রাজাকার - বজলুস শহীদ
(এই অনুগল্পের চরিত্র, স্থান সবই কাল্পনিক। কারো সাথে মিলে গেলে বিনীত ক্ষমা প্রার্থী। কাউকে ছোট বা বড় করার জন্য এ গল্পের অবতারণা নয়। মানুষের দেখা আর সাধারণ বোধের মাঝে অসাধারণ কিছু লুকিয়ে থাকে, সাধারণ চোখে যা দেখা যায়, তার বাইরেও একটা জগৎ থাকে। সে জগতের বাসিন্দাদের আমরা চিনি না। )
তখন মাগরিব ছুঁই ছুঁই করছে। আমদের দলটি নলডাংগা স্টেশন থেকে আধামাইল পেছনে নৌকা নোংগর করলো। গেরিলার এই দলটি আজ পাট কেনার বেপারি। নলডাংগায় এখন আর কোন হাট বসে না মিলিটারীদের ভয়ে।
ব্রিজটা পাহারা দেবার জন্য মিলিটারীরা ১৫ সদস্যের এক রাজাকারের দলকে সার্বক্ষনিক পাহারায় বসিয়েছে। এরাও সু্যোগ পেলেই, মিলিটারী কায়দায় মানুষকে নানা ভাবে হয়রানি করে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করে।
কান ধরে উঠা বসা থেকে শুরু করে লুংগি খুলে দেখা, কিছুই বাদ যায় না।
আজকে এদের উপর একটা আক্রমণের ছক কাটা হয়েছিল আগে থেকেই। তাদের বাংকারের ভেতর গ্রেনেড মারার দায়িত্ব দলটির কমান্ডার আফাজ নিজেই নিয়েছিল। আমদের কাজ ছিল অতঃপর ওদের অস্ত্রগুলো নৌকায় নিয়ে জমা করা।
নলডাংগা হাটের পশ্চিম পাশের মসজিদে আযান হলে আমাকে নৌকা থেকে নামিয়ে দেয়া হলো, মসজিদে মুসল্লিদের সংখ্যা আর ভেতরের পরিবেশটা যাচাই করার জন্যে। মুয়াজ্জিন আর জনা পাঁচেক মুসল্লি, আমি কাতারের ডান পাশে দাঁড়ালাম। নামাজ শেষ হলো। ইমাম সাহেব ইংগিত দিলেন তাঁর কাছে যেতে। আমাকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মোকাম কোথায়, কেন এখানে।
বল্লাম, নদীতে আমাদের নৌকা আছে, আমি মাগরিব পড়তে নেমেছি। উনি আর কথা বাড়ালেন না। সুন্নত নামাজ পড়ে বাইরের দরজায় পা দিতেই পেছন থেকে অতি পরিচিত গলায় ডেকে উঠলো, এই সাবের, কেমন আছিস।
লতুর গলা, আমার অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর, আমার সহপাঠি। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে মসজিদের এক কোণায় নিয়ে গেল। বললো, সময় খুব কম। কথা বলা যাবে না। ক্যাম্পে খবর আছে, তোরা এদিকে আসবি, এর বাইরে আর কিছু বলবো না, পালিয়ে যা তোরা অন্য পথে।
আর একটা কথা মনে রাখিস, তোদের দলে যেমন বিশ্বাস ঘাতক রয়েছে আমিও এই রাজাকার দলের একজন বিশ্বাস ঘাতক। দলে এ ধরণের লোক থাকলে লড়াই সংগ্রামে জেতা যায় না। আমার ইচ্ছে আছে তোদের দলে যোগ দেবার কিন্তু সময় আসেনি। দেরি করিস না পালিয়ে যা।
নৌকায় ফিরেই আমি আফাজ ভাইকে খুলে বল্লাম, লতুর কথা। আফাজ ভাই নৌকাটা সামনে না নিয়ে সবাইকে পজিশন নিতে বলে পেছনে চলে যেতে বললেন। মীরজাফর লতু রাজাকারের কারণে আমরা সেদিন সবাই বেঁচে গেলাম।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই আমাদের দলটিতে ভারত থেকে আসা বেশ ক' জন মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিল। এতদিন পুরানো থ্রি নট থ্রি, কয়েকটা গ্রেনেডই ছিল আমাদের সম্বল। এদের সাথে এস এমজি, এলএমজি, স্টেন গান যোগ হওয়াতে আমদের শক্তি সাহস বেড়ে গেল। নলডাংগা ব্রিজের রাজাকার ক্যাম্পে এখন আর আক্রমণ করার জন্য আমরা দিন গুনতে লাগলাম। এরই মধ্যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল,শুরু হলো ভারত পাকিস্হান যুদ্ধ। আগদিঘা গ্রামের স্কুল মাঠে রাজাকারদের একটা বড় দলকে আমাদের দল নিঃশেষ করে দিল। তাদের দু' একজন পালাতে পারলেও অধিকাংশই নিহত হলো।
দলের পরবর্তী টার্গেট হলো নলডাংগার রাজাকারদের উপর আক্রমণ।
আমার, লতুর কথা মনে পড়ে গেল। ওকে না বাঁচাতে পারলে আমি নিজের কাছে কী জবাব দেবো, এ প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। কিন্তু দলের সাথে কিভাবে বিশ্বাস ঘাতকতা করি, এই আত্ম দহনে পুড়তে লাগলাম।
একবার মনে হলো,আফাজ ভাইকে খুলে বলি সব, আবার আরেক টা মন বলে উঠলো পাগল কাজ নেই। বিজয়ের শেষ লগ্নে এসে কেন দলের লোকদের অনাস্থা ভাজন হবি।
মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম,আমাদের আক্রমণের দিন লতু যেন রাজাকার দলে না থাকে। কিন্তু তা হলো না, পুরো রাজাকারের গ্রুপটা আমাদের সাঁড়াশি আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে আত্মসমর্পণ করলো।
ব্রহ্মপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের অফিসটা ছিল নলডাংগা হাটের এক কোনায়। এখানেই একটা কক্ষে রাজাকারের দলটিকে আটকিয়ে রাখা হলো।
বুড্ডা বলে আদিবাসী এক মুক্তিযোদ্ধাকে দায়িত্ব দেয়া হলো এদের বিচারের। বুড্ডা যেমন সাহসী তেমনি তার নিশানা।
লতুকে যখন হাত বেঁধে ঘরে ঢুকানো হচ্ছিল, ও একবার আমার দিকে তাকিয়ে একটা করুণ হাসি দিল। আমার বুকের ভেতর কেমন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে হলো, লতু বন্দী নয়, লতু শ্রেষ্ট বিজয়ী বীর। আমি পরাজিত আজ ওর কাছে।
আমি বার কয়েক চেষ্টা করলাম,আফাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলতে , কিন্তু বাঁশিলা গ্রামের রাজাকারদের অত্যাচার,নির্মমতার উপযুক্ত শাস্তি দিতে সে বদ্ধ পরিকর।
তা' ছাড়া বুড্ডা তার কথা শুনবে কি-না তাও আমি নিশ্চিত ছিলাম না।
এদিকে আমার চোখের সামনে একটাই ছবি ভাসছে আর তাতে লতু তার বিজয়ীর হাসি হেসে যাচ্ছে।
আমি এ কষ্ট কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না।
একবার খেয়াল করলাম, আফাজ ভাই একলা একটা ভিন্ন ঘরে বসে কার কি শাস্তি হবে, কে কাকে গুলি করবে তার তালিকা করছে।
আমি কাছে যেয়ে তাঁকে লতুর কথা মনে করিয়ে দিলাম। কিন্তু কোনই উত্তর না দিয়ে বললো, লতুকে গুলিটা তুই করবি, আমি সেভাবেই তালিকা করেছি। আজ রাত ২ টায় আমার সে আদেশ তুই কার্যকরী করবি, লতুকে তোর হাতে ছেড়ে দেবো। কথা বাড়াসনে, মনকে শক্ত কর।
আমি জানি, আফাজ ভাই ভিন্ন ধাঁচের মানুষ,বেশি কথা বলে না। তবুও আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগলাম।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, আর বল্লেন, স্টেন গানটা চেক কর, তোর গুলি যেন একটাও মিস না হয়।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। নদীর পাড়ে এলাম, লতুকে গুলি করার লোকেশন দেখতে, লতুকে কোথায় নিয়ে গুলি ফুটালে লতু পালিয়ে যেতে পারবে।
রাত দু' টায় চেখ বাঁধা, হাতবাঁধা লতুকে আমার হাতে তুলে দেয়া হলো। ডিসেম্বরের শীত, উপরে খোলা জোৎস্না, এক গভীর কুয়াশা চাদরে ধরিত্রী মাতা তার সকল সন্তানদেক উষ্ণ আদরে জড়িয়ে রেখেছে। লতু, হাঁটতে হাঁটতে তার জীবনের শেষ ইচ্ছে জানিয়ে দিল,তাকে যেন সেই মসজিদে একটু নেয়া হয়, যেখানে আমরা একসাথে মাগরিব পড়েছিলাম।
আমি বললাম ঠিক আছে, তুই চুপ চাপ থাক, আমি আছি না। হাঁটতে হাঁটতে ওর হাতের বাঁধন খুলতে লাগলাম। আমি বল্লাম লতু, 'আমি তোকে ছেড়ে দেব, আমি গুলি করবো ঠিকই কিন্তু তোর গায়ে লাগবে না। তুই পালিয়ে যাবি এমন কোথাও, যেন তোকে আর কেউ খুঁজে না পায়।'
লতু রাজী হলো না, বললো -'এতে তোর বিপদ হবে। কেন তুই এই ঝুঁকি নিবি আমার জন্যে।'
আমি বললাম, সেটা আমার উপর ছেড়ে দে।
- দেখ সাবের, আমি কিন্তু রাজাকার হতে চাইনি। আমার বাবাকে যেদিন চেয়ারম্যান চাচা ডেকে বল্লো, হয় তোমার ছেলেকে রাজাকার বানাও, কিংবা মেয়েকে দাও ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে। সেদিন আমি বাবাকে বলেছিলাম, আমি রাজাকার হবো। এছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। এই চারটা মাস আমিও প্রতি রাতে নামাজে বসে দেশের স্বাধীনতার জন্যে প্রার্থনা করেছি।' ওই আরশের মালিক জানেন, আমি সত্যি না মিথ্যা বলেছি।'
আমি জোৎস্নার আলোতে লতুর মুখটা দেখতে পেলাম । লতুর কান্না আর মায়াবি জোৎস্না ওর গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে।
আমি লতুকে বল্লাম,'লতু আর পেছনে তাকাবি না। তোর যাত্রা অজানা গন্তব্যে। এই আমি গুলি চালালাম।' বেশ কয়েকটা গুলি ছুঁড়লাম, রাতের আকাশ চিরে গুলির শব্দ সহযোদ্ধাদের কানে পৌঁছে গেল। দূরে দু' একটা কুকুর দীর্ঘ স্বরে ডাক ছাড়ল। দেখলাম, কুয়াশা আর জ্যোৎস্নার মাঝে লতু অদৃশ্যে লুকিয়ে যাচ্ছে।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে লতুর মতই একটা হাসি দিয়ে বল্লাম, মুক্তিযোদ্ধারা শুধু নিতেই জানে না, দিতে ও জানে। দান নেয় না প্রতিদানও দেয়।
বজলুস শহীদ
অটোয়া, কানাডা।
-
গল্প//উপন্যাস
-
18-04-2019
-
-