মনের চিলেকোঠায় জীবাশ্ম হয়ে……(১ম পর্ব ) - বন্যা হোসেন
১)
বাবার মৃত্যুর সময়টা আমি দেশে ছিলাম না । চেষ্টা করলেও আসতে পারতাম না । কারণ আমার বৈধ কাগজপত্র ছিল না । অবশেষে বৈধতার মেয়াদ পেয়েছি, তাই প্রথম সুযোগেই দেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দশ বছর পর ফিরেছি, বাবা চলে গেছেন দু’বছর হলো।
বাস রাস্তার পাশেই আমাদের বাড়ী। মনে দ্বিধা আর কুন্ঠা নিয়ে ভীরু পায়ে এগিয়ে যাই বাড়ীর পথপানে। আমি মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে বাবা দুটি ঘর তুলতে পেরেছিলেন। আমরা তিন ভাই বোন আর মা সেই একটি ঘরেই থাকতাম। বাবা সারা সপ্তাহ থাকতেন ঢাকায়। বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ী ফিরতেন, আবার শনিবার খুব ভোরে ঢাকার বাস ধরতেন। কুমিল্লা শহরে বাবার শেষ বয়সে করা বাড়ীটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে, যদিও তারকিছু বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। কেমন যেন তাচ্ছিল্য আর ধিক্কারের চাহনী তার চোখে। নাকি আমার আত্মধিক্কার!
বাড়ীটির অর্ধেক দালান আর বাকী অর্ধেক টিন শেড, উপরে টিনের চাল। টিনের চালে সেই কবে আমার ছোট বোনের লাগানো মাধবীলতার ঝাড় ফুলে ফুলে ভর্তি। পূব দিকের কোণায় আঙ্গিনাতে লাউ গাছ আর মৌসুমের সবজি। লাউয়ের মাচা নুয়ে পড়েছে কচি কচি লাউয়ের ভারে। বাবা বেঁচে থাকতে বাবা আর মা মিলে করতো সবজি চাষ সারা বছর ধরে। এখন নিশ্চয়ই মা একাই করে।
পরিষ্কার উঠোন পেরিয়ে ঘরের ভিতর উঁকি দিলাম দুরু দুরু বুকে। নাহ, কেউ নেই কামরায়। বাবা বুঝি আরও দেড়টি কামরা সংযোগ করতে পেরেছিলেন মূল বাড়ীটির সংগে। কোন ঘরে কেউ নেই। ঘরের সাজসজ্জা, আসবাবপত্র খুবই সাধারণ কিন্তু পরিপাটি গুছানো। সঙ্গের ব্যাগটি মেঝেতে নামিয়ে রেখেই পিছনের আঙ্গিনায় এলাম মায়ের খোঁজে। ওখানেও কেউ নেই। চোখে পড়লো সুপারি গাছ পেরিয়ে সামনের আমলকি আর শিমুল গাছের সংলগ্ন জমিতে খাটো করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘেরা স্বল্প পরিসর জায়গাটি। কেউ না বললেও জানি, বাবা ওখানে শুয়ে আছেন। ঘুমোচ্ছেন, চিরতরে। আমার অপরাধী মন…... চোখ তুলে তাকাতে পারি না, বাবা বুঝি আমাকে ভর্তসনা দিচ্ছেন।
বাবা কখনো উঁচু গলায় চিৎকার করে বকুনি দিতেন না বা গায়ে হাত তুলতেন না। কিন্তু অন্যায় করলে তার চোখের বিষাদময় দৃষ্টিই ছিল যথেষ্ট, নিজেকে মনে হতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি...এক্ষুণি বুঝি ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হবে। সেই বাবার আত্মবিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছি আমি, বিবেকের দংশনে দংশিত হলেও মাফ চাওয়ার আর সুযোগ নেই।
নিজেকে ভন্ড, আত্মসর্বস্ব মনে হয় …...মনে হওয়ার কিছু নেই .. . নিঃস্ব করে দিয়েছি বাবাকে ...আর্থিক যতটা নয় আত্মিক ক্ষতি করেছি অনেক বেশী।
শিমুলতলা আমাকে টানছে চুম্বকের মতো। এক পা বাড়িয়ে আবার পিছিয়ে যাই ...সত্যিই গিয়ে দাঁড়াবো কি করে মানুষটির সামনে ...মা যে কোথায় গেল, মা সামনে থাকলে তাও একটু ভরসা পেতাম।
২)
আমার মা আর বাবা অসম দুটি মানুষ কি করে একসাথে একঘরে এতগুলো বছর কাটিয়ে গেলেন, এ এক রহস্য। ছোটবেলায় শুধু জানতাম বাবা ঢাকায় চাকরি করে, এ নিয়ে গর্ব হতো। কেমন করে যেন একদিন জেনে গেলাম বাবা আসলে ঢাকায় এক সরকারী অফিসে পিয়নের চাকরি করে। সে কি লজ্জা তখন আমার। বন্ধুরা জেনে গেলে কি বলবে সেজন্য কিছুদিন বন্ধুদের থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতাম আর প্রার্থনা করতাম সম্মান করার মতো বড় চাকুরে ওয়ালা বাবার জন্য।
আমার বাবা আবুল কাশেম ছিলেন দরিদ্র দিনমজুরের সন্তান। নুন আনতে পান্তা ফুরায় কিন্তু বছর বছর সন্তান জন্মানো যে সংসারে অতি সাধারণ ঘটনা। বাবারা তিন ভাই আর পাঁচ বোনের পরিবার কি কষ্টেসৃষ্টে আধপেটা বা অনাহারে দিন কাটাতো তা সহজেই অনুমেয়। গ্রামেরই এক পড়শী সহানুভূতি বশত তার আত্মীয়ের শহরের বাড়ীতে বাবাকে কাজে লাগিয়ে দেয় ৭/৮ বছর বয়সে। সেই শুরু বাবার কর্মজীবনের। বছরে একবার বা দুবছরে একবার তার সুযোগ হতো পরিবারের কাছে আসার। বাবার বেতনের টাকা দাদা গিয়ে নিয়ে আসতো প্রতি মাসে ঢাকার বাসা থেকে। সেই স্বচ্ছল পরিবারে বাবা গৃহস্থালির সব কাজে সাহায্য করতো গৃহকর্ত্রীকে। কুটনো কোটা, বাটনা বাটা, কাপড় ধোয়া, ছোট ছোট বাচ্চাদের কোলে কাঁখে ঘুরে বেড়ানো, বাগানের কাজ, বাজারঘাট দোকানপাট সব কাজের জন্য ঐ পরিবারের প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে ছোট্ট কিশোর আবুল কাশেম। তাদের মনে দয়ামায়া ছিল অগাধ, সংসারও ছিল প্রাচুর্যে ভরা।
আবুল কাশেমের ১৮ বছর বয়সে পরিবারের গৃহকর্তা আমার বাবাকে ডেকে বলেন, “ আমি তো চিরজীবন বাঁচবো না, মরার আগে তোর একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারলে শান্তি পেতাম।”
পরদিন তিনি তার বন্ধুর অফিসে নিয়ে গেলেন উঠতি যুবা কাশেমকে। চাকরি হয়ে গেলো পিয়ন হিসেবে। কাশেম নামক তরুণ যুবাটি শুরু করলো জীবনের নতুন এক অধ্যায়। বাসস্থান রয়ে গেলো তার ঐ বাড়ীটিতেই। ভোরে উঠে বাড়ীর কিছু কাজে সাহায্য করে নাকে মুখে দুটো গুঁজে দিয়েই বেরিয়ে যায় বাস ধরতে। দৌড়াতে দৌড়াতে অফিস দালানে প্রবেশ করে বড়সাহেব অফিসে আসার অনেক আগেই।
সারাদিন দৌড়ের উপরই থাকতে হয় তাকে, হাজার হোক বড়সাহেবের খাস পিয়ন সে। অফিসে অনেকেই তাকে হিংসের চোখে দেখে… যতো হিংসেই করুক কাজগুলো তো তাকেই করতে হয়। অফিসের কাজ ছাড়াও স্যারের বাসার বাজার করতে শহরের এপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটতে হয়। স্যারের গিন্নী বড়ই রগচটা মহিলা, তাকে ক্ষেপানোর সাধ্য তার স্বামীরও নেই… কাশেম তো কোন ছার!
অফিস সংক্রান্ত সমস্ত কাজ সাঙ্গ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যেতো। এই পরিবারটির প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না কাশেমের। রাতে সে খুঁজে খুঁজে কাজ বের করতো, সমস্ত পরিবারের সদস্যদের কাপড় ইস্ত্রি করা ছিল রাতে তার একটি প্রধান কাজ। কর্তা কর্ত্রীর রাতের খাওয়া শেষ হলে তাদেরকে মশারি টাংগিয়ে দিয়ে তার ছোট্ট ঘরটিতে কাপড় ইস্ত্রি শুরু করতো। ততদিনে এ পরিবারের সদস্য সংখ্যা আরও বেড়েছে। ছেলেরা বিয়ে করেছে, সন্তানাদি হয়েছে ...সবার কাপড় ইস্ত্রি করে শেষ করতে এক একদিন মধ্যরাত পেরিয়ে যেতো। তারপর দুটো মুখে দিয়ে বেহুঁশ ঘুম। আবার কাকডাকা ভোরে উঠেই দৌড় শুরু হতো তার।
৩)
যতদিন বিয়ে করেনি ততদিন এই রুটিন ধরেই চলছিল কাশেমের জীবন। চাকরি পাওয়ার আরও দশ বছর পর কাশেম বিয়ে করে তারই আপন মামাতো বোনকে। দাদীর কাছে শুনেছি তার ভাইয়ের অবস্থা স্বচ্ছল, মেয়ে রূপসী এমনকি ম্যাট্রিক পাস হওয়া সত্ত্বেও অশিক্ষিত কাশেমের সাথে নানা তার মেয়ের বিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন। এর কারণ শুধুমাত্র বাবার সচ্চরিত্র ও পরিশ্রমী স্বভাব। আমার মা ছিল বাবার জীবনে বানরের গলায় মুক্তোর মালার মতো। বাবা শুধু নিজের নাম স্বাক্ষর করতে শিখেছিলেন। একটি বাক্য লিখতে বা পড়তে পারতেন না। মা দেখতেও সুন্দরী ছিলেন। তবে সুন্দরী, শিক্ষিতা স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ের সাথে বসবাস করতে গিয়ে বাবাকে অনেক আপোষ করতে হয়েছিল।
বাবা সব বোনদের বিয়ে দিয়ে তারপর নিজে বিয়ে করেছিলেন। দাদা-দাদী বেঁচে ছিলেন তখনও …...আমাদের পরিবার আলাদা হয়ে গেলো। মা কিছুতেই এত বড় সংসারের দায়িত্ব নিতে রাজী হননি। আমার দুই চাচাও তখন কাজ করা শুরু করেছে ...বাবা তার অফিসেই এক চাচাকে পিয়নের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ছোট চাচা কলেজে পড়ে আর ছাত্র পড়ায়। আমাদের ঘর আলাদা হয়ে গেলেও বাবাকে দাদা দাদীর ভরণপোষণ দেখতে হতো। মায়ের সাথে এ নিয়ে নিত্য অশান্তি হতো।
মা নিজে খুব হিসেবী ছিলেন …...তার নিজস্ব কিছু উপার্জন সবসময় ছিল। অল্প কিছু টাকা পেয়েছিলেন নিজের বাবার থেকে, সেই টাকা চড়া সুদে ঋণ হিসেবে দিতেন গ্রামের লোকদের। এছাড়া চিনি, তেল, চাল এসব বিক্রী করতেন গোপনে চড়া দামে বাকীতে। পরে কড়ায় গন্ডায় সুদ আদায় করতেন পাই পয়সা হিসেব করে। কারো সাথে কখনো টাকা পয়সা নিয়ে বাক বিতন্ডা হতে দেখিনি। তার ধারালো ব্যক্তিত্বের সাথে শান্ত স্নিগ্ধ রূপটি ছিল মন কাড়া। মায়ের হাঁস মুরগীর খামার, গরু পালন, সব্জির চাষ, ক্ষেতে ফসলের তদারকিতে সারাদিন কেটে যেতো।
মা নিজের উপার্জন জমিয়ে শহরের উপকন্ঠে এক খন্ড জমি রাখলেন ভবিষতে বাড়ী বানানোর অভিপ্রায়ে। মা নিজে পড়ালেখা জানতেন বলে আমাদেরকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে জোর দিলেন। বাবা নিজেও দুঃখ করতেন, শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতেন। ঢাকায় যে বাড়িতে তিনি আশ্রিত থাকতেন তাদের মান সম্মান প্রতিপত্তির মূলে ছিল শিক্ষা... ...এ কথাটি বারবার বলতেন।
মায়ের কল্যাণে আর বাবার সরকারী অফিসের পিয়নের কাজ থাকার সুবাদে আমাদের একেবারে হা ঘরে অবস্থা ছিল না। বছরে দুবার নতুন কাপড় পেতাম, তিনবেলা ভাতও জুটে যেতো। সপ্তাহের শেষে বাবা এলে শুক্রবার বড় মাছ আনা হতো। ফুফুদের শ্বশুরবাড়ী থেকে আনাগোনা লেগেই থাকতো, তখন ঘরের পুষে রাখা মুরগী জবাই হতো, দু’মাসে একবার হাট থেকে জবাই করা গরুর মাংস কেনা হতো। গরুর মাংস কষানোর মশলা সুবাসিত ভুরভুর করা গন্ধে মন মাতাল হতো। সেদিন গুলোতে ঘর ছেড়ে বের হতাম না। মায়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতাম মাংস খাবার লোভে। ভয় হতো,বাবা যদি সবটা মাংস দাদার বাড়ী পাঠিয়ে দেয়। ভালো মন্দ কিছু রান্না হলে ওবাড়ীতে যাবেই, এ তো জানা ছিলই।
দেখতে দেখতে আমি ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। আমি আর বোন মায়া এক বছরের ছোট বড় ছিলাম। আমি কলেজে ঢোকার পরের বছর মায়া এস এস সি পাশ করে প্রথম বিভাগে। চারিদিকে সারা পড়ে যায়, দিনমজুর আর ক্ষেতমজুর ছিল বাবার পরিবার বংশপরম্পরায় ...সেই পরিবারের একটি মেয়ে এত ভালো হতে পারে পড়াশুনায় কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। আসলে মায়ের জন্যই সম্ভব হয়েছিল সব। মায়ের বদলে বাবা যদি সমমানের পরিবারের কাউকে বিয়ে করতেন তাহলে হয়তো আমাদের পরিবার এতদূর এগুতো না।
মায়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই ওর জন্য অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসতো। মা রাজি হতেন না। বলতেন,” আমার বিয়ে হলো ম্যাট্রিক পাশ করে, মেয়েকে বি এ পাশ না করিয়ে বিয়ে দিবো না।” বাবা এসময়টা না বুঝেই জেদ ধরতেন লোকজনের পাল্লায় পড়ে। মায়ের সাথে ঝগড়া করলেও কখনোই পেরে উঠতেন না। আমি কলেজ শেষ করে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ইংরেজীতে অনার্স পড়া শুরু করলাম। বোনটি ততদিনে বিএ পড়া শুরু করেছে। এবার মা আর অপেক্ষা করতে পারলো না। মাঝে মাঝে বাবার শরীর খারাপ হতে থাকলো, অস্থির হয়ে গেলেন মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য। মায়ার বিয়ে হয়ে গেলো কুমিল্লা শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বিয়ের পর মায়া পড়া চালিয়ে গেলো এবং বিএড শেষ করে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলো। ...চলবে।
বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।
-
গল্প//উপন্যাস
-
09-03-2019
-
-