হাউড়া - বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল
'হাউড়া' শব্দটার সঙ্গে আমি পূর্বে একেবারে পরিচিত ছিলাম না। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে এই শব্দটার ব্যবহারে বিশেষায়িত করেছিল একজন অতি গুণী মানুষের চরিত্রকে। যার স্মৃতি আমার মনে অহরহ বেদনা দেয়। গ্রামসুদ্ধ আবাল বৃদ্ধ বণিতা উনাকে দেখলেই একবার অন্ততঃ বলতে শুনেছি ' হাউড়াটা ' বা ' হাবড়া ' । শব্দটাতে যেন একটা কৌতুক লুকিয়ে আছে। শব্দটির অর্থ বোধ হয় বোকা, অকর্মণ্য। ' হাবড়া ' থেকেই এখানে ' হাউড়া ' বলার চল আছে মনে করি। গরীব ঘরে জন্ম নিয়েছে তাই অভাব কে নিত্য সঙ্গী করতে হয়েছে। হ্যাঁ, দেখতে একটু অন্যরকম, অকালে বুড়ো, রোগা ও লম্বায় পাঁচ ফুটের মতো। মাথায় একটু ব্যারাম আছে বটে তবে অকর্মণ্য মোটেও বলার যোগ্য নয়।
যখন দেখেছি গ্রীষ্মকালে খরার চাষের ধানের ভারী ভারী ও আকারে বড় বড় বোঝা মাথায় করে দূরের জমি থেকে নিয়ে আসতে, দেখেছি ঘরের পালিত গরুকে খেতে দেওয়ার জন্য মাঠ থেকে বিশাল ঘাষের বোঝা নিয়ে আসতে। তখন কে তাকে অকর্মণ্য বলার সাহস পায় ?
অনেকে হঠাৎ করে বাড়িতে এসে তার নাম ধরে যখন খোঁজ করতো। তখন মনে হত এই অকর্মণ্য ব্যক্তির কেন এত খোঁজ করে মানুষ? দু একটা অনুষ্ঠান বাড়িতে তার সেবামূলক কাজ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য করেছে যে।
অনুষ্ঠান বাড়িতে বা পঙতি ভোজনে মূলত তাঁর ডাক পড়তো - রান্নার কাজে সাহায্যকারী হিসেবে বা এঁটো পাতা তোলানোর মতো পূণ্য কর্মে। কম পারিশ্রমিক দিয়ে প্রচুর সেবা একমাত্র যন্ত্রই দিতে পারে। হাউড়া তকমার মহৎ লোকটিকে সকলেই এক প্রকার যন্ত্র মনে করেই কাজ বাড়িতে ভাড়া করে নিয়ে যেত। যন্ত্রটাকে কাজে লাগিয়ে দিলে যত জল লাগবে অনুষ্ঠান বাড়িতে বালতি বালতি জল উঠে আসে, রান্নার কুটনা কুটতে হলে হামনদিস্তা পরিশ্রান্ত হয়ে গেলেও সে পরিশ্রান্ত হোত না। কাজে কোন গড়মশি করতো না, কাজকে ভালো বেসে নিজের মতো করে করত। অনেকে দেখেছি ধীর স্থির ভাবে, ঘুরে ফিরে, তামাক বিড়ি খেয়ে, গল্প - গুজব করে কাজে ফাঁকি দিতে চায়। এক কথায় ' কামচোর ' । তার অভিধানে কোন ফাঁকি শব্দের ব্যবহার ছিল না। পঙ্গতের পর পঙ্গত বসলে হনহন করে দ্রুততার সঙ্গে সব এঁটো পাতা তুলে পরিষ্কার করে দিতো তৎক্ষণাৎ।
কাজের পারিশ্রমিক পেত খুবই কম। বলতে গেলে যা পরিসেবা দিত, তার কিছুই না। একলিটার তেল খরচে পাঁচ লিটার তেলের কাজ এই মনুষ্য রূপী যন্ত্র দিয়ে করিয়ে নিতো আধুনিকতার আড়ালে থাকা চতুর মানুষ । তাই বিয়ের লগ্নে একটা কাজ ধরলে অন্যরা ঐ তারিখে কাজে নিয়ে যেতে চাইলে যখন ঐ তারিখে কাজ ধরা আছে বলত তখন বিষাদ নয়নে ফিরে যেত সকলে।
কাজে বের হওয়ার সময় গলায় পরত একটা মটা দানার মালা, আর মুখে বলত তিনবার দুগ্গা - দুগ্গা - দুগ্গা। বাড়ি ফিরলে "কৈ গো - কোথায় গেলে" বলে স্ত্রীকে ঝাঁটা আনতে বলত। যা কিছু থৈলা / থৈলি - মাকুড়ি থাকতো সেগুলো ঝাঁটা পেটা করে নিজে ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে, তবে বাড়িতে ঢুকত। শুনেছি রাস্তার লেগে যাওয়া অপবিত্র আত্মারা ঝাঁটার ঘা খেয়ে পালিয়ে যেত আর কি ? এরকমই ছিল তার কুসংস্কারের ধরন ধারন।
একদিন পাশের গ্রামে অষ্টম প্রহরে কাজের ডাকে গিয়ে আর বাড়িতে জীবিত ফেরতে পারেনি। সরকারী হাসপাতালের লাসকাটা ঘর ঘুরে কা টা ছেঁড়ার পর একেবারে সয়ের ওপরে অগ্নি কুণ্ডে প্রজ্জ্বলিত হয়। সেদিন কোন ঝাঁটার বাড়ি আর খায়নি।
সময়টা ছিল শীতকাল। প্রচুর মানুষ খাওয়ানোর জন্য রাত থাকতে রান্নার কাজ শুরু হয়। পাশে একশো দিনের কাজে মাটি কাটানো গভীর পুকুর থেকে জল তুলে আনতে গিয়ে কিভাবে অন্ধকার রাত্রে জলে পড়ে মারা যায়। পরে লাশ ভেসে উঠলে সকলে জানতে পারে।
হাউড়ার মৃত্যু রহস্য আজিও জানা যায় নি?
বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল
রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
-
গল্প//উপন্যাস
-
11-01-2024
-
-