ভিন্ন জীবন (পর্ব- এগারো) - সুফিয়া ফারজানা
আরমান বহু বার বলার পরেও আগে কখনও আরমানের বাসায় আসেনি ফারিন। আজ হুট করেই চলে এসেছে একটা ঘোরের মাঝে। অথচ দরজা খুলে ফারিনকে দেখে একটুও অবাক হল না আরমান। কী আজব একটা মানুষ! ফারিন তো আসার আগে কিছুই জানায়নি তাকে। তবু সে যেন জানতো, ফারিন আসবে। তবে সে যে ঘুমাচ্ছিলো, এটা বোঝা যাচ্ছে তাকে দেখে। ছুটির দিনে দশটা পর্যন্ত ঘুমানো তার জন্য খুবই স্বাভাবিক। আরমান খুব স্বাভাবিক গলায় বললো, "এসো, ফারিন।"
দুই রুমের ছোট্ট বাসা, ছয় তলায়। পাশাপাশি দুটো বেডরুম, ডাইনিং, একটুখানি বসার ঘর, রান্নাঘর আর এক চিলতে বারান্দা। আরমানের অগোছালো, জিনিসপত্র এদিক-সেদিক ছড়ানো, এলোমেলো বসার ঘরে ঢুকে ইতস্তত করছিল ফারিন। কোথায় যে বসবে, ভেবে পাচ্ছিলো না ঠিক। আরমান নিজেই একটি বেতের চেয়ার এগিয়ে দিলো, "বসো এখানে।"
ফারিন বসলো, "বাসায় আর কেউ নেই?"
"না।"
"তোমার মা?"
"মা কাল রাগ করে চলে গেছেন বড় আপার বাসায়।"
"কেন, রাগ কেন?"
"সেই একই প্যাচাল। বিয়ে-শাদি করি না কেন, বয়স শেষ হয়ে গেল। আর কবে করবো? ফাঁকা বাসায় তার ভাল লাগে না একা একা, এইসব পুরনো ক্যাচাল।"
"ঠিকই তো। বিয়ে করো না কেন?"
আরমান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ফারিনের দিকে। তারপর মিটিমিটি হাসতে থাকে।
"হাসির কি হল?"
"আরে দূর! আমি করবো বিয়ে, সংসার? সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয়? একাই ভালো আছি। তাও যদি তুমি আগেই বিয়েটা না করে ফেলতে, তাহলে হয়ত ভেবে দেখতাম। তোমার সাথে দেখাই তো হল অনেক দেরীতে। এনিওয়ে, অনেক দিন পর শাড়িতে কিন্তু দারুণ লাগছে তোমাকে। চমৎকার! মনে হচ্ছে, অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। তুমি কিন্তু এখনও যথেষ্ট সুন্দরী!"
ফারিন কিছু বলে না। মাথা নিচু করে বসে থাকে চুপচাপ।
আরমান কাছে এসে দাঁড়ালো, "কি খাবে, বলো।"
"কিচ্ছু না।"
"আমি তো খাবো। চলো, নিচে যাই। আমার পরিচিত একটা রেস্টুরেন্টে চমৎকার ভুনা খিচুড়ি পাওয়া যায় এই সময়ে।"
"না, বাইরে যাবো না আজ। তোমার বুয়া আসবে না?"
"না, মা নেই। তাই বুয়ারও ছুটি।"
"তুমি কি খাবে?"
"বাইরেই তো খাই।"
"এভাবে সব সময় বাইরের খাবার খাওয়া কি ঠিক?"
"আরে দূর! আমার কিছু হবে-টবে না। আর হলেই বা কি? কে কাঁদবে আমার জন্য?"
"বাজে কথা বলো না। তোমার রান্নাটা আমি করে দেই আজকে।"
"মোস্ট ওয়েলকাম, ডিয়ার। কিন্তু বাসায় কি আছে বা নেই, আমি কিন্তু কিচ্ছু জানি না। হা হা হা।"
ফারিন ফ্রিজ খুলে সবজি আর ডিম বের করে। সবজি-খিচুড়ি আর ডিম ভাজি করে ফেলে বেশ অল্প সময়েই। দক্ষ হাতে গুছিয়ে ফেলে ঘর। আরমান অবাক হয়ে দেখে, কিছু বলে না। গরম গরম খিচুড়ি খুব মজা করে খায় আরমান। ফারিন খেতে পারে না কিছুই। শুধু একটু খিচুড়ি প্লেটে নিয়ে নাড়াচাড়া করে রেখে দেয়।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে বারান্দায় আসে দু জনে। বারান্দায় রোদ এসেছে। নভেম্বরের হালকা শীতে রোদটা ভালোই লাগছে। বেশ কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছেন আরমানের মা। একটা ইজিচেয়ার আর দুটো মোড়া আছে বেতের। একটা টবে চমৎকার লাল গোলাপ ফুটে আছে। আরমান একটা গোলাপ ছিঁড়ে গুঁজে দেয় ফারিনের খোঁপায়। তারপর একটা মোড়া টেনে বসে, "এবার বলো তো, কি হয়েছে তোমার?"
ফারিন বসে না, গোলাপ গাছটার কাছে নরম রোদে গিয়ে দাঁড়ায়। আরমান অবাক হয়ে দেখে, ফারিনের চোখ ভেজা। ফারিন খুব শক্ত মেয়ে। এত বছরে কখনও ফারিনকে কাঁদতে দেখেনি সে।
"আমি আর হিমেলের সাথে থাকবো না, আরমান।"
"কি বলো? কেন?"
"ও খুব বাজে বিহেভ করে সব সময়। বলতে পারো, একই ছাদের নিচে থেকেও কোন সম্পর্কই নেই আমাদের।"
"সে তো জানি, তুমি বলেছো আগেও। কিন্তু কি করতে চাও, তা কখনও বলোনি।"
"আমি আর ফিরে যাবো না।"
"কোথায় থাকবে তাহলে?"
"তোমার সাথে।"
হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে আরমান। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে তারও।
"ফারিন, তুমি কি বোকা? তুমি আসলেই অনেক অবুঝ। আমি আবার একটা মানুষ? আমি কোন দিক থেকেই তোমার যোগ্য নই, ফারিন। তবে আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর আর কোন মেয়েকেই ভাল লাগেনি আমার। তাই বিয়েটাও করা হয়ে ওঠেনি।"
"তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়? আমি আর ফিরে যাবো না, আরমান।"
"সমস্যা আমার না, ফারিন, সমস্যা তোমার। তুমি এখন, এই মুহূর্তে যা বলছো, তার পুরোটাই তোমার আবেগের কথা। বাস্তব এটা নয়। বাস্তবটা তুমি জানো, আমিও জানি। ফারিন, আমি তোমার বন্ধু, সহকর্মী। খুব ভালো বন্ধু আমরা। কিন্তু এত বছরের পরিচয়ে আমার মায়ের সাথে দেখা করতেও তুমি কখনও আসোনি আমার বাসায়, আমি অনেক বার বলার পরেও কোনদিন আসোনি। আজ একটা দুর্বল মুহূর্তে হয়ত চলে এসেছো হঠাৎ। তুমি কিভাবে ভাবলে, তোমার সেই দুর্বলতার সুযোগ আমি নিতে পারি? তুমি আমাকে বুঝতে ভুল করেছো, ফারিন। এতটা নীচ, এতটা অবিবেচক আমি নই। তাছাড়া তোমার হিমেলকে তুমি কতটা ভালবাসো, এটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে বলে আমার মনে হয় না।" এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামে আরমান।
ফারিন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে ঝরতে থাকে অশ্রু। আরমান কাছে এসে মাথায় হাত রাখে ফারিনের। খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতো আরমান এক সময়। আজ হঠাৎ মহাদেব সাহার একটি প্রিয় কবিতার কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করে সে ফারিনের মাথায় হাত রেখেইঃ
"বহুদিন ভালোবাসাহীন
বহুদিন উথাল পাথাল
বহুদিন কারো হাত পড়েনি কপালে
বহুদিন দু'চোখের অশ্রু কেউ মোছায়নি আর
বহুদিন দূর দ্বীপে
বহুদিন একা নির্বাসনে…"
কে বহুদিন ভালবাসাহীন?? হয়ত ফারিন, হয়ত হিমেল, হয়ত বা আরমান, হয়ত লিলি, হয়ত মতিন বা মতিনের বউ সালমা। হয়ত সবাই।।
"চলো, ফারিন। তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি, চলো। সাবিত-সারা হয়ত কান্নাকাটি করছে এতক্ষণে।" আরমান বলে।
কাঁদতে কাঁদতেই ফারিনের মনে হয়, আরমানের মত বন্ধু তার আর কেউ নেই পৃথিবীতে, সত্যিই নেই। সে কিভাবে বুঝে ফেললো তার মনের কথা? সত্যিই হিমেল তার আত্মার অংশ, হিমেলের জায়গাটা সে অন্য কাউকে দিতে পারবে না কোনদিন, সত্যিই পারবে না।। (চলবে)
সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা,বাংলাদেশ
-
গল্প//উপন্যাস
-
11-01-2024
-
-