কির্তিকা - মোহাম্মদ হারুনূর রশীদ
হঠাৎ করে কেন যেন মনে পড়ল কির্তিকার কথা। তাও আবার প্রায় সত্তর বছর পর। কেন মনে পড়ল জানি না। আজকাল কেন জানি ভাবনায় এসে ভীড় করে এ বিশ্ব জগতের সৃষ্টির রহস্যগুলো। ভাবি এই মানুষ কূলের কথা। কত বিচিত্র জীবন নিয়েই না বেঁচে আছে প্রতিটি মানুষ এই ধরায়। এই মানুষ সৃষ্টির কথা ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল কির্তিকার কথা । তাও সেই সুদীর্ঘ সত্তর বছর পর।
কির্তিকাকে দেখেছি আমার বয়স শুরুর ক্ষণ থেকে প্রায় পনর ষোল বছর বয়স অবধি। আমার সেই বয়স অবধি আমরা ছিলাম ছোট একটা উপজেলা শহরে। সেই উপজেলাতেই থাকত কির্তিকা। বাবা কর্মরত ছিলেন ওখানটায়। আমাদের বাসা থেকে খানিকটা পথ পেরিয়ে আরও কিছুদূর হেঁটে গেলে একটা ধান ক্ষেতের পাশে ছিল একটা টিনের ঝুপরী ঘর। ওটা নাকি কোন এক সময় ছিল গরুর খোয়ার। তবে সেটা ছিল তখন পরিত্যক্ত। কির্তিকা ঐ ঝুপরি খোয়ার ঘরেই থাকত একাকি। সবাই কির্তিকাকে ডাকত কির্তিকা পাগলি বলে। পাগলিই ছিল কির্তিকা। সারাদিন বিড়বিড় করে কি যেন বলে যেত কির্তিকা। কেউ বোঝত না ওর বিড়বিড় করা কথা। কোথা থেকে কির্তিকা এসেছে কে ছিল ওর পরিবারে কোথায় থাকে ওর পরিবার কেউ জানত না। না খাওয়া রোগা পাতলা চেহারা নিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াত আপন মনে। ওর বযসটা ঠিক কত ছিল ধারনা করা ছিল কঠিন। তবে মনে হয় ত্রিশ এর দিকে ছিল হয়তো। কির্তিকার গায়ের রঙটা দেখলেই বোঝা যেত এক সময় চেহারা উজ্জ্বলই ছিল ওর। মাথায় ছিলো জট বাধা ঝাকরা চুল। এক চিলতে একটা শাড়ি কোন রকমে গায়ে জড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াত কির্তিকা। কি খেত কে জানে। কেউ কিছু খেতে দিলে খেতো। তা না হলে না খেয়েই হয়তো পড়ে থাকত একাকি ঐ খোয়ার ঘরে। লোকজন বলত খাবার জোগাড় যেদিন হতো না সেদিন মরা মুরগী কোথাও পড়ে থাকলে ওটাই খেত।
কির্তিকার ঘরে কোন বাতি জলতে দেখিনি কোনদিন। জলবেই বা কোত্থেকে? অন্ধকারের মাঝেই পড়ে থাকত। পাড়ায় ঘুরতে এলে দেখতাম পাড়ার ছোট ছেলে মেয়েরা কির্তিকা কির্তিকা বলে ছুটত ওর পেছনে। কির্তিকা হাতের কাছে যাই পেত তা দিয়ে তাড়া করত ওদেরকে। আর বাচচারা তাড়া খেয়ে হেসে লুটোপুটি যেত। আমি দেখে মজা পেতাম আর হাসতাম। আজ মনে হয় কি নিষ্ঠুর না ছিল আমার সেই হাসি। কেন হেসেছিলাম কির্তিকার কান্ড দেখে? কির্তিকা কারও বাড়িতে এসে উপদ্রব করতো না। চুপচাপ দাড়িয়ে তাকিয়ে থাকত। কেউ কিছু খেতে বা কিছু দিলে নিতো। না দিলে বিড়বিড় করতে করতে চলে যেত উদাস মনে।
কির্তিকার নামটা কেমন করে হলো কেউ জানত না। তবে বড় ছোট শিশু বৃদ্ধ সবাই ওকে কির্তিকা বলেই জানত। কির্তিকা কি কোন হিন্দু ঘরের মেয়ে ছিল? নামটা শুনে কেন যেন ওরকমটাই মনে হয়েছিল আমার যখন থেকে বুঝতে শিখেছি। কেউ জানত না ওর জাত ধর্ম। অদ্ভূত এ জগত। খড় কোটার মত কত শত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব সন্তানরা এভাবে শ্রেষ্ঠত্বের পাল উড়িয়ে সৃষ্টির মহত্ত্বতার জানান দিচ্ছে ভাবতে আশ্চর্য লাগে। তাই না?
এমনি করেই দিন আর প্রহর কাটছিল কির্তিকার। কির্তিকা তো একদিকে বলতে গেলে বলতে হয় ও ছিল আমাদের পাড়া প্রতিবেশী। কতটুকুই বা দূর ওর ঝুপরীটি? হেঁটে গেলে নিদেন দশ মিনিট। এই ছোট্ট এলাকায় বলতে গেলে সবাই একে অপরের বেশ ভাল ভাবেই পরিচিত। শুধু কির্তিকাই ছিল ছিন্নমূল আপনজনহীন অচেনা আজানা এক বাসিন্দা এখানকার। প্রতিবছর কত ঈদ পূজার সমারোহ চলে এখানটায়। ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রসাদ বিতরণ, উলু ধ্বনি, পাঠা বলি হয় পূজোতে মা দেবীর প্রসন্নতা লাভের আশায়। গরু ছাগলের গোশত বিলানো হয় ঈদ এলেই। জরদা ফিরনি পোলাও কোপতা কাবাবের সুঘ্রান ছড়ায় বাতাসে। পাড়া প্রতিবেশীরা একে অপরের বাড়িতে যায় বেড়াতে এই উৎসবের দিনগুলোতে। কিন্তু প্রতিবেশী কির্তিকার ঘরে কারোও পা পড়ে না। পূজোর দিন ঈদের দিন হয়তো কির্তিকার থালায় খাবার একটু বেশীই জোটে। কিন্ত পরদিন হয়তো আবার সেই মরা মুরগীর গোশতে উদর পুরতি হয় আমাদের পরশী কির্তিকার।
এমনি করেই দিন কাটছিল কির্তিকার।
হঠাৎ করে মনে হলো ইদানিং কির্তিকাকে পাড়ায় খুব একটা ঘুরতে দেখা যাচ্ছে না। একসময় সে উধাও হয়ে গেল। কিন্ত মনে হলো পাড়ায় এক ধরনের গুঞ্জন আর ফিস ফিস কথাবার্তা চলছে কির্তিকাকে নিয়ে। সবাই কি যেন বলছে। হঠাৎ একদিন কির্তিকাকে আবার দেখা গেল পাড়ায়। উচু একটা পেট নিয়ে কির্তিকা হাঁটছে। দরজায় গিয়ে গিয়ে খালি থালাটা বাড়িয়ে দিয়ে তাকিযে থাকছে ভাবহীন উদাস হয়ে। কেউ কেউ তাড়িয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে আর বলছে "কির্তিকা, তুই নষ্টা। দূর হ এখান থেকে।"
আমার বুঝতে দেরী হলো না কেন কির্তিকাকে দেখা যায়নি এদদিন। কেন কানাঘোষা আর ফিসফিস করছিল সবাই কির্তিকাকে নিয়ে। কির্তিকা খালি থালাটা বুকে চেপে উদাস মনে চলে গেল ধীরে ধীরে। কোথায় গেল জানিনে। হয়তো কোন মরা মুরগীর খোজে।
এরপর কির্তিকাকে দেখা যেত হঠাৎ হঠাৎ। পেটটা আগের চেযে আরও উচু হয়ে গিয়েছে এরি মাঝে। হাঁটছে খুব আস্তে আস্তে। কি খেয়ে বেঁচে আছে কে জানে। আমাদের পাড়ার মেয়ে কির্তিকা। আমাদের পরশী। কে এই সর্বনাশ করল কির্তিকার। পূজোর সানাই আর আজানের ধ্বনি আগের মতই চারিদিক ছাপিয়ে বাজছে প্রতিদিন। দেবতা আর বিধাতার ভক্তরা আগের মতই ছুটছে মন্দিরে মসজিদে বিধাতার প্রসন্নতা লাভে।
এপর বেশ কিছুদিন কির্তিকাকে আর দেখা যায় নি এ পাড়ায়। ঘরে কাউকে কির্তিকার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার মত সাহস ছিল না আমার। মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম হয়তো ঝুপরীটিতে ও মরে পরে আছে। কুকুর শেয়ালে খেয়ে নিয়েছে হয়তো। কদিন পর হঠাৎ পাড়ায় ছড়িয়ে গেল কির্তিকা মরে নি। ওর এক ছেলে সন্তান হয়েছে। কে কির্তিকার দেখভাল করল বা করছে কেউ বলতে পারল না। মনে মনে ভাবলাম বিধাতা কি কাউকে পাঠিয়ে করুণা করছে কির্তিকার? কিন্ত কেন? কি লাভ বিধাতার এই ছলাকলা করার? আমাদের পরশী কির্তিকার খোজ কেউ নিল বলে মনে হলো না। না কোন মোল্লা পুরোহীত না কোন দরবেশ দস্তরগীর।
বিধাতার স্তুতি গান আর মানবতার বন্দনার গীতগানে মুখরিত চারদিক। কিন্ত সেই মানবতার স্থান নেই কির্তিকাদের ঝুপরী ঘরে।
একদিন হঠাৎই কির্তিকা হাজির হলো পাড়ায় ওর নবজাত শিশুটিকে নিয়ে। ছোট বয়সী ছেলে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ওর বাচ্চাকে দেখার জন্য। বাবা মারা তেড়ে এলো আর চিৎকার করে কেউ কেউ বলতে লাগল "ওটা পাপ। ঐ বাচ্চাটাকে দেখিস নে। ঘরের ভেতরে যা।" কির্তিকাকে পারলে লাঠিপেটা করে ছাড়ে লোকজন।
কি করে বেঁচে ছিল কির্তিকা ওর সদ্যোজাতককে নিয়ে কেউ জানেনা। বন্ধুবান্ধবদের সাথে বা পরিবারে এনিয়ে কথা বলাও ছিল দুরূহ। বেশী উৎসাহ দেখালে আমাকে নিয়ে বন্ধু মহল কানাঘোষা শুরু না করে দেয় সেই ভীতিটাও ছিল।
কে বা কারা কির্তিকার ছেলের নাম বাজারে প্রচার করে দিল "খোয়ার" বলে। মানুষ বেশ মজাই পেল ও নামে। সেই থেকে কির্তিকার ছেলে খোয়ার নামেই পরিচিত হয়ে গেল পাড়ার সবার কাছে। আস্তে আস্তে খোয়ার আমাদের সামনে বড় হতে লাগল। ছিপছিপে রুগ্ন দেহটা নিযে মায়ের সাথে ঘুরে বেড়াত খোয়ার। বাচচারা খোয়ার খোয়ার বলে ডাকাডাকি করলে খোয়ার ওর মায়ের আচলে মুখ ঢেকে লুকিয়ে পড়ত। কির্তীকা ওকে আচল থেকে বের করে নিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরত। আর বিড় বিড় করে কি যেন বলে ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে খাবারের অন্বেষণে দ্বারে দ্বারে ঘুরা ঘুরি শুরু করত। খোয়ার একটু একটু কথা বলা শিখলেও ওর কথাও শুনা যেত বিড় বিড় করার মত। পুরনো একটা হাফ প্যান্ট পড়ে লজ্জা লজ্জা ভাব করে মার সাথে ঘুরে বেড়িয়ে সময কাটত ওর। আরেকটু যখন বড় হলো তখন পাড়ার ছেলেরা খোয়ার খোয়ার বলে ডাকলে খোয়ারও হি হি করে হেসে লুটোপুটি খেত আর তার সাথে কির্তিকাও হাসত। কির্তিকাকে কেউ কোনদিন হাসতে দেখেনি। খোয়ার যেন ওর হাসির হয়ে এলো ওর জীবনে। খোয়ারকে দেখলেই মনে প্রশ্ন জাগত কে ওর পিতা। সে কি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে খোয়ারকে? ঐ ছোট্ট না খাওয়া বুভূক্ষু ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিতে কি ইচ্ছের করে না ঐ লোকটার? আর বিধাতার? খোয়ারের দায়ভার কার? ঐ লোকটারিই কি শুধু?
হঠাৎ করে আমার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ঢাকার এক আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিযে দিবেন। আমি তখন দশম শ্রেণীতে উঠেছি। তাই হলো। আমার চলে যাওয়ার সময হলো আমার চিরপরিচিত জায়গাটা ছেড়ে। চলেও এলাম একদিন। আমার চলে যাওযার কয়েকমাস পর আমার বাবা স্বপরিবারে চলে এলেন জেলা শহরে স্থায়িভাবে বসবাসের জন্য। আমার আর ফেরত যাওযা হলো না আমার সেই জন্ম স্থানে। আর সেই সাথে আর জানাও হলো না কেমন ছিল খোয়ার ওর মাকে নিয়ে। অনেকগুলো বছর পর কর্ম জীবনে একবার যাওযা হয়েছিল ঐ উপজেলা শহরে। কিন্ত কাউকে কির্তিকার আর খোয়ারের কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি কেমন ছিল ওরা এই বিগত বছরগুলোতে। অনেকটা দ্বিধাগ্রস্থ ছিলাম এ নিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করতে। তাই আর করা হয়নি। দেখলাম গরুর খোয়ারটা আর নেই ওখানটায়। ধরে নিয়েছিলাম কির্তিকা এতদিনে মরে গিয়েছে। আর ওর ছেলে খোয়ার? ও কি এখনও বেঁচে আছে? ও কি এখন বড়সড় একজন মানুষ? ও কি ওর বাবাকে খোঁজে পেয়েছে? একটু মাথা রাখতে পেরেছে ওর বাবার বুকে? বাবার বুকে মাথা রেখে কি বলতে পেরেছে "বাবা, তুমি কোথায় ছিলে এতদিন আমাকে ফেলে?"
আর বিধাতা? খোয়ারকে দেখে খোয়ারের সৃষ্টি কর্তার কি বুক কেঁপে উঠেনি? নাকি শেষ বিচারের দিনে ওর মাকে সহ খোয়ারকেও বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করাবেন বিধাতা? বিধাতা, আরাধ্যি তোমাকে। ক্ষমা করো দিনজনে!
মোহাম্মদ হারুনূর রশীদ
অটোয়া, কানাডা
-
গল্প//উপন্যাস
-
21-10-2023
-
-