অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
হজের চেয়ারম্যানের ষাঁড় - ইকবাল কবীর রনজু

ভোর বেলা বাড়ি সংলগ্ন গোয়াল ঘড় থেকে আসা হাম্বা হাম্বা ডাক শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় মজিরনের। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে চকির উপর কিছু সময় বসে সে। আবার শুনতে পায় সেই হাম্বা হাম্বা ডাক। শাড়ি ছায়া ঠিকঠাক করে ঘরের দরজার কাঠের খিল খুলে বাইরে বেড়িয়ে আওলার বাঁশের চেগার ধরে দাঁড়ায়। দ্যাখে, লাল বকনাটা ডাকা ডাকি করত্যাচে। অন্য দিনতো এভাবে ডাকা ডাকি করেনা বকনাটা। খড়ের পালা থেকে এক পাজা খড় খুলে বাঁশের চেগার ডিঙিয়ে গোরায় খড় দেয় মজিরন। মজিরনকে খড় দেওয়া দেখে অন্য গরুটি গোরার দিকে এগিয়ে খাওয়া শুরু করে। সারা রাত উপোস থাকলেও খাওয়ায় লাল বকনাটার উৎসাহ চোখে পরেনা মজিরনের।

ঘরে ফিরে মজিরন দেখে, তার স্বামী নুরু খাঁ তখনও বেঘোরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
-শুনচ্যাও। লাল বকনাটাতো খাচ্চে না। খালি ডাকা ডাকি করত্যাচে।
-আ। কি কও।
-লাল বকনাটা খাচ্চে না। ডাকা ডাকি করত্যাচে।

দ্রুত ঘুম থেকে উঠে মজিরনকে সাথে নিয়ে গোয়ালে ঢোকে নুরু খাঁ। টক টকে লাল বকনাটার দিকে তাকায়। বকনাটা খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ঠিক মতো খাচ্ছে না। গোহাল সংলগ্ন আওলায় ছেড়ে রাখা অন্য গরুটির পিঠের উপর লাফিয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পর পর প্রস্রাব করছে। এসব দেখে নুরু খাঁ নিশ্চিত হন বকনাটার ডাক এসেছে।
-কি হইছে? স্বামীর দিকে তাকায় মজিরন।
- ষাঁড়ের কাছে লেওয়া লাগবি।

আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মজিরন। খুব কষ্টে চল্লিশ হাজার টাকা জমিয়েছিল ওরা। পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ করে আর জমানো চল্লিশ হাজার টাকা একত্র করে নব্বই হাজার টাকায় মাস দুয়েক আগে জুলু বেপারীর কাছ থেকে বকনাটি কিনেছে মজিরনরা। সারা দিন ভ্যান গাড়ি চালিয়ে নুরু খাঁ যে টাকা পায় সে টাকায় সংসার চালাতে হয়, ঋণের কিস্তি দিতে হয় আবার গরুর খাবারও কিনতে হয়। সব মিলিয়ে প্যারায় আছে নূরু খাঁ।

কেনার সময় জুলু বেপারী কইছিলো দু এক মাস পাললিই ডাক আসপি, বিয়েনের পর বিশ থেকে পঁচিশ লিটার দুধ হবি। হাতের কর গুনে গুনে মজিরন দেখে এক মাস চব্বিশ দিন হলো কেনা হইচে বকনাটা। জুলু বেপারীর প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়ে মজিরনের। ওলানের মোটা মোটা বাটের দিকে তাকিয়ে মজিরনের মনে হয় দুধের ব্যাপারেও বেপারী যা কইচে তা মনে হয় ঠিকি হবি। বকনাটিকে ঘিরে সংসারে স্বচ্ছলতার স্বপ্ন দেখে মজিরন।

বিয়ের আগে কয়েক ক্লাসে পড়েছিল মজিরন। গাই গুনে বাছুর এ প্রবাদ প্রবচনটি তার পড়া থাকলেও পুথিগত এ বিদ্যায় এখন আর বিশ্বাস করেনা সে। কেননা সে নিজে লম্বা চওড়া হলেও তার সন্তানটি বাপের মতোই খাটো, চেকন হইচে। তাই বাড়ির আশ পাশে কিছু পুঁচকে ষাঁড় থাকলিও লাল বকনাটিকে সেসব ষাঁড়ের কাছে না লিয়্যা হজের চেয়ারম্যানের হ্ষ্টিপুষ্ট মুটাসুটা সরকারি ষাঁড়ের কাছে লিয়ে যাব্যার কয় স্বামীক।

ফিরতে দেরি হতে পারে ভেবে দু মুঠো খেয়ে লাল বকনাটি লিয়্যা হজের চেয়ারম্যানের ষাঁড়ের খোঁজে বারায় নুরু খাঁ। বকনাটির গলার রশি ধরে টানতি টানতি সামনের দিকে এগোয় সে। আশরাফুলের চায়ের দোকানের সামনে রবিনদের চা সিগারেট খাওয়া দেখে তারও চা বিড়ির নেশা জাগে। দোকানে বসলে অন্যদের কাছে ষাঁড়ের খবর পাওয়া যাব্যের পারে। আবার এসময়ে চা বিড়ি খাওয়ার কামডাও সারা হয়া যাবিনি। দোকানের সামনের রাস্তায় বট গাছের শিকড়ের সাথে বকনাটা বাঁদে নুরু খাঁ। চা দিব্যার কয় আশরাফুলকে।

বকনাটা প্রস্রাব করে দেয়। তার ছিটে ফোটা গিয়ে পরে রবিনের সাদা ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবীতে। রবিন আগে এ পাড়ার পাতি নেতা ছিল। উপজেলার নেতাদের সাথে ভাব আছে তার। রবিন তাদের কথায় ওঠে বসে। নেতারা কাউকে ধরে আনতে বললে রবিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বেঁধে নিয়ে আসে। দলের জন্যি লাঠি হাতে মিছিলি যায়। দোকান থেকে চা সিগারেট এনে খাওয়ায়। রবিন নাকি তার প্রতিদানও পেয়েছে। নূরু খাঁ শুনেছে বড় নেতাদের মোটা অংকের টাকা বকশিস দিয়ে রবিন  কিছু দিন আগে দলের অঙ্গ সংগঠনের একটা পদ বাগিয়ে নিয়েছে। এখন বড় নেতাদের ছত্রছায়ায় বালুর ব্যবসা করে আঙ্গুল ফুলে তালগাছ হয়ে যাচ্ছে। মন মেজাজও বদলে যাচ্ছে তার। সেই রবিনের গায়ে প্রস্রাব করেছে নুরু খাঁ’র বকনা। ভাবা যায় বকনাটা কত বড় অন্যায় করে ফেলেছে। ভয়ে নুরু খাঁর ও প্রায় প্রস্রাব করে ফেলার উপক্রম হয়।

দ্রুত উঠে বকনাটির গলার রশি খুলে একটু দূরে নিতে উদ্যত হয় নূরু খাঁ। এরই মধ্যে রবিন দু চার ঘা চর থাপর বসিয়ে দেয় নূরু খাঁ’র গালে। ওর সহযোগিরাও তেড়ে এগিয়ে আসে। ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পায়না নূরু খাঁ। নূরু খাঁ যদি জানতো বকনাটা এখানে প্রস্রাব করে ফেলবে তবে কি সে এখানে বাঁধতো! চর-থাপ্পর নিরবে হজম করে বকনাটি নিয়ে বড় রাস্তায় ওঠে নূরু খাঁ। চা খেতে আসা অন্যরা সবই দেখে কিন্তু ভয়ে কেউ কিছুই বলে না।

একটা মোটরসাইকেলের বহর এগিয়ে আসছে। সামনে ভোট। দিন নাই রাত নাই মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন নেতারা। রবিনরাও কি এই বহরে যোগ দিবি? কিন্তু এসব নিয়ে ভেবেতো লাভ নেই নূরু খাঁ’র। তাকে যে হজের চেয়ারম্যানের ষাঁড় খুজে বের করতে হবে। কোন মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে কে জানে। রাস্তার এপাশ ওপাশে খেশারী, মশুর, গম খেতসহ মৌসুমী ফসলের মাঠে সারা বছর অবাধ বিচরণ হজের চেয়ারম্যানের ষাঁড়ের। খেয়ে খচে ফসল নষ্ট করলেও কেউ কিছুই বলে না। সরকারি ষাঁড় বলে কথা। চার বছর আগে এলাকাবাসীকে স্বাক্ষী রেখে ছয় মাস বয়সী এড়ে বাছুরটা আল্লার ওয়াস্তে ছেড়ে দিয়েছিলেন হজের চেয়ারম্যান।

বড় হলে এ ষাঁড় বিক্রির টাকা এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে ব্যয় হবে। এ ষাঁড়ের উপর তাই এখন হজের চেয়ারম্যানের আর ব্যক্তি অধিকার নাই। এলাকার সবাই এ ষাঁড়ের অংশীজন। তাই ফসলের ক্ষতি করলেও কেউ এ ষাঁড় খোয়াড়ে দেয় না। মাঠের গম, খেশারী, ধান খেয়ে খঁচে নষ্ট করলেও অংশীজন হওয়ায় জমির মালিকরা কিছইু বলেন না। কারো বকনা বা গাভীর ডাক আসলে তারা মাগনা এ ষাঁড় ব্যবহার করেন। কেউ কেউ ধান গম ঘরে তোলার সময় মলন দেওয়ার কাজেও ব্যবহার করেন হজের চেয়ারম্যানের ষাঁড়। যাদের বকনা বা গাভী নেই আবার মাঠে জমিও নেই তারাও এই ষাঁড়ের অংশীজন কেননা  ষাঁড় বিক্রির টাকা তো সমাজের কল্যাণেই ব্যয় হবে।

গলায় দড়ি না থাকায় সাড়ে চার বছরে কালো কুচ কুচে ষাঁড়টির যে ঘার গর্দান হয়েছে দেখলে ভয়ই করে। ভয়ঙ্কর দৈত্যের মতো চেহারা হয়েছে। গর্দানের উপরের চুট গোস্তের ভারে বেঁকে নিচের দিকে চলে এসেছে। রাতের অন্ধকারে মাঠের মধ্যকার রাস্তা দিয়ে এ এলাকায় আসার সময় বাইরের বেশ কয়েকজন এ ষাঁড় দেখে জ্বিন ভুত মনে করে ভয় পেয়েছেন। 

নূরু খাঁ হজের চেয়ারম্যানের ষাঁড়ের সন্ধানে এ মাঠ ও মাঠ, এ রাস্তা ও রাস্তায় হাটে আর তাকায়। অনেক দূর পর্যন্ত তাকায়, যত দূর চোখ যায়। ফসলের মাঠ পেড়িয়ে ইট ভাটার চিমনি বেয়ে ওঠা কালো ধোয়া, শাহী মসজিদের মিনার, উচু উচু মোবাইলের টাওয়ার তার দৃষ্টিগোচর হলেও হজের চেয়ারম্যানের ষাঁড় তার দৃষ্টি সীমার বাইরেই থেকে যায়। নুরু খাঁ একে ওকে জিজ্ঞেস করে। কেউ বলে পরশু নটাবাড়িয়া মাঠে দেখেছি, কেউ বলে কাল চড়পাড়া মাঠে দেখেছি। আপাতত চড়পাড়ার দিকেই এগুচ্ছে নূরু খাঁ।

পৈলানপুর গ্রামের মিন্টু কিছু লোকজন সাথে নিয়ে গাছে গাছে ভোটের ব্যনার লাগাচ্ছে। মিন্টু ছাড়া অন্য কাউকে চিনতে পারেনা নূরু খাঁ। মিন্টুকেও সে আগে চিনতো না। বছর দুয়েক হলো চেনে। ভ্যান গাড়িটা কেনার পর থেকে। মিন্টু আর ওর সহযোগিরা ভ্যান, লছিমন, করিমন গাড়ি থেকে চাঁদা তোলে। মিন্টু যখন তার নতুন গাড়িটা রাস্তায় নামায় তখন তার জানা ছিলনা কেউ এ রাস্তায় নতুন গাড়ি নামালে নেতা ফি বাবদ মিন্টুদের এককালীন অফেরতযোগ্য হাজার টাকা দিতে হয়। এক দিন মিন্টুরা নূরু খাঁ’র গাড়ি আটকে এ টাকাটা আদায় করেই ছাড়ে। এ ছাড়া দৈনিকের বিশ টাকা চাদা তো দিতেই হয়।

চরপাড়ার মাঠেও হজের চেয়ারম্যানের ষাঁড়ের দেখা পেল না নূরু খাঁ। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। চড়পাড়ার পুচকে ষাঁড়গুলো তার ক্লান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। ডাক আসা গরু নিয়ে পথ চলার সময় পুচকে ষাঁড়গুলো কিভাবে বুঝতে পারে কে জানে ? দড়িতে বেঁধে রাখা পুচকে ষাঁড়ও দড়ি ছিড়ে জোড় করে নূরু খাঁ’র বকনার পিঠের উপর ওঠার চেষ্টা করে। মজিরনের কথা মনে পড়ায় পুচকে ষাঁড় ঠেকাতে নূরু খাঁ গলদঘর্ম হয়। ইতি মধ্যে কয়েকটি পুচকে ষাঁড়কে নিবৃত করতে হয়েছে তাকে। সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা তার।

এবার চরপাড়া মাঠ পেড়িয়ে নটাবাড়িয়া মাঠের দিকে এগুতে থাকে নূরু খাঁ। বিকেল হয়ে আসছে প্রায়। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথায় টন টন করছে। সেই সাত সকালে খেয়ে বেড়িয়েছে সে। ক্ষিধেয় পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে। মাঠের মধ্যকার রাস্তা দিয়ে বকনাটি নিয়ে হাটছে নূরু খাঁ। সন্ধ্যা আসন্ন প্রায়। তার পা যেন আর উঠছে না। গরুর দড়িটা হাতের মধ্যে রেখেই রাস্তার এক পাশে দূর্বা ঘাসের উপর বসে পরে নূরু খাঁ। বকনাটা দু একবার ঘাসে মুখ দেয়। নূরু খাঁ’র দেহে  ভর করে রাজ্যের ক্লান্তি। চোখে তন্দ্রা ভাব। চোখ বুঁজে আসে নূরু খাঁ’র। নিমিষে সে দেখতে পায় লাল, কালো, সাদা পুচকে শত শত ষাঁড় লাল বকনাটার পিঠ বইছে। নিজের অবচেতন চোখকে কি করে অবিশ্বাস করে নূরু খাঁ। লাল বকনাটার পিঠটি যেন ধনুকের মতো বেঁকে সমস্ত দেহ কুচকে যাচ্ছে। হাতের দড়িতে টান পরতেই জেগে ওঠে নুরু খাঁ। চোখ মেলে তাকায়। চার দিকে তখন আঁধার নেমে এসেছে। 

ইকবাল কবীর রনজু
পাবনা, বাংলাদেশ
লেখক-সাংবাদিক, সাহিত্যিক। 
সহকারি অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, মির্জাপুর ডিগ্রী কলেজ, চাটমোহর, পাবনা