অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
এদিকে জেলে জীবন - ইকবাল কবীর রনজু

রান্না ঘরটা গেলই নাকি! ঘরের ভেতর থেকে ঝুপ করে পাড় ভাঙার শব্দ শুনে অষ্টমীর মনের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে কথাগুলো। ক’দিন আগে ফাঁটল দেখা দিয়েছিল বলতে বলতে তড়িৎ গতিতে ঘর থেকে বেড়োয় সে। একবার মরা করতোয়ার দিকে একবার রান্না ঘরটির দিকে শৈন দৃষ্টিতে তাকায় অষ্টমী। না, রান্না ঘরটি যায়নি আবার বাঁকিও নেই। রান্না ঘরের পেছনের বেড়াটা ঠিক ঠাক থাকলেও খুঁটিগুলোর গোড়া বেড়িয়ে গেছে। অবাক, উদাস দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকায় সে। বছরের পর বছর যৎসামান্য করে ভাঙতে ভাঙতে মূল ভিটেটা এখন নিশ্চিহ্ন হওয়া বাঁকি।

বাড়িটার নদীর পাশ বরাবর বেড়া দেওয়ার সক্ষমতা হয়নি অষ্টমীদের। নিখিলের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া পাঁচ কাঠার ভিটেটার প্রায় তিন কাঠার মতো ইতিমধ্যেই বিলীন হয়েছে নদী গর্ভে। সুফল ভোগি প্রাপ্যতা ও জীবন জীবিকার জন্যই নদী সংলগ্ন বাড়িতে থাকতে হবে তাদের। তাই বাধ্য হয়ে থাকতেই হয়। এছাড়া অন্য উপায়ও যে নেই। তার জীবনে তো আর ভিটে মাটি কেনার সাধ্য হলো না।

চুলো থেকে পোড়া মাটি তুলে দাঁত মাজছে অষ্টমীর স্বামী নিখিল। বেপরোয়া ছেলেটা সাত সকালেই জলে নেমেছে অষ্টমীর মুখে এ কথা শুনে পোড়া মাটির হলুদাভ গুড়ো মিশ্রিত মুখের লালা পানের পিকের মতো ফেলে নদীর দিকে তাকায় নিখিল। ছাওয়াল দহে সাঁতরে বেড়াচ্ছে নিখিলের ছেলে কার্তিক। নদীটির অপেক্ষাকৃত গভীর এ অংশে নামতে পরিবারের বারণ থাকলেও কে শোনে কার কথা। এ নদী যেন এখনই কার্তিকের নখ দর্পণে। যেন কিছুই হয়নি এমন মনোভাবে বদনার পানিতে হাত মুখ ধুয়ে সকালের খাবর খায় নিখিল। ভোড় রাতে নিজের খড়া জাল ধরে যে সামান্য মাছ পেয়েছিল সেগুলো বিক্রি করতে পার্শ্ববর্তী মির্জাপুর হাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে।

গ্রামে খেলার মাঠ নেই, ফাল্গুন-চৈত্রে পানি শূন্য করতোয়ার ধূ ধূ বালুচরে ফুটবল খেলে কার্তিকরা। গারোয়ানদের গরু মহিষের গাড়ি চলে করতোয়ার বুকে। নদীর বুকে লতাগুল্ম জন্ম নেওয়ায় করতোয়া হয়ে ওঠে পশু চারণ ভূমি।

বাৎসরিক চক্রে বৈশাখ-জৈষ্ঠে নদীর তলদেশ দিয়ে জোয়ারের পানি যখন সাপের মতো কিলবিল করতে করতে প্রবেশ করে তখন নদীর দু পারের ছেলে মেয়েদের মধ্যে হৈ হুল্লোরের ধুম পরে যায়। এসময় করতোয়ার তলদেশের চৌচির মাটি দুধে ভেজানো চিতা পিঠার মত তুলতুলে নরম হয়। গ্রামের ভূমিহীন শ্রমজীবি মানুষেরা আশা নিয়ে করতোয়ার তলদেশে বোরো ধান আবাদ করে। কেউ এক বিঘা কেউ আধা বিঘার মত জায়গা সমান করে রোপন করে ধানের চারা। করতোয়া কিন্তু মাঝে মধ্যে নিরাশ করে তাদের। কোন কোন বছর জৈষ্ঠে কিশোরী করতোয়া তার পেট পিঠে লাগানো পাকা বোরো ধান রাক্ষসের মতো গ্রাস করে।

আষাড়-শ্রাবনে উজানের ঢলের ঘোলা পানি নদীতে পরলে নদীর সে স্রোতকে গ্রামের তন্বী কিশোরীর চঞ্চলতার আবেগে ছুটে চলার মতই মনে হয়। মনে হয় করতোয়া কৈশর পোড়িয়ে যৌবন ছুই ছুই করছে। এসময় থেকে পরবর্তী কয়েক মাস নদীর বুকে সাঁতরে বেড়ায় কার্তিক ও তার সমবয়সীরা। নদীর তলদেশের কাদা-মাটি তুলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে ওরা বড় হচ্ছে। পানিতে ওদের কোনও ভয় নেই।  শ্রাবণে চিনাভাতকুর গ্রাম ও তার আশপাশ এলাকায় অষ্টাদশী করতোয়া তার বক্ষে ধারণ করে পূর্ণ যৌবন।

কথিত আছে দূর অতীতে এ নদীতে কুমিড় আসতো, শ্বুশুক আসতো। শ্বুশুক তাড়িয়ে তাড়িয়ে মাছ ধরতো, প্রচুর স্রোত হতো। নাইওরে যাবার সময় কোন এক গৃহবধুর ছাওয়াল নৌকা থেকে পড়ে স্রোতের পাকে তলিয়ে প্রাণ হারায়। কিছু সময় পরে ছাওয়ালটাকে যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে ভাটিতে ঠেলে দেয়। সেই থেকে মুখে মুখে এ দহের নাম হয় ছাওয়াল দহ। এও কথিত আছে শত শত বাঁশ একত্রে বেঁধে বৃহত আকারের বাঁশের ভেলা তৈরী করে ব্যবসায়ীরা এ নদী হয়ে ভাটি অঞলে নিয়ে যাওয়ার সময় ছাওয়াল দহের স্রোতের পাকে ঘুরপাক খেত। এক সময় মনে হতো কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে বাঁশের ভেলা দ্রুত ভাটিতে ঠেলে দিল। এ স্থানে এসে প্রায় সকলেই প্রাণ সংশয়ের আশংকায় থাকতেন। এ এলাকা অতিক্রম করার সময় নাইওরের নৌকার নারী পুরুষ স্মরণ করতেন সৃষ্টি কর্তাকে। বংশ পরম্পরায় লোক মুখে এসব কথা শুনে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। এখন সারা বছর নদীটি স্রোতস্বিনী না থকলেও ছাওয়াল দহ সকলের ভয়ের কারণ হয়েই রয়েছে। ভয় থাকলেও, জীবনের ঝুঁকি থাকলেও পেশার খাতিরেই ছাওয়াল দহের গভীর তলও নিখিলদের বাপ দাদাদের ছুইতে হয়েছে; নিখিলরা ছুইছে, হয়তো কার্তিকদের ছুইতে হবে। কেননা মাখন চেয়ারম্যানের মতো, এই সমাজের বড় বড় গভীর জলের মানুষের মতো বড় বড় রুই কাতলাও গভীর পানিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে কার্তিকদের ভাল থাকা মন্দ থাকা।

ভরা ভাদরে বাতাস তাড়িত ঢেউ যখন জলমগ্ন করতোয়ার দুই তীরে আছরে পরে তখন গ্রামের গরীব পরিবারের বিয়ে না হওয়া স্বাস্থবতী অষ্টাদশী ললনার হেটে যাওয়া নিতম্বের নান্দনিকতাকেও যেন হার মানায়। আগের চেয়ে আরো বেশি ফুলে ফেঁপে ওঠে করতোয়া। নদীর পাড়ে বসে গৃহস্থের পাটের আঁশ ছড়িয়ে দিয়ে মাজায়, মাথায় ভেজা পাটকাঠি নিয়ে বাড়ি ফেরে নারীরা। পাটের পঁচা আশের গন্ধ অন্য অনুভূতি গুলোর সাথে মিলে মিশে যেন একাকার হয়ে যায়।

আশ্বিনে নতুনকে স্বাগত জানাতে কিছু কালের জন্য করতোয়ার দুই পাশের কাশবন ছেয়ে যায় শ্বেত শুভ্র ফুলে। মৃদু বাতাসে দোল খেয়ে জানান দেয় অপরুপ সৈন্দর্যের। পার্শ্ববর্তী বিল জলাশয় গুলো জলমগ্ন থাকায় করতোয়া পাড়ে, রাস্তার ধারে নেচে বেড়ায় ঝাঁক ঝাঁক ফরিঙের দল। কার্তিকরা পাটকাঠির মাথায় জিওলের আঠা লাগিয়ে কাশবনে সন্তর্পণে মেতে ওঠে লাল, হলুদ, সবুজ, সোনালী রঙের ফরিঙ ধরায়।

নিখিলদের টাকা না থাকায় চৈত্র-বৈশাখে মাখন চেয়ারম্যান টাকা খাটিয়ে নিখিলদের মৎসজীবি সমিতির অনুকূলে করতোয়া নদী সরকার থেকে ইজারা নেয়। সমিতির নামে ইজারা নেওয়া হলেও মালিক বনে যান মাখন ও তার সাঙ্গ পাঙ্গরা। নদী পাড়ের নিখিলদের মতো জেলেদের সুফল ভোগি হিসেবে সুফল ভোগ করার কথা কাগজে কলমে লেখা থাকলেও সুফল বঞ্চিত হয় তারা। প্রকৃত সুফল ভোগ করে মালিক বনে যাওয়া অমৎসজীবি মাখন গং বা তাদের মতো অন্যান্যরা। জাল যার জলা তার এ নীতি বাক্য হারিয়ে যায় কর্তার গাই কেতাবে আছে গোয়ালে নাই এ প্রবাদ বাক্যের কাছে।   

আশ্বিনের শেষ থেকে অগ্রহায়ন পর্যন্ত উজানের বিলের পানি করতোয়া হয়ে বিদায় নেয়। এসময় কিছু দিনের জন্য কদর বাড়ে নিখিলদের। জীবন যাপনের সংগ্রামে প্রকৃত মৎসজীবি নিখিলদের টিকে থাকা যখন অনিশ্চয়তায় নিপতিত এমন সময় সমাজের বিত্তবানরা, মাখন গংরা নিখিলদের শ্রমকে অল্প পয়সায় কিনে করতোয়ায় স্বোতী জাল পেতে মাছ সংগ্রহ করিয়ে নেন। নিখিলদের জাল দড়ি ব্যবহার করে ধরা মাছ বিক্রির টাকায় বিত্তবানরা ইটের উপর ইট গাঁথলেও নিখিলদের ভিটের মাটি চলে যায় করতোয়ায়। মাছ ধরা যাদের প্রকৃত পেশা, পৈতৃক পেশা তারা মাখনদের মাছ ধরে দেয়, বিনিময়ে জোটে কিছু দিনের অন্ন।

চুলোর অদূরে দাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে পড়নের ভেজা হাফ প্যান্ট চিপছে কার্তিক। প্রায় দুপুর নাগাদ জলে নেমে থাকায় ওর হাত পায়ের চামড়া সাদা হয়ে কুচকে উঠেছে। চোখ দুটো লাল টক টক করছে। গাবের চাড়িতে সুতোর জাল ভেজাতে ভেজাতে আড়চোখে ছেলের দিকে তাকায় অষ্টমী। হাতের কাজ টুকু শেষ করে সে যখন ছেলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে শাড়ির আচল দিয়ে পরম মমতায় মাথা মুছে দিচ্ছিল এমন সময় মাখন চেয়ারম্যানকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে অস্বস্তি বোধ করে অষ্টমী।

গত বছর থেকে এই লোকটাকে দেখলেই ভয় লাগে তার। যতবারই লোকটার সাথে অষ্টমীর দেখা হয়েছে ততবারই তার মনে হয়েছে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়ষ্ক গরীব এই জেলেনীর মধ্যে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করে সে। লোকটার লোলুপ দৃষ্টি যে বার বার অষ্টমীর বুক ভেদ করে তা অন্য কারো নজরে না পরলেও অষ্টমীর নজর এড়াতে পারেনি। এসময় অষ্টমীর বুকের ভেতর যেন ভয়ে ছ্যাৎ করে ওঠে। তার পরও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে লোকটার মুখোমুখি হতে হয়েছে অষ্টমীকে, হয়তো ভবিষ্যতেও মুখোমুখি হতে হবে।

গত বছর কার্তিকে নদীতে একটানা বেশ ক’দিন অপেক্ষাকৃত বেশি মাছ হচ্ছিল। রুই, কাতলা, বাইম, টেংড়া, শৈল, টাকি, ফাতাসি কত মাছ। সে সময় জিড়ানোর মত সময় ছিল না নিখিলের। ভেজা জাল টানতে টানতে হাতে থ্যাক থেকে সাদা ঘা হয়ে গেছিলো নিখিলের। খুব চুলকাতো তাই এ থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে সন্ধ্যা রাতে বাড়িতে চুলোর পাশে বসে পাটকাঠি পুড়িয়ে পাওয়া কষ যুক্ত ধোয়া নিচ্ছিল হাতের থ্যাক থেকে ঘায়ে। রাত আটটার দিকে ঘাটে বাঁধা ডিঙি নৌকা নিয়ে ও চলে যায় বাড়ির অদূরের স্বোতী জালের কাছে। জ্বরে কার্তিকের গা পুড়ে যাচ্ছিল। মাঝে মধ্যে ভুল প্রলাপ বকছিল। অষ্টমী মাথায় জলপট্রি লাগিয়ে দেওয়ায় কার্তিকের শরীরের তাপ কমে আসে। রাত এগারোটা নাগাদ লোকজনের হৈ-হুল্লোরে জেগে ওঠে সাড়া পাড়ার মানুষ। কি হয়েছে জানতে ঘর থেকে বেড়িয়ে এক পা দু পা করে এগুতেই অষ্টমী জানতে পারে স্বোতী জালের সামনে নৌকা ডুবেছে।

একটু এগিয়ে শ্মশান ঘাটের দিকে যায় অষ্টমী। স্বোতী জাল কেটে দিয়ে নৌকা বের করে দিয়েছিল নিখিল ও তার সহযোগিরা। ওরা যে যার মত পারে দ্রুত সটকে পরছিল। একটা ডিঙি নৌকা এগিয়ে আসে অষ্টমীদের ঘাটের দিকে। নিখিলকে চিনতে পারে অষ্টমী। অষ্টমীর গলার আওয়াজ পেয়ে শ্মশান ঘাটেই নৌকা থামায় নিখিল। পাক কাদা মাড়িয়ে অষ্টমীর কাছে এসে ক্ষণকাল দাঁড়ায় সে।
-কপালে কি আছে কে জানে! 
-কেমন করে এসব ঘটল?
-একটা নৌকা উজানে যাচ্ছিল। স্বোতীর সামনে গিয়ে হালে পানি মানেনি। পাতাল হয়ে যায় নৌকাডা। স্রোতের বেগে কুলোতে না পেরে স্বোতীর পাশের বাঁশের বেড়ায় ঠেকে, শেষতক কাত হয়ে ডুবে যায়। জাল কেটে কুটে কোন রকমে বের করে দিয়েছি। 
-আর এক মুহুর্ত দেরী নয়। বাড়ি চল, বলেই হাটতে শুরু করে অষ্টমী। কথা না বাড়িয়ে অষ্টমীকে অনুসরণ করে নিখিল। 

এ বাড়ি ও বাড়ির উপর দিয়ে নিজের বাড়ি পৌছে কাপর চোপর পাল্টে ছেলে ও বৌকে এক নজর দেখে আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরে নিখিল। দুঃশ্চিন্তা গ্রাস করতে থাকে অষ্টমীকে। পর দিন সকালে তিন কিলোমিটার ভাটিতে দুইটি লাশ ভাসতে দেখে থানায় খবর দেয় এলাকাবাসী। মাঝি ও তার সহযোগির পরিচয় সনাক্তের পর হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্বজনরা। মাস খানেক পালিয়ে থাকার পর শেষতক ধরা পরে নিখিল। পুলিশ হত্যা মামলার অভিযোগে আদালতে সোপর্দ করে নিখিলকে।

নিখিলের পরিবারকে সহায়তার জন্য মাখন চেয়ারম্যান চাল ডাল পাঠিয়েছিল। নিখিল জেলে যাওয়ার পর আগের চেয়ে এ পরিবারের বেশি খোঁজ খবর রাখা শুরু করে মাখন চেয়ারম্যান। হুট হাট করে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে চলে আসে যখন তখন। এরই মধ্যে জেল খানায় নিখিলের সাথে দেখা করেছে অষ্টমী। উকিলের সাথে কথা বলেছে। জামিন ধরেছিল, হয়নি। সঞ্চয় তো নেই, কি দিয়ে জামিন করাবে? নানা দুশ্চিন্তা গ্রাস করে অষ্টমীকে।

নিখিল যখন জেল হাজতে সে সময়ের এক রাতের কথা এখনো ভোলেনি অষ্টমী। কেউ না জানুক অষ্টমী তো জানে সেই রাতে এই চরিত্রহীন লোকটা কতটা জবর দস্তি করেছিল তার সাথে। সমাজ, সংসারের ভয়ে অষ্টমী আজও না পেরেছে কাউকে কিছু বলতে, না পেরেছে ভুলতে। আর কোন দিন ভুলতে পারবে বলেও মনে হয়না। অষ্টমী তখন সাত মাসের গর্ভবতী।

সে রাতে অষ্টমীদের ঘাটে একটা নৌকা এসে থামে। ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দ শুনে উঠানে এসে দাঁড়ায় অষ্টমী। নৌকা থেকে নেমে উঠানে এসে দাঁড়ায় মাখন চেয়ারম্যান। 
-নিখিলের জামিন করাতে হবে।
- জামিন করানোর কথা শুনে কিছুটা ভরসা পায় অষ্টমী।

একটা চেয়ার আনি বলে ঘরের দিকে এগোয় অষ্টমী। ও ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মাখন চেয়ারম্যান ঘরে ঢুকে দড়জা আটকে দেয়। কার্তিক ততক্ষণে ঘুমিয়ে পরেছে। ঘরে ঢুকেই লোকটা হায়েনার মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। কিশোর ছেলেটি জেগে উঠতে পারে  এ আশংকায় অষ্টমী চেঁচামেচিও করতে পারে না। গায়ের জোড়েও লোকটার সাথে পেরে ওঠে না সে। লোকটা যখন তাকে খুবলে খাচ্ছিল তখন বারবার নিখিলের কথা মনে পরছিল অষ্টমীর। নিখিলের মুখ ভেসে উঠছিল চোখের সামনে।

অষ্টমীর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় নিখিল। অষ্টমী যখন ডাগর হয়ে উঠছিল, সে সময় নিখিলের দমে মুগ্ধ হয় সে। এ পাড়া-ও পাড়ায় বাড়ি। জাত পাতেও মিল আছে। কুমির দেবতাকে খুশি করতে সেবার পৌষ অমাবশ্যায় নিখিলরা যখন প্রায় শুকিয়ে যাওয়া করতোয়ার পাড়ের বটতলায় কুমিড় পূজার আয়োজন করেছিল পিসি কাকীমাদের সাথে সেখানে কুমির পূজা দেখতে গিয়েছিল অষ্টমীও। ঠাকুর যখন মন্ত্র জপছিল, সবাই যখন প্রতিকী মাটির কুমিরকে খুশি করতে তার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করছিল এমন সময় সুঠাম দেহের অধিকারী নিখিলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল অষ্টমী। নিখিলের চোখের পলকও পরছিল না। সেদিন অল্প সময়ে যেন চোখে চোখে অনেক কথা হয়ে যায় ওদের।

ক’দিন পরেই নিখিলের বিরেণ কাকা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। মাঘের মাঝামাঝি সবার সম্মতিতে বিয়ে হয় ওদের। জেলে পাড়ার রাস্তায় যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় বর ও বরযাত্রীদের  সাথে নব বধূ অষ্টমী জলশূন্য করতোয়ার বুকের পাক কাদা মাড়িয়ে হেটে এ বাড়িতে এসেছিল। সেই থেকে সুখের সংসারে টানাপোড়েন থাকলেও শান্তির কোন অভাব ছিল না। নিমিষে এসব দিনের কথা মনে পরে অষ্টমীর।

সে রাতে মাখন চেয়ারম্যান আনন্দে বেড়িয়ে যায় বটে কিন্তু এর জ্বালা ভোগ করতে হয় অষ্টমীকে। পরের দিন নিখিলের জামিন হয়। দু দিন বাদেই অষ্টমীর শরীর থেকে রক্ত ঝড়তে শুরু করে। সব বুঝতে পারে অষ্টমী। ভয়ে তার চোখ মুখ শুকিয়ে যায়। মাখন চেয়ারম্যানের জবরদস্তির কথা গোপন করে স্বামীকে শুধু রক্তপাতের কথা খুলে বলে সে। অষ্টমীকে আমজাদ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় নিখিল। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমজাদ ডাক্তার বুঝতে পারেন পেটের সন্তানটি মৃতাবস্থায় আছে। দ্রুত উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দেন তিনি। এও বলেন, দ্রুত অস্ত্রপোচার না করালে  অষ্টমীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পরবে। যেন আকাশ ভেঙ্গে পরে নিখিলের মাথায়, হাতে তার একটি  টাকাও নেই। কি করবে এখন এ চিন্তা অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে তাকে।

অষ্টমীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। চাপ চাপ রক্ত ভাঙতে থাকে। অন্য কোন উপায় না থাকায় মাখন চেয়ারম্যানের দারস্থ হয় নিখিল । আগামি বর্ষা মৌসুমে স্বোতী জালে মজুরী খেটে ধারের টাকা শোধ করে দিবে এমন প্রতিশ্রুতিতেও মন গলে না মাখন চেয়ারম্যানের। সেদিন খালি হাতে  ফিরে এসে বড় বেদনা নিয়ে নিখিল তাকে কথাগুলো বলেছিল। কাকীর কাছে বীরেন কাকা অষ্টমীর কথা শুনে নেউতিগাছার মোকছেদ কবিরাজের সন্ধান দেন। নিখিল অষ্টমীকে মোকছেদ কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। তার ওষুধ খেয়ে খালাস পায় অষ্টমী। তথাপিও প্রায় দেড় মাস ভোগান্তির পর সুস্থ হয় অষ্টমী। লোকটার দিকে তাকিয়ে মুহুর্তের মধ্যে সেসব দিনের কথা মনে পরে অষ্টমীর বুকের ভিতর হুহু করে ওঠে। 

মাছের খালি ঝাঁকা আর বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়িতে ঢুকে মাখন চেয়ারম্যানকে দেখতে পায়  নিখিল। 
-বাবুকে বসতে দেও নি?
-নিরুত্তর থাকে অষ্টমী।
-পানি কমতে শুরু করেছে রে নিখিল। স্বোতীর বেড়ার বাঁশ গাড়তে হবে।
-বাবু এখন এদিকে জেলে জীবন খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। জলমহালে প্রভাবশালীদের অনৈতিক, অযাচিত হস্তক্ষেপের কথা মুখ ফুটে বলতে না পারলেও এটুকু বলতে ছাড়ে না আপনাদের সাথে টাকায় কুলোতে পারছেনা মৎসজীবিরা। জলাশয় নিজেরা ইজারা নিতে পারেনা। অমৎসজীবিরা মৎসজীবি বনে যাওয়ায় প্রকৃত মৎসজীবিরা এ পেশা বাদ দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এর সাথে যোগ করে নিখিল বলে, এবার লোক বল সংকট তো আরো বেশি হবে। গনেশ এখন চুল কাটে, ভজন অটো ভ্যান কিনেছে, শিবু বৌ নিয়ে গার্মেন্স এ গেছে, শম্ভু জাল দড়ি বেঁচে  বসে আছে। কি করবে এখনো ঠিক করেনি, তবে মাছ ধরার কাজ যে আর করবে না তা বলে দিয়েছে।

ইকবাল কবীর রনজু, 
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, পাবনা, বাংলাদেশ।