ধোঁয়ার কুন্ডলি - শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস
এরকম সকালগুলো মাঝেমধ্যে আসে। এই গ্রহের সকল সেকশন, স্কয়ারে ফিটে একইরকম সাইজের নয় ! তাদের আলাদা আলাদা দূরত্বের কারণে সূর্যের কিরণের রকমফের ঘটে! আর তাই..
আর তাই? রুশদি সেন আমাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো। ওর মুখেচোখে একটা প্রত্যয়ের ভাব আমি প্রথম দিনেই লক্ষ্য করেছিলাম। রুশদি, আমার কলিগ। আমাদের এই শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র জলসেচ দপ্তরের অফিসে রুশদি সেন নর্থবেঙ্গল থেকে বদলি নিয়ে অল্পদিন হলোই এসেছে। বয়সে তরুনী, শান্ত স্বভাবের এই মেয়েটি অ্যাকাউন্টস সেকশনে বসে। ইতিমধ্যেই ও এলাকার ঠিকাদারদের নাম ঠিকানা প্রায়ই মুখস্ত বলে দিতে পারে। আপাত গম্ভীর,চোখে ব্রাউন ফ্রেমের চশমা পরা,মাঝারি গরনের এই মেয়েটিকে নিয়ে তাই ঠিকাদার মহলে গুনগুন ফিসফাস।
শুশুনিয়াতে বসন্ত এসে গেছে। চারিদিকে লালের আভা ছড়িয়ে পাহাড় যেন রানীর সাজে সেজেছে। পলাশ শিমুলের লালিমায় বনাঞ্চলের চরণে যেন 'একি লাবণ্য আজ পুণ্য প্রাণ' এর নুপুর নিক্কণ! আমরা এ সময়ে যা করি। অর্থাৎ বিকেলে অফিস ফেরতা পাহাড়ের বাঁকে বসে থাকা লোকাল আদিবাসীদের চাষ করা কিছু আনাজ, কিছু ডিম, বনমোরগের মাংস- এইসব তাদের থেকে সওদা করে কোয়ার্টারে ফিরে আসি। আমার কোয়ার্টারের ঠিক পাশেরটাই রুশদির। একাই থাকে।জিগ্যেস করিনি কোনোদিন মেয়েটিকে, ও একা কেন এ বয়সে! কেননা ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্লডে এখন কেউ কি সত্যিই একা? এ প্রশ্ন আমার নিজেরই তো নিজের কাছে! এছাড়াও আমি নিজেও, একটি পরিবারের সদস্য হয়েও তো একাই!
তবুও উত্তর বঙ্গের নদীর মত বহতা একটি মেয়ের পাহাড়িঝোড়া থেকে স্বেচ্ছাবিচ্যুতি নিয়ে এই খরমৃত্তিকার বাঁকুড়াজেলায় বদলি নিয়ে চলে আসাটাকে আমি কিন্তু কোনওভাবেই সহজ করে নিইনি। এই যেমন ক'দিন আগে টিফিনের সময় কথা হচ্ছিলো আমাদের অফিসের বড়বাবু পরেশ সরকারের সাথে। পরেশবাবু আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছিলেন- ভাতের হাঁড়ির একটা ভাত টিপলেই বোঝা যায় যে, সব ভাত হয়েছে কি না! আমার একটু রাগই হলো ওনার ওপর। বলেই ফেললাম, মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি? বুঝলেন ম্যাডাম, এসব মেয়েরা হচ্ছে চর্কির মত। আগুন ছিটকিয়ে ঘুরতে থাকে এখানে সেখানে।তারপর বারুদ ফুরিয়ে গেলে পোড়া একটা কাগজের বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়! বললাম- বড়বাবু, পদাধিকার বলে আপনি বড় বলে কিছু বলছিনা! আপাতত এটুকুই আপনার প্রতি আমার বক্তব্য। এই বলে চলে এসেছিলাম আমার কাজের টেবিলে।
নারী পুরুষের সমান অধিকারের প্রশ্ন সংসদ ভবনের ভিত কাঁপিয়ে দিলেও আজও সীমানা প্রহরারত মেয়েটি আসলে মেয়েই। এইসব ভাবনাগুলো আজকাল আমাকে খুউব ভাবায়। এই যে সমর, আমার স্বামী। তার চাকরি সুত্রে সে বর্ধমানে। আমাদের, ছেলে মানুষ হচ্ছে আমার মা'র কাছে হুগলির শ্রীরামপুরে। আর আমি এই শুশুনিয়ায়। কিন্তু তবুও তো একটা বাঁধন এই যে, দিনের শেষে আমরা তো তিনজন! মানে একটি পরিবার!
আজ বিকেলে পাহাড়ে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো। নীচে নামার সময় আমি ও রুশদি প্রায় একটা ছাতার নীচে অর্ধেক ভেজা অবস্থায় কোয়ার্টারে ফিরলাম। পাশাপাশি হাঁটার জন্য ছাতা ধরা আমার হাতটা ওর বাঁ শরীরে ঠেকছিলো। বললাম তোমার কি জ্বর এসেছে নাকি? রুশদি ম্রিয়মাণ একটা হাসি হেঁসে বললো- কই, নাতো! আমার শরীরের নর্মাল টেম্পারেচার একশোর কাছাকাছি,আর এটা সবসময়ই একই থাকে। কোয়ার্টারে পৌঁছে যাওয়ায় আর কথা বাড়াইনি আমি।
পাহাড়ে সন্ধ্যা নেমে আসে তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যার একটু পরে মোরগের একটা প্রিপারেশন করে হাতে নিয়ে ওর দরজায় টোকা দিলাম।
এরপরেরটা প্রায় অবিশ্বাস্য! দরজাটা ভেতর থেকে আবঝানো থাকাতে আমার বাঁ হাতের স্পর্শেই দরজা খুলে গেলো। দেখলাম, রুশদি প্রায় অন্ধকার ঘরের মেঝেতে একটা আসন পেতে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। যেন ধ্যানমগ্ন এক যোগীনী! চিনতে ভুল করিনি একদম! ওর সামনে যে উপাস্য দেবতা, তিনি আর কেউ নন! উনি ভগবান বুদ্ধ। হালকা সুরে স্টিরিও থেকে ভেসে আসছে-- বুদ্ধং স্মরণং গচ্ছামি..
এপর্যন্ত হলে তো ঠিকই ছিলো! কিন্তু এরপর?
বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে, পরেশবাবু মারফৎ এ খবর হেড অফিসে চলে যেতে বাধ্য হলো।
পরেশবাবুকে না বলে এছাড়া আমার উপায়ই বা কি ছিলো? ওই যে সেদিন,যেদিন আমি ওর কোয়ার্টারে গিয়ে ওকে ধ্যানমগ্ন দেখলাম, আর তারপরই ও যখন চোখ খুললো, দেখলাম- এক অপ্রকৃতিস্থ রুশদি সেনকে।
চোখের ঘোলাটে মণির দৃষ্টি, বারবার ছুটে যাচ্ছে একটা মাত্র পাকুড় গাছ সম্বলিত ন্যাড়া পাহাড়টা'র দিকে। আর ওর মুখে তখন ক্রমাগত একই কথা! বলেই চলেছে -- " প্লিজ, আপনারা যতখুশি ম্যাঙ্গানিজ তুলুন, কিন্তু ওই গাছটিকে বাঁচিয়ে! গাছে আটকে আছে আমার সন্তান! ও আমার দেশ! আমার প্রাণভোমরা! ম্যাঙ্গানিজ তুলতে গিয়ে পাহাড়ের মাটি সরে গেলেই খাঁদে পরে যাবে গাছটা! তারপর ঈশ!! আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিনা। " আর এভাবেই কয়েকটা দিন কিভাবে যে কেটে গেলো, তা আমার মত আর ক'জন জানে?
এরপরেরটা খুবই পীড়াদায়ক! আমরা অনেক চেষ্টা করেও ওর বাড়ির লোকেদের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। কেননা এই সময়ের মেয়ে হয়েও রুশদি কোনো মোবাইল ব্যবহার করতো না। ফলতঃ, কোনো আত্মীয় বা স্বজনের সাথে যোগাযোগ করা কার্যত অসম্ভবই হয়ে গেলো। নর্থ বেঙ্গলে ওর প্রথম জয়েনিং হিলি অফিস থেকেও সেভাবে কেউ বলতেই পারলো না যে, ওর আদৌ কোনো আত্মীয় বা পরিচিত আছে কি না! এ অবস্থায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ইউনিয়নের সেক্রেটারি উমিরচাঁদ জৈনের তৎপরতায় পাহাড়তলিরই একজন সাইক্রিয়া- মেডিসিনকে দেখানোর ব্যাবস্থা হলো অফিস থেকেই। সেদিন সঙ্গে আমিও ছিলাম। সব শুনে ডাক্তারবাবু বললেন, রোগটা সাইকোজনিক ডিসঅর্ডার। আমি বললাম, "ডাক্তারবাবু, মেয়েটি অসম্ভব ইনটেলিজেন্ট আর নম্র ও শান্ত স্বভাবের! সঙ্গে প্রচুর পড়াশোনা করে ও!" আমাকে এরপর থামিয়ে দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, "এইসব মানুষই এই রোগের শিকার বেশি হয়। কারণ অত্যধিক পড়াশোনা তৈরি করে গভীর ভাবনা, আর সাথে বাসনা বা ইচ্ছে। যা মস্তিষ্কের কোষগুলোর ওপর বাসা বাঁধতে গিয়ে জায়গা না পেয়ে একে অপরের ওপর লেপ্টে যায়। ফলে এক গোলোকধাঁধায় পরে গিয়ে শুভবুদ্ধির ওপর একটি কঠিন জট -এর সৃষ্টি হয়। আর এটাই হয়েছে ওনার ক্ষেত্রে।" উপায়? আমি বললাম। ডাক্তারবাবুর কথায়- ক্লিনিক্যাল থেরাপির মাধ্যমে যেতে হবে। অতএব কোলকাতা ছাড়া কোনো উপায়ই নেই।
গতকাল এই নিয়ে টিফিন আওয়ার্সের মিটিঙে ঠিকাদারি সংস্থার সেক্রেটারি ভদ্রলোক, ওই উমিরচাঁদ জৈন চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রুশদি সেনকে নিয়ে কোলকাতার পথে রওনা দেবেন, এমনটাই ঠিক হয়ে গেলো। সঙ্গে আমাদের অফিসের গ্রুপ ডি স্টাফ কমলি হেমব্রোম একজন মহিলা হিসেবে যাবে।
ঘটনার আকস্মিকতায় গত কয়েকদিন ধরেই অফিসের কাজকর্ম প্রায়ই শিকায় ওঠার জোগাড়!
তবে শেষ মুহূর্তটুকু ভীষণ মর্মস্পর্শী! একটা কালো রঙের টয়োটা গাড়িতে যখন রুশদিকে জোর করে তোলা হচ্ছে, তখন ওর একহাত দূরে ন্যাড়া পাহাড়ের বাঁকের দিকে নির্দেশের ভঙ্গিতে। আর ক্রমাগতই বলে চলেছে- প্লিজ, আপনারা আর এক কদমও এগোবেন না গাছটার দিকে। ওই গাছে আটকে আছে যুদ্ধের দামামা! ওগুলো আমাদের দেশের মাটি দিয়ে তৈরি। গাছে অনেক পাখিদের বাসা আছে স্যার! নীচে গভীর অন্ধকার! অত উঁচু থেকে মাটি খসা শিকড়সমেত গাছ পরে গেলে যুদ্ধের দামামা, শান্তিপ্রিয় পাখি, এরা সব অন্ধকার খাঁদে পরে যাবে। মৃত্যু হবে তৎক্ষনাৎ! বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলোরও!!
গাড়িটা রুশদিকে নিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে পাকদণ্ডি পথ বেয়ে পাহাড়তলির বাঁকে মিলিয়ে গেলো। সন্ধ্যার পাহাড়ে দূরের-কাছের আলোর মালা! যেন পাহাড় এই একবিংশেও একজন রানি এলিজাবেথ হয়ে উঠেছে। ভুলতে চেষ্টা করছি রুশদি সেনের শেষ সংলাপ- " প্লিজ, আর এক কদমও এগোবার চেষ্টা করবেননা ওই গাছটার দিকে, ওই গা....ছে আট....কে আছে যুদ্ধে..... দা....মামা.."
আমাকেও যেন অ্যটাক না করে কোনো সাইকোজনিক ডিসঅর্ডার! এই মুহূর্তে তাই আমি আমার ছেলে তিতিরের দু' বছর বয়সের দুধসাদা হাঁসি হাঁসি মুখটিকে মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ওভেনে 'চা'এর জন্য ফুটন্ত জলে বাষ্পীভূত হয়ে যাচ্ছে একটি অল্পবয়সী নাম না জানা বিদুষী ফুলের মুখ ।।
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস
ওয়েস্ট বেঙ্গল, ইন্ডিয়া।
-
গল্প//উপন্যাস
-
02-03-2019
-
-