অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা – বন্যা হোসেন

রায়না আর আশিকের বিয়ে হয়েছে পনের দিন হলো। নেপালে গিয়েছিল দুজন হানিমুনে। এরপর থেকেই চলছে  দাওয়াতের  ধুম আত্মীয়স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবের বাড়ীতে। বিভিন্ন দাওয়াতে সবার সাথে বারবার দেখা হচ্ছে। আশিক আছে মহাফুর্তিতে। হাসি,  ঠাট্টা, রসিকতায় সে তুখোড়, সব আড্ডার মধ্যমণি। 

দুটো সপ্তাহে তার জীবনটাই বদলে গেছে। চারদিকে শুধু আনন্দ আর খুশীর বন্যা। বউটা দেখতেও হয়েছে দারুণ মিষ্টি  আর সবচেয়ে বড় গুণ সবার সংগে মিশে যাওয়ার  সহজাত প্রবণতা। আশিক  চোখ বন্ধ করলেই ওর সামনে ভেসে ওঠে রায়নার টানা টানা বড় বড় চোখ দুটো। অতল গভীর ঐ চোখ দেখে ভালোবাসার মাদকতায় হারিয়ে  যায়  আশিক। প্রেম সে করেনি কখনো, দুএকজনকে ভালো লেগেছিল।  হৃদয় বিনিময়ের ব্যাপারটা ঠিকঠাক বোঝে না বলেই ওপথে এগোয়নি। রায়নাকে পছন্দ করেছে বাবা-মা। একটা ব্যাপারেই আশিক উদ্বিগ্ন ছিল…… মেয়েটা মানিয়ে নিতে পারবে তো বাবা মায়ের সাথে। ওর বড় বোন অজন্তা  বরের সাথে চাটগাতে থাকে। ঝুট-ঝামেলা কমই তাদের সংসারে।  আজকাল অনেক বন্ধুরাই বাবা-মায়ের সাথে থাকছে না, মতের অমিল হচ্ছে, অশান্তি এড়াতে আলাদা সংসার করছে। আশিক কিছুতেই ওপথে যেতে চায় না।  সুখের কথা , বাবা-মায়ের সংগেও বেশ ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছে রায়না। মা-কে কিচেনে টুকটাক  সাহায্য করে  বাবার সংগে বসে টিভিতে টক শো আর খেলা দেখে।  

আজ মামার বাড়ীতে  দাওয়াত ছিল দুপুরে। ফিরে এসে নিজের বেডরুমে  বিছানায় আধশোয়া  হয়ে দেয়ালে লাগানো টিভিটা ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ পর বাবাও এসে ঢোকে  ওর ঘরে। আশিক তখন নেটফ্লিক্স থেকে বহুবারের দেখা টিভি শো ফ্রেন্ডস দেখছিল। র‍্যাচেল আর মনিকার কান্ড দেখে হাসতে হাসতে দমফাটা অবস্থা।  বাবা কিছুক্ষণ উস্খুস করেই বলে উঠলো,
-কিভাবে যে ভালো লাগে তোদের  এরকম সুড়সুড়ি হাসি দেয়া শো।  আমার তো হাসি পায় না। তোদের নিয়ে হয়েছে মুশকিল, শুধু হালকা আনন্দ চাস তোরা। জীবনটা তো এত হালকা নয়।  বিয়ে করেছিস, ধীরে ধীরে বুঝবি!!!

আশিক উত্তর দেয়ার আগেই  মোবাইলটা বেজে উঠলো। মামাতো ভাই মামুনের কল।
-কি রে, সব খবর ভালো তো??  আশিক জানতে চায় 
-হ্যাঁ, ভালোই তো ছিল সব কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত। ওপ্রান্তে মামুন উত্তর দেয়। 
-কেন, কি হয়েছে? আশিকের গলায় উদ্বেগ।

বাবা ভুরু কুঁচকে  তাকিয়েছে।
-তেমন সিরিয়াস কিছু না, তবে রিঙ্কি একেবারে চিৎকার করে বাড়ী মাথায় উঠিয়ে রেখেছে। ওর পায়েল জোড়া পাওায়া যাচ্ছে না।  মা  গড়িয়ে দিয়েছিল  রিঙ্কির খুব পছন্দ বলে। পরেই থাকে সবসময়। আজ তোদের উপলক্ষে  এত  লোক …...ছোট বাচ্চা খেলা করতে গিয়ে খুলে পড়ে গেছে নিশ্চয়ই। 
মা-বাবা, রিঙ্কি আর ওর মা মিলে পুরো বাড়ী এমন তল্লাশী চালাচ্ছে  পুলিশও ওদের কাছে  হার মানবে।  আমার দরকারী কাগজপত্র পর্যন্ত ঘেঁটে দেখে গেল ……

আশিক সব শুনে হাসতে হাসতে বলে,
-ওদের সবাইকে পুলিশের ডগ স্কোয়াডে চাকরী নিতে বল!!! 
-পারবে রে পারবে …… আমার বউয়ের ওখানে চাকরী হবে নির্দ্বিধায়। আমি কয়েকবার বলেছিও ওকে মাস্টারীগিরি  ছেড়ে  পুলিশের চাকরী নিতে। একটা কিছু এদিক ওদিক হবার উপায় আছে??  বাপ-মা খুঁজে খুঁজে এক মহিলা পুলিশ বউ নিয়ে আসলো …... আমার মুখের দিকে তাকালেই  আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি এই ভেবে যে , আবার কি ভুলচুক করলাম!!! 
আশিক হো হো করে হেসে দিল। 
-হা হা হা, ভাইয়া তুই একটু বাড়িয়ে বলছিস … নুপুর ভাবী মোটেও  এমন না!! 

বাবার দিকে আড়চোখে  তাকিয়ে দেখে  টিভিতে টক শো  দেখছে। একটু চাপাস্বরে বলে মামুনকে, 
-আমার বউটা  হেব্বি  হয়েছেরে মামুন ভাইয়া। এত কিউট…...আমি তো ভয়েই ছিলাম এরেঞ্জড ...কিভাবে  এডজাস্ট  করবো। রায়না খুব সুন্দর মিশে গেছে সবার সাথে। তোদেরকে তো  ওর খুব ভালো লেগেছে। বাড়ী ফেরার সময় বলছিল এত ভালো শ্বশুরবাড়ী  ও আশাই করেনি ।
অট্টহাসি দিয়ে উঠলো মামুন। হাসি থামিয়ে বলে,
-রোসো বাছাধন, মাত্র পনের দিন গেছে, পনের মাস পরে এই কথাগুলো  মনে করিয়ে দিবো।  আবারও জোরে হেসে উঠলো। 

আশিক একটু লজ্জা পায়। রায়নার প্রেমে পড়েছে গভীরভাবে তা সে নিজেই বুঝতে পারছে। ইশ, কিভাবে যে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল কথাগুলো।  এখন বিটকেলে কাজিনের গুষ্টি  মাসের পর মাস এক টপিক নিয়েই ক্ষেপাবে তাকে। কিছুদিন আত্মীয়বাড়ি আর দাওয়াত নেয়া যাবে না। 

আশিকের মা দীপা এসে ডাকলেন স্বামীকে। বাবা বড় অনিচ্ছায় উঠে গেলেন। মা বাবাকে বলছে চাপা স্বরে, আশিক ঘরে বসেই শুনতে পেলো,
-তোমার কি কোন আক্কেল জ্ঞান আছে, বসার ঘরে টিভি দেখতে পারো না … ছেলের বিয়ে হয়েছে ...ওদের প্রাইভেসী বলে তো একটা ব্যাপার আছে। 
বাবা আমতা আমতা করে বলে,
-কেন, এখনও তো শোয়ার সময় হয়নি!! 
-উফ এই লোকটার  বুড়া বয়সে ভীমরতি  ধরেছে। শোয়ার সময়  ছাড়া কি মানুষের আর প্রাইভেসীর দরকার নেই!!! যাও তো ওঘরে!!!
আশিক সব শুনে  ঘরে বসে হাসে। আহা, এমন মা বাংলার ঘরে ঘরে নেই কেন  মাবুদ!!

কিছুক্ষণ পর রায়না ঘরে এসে ওয়ার্ডোব খুলে কি যেন খুজতে  থাকে। আশিক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে দ্যাখে। রায়না ওর দিকে একেবারেই তাকাচ্ছে না। আর সহ্য হল না!! বিছানা  থেকে লাফ দিয়ে উঠে  গিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে নেয় রায়নাকে।  মেয়েটা চমকে ওঠে। আশিক ওর চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়।  চুলের ভেতর  নিজের নাক ডুবিয়ে  দিয়ে হাস্নাহেনার গন্ধ পায়। জোরে শ্বাস টেনে বলে,
- কি ব্যাপার? আমাকে এভয়েড করছো কেন??? ঘরে এসে অপেক্ষা করছি এতক্ষণ ধরে তুমি আসছো না কেন??
এই বলে বুকে আরও ঘন করে চেপে ধরে বউকে। রায়নার বুকে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। মাথা নামিয়ে ডান হাতের তর্জনী আলতো করে ছোঁয়ায় রায়নার চিবুকে।  মৃদু স্বরে বলে,
-রায়না, হঠাৎ চমকে গেলে কেন?? তোমার বুকে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে।   
 রায়না ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বেশ স্বাভাবিক গলায় বলে, 
-নাহ, চমকাইনি তো! তোমার সব উল্টোপালটা কথা। শোবে না ...কাল  সকালে অফিস আছে তোমার।   রায়নার ঠোঁটে মৃদু হাসি  ফুটে ওঠার আগেই যেন মিলিয়ে গেলো। কারণ সে জানে ওর কাছ থেকে সামান্য প্রশ্রয় পেলেই কী পাগলামী শুরু করে আশিক। আশিক কি আর সুযোগ ছাড়ে, 
-আমি তো তোমার অপেক্ষাই করছি ডার্লিং … এত সুন্দর কথাটা শোনার জন্য …...রায়নাকে পাজাকোলা করে তুলে নেয় সেকেন্ডের মধ্যে। আশিকের বুকে কিল দিতে দিতে রায়না বলে, অসভ্য, ফাজিল কোথাকার!! 

আশিকের মাঝে মাঝে মনে হয় রায়না তার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। নিজের ভাগ্যকে নিজেরই বিশ্বাস হয় না। নিজেকে আরব্য রজনীর বাদশা ভাবতে ইচ্ছে হয়। আদর, সোহাগ আর গল্পে গল্পে কিভাবে যে রাতগুলো কেটে যায়  আশিক টের পায় না। রায়না এত সুন্দর  করে গল্প করতে পারে ...ওর মধ্যে কোন জড়তা নেই। কবে কোন ছেলে ওকে দেখে রোমিও হয়েছিল, পাড়ার কোন মাস্তান ওকে চিঠি দিয়েছিল, খালাতো বোনের বিয়েতে বর পক্ষের কোন ছেলে ওর কোমরে হাত দিয়েছিল যাকে ওর শাহরুখ খান মনে হয়েছিল  … সব অবলীলায় হাসতে হাসতে বলে যায়। আশিক বোঝে ওর মন খুব পরিস্কার। রায়নার তুলনায় আশিকের জীবনটা খুব ম্যাড়ম্যাড়ে, বোরিং, ঘটনাশুন্য!!! 

দিন পনেরো পরে আশিকের সব বন্ধু আর তাদের বউদের নিমন্ত্রণ করা হল ওদের বাড়ীতে।  উপলক্ষ্য রায়না সবাইকে রেঁধে খাওয়াবে। রায়না নতুন নতুন রান্না শিখেছে, তার খুব শখ লোক ডেকে খাওয়ায়। আশিককে আর পায় কে!! সে মহাখুশী। এ তো মেঘ না চাইতেই জল। মা-কে অনেক বলে কয়েও যা করা যায়নি বউ এসে দুদিনের মধ্যেই তা করে  দিলো। তাছাড়া, বন্ধুদের বাড়ীতে এত খেয়েছে ওদেরকে একবার বাড়ীতে ডেকে না খাওয়ালে একেবারে প্রেস্টীজের  বারোটা বেজে যাচ্ছিল। কাচ্চি বিরিয়ানী এত ভালো রেঁধেছে  রায়না। সবাই চেটেপুটে খেলো। প্রশংসায় পঞ্চমুখ বন্ধুরা। গর্বে আশিকের বুকের  ছাতি ফুলে দ্বিগুণ হয়ে যায়। 

আশিক  বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর মাঝরাতের দিকে ঘরে  ঢোকে। বেশ অগোছালো হয়ে আছে বিছানা।  মেয়েরা ডিনারের পর সব এখানে বসে আড্ডা দিয়েছে।  একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে  ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই  মোবাইলে তাপসের ফোন এলো। আশিক ফোন তুলেই বলে,
-কিরে, পৌঁছে গেছিস তোরা?? 
-হ্যাঁ রে। আচ্ছা, দ্যাখ তো, মণিকার হাতের চুরিটা আছে  কি না তোদের বেডসাইড টেবিলে? ও নাকি খুলে রেখেছিল। আনতে ভুলে গেছে।
আশিক  ওদিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেলো না  বেডসাইড টেবিলে। 
-না রে, কিছু তো নেই ওখানে। রায়না হয়তো জানে, কোথাও সরিয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই। খুব দামী কিছু নাকি?
-আর বলিসনা, উনি আবার তার অস্ট্রেলিয়ার মামার দেয়া ব্রেসলেট না, মান্তাশা, ফান্তাশা কি বলে … সেটাই পড়েছিল! ওটা  তার খুব পছন্দের ...দাম সম্পর্কে আইডিয়া নেই। তুই একটু দেখে জানাবি কিন্তু। এখন রাখছি, গুডনাইট।

রায়না ঘরে ঢুকতেই  আশিক জানতে চাইলো  মণিকার ব্রেসলেটের কথা। সে অবাক হয়ে বলে।
-আমি তো দেখিনি এমন কিছু, আর খুলে রাখবেই বা কেন!! লোকের বাড়ী বেড়াতে গিয়ে গয়না কেউ খোলে নাকি? আশিক একটু ভেবে বলে,
-জানিনা, কেন খুলেছিলো!  চল  তো, দুজনে মিলে একটু খুঁজে দেখি। মণিকার নয়তো আজ ঘুমই হবে না।  দুজনে উঠে পুরো ঘর, ফ্ল্যাট খুঁজে দেখলো। কোথাও নেই। আশিকের বেশ  খারাপ লাগছে। বন্ধুকে ফোন করে আরও ভালো করে কাল খুঁজবে  এই প্রতিশ্রুতি দিলো। 

অনেক খোঁজার পরও যখন পাওয়া গেলো না, তাপস চিন্তিত মুখে বললো,
-রাস্তাতেই খুলে পড়ে গেছে মনে হয়। যাক, এখন আমার ঠ্যালা সামলাতে  হবে আর কি!! ঐরকম জিনিষ বানিয়ে না দিলে ঘরের শান্তি বোধহয় গেলো। মামাশ্বশুরের দেয়া গিফট বলে কথা!!!

আরও কিছু হাসাহাসি করে ফোন রেখে  দিল আশিক। রায়না  সব শুনে  মন্তব্য করে বসলো,
-দ্যাখো, মনিকাদিকে আমার কেমন জানি লেগেছে!! উনি নিজেই লুকিয়ে রেখে এসব বলছে যাতে তাপসদার কাছ থেকে আরও গয়না পাওয়া যায়। 

রায়নার এই মন্তব্য শুনে আশিক তো একেবারে তাজ্জব! বলে কি মেয়েটা! এরকমও হয় না কি!  কিন্তু মনিকাকে অনেক আগে থেকে চেনে বলে মেনে নিতে পারলো না।  তাপস আর মনিকা ক্লাসমেট ছিল। ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করেছে। তারপর থেকে দুজনেই অনেক কষ্ট করে ছাত্র পড়িয়ে পড়াশুনা শেষ করে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। মনিকার সম্পর্কে এধরনের উক্তি একেবারেই মূর্খতার পরিচয়। কিন্তু মুখে কিছু বললো না।  আশিকের  মনে এই প্রথম খটকা লাগলো রায়না সম্পর্কে। না জেনে শুনে কারো সম্পর্কে খারাপ কথা বলা খুব অন্যায়। হাজার হোক, নতুন বউ বলে ফেলেছে  বিরক্ত  হয়ে -- এই ভেবে ক্ষমা করে দিলো মন থেকে।  

কিছুদিন পর রায়না বাপের বাড়ী গেছে। আশিক অফিস থেকে ফেরার পর  বাবা-মা ওর রুমে বসে একসংগে  টিভি  দেখছিলেন। আশিকের মন ভার। বউটা না থাকলে আজকাল বাড়ীটা এত ফাঁকা লাগে। দুদিন থাকবে ওখানে। ওকেও যেতে বলেছে। কিন্তু রায়নাদের বাসা থেকে অফিস অনেক দূর হয়ে যায় বলে যায়নি আশিক।  

মা-কে বেশ গম্ভীর লাগছে  আশিকের। শরীর  খারাপ না তো!!  জিজ্ঞেস করলো, 
-মা, তোমার প্রেশারটা ঠিক আছে তো?? আজকে চেক করেছো?? 
-আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তোর সাথে রায়নাকে নিয়ে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম। 
-কি কথা মা??  কি হয়েছে?? 
-আমরা আসলে রফিক ভাইয়ের পরিচিত পরিবার দেখে তেমন খোঁজ নেইনি মেয়েটা সম্পর্কে, আরও খোঁজ নেয়া দরকার ছিল।
- কেন এসব বলছো, মা??  রায়নার সাথে কোন ঝামেলা হয়েছে কিচেনে? আশিকের গলায় বিদ্রুপের আভাস।
-কিচেনে ঝামেলা না, ব্যাপারটা কি করে বলি … মেয়েটার যেন কেমন অদ্ভুত স্বভাব! সেদিন তোর মামী যে পারফিউম পাঠিয়েছিলো লন্ডন থেকে ওটা আমার ঘর থেকে উধাও! কি মনে হতে তোদের ঘরে গিয়ে দেখি বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছে। আমাকে বললে আমি তো ওকে দিয়েই দিতাম। কিছু বলিনি …… অল্পবয়স …… এটাই তো শুধু না ...তোর বাবার শখের স্ট্যাম্পের এলবাম নিজের ওয়ার্ডোবের  কাপড়ের ভিতর এনে ঢুকিয়ে রেখেছে। এমন অনেক জিনিষই উধাও হয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। ভালো ঘরের মেয়ে, শিক্ষিত অবস্থাপন্ন পরিবার। বুঝি না, এমন স্বভাব কেন? ওদের তো কোন অভাব নেই, তাহলে? 
আশিকের মনে হলো, মা-কি সত্যি কথা বলছে!! 
মা, বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,  তোমারও তো কেমন যেন মনে হয়েছে  ...তাইতো বলছিলে সেদিন। 
বাবাদের এক্ষেত্রে গভীর জলের মাছ হতে হয়।  আশিকের বাবাও ধরি মাছ  না ছুঁই পানি টাইপের একটা উত্তর তৈরী  রেখেছিলো। বললো,
-কোন সমস্যা থাকলে ওর সাথে খোলামেলা কথা বলা যায়। 
একথা শুনে মা একেবারে ফেটে পড়লো রাগে। 
-কে ওকে বলবে কেন তুমি চুরি করছো? তুমি? তোমাকে বারবার বলেছিলাম একটু ভাল করে খোঁজ নাও। না, তোমার বন্ধুর আনা প্রস্তাব! তাই তো নাচতে নাচতে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করিয়ে আনলে! এখন আশিককে ভুগতে হবে!!  

হঠাৎ করেই মা-কে কেন যেন খুব দূর গ্রহের প্রাণী মনে হলো আশিকের। কেমন করে মা রায়না সম্পর্কে এত বাজে কথা বলতে পারলো। যে রায়না ভালোবাসায়, শরীরের উত্তাপে, আদরে, সোহাগে জীবন ভরিয়ে দিয়েছে  তার সম্পর্কে এমন কথা!! একেবারেই ডিসগাস্টিং! বউ -শাশুড়ী সম্পর্কটাই যাচ্ছেতাই। ধুরছাই! মা এমন করলে একসাথে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাবে!!  
বাবা-মা বেরিয়ে গেলেন  একটু গোমড়ামুখে। আশিকের নির্বিকারভাব দেখে তারা বেশ জোরালো ধাক্কা খেয়েছেন। ওর মুখ দেখে মনে হলো একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। 

আশিকের মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে। বউকে ফোন করলো। বউ মেসেঞ্জারে ভিডিও কল দিতে বললো। রায়নাকে দেখেই স্ক্রিনের দিকে চুমু  ছুঁড়ে দিলো আশিক। ভাবলো, এতো নিষ্পাপ চেহারা! মা যেকি সব বলে!!  আহ্লাদীপনা করে  রায়না দুহাত তুলে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দিচ্ছে স্বামীকে। 
হঠাৎ আশিকের চোখে পড়লো, রায়নার ডান হাতে …… নতুন ধরনের একটা গয়না, ঠিক চুড়ি না...ব্রেসলেট হতে পারে!!   
রায়নার সাথে কথা শেষ করে ওকে গুডনাইট দিয়ে ভাবতে বসলো। কেন যেন মনের ভেতরে কুড়কুড় সন্দেহের দানা বেঁধে  উঠলো। মনিকার ব্রেসলেটটা দেখতে কেমন ছিল, কাকে জিজ্ঞেস করা যায়?? 
ইউরেকা! ডিজিটাল যুগে এত ভাবার দরকার আছে? সেদিনের তোলা ছবিগুলো দেখলেই তো হয়! 

বেচারা আশিক! ছবি দেখে যখন রায়নার হাতের গয়নার সাথে মিলে গেলো। মনটা দুঃখে ভারাক্রান্ত হলো। রায়না কেন মিথ্যে বললো, সেটাই  বুঝতে পারছে না। ফেরত না দিয়ে জিনিষটা ব্যবহার করছে। অদ্ভুত, পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত!! দুই বাড়ী মিলিয়ে কম গয়না নয় রায়নার!  তাহলে? এই রহস্যের সমাধান কী?? ঐ বিশেষ গয়নাটা ওর ভালো লেগেছে, বললেই তো পারতো ---- আশিক কিনে দিতো, সে সামর্থ্য ওর আছে!!  
অনেক উল্টোপাল্টা চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো আশিক। রায়নাকে নিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নও দেখলো।  সকালে উঠেই ঠিক করলো, আজ অফিস থেকে ফেরার সময় রায়নাকে নিয়ে আসবে। ওকে ছাড়া ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছে। কাল রাতের সন্দেহের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। অফিসের একটা জরুরী কাগজ খুঁজতে গিয়ে পুরো ঘর লন্ডভন্ড করে ফেললো আশিক। বউটা থাকলে কি সুন্দর গুছিয়ে রাখে সব… হাতের কাছে সব মিলে যায়। ওয়াল ক্যাবিনেটে বুক শেলফের পাশের  ড্রয়ারটা খুলে দেখলো। ওখানে নেই দেখে যে-ই বন্ধ করতে যাবে, কি যেন চকচক করে উঠলো। টিসু পেপারে মোড়ানো  হাতে নিয়ে দেখলো সোনালী ঝকঝকে ছোট্ট এক জোড়া পায়েল!!  
আশিকের হাত কাঁপছে। এ কি সত্যি দেখছে!! মা-বাবার সন্দেহ তাহলে অমূলক নয়। কাল রাতের ভাবনাটা আবার ফিরে এলো। রায়না এসব কেন করে??  চিন্তাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে। আশিক ভাবছে, ভালো করে তল্লাশী করলে না জানি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে আসে।  এখন এ পায়েল ফেরতই বা দেবে কিভাবে মামুন ভাইয়াদের ?? 
অফিসের কাজের মাঝেও  বারবার মনে পড়ছিলো সকালের ঘটনাটা। কি ভেবে ইন্টারনেটে গুগলে সার্চ  দিলো ...লিখলো, স্টিলিং ফর ফান। গুগলে  সংগে চলে এলো ক্লেপ্টমোনিয়া  নামে একটি শব্দ। বলা হয়েছে, কিছু মানুষ আছে  যারা না বলে অন্যের  জিনিষ নিতে পছন্দ করে … এটি মনের রোগ। তারা নিজেদের প্রয়োজন বা প্রাপ্তির জন্য চুরি করে না। তারা অনেক চেষ্টা করেও  নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।  অনেকে আবার নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জে রাখতে পছন্দ করে বা অন্যের সাথে  চাতুরী করে আনন্দ পায়। এর সমাধান  হলো মনোরোগ  বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে  এন্টি ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করা। এই রোগ  সম্পূর্ণভাবে না-ও সারতে পারে মনোবিদের কাছে গিয়ে কাউন্সেলিং করলে  অবস্থার উন্নতি হতে পারে।  

তাহলে কি রায়না ক্লেপ্টোমেনিয়ার শিকার?? ও অসুস্থ ?? ওর বাবা -মা নিশ্চয়ই জানে, ভাবে আশিক। ওদের সাথে কথা বলা দরকার। কিন্ত এখন তো রায়না আছে ওখানে। আচমকাই বুদ্ধিটা এলো মাথায়। রায়নাকে ফোন করে বলে, বাবা-মায়ের বিয়ে-বার্ষিকী আসছে দুদিন পর ...রায়না যেন ওদের উপহারটা আজই কিনে রাখে। রায়না বেশ খুশী মনেই মেনে নিলো। এক ঘন্টা পর  আশিক ফোন করলো শ্বশুরবাড়িতে ।  তাদের  সাথে কথা বলে আশিক  হতবাক, নিস্তব্ধ হয়ে যায়।  ওরা  বললেন, 
-রায়নার এ স্বভাব ছোটবেলাতে যখন ও স্কুলে পড়ে তখনই ধরা পড়ে। কতবার কত অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হয়েছে, তা বলার নয়। একবার তো এক দোকান থেকে কি এক সামান্য কস্মেটিক্স সরাতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলো। দোকানদার তো পুলিশের হাতে সোপর্দ করতে চেয়েছিল। রায়নার বাবা দুঃখ করে  প্রায় ক্রন্দনরত ধরা গলায়  বলেন, 
-বাবা আমাদের কিছুর কমতি নেই। তারপরেও মেয়েটা এমন যে কেন করে! ওর কোন ভাই-বোন নেই। ওর মা আর আমি দুজনেই  কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ওর শৈশবের সময়টা  আয়া -বুয়াদের সাথেই কেটেছে। আমরা বুঝতে পারিনি ওর মনের মধ্যে অস্থির, অস্বচ্ছ ভাবনার তৈরী হয়েছে। একবার স্কুলে  এক সহপাঠীর  চার মাসের বেতনের টাকা চুরি করেছিল। সবার স্কুল ব্যাগ তল্লাশী করতে গিয়ে রায়না ধরা পড়ে। ঐ স্কুল থেকে ওকে বের করে দেয়। 

আশিকের মন বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। ইচ্ছে করছে না আজ রায়নার বাসায় যেতে। গুগলে লিখেছে, এই অসুখ চারপাশের মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে ফেলে। সে ভাবে, তার মানে এই দেড় মাসের সবকিছু মিথ্যে। এই যে সারারাত গায়ের সাথে লেপ্টে থেকে একটার পর একটা গল্প করে যেতো নিজের জীবনের, সেগুলো কি তাহলে? একবারও তো রায়না তার এ স্বভাবটার কথা বলেনি। 

মেয়েটা ঠকিয়েছে , পুরো ধোঁকা দিয়েছে। তার শরীরের  উষ্ণতা দিয়ে যে  মায়াজালে বেঁধেছিল সেটাও মিথ্যে??  অস্থির চিত্তে ভাবতে থাকে আশিক। নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে। বিভ্রান্তি কাজ করছে মনের ভেতরে। প্রচন্ড  ক্ষুধার্ত ছিল। লাঞ্চে কিছুই খেতে পারলো না। বাবা-মায়ের  মুখ দুটো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। কি সিদ্ধান্ত নিবে?  একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন  মানুষের এ পরিস্থিতিতে  কি সুষ্ঠ  বিবেচনাবোধ কাজ করে?  বাবা মাকে বলে কি কোন লাভ হবে? রায়নাকে ডিভোর্স দিবে?  ভাবতেই বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো !!  অপরূপ  মায়াবতী  মেয়েটা যে কি মায়ার বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে  আশিকের  হৃদয়ের প্রকোষ্ঠ। 

রায়নাকে মেসেজ করে দেয়া যাক, আজ আর যাওয়া হবে না ওকে আনতে। অনেক কাজ। কাজের মধ্যেই ডুবে  ছিল বেশ কয়েক ঘন্টা। সন্ধ্যের দিকে  রায়নার কল এলো।  কয়েকবার বেজে গেলো। আশিক ইচ্ছে করেই ধরেনি। ঘন্টাখানেক পর আবার  কল এলো রায়নার। আশিক হ্যালো বলতেই  বললো, 
-তুমি সব জেনে গেছো  তাই না,  তা-ই আমাকে এভয়েড করছো??  উৎকণ্ঠা মিশ্রিত গলায় বলে রায়না।  আশিক একটু চুপ করে  থেকে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব ধীরে ধীরে বলে,
-আমার কি করা উচিৎ বল?   
-বাবা মা আমাকে বলেছে …...তোমার সাথে কথা হয়েছে। কান্নাভেজা গলা  রায়নার। 
-বিশ্বাস কর আমি অনেক চেষ্টা  করি সামলে চলতে, অনেক সময় পারি না। বিয়ের আগে বাবা- মা আমাকে অনেক সাবধান করেছে …...শ্বশুরবাড়ী  গিয়ে এসব করলে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দেবে। বিশ্বাস কর, আমি অনেক চেষ্টা করেছি … আমি নিজেও জানি না কিভাবে এসব হয়ে যায়। 
রায়না হঠাৎ  চুপ হয়ে যায়।  বলে, শুনছো তুমি??
-শুনছি, বল।  নির্লিপ্তি আশিকের কন্ঠে।
-উম… আমার এ  স্বভাবের জন্য কেউ মিশতে চায় না। আমার কোন বন্ধু হয় না। সবাই নিজের ব্যাগ সামলে রাখে আমার সংগে দেখা হলেই। অনেক সময় হতাশা, বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে  আমি এসব করি।
-কিন্তু তুমি বিয়ের পর যে কাজগুলি করেছো ...তখন তো বিষন্নতা ছিল না… তুমি কি  আমাকে নিয়ে খুশী ছিলে না  ………...।।  বিস্ময়ের সাথে বলে আশিক,
-উমম… মানুষকে চ্যালেঞ্জ…... করতে আমার …...মজা  লাগে। দ্বিধাজনিত স্বরে রায়না বলে,
-তুমি আমাকে আর চাও না, তাই না?  নিতে আসবে না?

আশিকের প্রান্তে নীরবতা। মিনিট পাঁচেক চুপ থাকার পর  মুখ খোলে, মৃদু কন্ঠে  শোনা যায়,
-আসতে তো হবেই।  বিয়ে করেছি যখন … আমার দায়িত্ব তো পালন করতে হবে। 
-শুধু দায়িত্ব?? … আর কিছু না??  তুমি যে বলেছিলে সারাজীবন  আমাকে ভালোবেসে যাবে। ঝগড়া হলে  নিজেরা  মিটিয়ে নিবো।  
 কথা অসমাপ্ত  রেখেই  ফোন ছেড়ে  দেয় আশিক। হানিমুনের কিছু ছবি ফেসবুকে দিয়ে ছিল,  দ্যাখে  আবার ছবিগুলো। কাজ শেষ করে বের হতে বেশ রাত হয়ে যায়।  রাস্তাঘাট  বেশ নিস্তব্ধ। 
আশিকের মনের বিষন্নতা  আর শুন্যতাকে ছাপিয়ে রায়নার ডাগর চোখ  দুটো ভেসে উঠছিল।  রূপোলী চাঁদের আলোয় শুনশান রাস্তায় সে মনে মনে রায়নার সংগেই কথা বলছিলো। 

আশিক ভাবছে, ভালোবাসার শক্তি তো অসীম। সে কি পারবে না ভালোবাসা  দিয়ে রায়নার এ অসুখ নির্মূল করতে!!  সব প্রশ্নের উত্তর তো গুগলে থাকে না।  চিকিৎসা  করিয়ে আর ভালোবাসা দিয়েই  রায়নাকে সুস্থ করতে হবে।  পথে অনেক সুড়কী, পাথর,  নুড়ি পড়বে  …… সব সরিয়ে মসৃণ পথ বের করেই  নিতে হবে, ভালোবাসার মানুষের জন্য।

বন্যা হোসেন 
অটোয়া, কানাডা।