অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
ভিন্ন জীবন (পর্ব-বারো) - সুফিয়া ফারজানা

রজা খুলে সালমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠে মতিন। এত রাতে, কিভাবে, কোথা থেকে আসলো সালমা? সালমার কোলে ঘুমিয়ে আছে ময়না। পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে  রকিব,"ভাইজান, বাড়ি যাওয়া তো ছাইড়াই দিছেন। তাই ভাবীই না পাইরা চইলা আইছে আপনারে দেখতে। আমি নিয়া আইলাম ইশটিশন থাইকা। আমারে সকালেই জানাইছিলো ভাবী। আমি কিছু কই নাই আপনারে।"

একই গ্রামে বাড়ি। রকিবকে ছোট ভাইয়ের মতই দেখে মতিন। একই কারখানায় রকিবের চাকরিও মতিনের সুপারিশেই হয়েছিল। তবে আজ মতিন খুশি হয় না। মুখটা কালো করে বলে, "ঠিক আছে। তুই অহন যা, রকিব।"

রকিব চলে যায়। সালমা ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত ময়নাকে শুইয়ে দেয় বিছানায়। ক্লান্তিতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটা। মতিন বলে, "ক্যান আইলা এইভাবে হঠাৎ?"
"তোমারে দেখতে আইলাম, কেমন আছো তুমি?"
"আমি তো ভালাই আছি। তুমিই তো কংকাল হইয়া গেছো, গলার হাড্ডি বাইর হইয়া গেছে তোমার।"

সালমা কিছু বলে না, একটু হাসে শুধু। হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টায় সে। তারপর একটা প্যাকেট থেকে কিছু পাটিসাপটা পিঠা বের করে মতিনের সামনে রাখে। আরেকটা টিফিন ক্যারিয়ার খুলে সে বের করে চালের আটার রুটি, খেজুরের গুড়ের পায়েস আর রান্না করা কবুতরের মাংস। সব কিছু  প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে মতিনকে খেতে বলে সে, "খাও একটু, কাইল অনেক রাইত জাইগা পাটিসাপটা পিঠা আর খেজুরের গুড়ের পায়েস রানছে মুন্নী তোমার লাইগা।"
"আব্বা জানে, তুমি আইছো?"
"আব্বারে কিছু কই নাই। কইলে কি আর আইতে দিতো একলা? মুন্নীরে কইছি।"
একটু থেমে সালমা বলে, "রাইতে কি খাইছো?"
"ভাত খাইছি। আবার কি খামু?"
"রান্দে কে?"
"হোটেলে খাই।" 
"তুমিও শুকায় গেছো অনেক। দুইটা রুটি খাও, কবুতরের মাংস দিয়া রুটি তুমি তো খুব ভালবাসো।"
"আমি খামু না, রুটি তুমিই খাও।"

আর বসে না মতিন। ময়নার পাশে গিয়ে শুয়ে পরে চোখ বন্ধ করে। কোন দুঃখে সালমা আসলো মরতে? কাল তো লিলির মা পাকা কথা দিবেন, বলেছেন। লিলিকে তিনি রাজি করাবেনই, যেভাবেই হোক। এই সময়ে সালমা কেন হঠাৎ? সালমাকে দেখেই মেজাজ আরও বিগড়ে যায় মতিনের। কী বিচ্ছিরি কংকালসার চেহারা হয়েছে সালমার! বিয়ের সময় তো ভালোই ছিল দেখতে। বাচ্চাটা হওয়ার পর সৌন্দর্য বলতে আর কিচ্ছু নেই সালমার। 

অথচ লিলি? যখন হাসে, মনে হয়, যেন মুক্তা ঝরে। চলাফেরা কী অপূর্ব! কী চমৎকার স্বাস্থ্য লিলির! শুধু গায়ের রংটাই একটু শ্যামলা। তাতে কি যায় আসে? যেভাবেই হোক, লিলিকে বিয়ে করবেই মতিন। সালমার প্রতি আর কোন আকর্ষণ নাই তার। শুধু ময়নার জন্য মায়া হয় একটু। বাচ্চাটাও শুকিয়ে গেছে একদম। কেন, এরা কি খায় না? না খেয়ে থাকে নাকি? সে তো প্রতি মাসে ঠিকমতই টাকা পাঠায় বাড়িতে।

মতিন তো সালমাকেও ছাড়তে বা তালাক দিতে চায় না আসলে। সালমা সংসারী মেয়ে। সে চায়, সালমা গ্রামে থাকুক ময়নাকে নিয়ে, তার বৃদ্ধ বাবার সেবাযত্ন করুক। সংসারের কাজে সালমা খুবই দক্ষ। রান্নাবান্নাও ভালো জানে। গ্রামের বাড়িঘর, জমিজমা, সবই তো তার। সালমাই তো আসল বউ। মতিন তো বাড়ির একমাত্র ছেলে। তার বউ তো বাড়ির মালিক এখন। ময়না বড় হোক, লেখাপড়া করুক। তারপর ভালো ছেলে দেখে ময়নার বিয়ে দেবে মতিন। 

লিলি থাকবে তার সাথে ঢাকায়। একা একা এই ঢাকা শহরে মতিনের খুব কষ্ট হয়। রান্নাবান্নার ঝামেলা, খাওয়াদাওয়ার কষ্ট, সব দিকেই কষ্ট। লিলি যদি তার বউ হয়ে তার শহরের বাসায় তার সাথে থাকে, তাহলে স্বর্গসুখ পাবে মতিন। লিলিকে কোনদিনও গ্রামে নিয়ে যাবে না সে। তাছাড়া লিলিও তো চাকরি করে, ভালোই বেতন পায়, মতিন জানে। লিলির টাকা দিয়েই শহরের সংসার চলে যাবে মতিনের। গ্রামে কেউ কিছু জানবেও না। সালমাও জানবে না যে, শহরে মতিনের আরেক বউ আছে। এমনটাই ভেবেছিল মতিন।

কিন্তু সালমা হঠাৎ কেন আসলো এই সময়ে? সে কি জেনে গেছে কিছু? মতিন যে লিলির প্রেমে পাগল, এটা কি সালমার কানে দিয়েছে কেউ? কে দিতে পারে সালমার কানে? রকিব? কিন্তু রকিবেরও তো জানার কথা নয়। কিছু ই ভাবতে পারে না মতিন। কি হবে এখন? কি করবে সে? সালমাকে খুলে বলবে সবকিছু? সালমা কি মানতে পারবে? আবার লিলি যদি শেষ পর্যন্ত রাজী না হয় বিয়েতে, তখন কি হবে? দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারে না মতিন। ময়নার আরেক পাশে শুয়ে সালমাও জেগে থাকে সারা রাত। সারাদিনের এত ক্লান্তিতেও ঘুম আসে না তার। মতিন কেন এত বিরক্ত হল তাকে দেখে? ময়নাকে এতদিন পর দেখেও একটুও আদর করলো না, কোলেও নিলো না একবারও। কি হয়েছে মানুষটার??

পাশাপাশি জেগে থাকে দু'জন সারা রাত, অনেক দিন পর বাবা-মার মাঝখানে অঘোরে ঘুমায় তাদের আদরের ময়না। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। জেগে থেকেও ঘুমানোর অভিনয় করে দু'জন সারা রাত।। (চলবে)

সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ