মৌপিয়া - সঞ্জয় কুমার দাস
তেইশ বছরের উদ্ভিন্নযৌবনা মৌপিয়া, মেদিনীপুরের তমলুকের মেয়ে। চাকরির সূত্রে বাগুইআটির একটা দু-কামরার ফ্লাটে একাই ভাড়া থাকে। সেক্টর ফাইভ্ হ'লো কর্পোরেট্ জগতের প্রাণকেন্দ্র। সেখানেই একটা অফিসে চাকরি পেয়েছে, এই বছর দুয়েক হ'লো।
কথাবার্তায়-চালচলনে-অঙ্গভঙ্গিমায়-পোশাকে-দৈহিক গড়নে... সবদিক থেকেই যেন, সর্বশক্তিমান, মৌপিয়াকে কর্পোরেট্ জগতের আদর্শ ক'রে গড়ে তুলেছে। কিছুতেই বোঝার উপায় নেই যে মৌপিয়া গ্রাম্য জলহাওয়ায় সংপৃক্ত।
মৌপিয়ার অফিসের কাছেই একটা গ্যারেজ্। "On the Wheel" মালিক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত পরিমলবাবু। প্রধান মিস্ত্রী তথা অংশীদার, পরিমলবাবুর একমাত্র বি টেক্(অটোমোবাইল্) পুত্রসন্তান কিংশুক। বস্তুত কিংশুক কোন' কাজে অনুপস্থিত থাকলে, আর সকালে গ্যারেজে আসার আগের সময়টাই পরিমলবাবুর রামরাজত্ব। যদিও অটোমোবাইলের, 'অ আ ক খ' তিনি কিছুই জানেন না। তিনি আসলে বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র। চাকরি জীবনে, একটা বেসরকারি ব্যাঙ্কের চীফ্ ম্যানেজার ছিলেন। অফিসে যাতায়াতের জন্যই, মৌপিয়া একটা পুরনো স্কুটির সন্ধানেই সেখানে যায়। দরদস্তুর ক'রে পছন্দসই একটা স্কুটি পেয়েও যায়। সেই সূত্রেই গ্যারেজে যাতায়াত। যদিও মৌপিয়া পারতপক্ষে কিংশুক থাকাকালীন কদাচিৎ গ্যারেজে যায়। মাসখানেকের পরিচয়েই পরিমলবাবুকে 'বুড়ো' ব'লে ডাকে। "বুড়ো, আমার একটা কথাও শোনো না।"/"সারাদিন তো জলও খাবে না। এই নাও গেলো!"/"বয়স হ'লে অমন ভুলভাল হয়।"/"তোমার বাপকে তো বলতে পারো একটা হেল্পার রাখতে।"/"আসলে বুড়ো, তুমিই হাড় কিপটে!"... এমনই তার শাসন/অনুশাসন তথা আব্দারের চানাচুরি বহর!
~ বুড়ো, কী করো? কী আর করবে, মাছি তাড়ানো ছাড়া পারোই বা কী?
~ তাই বুঝি! তো জানিস যদি জিগাস কেন?
~ সেইইই... নাও, হাত পাতো। সকালে দক্ষিণেশ্বর-বেলুড়মঠ গিয়েছিলাম, পুজো দিলাম। বাবা-মা তো সেই তমলুকে, তুমিই প্রসাদ নিয়ে উদ্ধার করো।
~ তোর ঈশ্বরভক্তি আছে নাকি? দেখে তো মনে হয় না।
~ আরে ধ্যাৎ... ভক্তি না কচু। ক'লকাতার একটা দর্শনীয় স্থান, তাই...! জায়গাটা ভীষণ শান্ত! মনের অনেক অবোধ্য জটের উত্তর পাওয়া যায়! একটা অন্য দর্শন কাজ করে। মনে হয়, আমরা যত সামাজিক রীতিরেওয়াজ যাপন করি, তার সিংহভাগই মেকি! ওখানে, সময় যেন থমকে যায়। স্বামীজীর চোখের দৃষ্টি কী দৃপ্ত! যেন জীবনদর্শনের প্রশান্ত মহাসাগর! তার অতল গভীরতা! যেন "প্রখর তেজ তব নেহারিতে নারি!"
~ আরে, তোর হলো কী!
~ বুড়ো তুমি পরেশনাথের মন্দির দেখেছো?
~ না।
~ ধ্যাৎ... ক'লকাতায় থেকে বেলগাছিয়া যাওনি? কোন' কাজের নয়। কুঁড়ের বাদশাহ্... শোন' না...
~ বল্
~ একদিন আমাকে ভিক্টোরিয়ায় নিয়ে যাবে?
~ আমি?
~ তাই তো বললাম। কানেও কি আজকাল কম শুনছো?
~ আরে তা' নয়। ওসব জায়গায়, আমাকে মানায় না। তুই বরং কিংশুককে বল্।
~ আস্ত মাথামোটা! আজ চলি গো...
★★★ ★★★ ★★★
একা থাকার জন্য, সময় পেলেই মৌপিয়া একাই বেরিয়ে পড়ে। কখনও ভিক্টোরিয়া, কখনও প্রিন্সেপ্ ঘাট্, ক্যাথিড্রাল্ চার্চ্, তারকেশ্বর, কালীঘাট, নিমতলা, পরেশনাথ, জোড়াসাঁকো... টো টো ক'রে ঘুরে বেড়ায়। তা'বলে টোটো ক'রে নয়!
~ পিয়া, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
~ কেন গো, তোমাকে বুড়ো বলি বলে গোঁসা?
~ আরে সেটা বড় কথা নয়...
~ তবে? তুমি তো মরোনি, মরেছি তো আমি। তুমি প্রত্যাখ্যান করতেই পারো। তবে...
~ এ হয় না পিয়া। তোমার ফুলের মত তনুমন উপযুক্ত জায়গায় নিবেদন করো। আমি সম্পূর্ণ সমর্থন করবো।
~ জানো বুড়ো; "যার সাথে মজে মন, কী বা মুচি কী বা ডোম!" আমার চোখে তুমি পুরুষোত্তম। আমি নিজেকেও বহুবার প্রশ্ন করেছি। ভেবেছি তুমি ষাট, আর আমি তেইশ। নৃবিজ্ঞানের বা সমাজবিজ্ঞানের নিরিখে এই চাওয়া অমূলক। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলেও তো বিজ্ঞানেরই একটা শাখা আছে!
~ তুমি তো দেখছি জ্ঞানপাপী, পিয়া!
~ আচ্ছা, এছাড়া, তুমি কি কিছুই বোঝো না?
~ সবকিছু বুঝলেই মানতে হবে, এমন কথা কোথায় লেখা আছে? প্রতিটা চাওয়াপাওয়া তথা কাজের মধ্যে 'স্থান-কাল-পাত্র'-র বিবেচনা করতে হয়। নতুবা আশা-আকাঙ্ক্ষা তাজমহলের নিচে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে।
~ আমি ওসব শুনতে চাই না। আমার বুকে এসো প্রিয়। আমার যৌবনসাগরে অবগাহন করো, প্রিয়তম। নিবিড় আলিঙ্গনে আমাকে তৃপ্ত করো!
"আমার সকল রসের ধারা,
তোমাতে আজ হোক-না হারা!"
ডিং ডং... ডিং ডং... ডিং ডং... কলিংবেলের ঝনঝনানিতে মৌপিয়ার সাধের স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়! চেতন-অবচেতনের দরিয়ার মাঝে, সে তখন খড়কুটোর মত থরথর ক'রে কাঁপছে। ঘড়ির দিকে চোখ গেল। সকাল সাড়ে দশটা। আজ ছুটির দিন। তাই মানদাদি দেরিতেই আসে। ডিং ডং... ডিং ডং... "আসছি, আসছি" বলে মৌপিয়া, বিছানার চাদরে, কোন'রকমে নিজেকে মুড়ে দরজা খুলে, সোজা বাথরুমে। বাথরুমের প্রমাণ সাইজের আয়নায় নিজের স্বল্পবসনা শরীরটার দিকে নিজেই তাকাতে পারে না। ঘুমভাঙার ক্লান্তি তো দূর, দুধেআলতা টোল-পড়া গাল দু'টো টকটকে লাল হয়ে গেছে। নাহ্, আর তাকাতে না-পেরে নিজেই নিজের মুখ ঢাকে। মনে মনে গেয়ে ওঠে, "আজ দু'জনে, মন্দ হ'লে মন্দ কী!"
~ দিদিমুনি তোমার চা। কী রাঁধবো কও দিনি!
~ এক মিনিট! আসছি....
"ছুঁ না না ছুঁ না না, ছুঁ না না ছুঁ না না-
অব্ ম্যায় জওয়াঁ হো গয়ি!"
~ নাচ থামাও দিকিনি বাপু। কী রাঁধবো বলি দ্যেও!
~ নো রান্না মানদাদি। নো রান্না! আজ আমার সাথে পরেশনাথ যাবে।
~ ছ্যা করো। আমার ভাতার তোমার সঙ্গে কেন যাবে কও দিনি?
~ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ... আরে পরেশনাথ মন্দিরে যাবো, তুমি আমার সাথে যাবে। তোমার ইয়েকে কেন নিয়ে যাবো? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ...
~ সেটা আবার কোন মন্দির গো? বাপের জম্মে...
~ তোমার বাড়ি তো নাগেরবাজার?
~ হ্যাঁ। তাতে কী হলো?
~ মন্দিরটা বেলগাছিয়ায়। তবে জৈন মন্দির।
~ অহ্! যাই হোক, আজ তবে আমি চলি।
~ কাল সকাল সকাল এসো কিন্তু...
মাননীয় পাঠকপাঠিকাবৃন্দের জ্ঞাতার্থে:
মৌপিয়া, আসলে যতটা আদুরে, ঠিক ততটাই অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক, এক মানবিক সত্তা। অথচ নিজের অবচেতন মনে দ্বৈতসত্ত্বার স্বত্ত্বাধিকারিণী। সে নিজেও জানে না যে, পরিমলবাবুকে সে নিজে কী রূপে চায়! অথচ কিংশুকের প্রতি তার কোন' মোহ বা আকর্ষণ কিছুই নেই। অথচ সময়োচিত আবহে, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। আবার পরিমলবাবুর শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখাটাও যেন তার দায়বদ্ধতা! কারণ যাই হোক, সময় পেলেই পরিমলবাবুর সান্নিধ্য মৌপিয়াকে মুগ্ধ করে, তৃপ্ত করে, শান্তি দেয়। একটা বটবৃক্ষের মত আশ্রয় মনে হয়। তাকে পূজা প্রেম দুইই সমর্পণ করা যায়। কিন্তু ঠিক কোন সম্পর্কটা যে আঁকড়ে ধরবে সেটা নিজেও বোঝে না। চিকিৎসা শাস্ত্র কি এটাকে কোন' রোগ বলবে? নাহ্, সেটা আমিও জানি না।
~ কৈ গো বুড়ো? কোথায় গেলে? (স্কুটিটা দাঁড় করিয়ে লক্ করতে করতে, পাপিয়া হাঁক পাড়ে! কিন্তু গ্যারেজের দিকে চোখ পড়তেই। থতমত...) সরি! সরি!! আসলে আমি ঠিক...উনি কি নেই?
~ থাকবে না কেন? তবে বাড়িতে। মাকে নিয়ে কোথায় যেন যাবে... বলুন আপনার কী সেবা করতে পারি?
~ না না... এমনি এসেছিলাম। আজ তবে উঠি।
~ আমি বুঝি খুবই বোরিং? নাকি খুবই অকেজো?
~ আরে ছি ছি... তা কেন? আপনি তো দারুণ...
~ দারুণ কী?
~ দারুণ...দারুণ...মানে দারুণ কর্মঠ আর বুদ্ধিমান।
~ চা চলবে নাকি?
~ না, মানে হ্যাঁ। আপনার অসুবিধা না হলে...
~ আমার তো সৌভাগ্য। অসুবিধা কেন হবে?
~ তাই বুঝি?
~ বাবার মুখে আপনার অনেক গল্প শুনেছি।
~ আজ চোখে দেখলেন, তাই তো?
~ না, তা নয়। রোজই দেখি..
~ তা "গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প...!" হিঃ হিঃ হিঃ...এমন নয় তো?
~ হাসছেন? যদি তাই হয়, খুব কি দোষের?
~ দোষ/গুণ কে দেখছে? আমি তো মজা করছি।
~ এই দেখুন... এখনও নিজেদের নামটাই...
~ আপনি কিংশুক। আমি মৌপিয়া। স্কুটিটা কেনার সময়েই তো নামটা জানার কথা!
~ সব কাজ কি সময়মতো করা যায়?
বসন্ত আসতে তো বছর কেটে যায়!
সব কথা কি আর সমাদর পায়?
কিছু তো কথার কথাই রয়ে যায়!
~ আরে বাহ্! আপনি তো গোবরে পদ্মফুল।
মানে বলতে চাইছি; হাতুড়ি-শাবল-রেঞ্জ্ আর লোহালক্কড়ের মাঝে, সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপুত্র।
~ এটাও হয়তো ব্যাঙ্গ! আমি কিংশুক সেন। আপনার পদবী?
~ ডাকার জন্য বা পরিচিত হওয়ার জন্য একটা নামের দরকার। বংশ পরিচয় কোন কাজে লাগবে শুনি?
~ বংশ পরিচয় কেন হবে? পূর্ণপ্রাপ্তিও তো হ'তে পারে!
~ আমি মৌপিয়া ইয়াসমিন্।
~ মানে?
~ মানে আপনার ভালোবাসা; 'দে দৌড়'! হি হি হি...
~ সে সব বিতর্কের বিষয়। সেদিকে যেতে চাই না। কিন্তু আপনার হাতে বিপত্তারিণীর সুতো, গন্তব্যে মন্দির... একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এমনটা কল্পনা করাও কষ্টসাধ্য!
~ হ্যাঁ, আমার মা ওই সুতো পরিয়ে দিয়েছে। আমি মানে আমরা সাম্প্রদায়িকতা মানি না। আমাদের বাড়িতে আরতিও হয়, আজানও হয়। আমার বাবা, মৌলানা আজাদ। মুসলমান, শিক্ষক। মা, পিয়ালী আচার্য। হিন্দু, গৃহবধূ। আমি তেইশ বছরে তাঁদের ভালোবাসায় এতটুকু খামতি দেখিনি। সর্বশক্তিমান একমেবাদ্বিতীয়ম্। তিনি নিরাকার, সর্বব্যাপী। তাঁর কোন' রূপ নেই, আকার নেই। তাঁর ছায়া প্রতিটি সজীববস্তুর কায়ায়! শুধু অনুভব-বিশ্বাস-ভক্তি-প্রেমেই তাঁকে পাওয়া যায়। এ কথা গীতা, কোরাণ, বাইবেল, ত্রিপিটক, জেন্দাবেস্তা সবেই বলা আছে।
~ মৌপিয়া, আপনি আজকের দিনের বিস্ময়!
~ ধুসসসস...! ওসব কিস্যু না। আসল হলো জীবনবোধ। লালনফকির, সাঁইবাবা, গুরুগোবিন্দ, চৈতন্যদেব, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণদেব, সারদামণি হজরৎ মহম্মদ, মাতা মেরী... বাদ দিন।
~ না না, বলুন না। ভালো লাগছে।
~ ভালো লাগছে, শুধু শুনতে। কাজে করে দেখাতে গেলেই একগাল মাছি!
~ কীকরে ভাবলেন, আপনি একাই সব বোঝেন? আপনি তো একমেবাদ্বিতীয়ম্ নন! আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন। সবকিছু জেনে, শুনে, বুঝেই যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়াই...?
~ আজকের দিনে 'প্রকৃতবন্ধু' পাওয়া বা হওয়া, দুটোই মহার্ঘ। আজ বরং উঠি। বাড়িতে, মানে বাসায় ফিরতে হবে। নিদেন বাড়ানো হাতটার কথা তো ভাবতেই হবে।
এইরকমই যুক্তিতর্কের মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা চলে। তবে কিংশুক যতটা কম কথা বলে, মৌপিয়া ততটাই বক বক করে। কিংশুক তাতে মুগ্ধ! মৌপিয়া বিড়ম্বিত! পরিমল? নাকি কিংশুক? সে কাকে বেছে নেবে? আজ মৌপিয়া বুঝতে পারছে, কিংশুক তার প্রতি হৃদয়দৌর্বল্যে আচ্ছন্ন। অস্বাভাবিক/অন্যায় কিছু নয়! অন্যদিকে: শুধু স্বপ্নে নয়, পরিমলকে সে সত্যিই মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু সেটা তো 'সোনার পাথরবাটি'! প্রেম তো স্বর্গীয় নিষ্কাম। শরীর তো সেখানে গৌণ! আবার এটাও ঠিক; মৌপিয়া তো সন্ন্যাসিনী/জিতেন্দ্রিয় নয়! তবে কি সে নিজেই স্বাভাবিক নয়? ওর মন আর মগজ কিছুতেই সহমতে পৌঁছতে পারছে না! তখনই মানসপটে, কালো মায়ার ধূসর ছায়া জাল পাতে! কিংশুকের বাড়ানো হাতে নিজেকে সঁপে দিলে, পরিমলকেও হারাতে হবে না, আবার দেহমনও ব্রাত্য র'বে না। আদিপুরুষও তো বহুরূপেই বিরাজিত! তবে কি সে বহুগামিনী হ'তে চায়? তেমনও তো নয়! মৌপিয়ার মাথায় রক্তচাপ বাড়তে থাকে...শিরাগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে... কেমন একটা কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব...চেনা রাস্তা কেমন অচেনা লাগছে! স্কুটিটা কি বেলাগাম পাগলা ঘোড়া? নাকি' সবটাই স্বপ্ন দেখছে?
★★★ ★★★ ★★★
~ চোখ খুলবেন না মৌপিয়া। আপনি নিরাপদেই আছেন।
~ আমি কোথায়?
~ নার্সিং হোমের বিছানায়। ডাক্তার বলেছেন, "কোন' ভয় নেই। তবে চিকিৎসার দরকার আছে।" তমলুকে খবর দেওয়া হয়েছে। ওনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন।
~ আর উনি?
~ উনি মানে? আপনার পরিমলবাবু? তিনি ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। ওই তো এসে গেছেন। আপনারা কথা বলুন। আমি দেখি চাচা আর মাসীমা কতদূর...
~ বুড়ো, আমার কী হয়েছিল?
~ হয়েছিল তো অনেককিছু। তবে সেটা দশ/বারো বছর আগে। এখন একদম চুপ করে থাক্। বিশ্রামের দরকার।
~ আসসালামুয়ালাইকুম্...
~ নমস্কার! আসুন মৌলানা সাহেব, আসুন।
~ জ্বী! এ' হলো পিয়ালী, পিয়ার গর্ভধারিণী। আপনি নিশ্চয়ই...
~ পরিমল সেন। এ কিংশুক, আমার একমাত্র সন্তান। আর... এই তো ডক্টর মুখার্জীও এসে গেছেন।
সবাইকে বসিয়ে, ড: পি সি মুখার্জী:
গুড্ মর্নিং এভ্রি বডি। আমার পেশেন্ট মিস্ মৌপিয়া ইয়াসমিন্ ইজ্ নাও কমপ্লিটলি আউট্ অব্ ডেঞ্জার, বাট্ ব্যাডলি নিডস্ আ লং ট্রিটমেন্ট্। এই রোগটা চিকিৎসা বিজ্ঞানে 'ম্যালপার ডিসঅর্ডার্' নামে পরিচিত। মানে "মাল্টিপল্ পারসোন্যালিটি ডিসঅর্ডার", অর্থাৎ এখানে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে দুটো সত্তা জন্ম নেয়। অনেকটা যেন দুটো আলাদা মানুষ একটা শরীর ব্যবহার করছে। দুটো আলাদা ব্যাক্তিত্ব, দুটো আলাদা চিন্তাধারা, কিন্তু শরীর একটাই। ফলে রোগী চরম মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বলা ভালো তার নার্ভাস্ সিস্টেম্ সিদ্ধান্ত নিতে দেয় না। বেসিক্যালি, ইট্ ইজ্ আ মেডিসিনলেস্ ট্রিটমেন্ট্ প্রসিডিওর্। য়্যু মে কল্ ইট্ সাইকিয়াট্রিক্ অর মেন্টাল্ ট্রিটমেন্ট্, হুইচ্ ইজ্ ভেরি ভেরি সেন্সিটিভ্।
পাস্ট্ কেস্ হিস্ট্রি বলতে, এ্যাজ্ য়্যাম্ এ্যাওয়ার্, মিস্টার কিংশুক ইজ্ দ্যা রাইট্ পার্সন্ টু এ্যাসিস্ট্ হার। এনি মিসচীফ্ অর মিস্ বিহেভ্যিয়র্ অর মিস্ গাইডিং অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মে লীড্ হার টু আ ডেডলি এ্যাক্সিডেন্ট্ হুইচ্ মে কজ্ হার ডেথ্ অর ম্যাডনেস্। সো টেক্ কেয়ার অব্ মৌপিয়া এ্যাজ্ ওয়েল্ এ্যাজ্ ইওরসেলফ্। আসলে মৌপিয়ার মনে, পরিমলবাবুর প্রতি দুর্বলতা আর কিংশুকের আবেদন ক্ল্যাস্ করছে। আপনাদের যদি সমস্যা না থাকে, মানে এনি সোস্যাল্ অর ফ্যামিলিয়র্ অব্লিগেশান্ না-থাকে তবে...
~ আমরা বুঝেছি ডাক্তারবাবু। উই উইল্ ট্রাই আওয়ার বেস্ট।
~ থ্যাঙ্ক য়্যু অল্ ভেরি মাচ্। আর হ্যাঁ, কাল সকালেই পেশেন্টকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন।
সকালে সব্বাই নার্সিং হোমে এসেছেন। কিংশুকের মা, কণিকাদেবীও এসেছেন।
কিংশুক, একটা গোলাপের তোড়া মৌপিয়ার হাতে দিয়ে বলল, "ভালো থেকো।" পরিমলবাবু মাথায় চুমু দিয়ে বললেন, "বাড়ি গিয়ে বুড়োটাকে ভুলে যাস না কিন্তু। আমি পথ চেয়ে থাকবো।" মৌলানা সাহেব করজোড়ে বললেন, "আপনারা না-থাকলে পিয়াকে ফিরে পেতাম কি না জানি না। কে বলে মানবিকতা বন্দিদশায়? মানবিকতা আজও মুক্ত।" পিয়ালীদেবী বললেন, "চলুন দিদি, আপনার বৌমাকে আশীর্বাদ করবেন তো?" কণিকাদেবী একটা লাল টেডি দিয়ে বললেন, "তুমি বুদ্ধিমতী। তাড়াতাড়ি এসো।" কিংশুক ফোড়ন কাটে, "শাদা ভল্লুকের হাতে লাল টেডি, দারুণ মানিয়েছে।" মৌপিয়া তেড়ে ওঠে, "বুড়ো, তোমার ছেলেকে মানুষ করো বলে দিলাম। নতুবা কপালে দুঃখ আছে।" ড: মুখার্জী, সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করেন:
"Let the humanity may over come all the silly and inhumanic schools builded up in our mind."
সঞ্জয় কুমার দাস
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
05-06-2023
-
-