আসতে বেশি সময় লাগলোনা৷ বাইরে দারোয়ানের উঁচু স্বরের কথা দুয়েক বার শোনার পর সুষমা দারোয়ানকে ডেকে এনে ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হলো৷ কথা বলতে শুরু করলো সুমনের সঙ্গে৷ ভয়ে সুমন কেঁদেই ফেলছে৷ চোখের পানি পড়ছে আর হাতের পিঠ দিয়ে নাক ঘষছে৷ সুমনের জন্য সুষমার খুব মায়া হলো৷
- তুমি এখানে কী করছিলে?
- অ....অ....নেকদিন আপনার .......সাক্ষাত না....আ... পেয়ে.....
- থাক, বুঝতে পেরেছি৷ কষ্ট করে আর বলতে হবে না তোমাকে৷ বিস্মিত হলো সুষমা! এতখানি ছোট বাচ্চার তার প্রতি ভালোবাসা দেখে সেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো৷ আদর করে কাছে বসালো৷ পুলিশও বিদায় দিলো৷
- তুমি ভয় পেয়োনা৷ এ বাসায় আসার পর থেকে আমার তিন তিনটে পান্ডুলিপি চুরি হয়ে গেছে৷ সেই ভয় থেকেই দারোয়ান এমন করেছে৷
- আরও একদিন আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বন্ধুরা ভয় দেখিয়েছে৷ বলে দারোয়ান নাকি মারবে৷ ওরাও এসেছিল৷ দারোয়ান নাকি তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের৷ সেই ভয়ে আসিনি৷ কিন্তু আজ মায়ের কথায় এসে পড়লাম৷
- ওহ্, তাই! তোমরা আমাকে এত্তো ভালোবাসো? খুব অসুস্থ ছিলাম ক'দিন৷ ডাক্তার সাহেব সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে বারণ করেছেন৷ তাই ছাদে উঠা হচ্ছেনা৷
সুষমা দু'মুঠো চকলেট এনে দিলো আর বলল, 'তুমি প্রতিদিন আসতে না বলে তোমার চকলেট গুলো জমা পড়েছে৷ এই নাও৷'
এতোটা চকলেট একসঙ্গে পেয়ে সুমনের ভিতরটা যে নেচে উঠলো তা সুষমা বুঝতে পারলো৷ হঠাৎ একটা প্রশ্ন তাঁর মনে জাগলো, 'আচ্ছা, তোমার মা আমাকে চিনেন নাকি? উনি আমাকে এতো ভালোবাসেন যে খুঁজতে পাঠালেন?'
সুমনের কথা বলার মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকলো৷ এখন মায়ের কথা বলতে গিয়ে গলায় আরও জোর আসলো, ' জ্বী, মা বলেন আমি যেন আপনাকে খালা ডাকি৷ আপনি নাকি আমার খালার মতো দেখতে৷ আচ্ছা, আপনি কবি না কি? আপনি বই লেখেন? আপনার নাম সুষমা সরকার? আমার মা আপনার বই পড়েন৷' একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সে ক্রমেই প্রশ্ন করে চলেছে৷ একের পর এক কথার প্যাঁচে মুগ্ধ হয়ে সুমনের কথা বলার ভঙ্গি অবলোকন করছিলো সুষমা৷ সে কেবল হেসে হেসে মাথা নাড়ছিল৷ সুমনের মা যে তাঁর বই পড়ে সেজন্য সে অবাক হলো না, কারণ তার লেখা বেশ জনপ্রিয় বলে অনেকেই পড়ে৷ তবে মহিলাটির জন্য তার মনে গভীর ভালোবাসার উদ্রেক হলো৷ আবার কথা বলা শুরু করলো সুমন, ' আমাদের বাসায় একদিন আসবেন খালা৷ আমার মাও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসেন৷'
-চলো, আজ-ই যাই৷
সুমনদের কলোনিতে গিয়ে সৃষ্টি হলো আরও একটি ছোট্ট গল্পের, যার চিত্র গড়ে উঠেছে অনেক বেদনার আদলে; যা সুষমার 'আত্মগাঁথা' গ্রন্থটির পরিসর আরও বাড়িয়ে দিলো৷
রূহামা৷ সুমনের মা সে, যে কি না এক কালে অতি আধুনিক, সুন্দরী, শিক্ষিত প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষায়িত ছিল৷ এ হলো সুষমার সেই বোন, যে ফেসবুকে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে আত্মার বাঁধনকে অপমান করে পাড়ি দিয়েছিল প্রেমিককে আপন করে পাওয়ার জন্য৷ কিন্তু বিধির লিখন, স্বামীর পরিবারে গিয়ে দেখে ভিন্ন চিত্র৷ এই সুমন, স্বামীর পূর্বের স্ত্রীর ছেলে, বয়স ছিল প্রায় দুই বছর৷ রূহামার কিছুই করার ছিলনা তখন৷ পরিবারে ফিরে আসা ছিল অসম্ভব, স্বামী তাকে দিন-রাত পাহারার মধ্যে রাখতো৷ একসময় স্বামীর পরিবার, সুমন সবাইকে আপন করে ভালোবাসতে শুরু করে সে৷ গর্ভে আসে তার সন্তান৷ জন্মও নেয়৷ এর প্রায় মাস ছয়েক পর রোজগারের লক্ষ্যে রূহামার স্বামী পাড়ি জমায় দূর বিদেশে৷ এখানেও ভাগ্য রূহামার সঙ্গে বাঁকা চোখে সাক্ষাত করলো৷ প্রথম দু'মাস স্বামী ঠিকমতো খোঁজ-খবর নেয়, কিন্তু এরপরে আর কোনো হদীস পাওয়া গেলোনা ওর৷ শুরু হলো রূহামার যুদ্ধের জীবন৷ মা-বাবার অতি আদরের সন্তান ক্রমেই হয়ে উঠলো জীবন যুদ্ধের লড়াকু সৈনিক৷ আর এই রূহামা-ই সুষমার ছোট্ট ভালোবাসা ছিল৷ পান্ডুলিপি চুরি করা, সুমনকে হাতেনাতে ধরা সবই ছিল দারোয়ানের সহযোগিতায় রূহামার সাজানো নাটক, তবু যদি বোনটার সঙ্গে ওর দেখা হয়, এই ছিল তার লক্ষ্য৷ সুষমার প্রতিটি বইয়ের পাঠক রূহামা৷ তার সর্বশেষ গ্রন্থের মাধ্যমে তারঁ অবস্থান নিশ্চিত করে রূহামা৷ সুষমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোচ্ছেনা৷ ওর চোখগুলো যেন কথা বলা শুরু করবে৷ ও ভাবেনি জীবনের কোনো এক বাঁকে কোনো আপনজনকে এভাবে ফিরে পাবে৷ রূহামার ভাবনায়, আপন কর্মফল সে পেয়ে গেছে৷ এখন সুষমার নিকট তার অনুরোধ সে যেন তাকে সঙ্গে রাখে৷ হা করে তাকিয়ে রইলো সুমন৷ এমন কত ঘটনা সে দেখেছে টেলিভশনে৷ কিন্তু ওইগুলোতো নাটক, সিনেমা৷ তাহলে এই ঘটনাকে কি বলতে পারে তা সে বুঝে উঠতে পারলো না৷ এটা যে জীবন; জীবনের একেকটি অংশকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় নাটক, সিনেমা তা কি আর সে বুঝে? সিনেমার নায়কের মতো আজকের কাহিনীর যে সে হিরো, তাকে সেটা বুঝাবে কে?
আরিফা আশরাফ তামান্না
সিলেট, বাংলাদেশ।
-
গল্প//উপন্যাস
-
21-04-2019
-
-