অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
স্বাধীনতার কয়েকটি কবিতা - মো. সুমন মিয়া

১) স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যোদয়...

মি স্বাধীনতার প্রথম সূর্যোদয় দেখিনি,
দেখেছি ৫০ বছরের পুরনো ঝলমলে রক্তিম সকাল।
ঘন কুয়াশাকে ভেদ করে আকাশ রাঙানো
সময়ের স্রোতে খুঁদিত এক রক্তাক্ত মহাকাল।
এত তেজদীপ্ত, উজ্জ্বীবিত, সতত অটুট বিশ্বাস!
প্রথম প্রহর; হাতে স্বাধীন দেশের পতাকা, বুকে স্বস্তির নিশ্বাস।

অলস সকাল, দিনভর অগ্নিঝরা ভাষণ
স্বাধীনতার সুর ক্ষণে ক্ষণে মর্মে উঠে বেজে,
হাতে প্লে কার্ড, মাথায় লাগানো লাল-সবুজের পতাকা
মন দুলে উঠে বিজয়ের সুরে, উদ্দেলিত হয় তেজে।
বৃদ্ধ যুবা সবার কাছে এক অভিন্ন আবেশ, অভিন্ন আবেগ
স্বাধীনতা প্রাপ্তির নিগুঢ় আকুতি,
এই যে এক অন্যরকম বিজয় অনুভূতি।

দেখেছি আগের রাত্রের প্রজ্জ্বলিত ফানুস, আতশবাজি
আর কান ফাঁটানো পট্কার শব্দে শহর গেছে ছেয়ে,
কামান, মর্টারের মূর্হমুহ ধ্বনি যেন কানে আসে ধেয়ে ।
ছাদে দাঁড়িয়ে কিশোর-কিশোরী দেখে ঝলমলে আলো
একটির পর অন্যটি দেখার অপেক্ষণে;
বৃদ্ধ দাদু ভয়ে আঁতকে উঠে নিজের স্মৃতিচারণে।

কনকনে শীতের রাত্রের বাঁশঝাড়ে লুকানো; দূর্গম কন্টকাকীর্ণ পথ,
জোস্না ও জননীর গল্প শোনায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ঘুরে দাঁড়ানোর দৃপ্ত শপথ;
আজও তাকে তাড়া করে জোয়ান করে তোলে,
ফিরিয়ে নেয় লোমহর্ষক ইতিহাসে।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে লাল সবুজের পতাকা পানে
মেতে উঠে বিজয় উল্লাসে। 

২) ৭১ এর গল্প...

সাল ১৯৭১, দেশে চলছে যুদ্ধের দামামা,
সংঘর্ষ ক্রমে শহর থেকে গ্রাম গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে,
লোকজন জড়ো হয়ে কান পাতে রেডিওতে, পাড়া-মহল্লা জুড়ে।
উজ্জবীত হয়ে শোনে উচ্চ কন্ঠের সেই ভাষন,
মানুষের প্রাণে জাগতে থাকে আশার সঞ্চারণ।

মায়ের কন্ঠে এই কথাগুলোই উচ্চারিত হয়; নিজের ভাষায় তার;
মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনি কান পেতে; গল্প স্বাধীনতার।

বাবা মায়ের উৎকন্ঠা মেয়েদের নিয়ে উঠতি বয়সের,
খবর শুনে যদি, মিলিটারীদের এলাকায় আগমনের।
কলিজার পানি শুকিয়ে যায় গ্রামের মানুষের, ভয়ে,
তারা নাকি অতি হিংস্র ! কানাকানি করে সবে।
সাক্ষাত যমদূত, গুলি করে মারে জ্যান্ত মানুষ,
মা বোনদের সততা আব্রুতে  উড়ায় রঙিন ফানুস।

তখন বর্ষার শেষ দিক,
ধানের নৌকাগুলো বন্দরে পাড়ি জমায়,
নানা রকমের খবর; হাটে বাজারে বাতাসে ভেঁসে বেড়ায়।
জীবনের নিশ্চয়তা নেই বৃদ্ধ যুবক, নারী পুরুষ করোরই,
তাইতো বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন নিজের গ্রামকে;
ছোট ব্রীজ কালভার্টগুলো ভেঙ্গে নিজেরাই।

আগামী কাল মিলিটারীর হানা পড়বে এই গ্রামে;
সবাই সতর্ক, যুবতী মেয়ে, নব বধূদের সরিয়ে নিতে হবে।
ভোর বেলায় ধানের নৌকায় গাদাগাদি করে উঠে বসে;
নৌকা ছাড়ে অন্য কোন গ্রামের উদ্দেশ্যে।

নৌপথে মিলিটারীদের নৌকা দেখা যায় মুখামুখি; সবাই ভয়ে জড়োসড়ো!
বিচক্ষণ মাঝি, ধানের নৌকা বলে তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় অন্যত্র।

বেচে যায় মা বোনদের সম্মান, নিরাপদ হয় কত জীবন।
মনে হলে সেদিনের কথা; আজও মায়ের গায়ে জাগে শিহরণ । 

৩) স্বাধীন দেশ ও আমাদের প্রাপ্তি

স্বাধীন দেশের পতাকা পেয়েছি ঠিকই;
তাড়িয়েছে ভিনদেশী আগ্রাসন,
দূরীভুত হয়নি আজও শকুনের দৃষ্টি
শোষনে হয়নি ক্ষান্ত বিভীষন।

উর্দূ ভাষায় শোনতে হয় না গালি
হুমকি ধামকি, চোখ রাঙানি তাতে কি,
নিজ দেশী ভাষাও বুঝে আসে না
যখন দেখি আড়ালে ছল ছাতুরি, চালাকি।

যারা রক্ত দিল, সব হারাল
বিনিময়ে কি বা পেল তারা,
তাতেই বা কম কিসে, সার্বভৌম স্বাধীন দেশের
সান্তনা টুকু ছাড়া।

সেদিন, ঘরগুলো ছিল বন্দি শিবির
চেতনার নিঃশ্বাসে জুলুমের দখল,
‘কি পাব কি হারাব’- সেটা ছিল না মুক্তিকামীদের ভাবনায়
স্বাধীনতার নেশা ছিল যাদের প্রবল।

যাদের ঘর শূন্য হলো, স্বজন হারালো
তারা পেল নিছক সান্তনা,
চাওয়া এতটুকুই- ‘প্রজন্ম যেন শোষনে বঞ্চিত না হয়;
না পেতে হয় নিঠুর প্রবঞ্চনা।’

আর আমাদের অর্জন-
কথা বলার অধিকার ফিরে পাওয়া ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে’
ভিনদেশী শাসকদেরকে করা চিরতরে বর্জন।
নিজ দেশ, মায়ের মুখের ভাষা,
আপন জন নিয়ে নিরাপদে থাকার প্রত্যাশা।

পাখিরা মুক্ত মনে তোলে বিজয় ধ্বনি, ফুলেরা হাসে স্বাধীনতার হাসি
সবার মুখে একই কথা- ‘দেশকে ভালবাসি।’
ফসলি জমিগুলো হেসে উঠে স্বাধীন মাঠের কোলে,
অদৃশ্য শিকল ছেড়ে মুক্ত বিহঙ্গ ডানা মেলে উড়ে,
লাল সবুজের পতাকা উড়ে বাতাসে দোলে।

মো. সুমন মিয়া
ঢাকা, বাংলাদেশ