অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
আমার জোনাক পোকা - রুমা বসু

জকে তোর সেই জোনাকি বুক পকেটে নিয়ে দুজনের আলপথ ধরে সন্ধ্যায় হেঁটে বেড়ানোর কথা খুব মনে পড়ছে। একহাতে আমার হাত ধরে আর অন্য হাত বুক পকেটের ওপর রেখে আলের ওপর দিয়ে ব্যালেন্স করে হাঁটার সেসব গোধুলী কোথায় মিলিয়ে গেছে! সেসব দিনের স্মৃতি যেন চিরকাল আমার মনের গহীনে জোনাকির মতই জ্বলছে নিভছে, কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে না। হয়তো জোনাকির মতই শুধু আমার মৃত্যুতেই ওরাও পন্চভূতে মিলিয়ে যাবে। তুই সেই যে ছোটো ছোটো ফুঁটো করা একটা কাচের বোতলে প্রতিদিন জোনাকি ধরে রেখে দিতি, সেটা এখনও আমার কাছে জীবনের সেরা কালেকশন মনে হয়। তোর পোকাদের যাতে কিছু না হয় সেজন্য কত খুঁজে সেই ছোট্টো ছোট্টো ফুটোর সে বোতল যোগাড়  করেছিলি। 

সেই ছোট্টোবেলা থেকেই তোর মত এমন কেয়ারিং কাউকে আমি আর দেখিনি। ভগবান যেন তোর ভেতরে সব রকম মায়া দিয়ে তৈরী করেছিলেন। বাগানের পিঁপড়ে থেকে রাস্তার কুকুর-বেড়াল সবার প্রতিই  তোর ভালবাসার ভান্ডার সব সময় পূর্ণ থাকত। কতবার যে  তুই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও উঁচু গাছে চড়ে, পড়ে যাওয়া কত পাখির ছানাকে রক্ষা করেছিস।আমাদের চলার পথের সব জীবজন্তু, গাছপালা যেন তোর পোষ্য ছিল। কী নিবিড় মমতায় তুই সবাইকে রক্ষা করতি, যত্ন করতি। 

কত মানুষ তোকে কত ব্যঙ্গ করত অথচ জীবনে কখনও তোর মুখ থেকে কোন কটু বাক্য বের হতো না। তোর ভদ্রতাকে সবাই তোর ভীড়ুতা, কাপুরুষতা ভাবত। তাতেও তুই কখনও প্রতিবাদ করিসনি। তুই জানিস না মানুষকে অত ভালো হতে হয় না। তুই তো দেবতা ছিলি না, অথচ আচরণ করতি দেবশিশুর মতই। তাই তো লোকে তোকে যীশুর মতো আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিত। 

আমি ছাড়া পুরো গ্রামে তোর কোন বন্ধু ছিল না জোনাক পোকা। তাও আমি তোর ভেতরে কখনও কোন ক্ষোভ দেখিনি। কেমন করে একটা মানুষ এত ভালো হোতে পারে, সেটা আমাকে কেন শিখিয়ে দিলি না! কীভাবে জোনাক পোকা তুই তোর কষ্টগুলো সারাজীবন আমার কাছ থেকেও লুকিয়ে গেছিস। মা শুধু সবসময় বলত- “তোমার জোনাক পোকাকে কিন্তু কখনও কষ্ট দিও না। ছেলেটার এমনিতেই অনেক কষ্ট।” আমি বলতাম, ওর কেন কষ্ট হবে? কাকু গ্রামের কলেজের সবচেয়ে ভালো অঙ্কের প্রফেসর, কাকিমা  আমাদের স্কুলে পড়াতেন, আর তুই ওনাদের একমাত্র ছেলে। কাকু কাকিমাকে লোকে কত শ্রদ্ধা করে, তাছাড়া কাকু-কাকিমাও তো তোকে কী ভীষণ ভালো বাসতো, তাই তোর কী কষ্ট সেটা তখন আমি বুঝতে পারতাম না।  তাইতো মাকে জিজ্ঞেস করতাম। মা আমাকে কখনও সত্য কথাটা বলেনি, শুধু বলতো যে গ্রামের বাচ্চাগুলো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে, তোকে ব্যঙ্গ করে কথা বলে তাই। কিন্তু তোর মতো এত ভালো একটা ছেলের সাথে সবাই কেন এমন করত সেটা মা কখনও বলত না। শুধু বলত বড়ো হও তখন সব বুঝবে।  আমি আর বড়ো হয়ে তোর কষ্ট ভাগ করে নিতে পারলাম না জোনাক পোকা। তুই আমাকে সে সুয়োগ দিলি না! তোকে যখন জিজ্ঞেস করতাম তোর কী অনেক কষ্ট আছে? তুই তখন হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতি যে তোর আবার কষ্ট কী! আমার মতো বন্ধু থাকলে নাকি কারো কোন কষ্ট থাকতে পারে না, শুধু আনন্দই আনন্দ। তুই আমার কাছেও মিথ্যে বলতে পারলি? তোর কষ্টটা কেন আমাকে বলিসনি? আমি কি সত্যি তোর বন্ধু ছিলাম?

তুই আর আমি প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যেতাম, আর স্কুল থেকে ফিরতাম। সেই ভয়াল দিনে, স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে তাও তুই আমাকে নিতে আসিসনি বলে আমিই গেলাম তোদের বাড়িতে, তোকে তুলে নিয়ে যেতে। সেই সকালে তোদের বাড়ির সামনে যেয়ে তোকে জোরে ডাকতে যেয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তোদের বাড়ির উঠোন ভর্তি লোক, সেখানে শুধু তুই নেই। 

জোনাক পোকা তোকে আমি, আমরা কেউ রক্ষা করতে পারলাম না। তোর ভেতরে এত কষ্ট ছিল অথচ তুই আমাকে আগের সন্ধ্যাতেও কিছুই বুঝতে দিলি না। জোনাক পোকা আমার সমাজ, আমার গ্রাম, আমার গ্রামের লোকেরা তোকে মেরে ফেলল। আমি কিছু করতে পারিনি। যে তুই একটা পিঁপড়ে পর্য্যন্ত মারতে পারতি না, সে কী করে নিজেকে মেরে ফেললি।জোনাক পোকা এর আগে আমি কখনও মৃত্যু দেখিনি, আর আমার দেখা প্রথম শব দেহটাই হলো আমার জোনাক পোকার। 

আমি আর এখন জোনাকি সহ্য করতে পারি না। তুই যাদের এত যত্ন করে, আদর করে বাঁচিয়ে রেখেছিলি, তারা কেউ তোকে ধরে রাখতে পারল না, এমন কি আমার বন্ধুত্বও না। জোনাক পোকা কেন তুই এত অভিমান করে চলে গেলি? জানিস এখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ইউনিভার্সিটির  টিচার হয়, ভালো চাকরী করে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। আমার মতো বন্ধুকে নিয়ে তুই তো তোর জীবনে এগিয়ে যেতে পারতি। কেন চলে গেলি জোনাক পোকা??? কেন? কেন? কেন?

রুমা বসু
অটোয়া, কানাডা