অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
আবার ঝুমতলি - সুলতানা শিরীন সাজি

তদিন পর আবার কুয়াশামাখা ভোর! ঝুমতলিতে দেখা হবার পর কেটে গেছে কত দিন! রেলষ্টেশনে রেলগাড়ি থামলো যখন, আকাশ তখন সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে। ষ্টেশন বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে ছবিতে দেখা পিওনগিয়ান ষ্টেশনতার কথা মনে এলো। প্লাটফর্ম এ এ নেমে সামনে এগোতেই দেখি তুমি এগিয়ে আসছো। লম্বা একটা ওভারকোট পড়েছো, মাথায়-কানে বাদুর টুপি। মনে ভাবি, দেশটা কি রাশিয়া হয়ে গেলো নাকি?

হাত বাড়িয়ে দিলে তুমি। হাতের উষ্ণতা ছড়িয়ে গেলো হৃদয় পর্যন্ত।
প্লার্টফর্মের এক কোণে বসলাম আমরা। দূরে চায়ের দোকান থেকে দু'কাপ ধোঁয়াওঠা চা আর একটা প্লেটে কয়েকটি বাকরখানি দিয়ে গেলো একটি কিশোর ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম আমি। অদ্ভুত মায়াময় এই মুখ আমি আগেও দেখেছি। নিমেষেই মনে পড়ে গেলো। এর সাথে দেখা হয়েছিল যেবার তোমার সাথে যেবার গৌহাটির সরাইঘাট ব্রীজ এর কাছে ষ্টিমারে এ দেখা হলো।
দোল পূর্ণিমার রাত ছিলো সেটা। একটা ছেলে জাহাজের ডেকে বসে অদ্ভুত সুন্দর বাঁশি বাজিয়েছিল।
বাঁশিবাদককে দেখবো বলে ওর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। মগ্ন কিশোর চোখ মেলে তাকায় আর নিমেষেই মাথানীচু করে চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল।
অবাক আমি ফিরে আসি কথাটা তোমাকে বলতে। অথচ কোথায় তুমি!

গতবার তোমার সাথে দেখা হলো প্যারিসের ডাউন টাউনে উইলিয়াম আর গ্রান্ড্ররিভার এর কর্ণার এর কফি শপটার কাছে। মন বলছিলে তুমি আসবে। রাস্তার পাশের একটা কফিশপের চেয়ারে বসে একটা স্কিনি ক্যাপাচিনোয় চুমুক।
বজ্যু মাদমোয়াজেল, চমকে তাকিয়ে দেখি তুমি।
তুমি কি ইলুউশনিষ্ট মুভ্যির নায়ক এর মতন ম্যাজিশিয়ান?
তোমার অদ্ভুত চোখের দিকে তাকালে কোন কথা বলতে পারিনা। অথচ কত প্রশ্ন, কত কৌতূহল! 
তুমি বলো, চলো হাঁটি।
তোমার পাশে হাঁটার সময় আমার খুউব ইউক্যালিপটাসের কথা মনে হয়।
তুমি জানতে চাও, সবুজ পাতার গন্ধ পাচ্ছো?
তোমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ঢুকে পড়ো একটা গিফট শপ এ।
আমরা অজস্র প্রজাপতির ভীড়ে হারিয়ে যাই। এই দোকানের সবকিছুতেই প্রজাপতির ছাপ!
একটা রুপালী ব্রেসলেট কিনি তোমার জন্য। তোমাকে দেবো বলে সারা দোকানে তোমাকে খুঁজি তন্ন তন্ন করে। কোথাও তুমি নাই।
অথচ পুরো দোকান জুড়ে  তখনো ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধ!

তুমি কি সত্যি কখনো ছিলে আমার সাথে অথবা তোমার সাথে আমি?
আমি কি তোমাকে চিনি অথবা তুমি কি আমার চেনা! এভাবে  কতবার তোমার সাথে লুকোচুরি দেখা হওয়া ক্ষণ।

দোল পূর্ণিমার বিশাল চাঁদটাকে দেখলেই তোমার কথা মনে পড়ে। অথবা ভীষন ভীড়ে মাঝে একলা হলে। মনে হয় তুমি আছো, কাছাকাছি কোথাও! হয়তো গীটার হাতে পথের ধারে দাঁড়িয়ে স্যাম হান্ট এর মত করে অদ্ভুত সেই গানটা "টেইক ইয়োর টাইম" গাইছো।

হয়তো একদিন ঝুম বৃষ্টি নেমেছে  বাফেলো শহরে। আমি সৌখিন পর্যটকের মত ঘুরছি। ছবি তুলছি। তুমি একমনে বসে কারো ছবি আঁকছো। যাযাবর মনটা এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার পিছে। আর তুমি পরিযায়ী পাখির মত উড়ছো এক আকাশ থেকে অন্য আকাশ!
হয়তোবা তুমি হেঁটে হেঁটে আমায় খুঁজছো নেপালের ভূমিকম্প বিধ্বস্ত কোন গ্রামে।
আর আমি অদ্ভুত সুন্দর শাদা ফুলের বাগান থেকে বের হয়ে আসছি। যেনো এখানে কোন বিপর্যয়ই ঘটেনি। আমি অবাক তাকিয়ে তোমাকে দেখছি। বৌদ্ধ ভিক্ষুর মত দেখাচ্ছে তোমাকে। আমি তোমার জন্য একগোছা সাদা ফুল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
বেঁচে থাকার অদ্ভুত খেয়ালীপনায় কেউ কেউ হয়তো এভাবেই বেঁচে থাকছি আমরা।
কখনো স্বপ্নতে, কখনো সত্যিতে, কখনো শাদা ফুল মূর্ছণায়!

সুলতানা শিরীন সাজি
অটোয়া, কানাডা