ভিন্ন জীবন - সুফিয়া ফারজানা
ভিন্ন জীবন - পর্ব ৯
সপ্তাহে দুই দিন ছুটি পায় ফারিন, শুক্রবার আর শনিবার। শুক্রবার সকালেই বাজারে যাওয়া নিয়ে বিশ্রী ঝগড়া হয়ে গেল হিমেলের সাথে। ফারিন বললো, "যাও, একটু মাছ বাজার থেকে ঘুরে আসো। সাবিত চিংড়ি মাছ খেতে চাচ্ছে অনেক দিন থেকে।"
"তুমিই যাও, ঘুরে আসো।"
"কেন? তুমি গেলে সমস্যা কি?"
"সব তো তুমিই করছো। পারো তো সবই।"
"পারতে হয়, তাই পারি। কাউকে না কাউকে তো পারতে হবে।"
"আমি আসলে মাছ-টাছ চিনি না, ফারিন। তুমিই তো বল, আমি বেশি দাম দিয়ে পচা মাছ কিনি।"
"তুমি পারো ঠিক কোনটা, বলবে একটু?"
"আমি আসলে কিছুই পারি না, ফারিন। সংসারে যেহেতু ফিনানশিয়ালি ইনভেস্ট করতে পারি না, তাই কিছু না পারাটাই হয়ত বেটার।"
ফারিন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ নাস্তা রেডী করলো, কড়া করে চা বানালো, বেশি করে দুধ আর চা পাতা দিয়ে। সবাইকে নাস্তা দিলো। নিজে খেলো শুধু এক কাপ চা। তারপর সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পরলো তাঁতের। ইদানীং শাড়ি পরা ভুলেই গেছে সে। আগে মাঝেমধ্যেই পরতো। ছুটির দিনে তো অবশ্যই। হিমেল শাড়ি খুব পছন্দ করতো। এখনও কি করে? কি জানি। এখন তো হিমেল আর তাকিয়েও দেখে না তাকে। দিনের পর দিন হয়ত একই ড্রেস পরে অফিস করে ফারিন। চুলে জট বেঁধে গেছে। সময় নিয়ে চুলটা আঁচড়ালো সে। খোঁপায় কাটা গুঁজে সুন্দর করে চুল বাঁধলো আজ অনেক দিন পর, অনেকটা সময় নিয়ে।
ফারিন অনেক দিন পর যেন অবাক হয়ে দেখলো, সে এখনও অনেক সুন্দর। তার বয়স যে তিরিশ পেরিয়েছে, সে যে দুটি সন্তানের মা, এটা কেউ বলে না তাকে দেখে। জীবনে কখনোই মেকাপ বা খুব বেশি সাজগোজ সে করে না। আজও শুধু একটু পাউডারের প্রলেপ বুলিয়ে নিলো মুখে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হল ফারিন, "নিজের কথা এবার ভাবো, ফারিন। অনেক তো হল অন্যের জন্য বাঁচা, এবার নিজের জন্য বাঁচো।।" নিজের মনেই কথাগুলো বললো সে। তারপর কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ বের হয়ে গেল বাসা থেকে।
আজ তার একবারও মনে হল না, হিমেল সারাদিন কি করবে, বাচ্চা দুটোই বা কি করবে ছুটির দিনে একা একা?? দুপুরে কি রান্না হবে, শাশুড়ি কি খাবেন, কিছু ই ভাবলো না আজ ফারিন। কাউকে কিছুই না বলে সে চলে গেল। কোথায় গেল, তা অবশ্য নিজেও জানে না সে।
কিছুক্ষণ রিকশায় ঘুরলো এলোমেলো। পার্কের বেঞ্চে একা একা বসে কাটালো অনেকটা সময়। তার আজ সবকিছুই অর্থহীন মনে হচ্ছে। সংসারে আসলে কেউই কারো নয়। আজ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সাবিত - সারাও তো জানতে চাইলো না, সে কোথায় যাচ্ছে। তাদের মা তো সারাদিন অফিসেই থাকে। মা কে ছাড়া ই তো থাকে তারা। মা কে ছেড়ে থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বাচ্চা দুটো। হিমেল সব দেখলো, কিন্তু কিছুই বললো না। কখনও, কোন বিষয়েই সে বলে না কিছু ইদানীং। শাশুড়ি অবশ্য শুয়ে ছিলেন নিজের ঘরে, খেয়াল করেননি হয়ত যে, ফারিন বাসায় নেই।
পার্কগুলো মেয়েদের একা বসার জন্য উপযুক্ত নয়। মানুষ অবাক চোখে তাকায়। মানুষের কৌতূহল ভাল লাগে না ফারিনের, অস্বস্তি হয়। হঠাৎ তার মনে হল, তার আসলে কেউ নেই, কোথাও কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে নেই। সারাদিন বাইরে থাকতে হয় বলে বাচ্চা দুটো এই বয়সেই কেমন দূরে সরে গেছে। হিমেল সব সময় বাজে বিহেভ করে। আজকাল তার কোন কথাই সহজ ভাবে নিতে পারে না হিমেল। প্রচন্ড হীনমন্যতা থেকেই কি এমন করে? নিজের অপারগতার দায় চাপাতে চায় আরেকজনের উপর? কি জানি, ফারিন বুঝতে পারে না, হিমেলের সমস্যাটা ঠিক কোথায়।
নিজে পছন্দ করে বিয়ে করার কারণে বাবা মা, ভাই বোনের সাথেও বিশাল দূরত্ব ফারিনের। আজকাল যোগাযোগও অনেক কমে গেছে তাদের সাথে। মানুষ কি আসলে শেষ পর্যন্ত একাই?? মানুষ একা আসে, একাই চলে যায়। একলা মানুষ মাতৃগর্ভে, একলা মানুষ চিতায়......শুধু মধ্যখানে কিছুটা সময়, একলা না থাকার অভিনয়।।
(চলবে)
সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ
-
গল্প//উপন্যাস
-
30-11-2023
-
-