নৃত্যতীর্থ "নৃত্যকুঠি" - সঞ্জয় কুমার দাস
"এই, একটু কাছে এসো না!" কথাটা হয়তো তেমন বিশেষ কিছু নয়, তথাপি প্রায় বিশ/পঁচিশ বছর পর, এই কথাটাই, চেনা পরেশকে, মালবিকার কাছে অচেনা ক'রে তুলল।
মালবিকা। মালবিকা সেন(পাত্র)। আর পাঁচটা ঘরোয়া মেয়ের মতোই, নিজের বহু অপূর্ণ সাধ পূরণের আশা নিয়েই একান্নবর্তী সেন-পরিবারে বধূ হয়ে এসেছিল। নাহ্! মা-বাবার শাসনে/শিক্ষায়, আধুনিক স্কুলকলেজে পড়াশুনা করলেও, কারোর একান্ত ডাকে মালবিকা সাড়া দেয়নি। যদিও সেটা ঠিক? নাকি ভুল? আজও বুঝে উঠতে পারে না।তবে মা-বাবা ভীষণ খুশি এবং গর্বিত। তাঁদের মতে, "হয়তো বয়সের ফারাকটা একটু বেশি, তবে সোনার টুকরো ছেলে পরমেশ্বর।" ফলে নীরবে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল! মালবিকা, 'পাত্র' থেকে 'সেন' হলো। এই 'বয়সের ফারাক' আর 'পরমেশ্বর' নাম, কোন'টাই মালবিকার পছন্দ নয়। রাজপরিবার ছাড়া, ইতিহাসের কোন যুগে আর মানুষ বিবাহযোগ্যা কন্যার পছন্দ/অপছন্দের দাম দিয়েছে! ফলে মালবিকার বিবাহিত সোপানের শুরুতেই থেকে গেল, একটা অপছন্দের ধাপ! প্রথম রাতেই 'পরমেশ্বর' নামটাকে নিজের মতো ক'রে, অনুমতি নিয়েই, 'পরেশ' ক'রে নিয়েছে। আশা করলেও, মালবিকা, পরেশের 'মলি' হয়ে উঠতে পারেনি। সে গুড়ে বালি!
বদলির চাকরি সূত্রে পরেশ রাঁচিতেই থাকতো। যাদবপুরের মালবিকা শ্বশুরবাড়িতে সবার সাথে থাকতো সোনারপুরে। পরিবারের লোকজনের সাথে চেনাজানা হওয়ার আগেই, মাত্র চারদিনের মাথায় পরেশ রাঁচি চলে গেল'। বিয়ে উপলক্ষে ওঁর ছুটি শেষ। শ্বশুর-শাশুড়ি-ভাসুর-দেওরের ভিড়ে, মালবিকা একা। সাথে ছিল বিবাহিতা ননদের অযাচিত সঙ্গত। বাড়ির স্থায়ী-ফোন থাকলেও, তখন মোবাইল্ ফোন আসেনি। ফলে মায়ের সাথে বা পরেশের সাথে নিভৃতে কথা বলার উপায় নেই। পরেশ মাসে একবার চার/পাঁচ দিনের ছুটিতে আসে বটে। কিন্তু সেটা বাড়ির ছেলে হিসেবে, মালবিকার স্বামী হিসেবে নয়। প্রাকৃতিক কারণেই মালবিকার চাহিদাগুলো তখন তুঙ্গে। কত নিঃসঙ্গ বিনিদ্র রাত কেটেছে শাশুড়ির বিছানায়! বাড়ির নানান সমস্যা, মায়ের চিকিৎসা, বোনের ভালোমন্দ, বাড়ির সংস্কার... ইত্যাদি নানান কাজে দিনেরবেলা দেখা পাওয়াই ভার। পরেশের বক্তব্য, "জানো তো, আমারও তো সাধ হয় তোমাকে নিবিড় ক'রে কাছে পেতে, কিন্তু দাদা-বৌদি-মা-বাবা কীভাববে! বড় লজ্জা করে!" এমনকি চায়ের আসরেও, পরেশকে পাশে পাওয়া যায় না।
এমন পিপাসিত উচাটন ভাবটা আরও প্রবল হয়েছিল, প্রতীক কোলে আসার পরে। মালবিকা ভেতরে ভেতরে শুকিয়েও গেল। যদিও একাকিত্ব ঘোচানোর দায় কিছুটা নিয়েছে ছোট্ট প্রতীক। ততদিনে পরেশেরও যেন কাজের চাপ ক্রমশ বেড়েছে। বেড়েছে যুগলের মাঝের ব্যবধান। যদিও সে অর্থে কিছুরই অভাব নেই। অভাব শুধু পরস্পরের সাথে কথা বলার সময়ের!
প্রবাদ আছে: "বজ্র আঁটুনি ফসকা গেড়ো!"
দেখতে দেখতে বেশ কিছুবছর এ'ভাবেই কেটে গেল। প্রতীক তখন মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী। স্কুলের বাচ্চাদের মা-বাবা-কাকা-কাকীদের সাথে, মালবিকার বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে। সেখানেই বান্ধবী বনানীর দাদা অনিকেতের সাথে পরিচয়। অমায়িক ভদ্রলোক। "নৃত্যকুঠি" নামে একটা নাচের স্কুল পরিচালনা করেন। "নৃত্যকুঠি", তার শিল্পীদের নিয়ে, বছরের বিভিন্ন সময়ে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করে। কখনও ওড়িশি, কখনও মণিপুরী, কখনও কত্থক, কখনও ভরতনাট্যম্, কখনও রবীন্দ্রগীতিনাট্য, কখনও একক ক্রিয়েটিভ্ নৃত্য...
মালবিকার মৃতপ্রায় কিশোরীমন নড়েচড়ে উঠল। তাতে ননদের সামান্য আপত্তি থাকলেও, ভাসুর-শ্বশুর-পরেশেরও কোন' আপত্তি ছিল না।
প্রতীক ততদিনে স্নাতক পর্যায়ে। সেই সূত্রে মণিপালই প্রতীকের ঠিকানা। মালবিকার ঠিকানা "নৃত্যকুঠি"। অনিকেতের একাগ্র প্রশিক্ষণ মালবিকাকে মুগ্ধ করে। মালবিকা অনিকেতের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়েও থাকে। যতটুকু চাহিদা, তার অনেকমাত্রা বেশি করেই নিজেকে উৎসর্গ করে মালবিকা। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মালবিকার তাল-লয়-ছন্দ-মুদ্রা-অভিব্যক্তির কাছে, যেকোন' অষ্টাদশীও হার মানবে। অনিকেতও মালবিকার জন্য গর্বিত।
"প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস!
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ!
এ সংসারের নিত্য খেলায়,
প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়,
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য পরিহাস-
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ!"
রবীন্দ্রনাট্যগীতির এই অংশটার, নিপুণ আঙ্গিক অনিকেতকে এমন বিভোর করল' যে বলেই বসল', "মলি, তুমি জিনিয়াস। তোমার মধ্যে এত শিল্প চাপা ছিল বুঝতেই পারিনি। সর্বশক্তিমান তোমার সহায় হোন!"
'মলি' নামটা যেন, একটুকরো বরফ হয়ে মালবিকার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। শুকিয়ে যাওয়া নন্দনকাননের শাখায় শাখায় নতুন কুঁড়ি এলো। প্রজাপতির ডানা আর পাখির কাকলিতে ভরে গেল মনের বৃন্দাবন। মাথা নত করে মালবিকা বলল, "আমি কোন' গহীন আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন যেন পথের দিশা পেলাম। একটা প্রণাম করতে পারি?"
~ এ বাবা, আবার প্রণাম কেন মলি? আচ্ছা 'মলি' ডাকলে তোমার আপত্তি নেই তো?
~ একটুও না। তুমি জানো না, আন্তরিক দুঃখিত।
আপনি জানেন না যে, আপনিই 'আমার আমি'কে দিবালোকে এনেছেন। আপনাকে...
~ দুঃখিত কেন হবে মলি? বেশ তো লাগছিল!
"আমি সাগরের বেলা, তুমি দুরন্ত ঢেউ।
বারেবারে শুধু আঘাত করিয়া যাও!
ধরা দেবে বলে আশা ক'রে রই,
তবু ধরা নাহি দাও...
বারেবারে শুধু আঘাত করিয়া যাও!"
~ চুপ করো অনি চুপ করো। শুধু জেনো, তুমি আমার অনেকখানি। আপাতত, "যেতে দাও আমায় ডেকো না।"
মালবিকার আঁধার ঘরের সবকটা ঝাড়বাতি জ্বলে উঠেছিল। আনন্দে পরেশকেও জরুরী তলব করেছিল। আগামী সপ্তাহে কলামন্দিরে মালবিকার একক ধ্রুপদী নৃত্যানুষ্ঠান। প্রধান অতিথি হয়ে আসছেন বিখ্যাত চ্যালেঞ্জিং নৃত্যশিল্পী সুধা চন্দ্রণ। মালবিকা সেন আজ সত্যিই আত্মহারা। প্রতীক আসতে না পারলেও পরেশ এলো। যথা সময়ে সবাই কলামন্দিরে। অনুষ্ঠান চলছে। সবাই ভীষণ আপ্লুত। বিস্ময় তখনও বাকি ছিল! হঠাৎ অনিকেত দত্তের ঘোষণা:
|| "নৃত্যকুঠি", এবছরেই প্রথম "নৃত্যতীর্থ" সম্মান তুলে দেওয়ার মতো শিল্পী পেয়েছে। মাননীয় প্রধান অতিথি সুধাদিকে সেই পুরস্কার তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। পুরস্কার নিতে মঞ্চে আসছেন...
সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে আলপিন পড়ার শব্দও শোনা যাবে। আসছেন... আসছেন নৃত্যতীর্থ মালবিকা সেন। ||
মালবিকা স্তম্ভিত! পরেশই ধাক্কা দিয়ে বলে, "আরে, তোমাকে ডাকছে তো...!!" মন্ত্রাবিষ্টের মতো মালবিকা মঞ্চে উঠলো। অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ গৌরবের সম্মান গ্রহণ করল। তারপর...মঞ্চেই সোজা অনিকেতের কাছে গিয়ে বলল, "এই সম্মান তোমার পায়েই উৎসর্গ করলাম। না ব'লো না।" অনিকেতের চোখে তখন কুয়াশার চাদর! কোন'রকমে চশমাটা মুছে, দু'হাত দিয়ে মালবিকাকে দাঁড় করিয়ে বলল, "মলি, তুমি আমার আবিষ্কার। তুমি আমার গর্ব। তোমাকে আরও ওপরে উঠতে হবে। আমি তোমার হাত ধ'রে থাকবো। চর্চা বন্ধ ক'রো না। চির সীমন্তিনী হও।" স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না-করেই মালবিকা, প্রণাম সেরেই, অনিকেতের বুকে মাথা রেখেছিল। দু'জনের মাঝে সেই অমূল্য স্মারকটা জ্বলজ্বল করছে। সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ফেটে পড়ছে। শুধু পরেশ 'ন যযৌ ন তস্থৌ!'
★★★ ★★★
সেটাই পরেশের চাকরি জীবনের অবসরের বছর। অবসরের পরে, লবণহ্রদে নিজেদের নতুন ফ্লাটে, মালবিকার স্বীকৃতির উপলক্ষে একটা ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনসহ কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধবও উপস্থিত। মালবিকা আজ যেন নবসাজে সেই নববধূ। নিজের কাজের স্বীকৃতি, নিজের মনেই ভীষণভাবে উপভোগ করছে, আর সারাক্ষণ অনিকেতের পথ চেয়ে আছে। অনিকেত আসতেই, মালবিকা নিজে দরজা খুলে দিতে একতলায় গেল।
~ তোমাকে যে কী সুন্দর লাগছে, মলি!
~ যাহ্! অসভ্য। এত দেরি করলে কেন, অনি?
~ সবরকা ফল মিঠা হোতে হ্যায় ডার্লিং...
~ এই ছাড়ো ছাড়ো...বাড়ি ভর্তি লোক... উফ্...! একটা বদ্ধ পাগল...! সব সাজগোজের বারোটা... কে কখন কোথা থেকে...
~ মলি, আমি জানি সব্বাই দোতলায়। নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না গো!
~ খুব হয়েছে। এবার ওপরে চলো মশাই!
~ আর একটু থাকা যায় না? কথা দিচ্ছি দুষ্টুমি করবো না। শুধু দুচোখ ভ'রে তোমাকে...
~ না। একদম না। আমি সব্বাইকে দেখাতে চাই আমার দিশারীকে। চলো চলো!
বসন্তের ঘর তছনছ করতে প্রতিবছরেই কালবৈশাখী আসে। এখানেও তার অন্যথা হলো না। পরেশের মনের ঈশান কোণে একটা কালো মেঘ। এমনিতে ওদের সম্পর্কটা শুধু আইনি সুতোতেই ঝুলছিল। বর্তমানে, প্রায় কুড়ি বছর পর পরেশের অধিকার বোধটা জাগল। মালবিকার একদিকে আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, নতুন দিগন্তের হাতছানি, অন্যদিকে পরেশের তির্যক ইঙ্গিত। ততদিনে প্রতীকও যথেষ্ট সাবালক। তার সমর্থনটাই মালবিকাকে একটু সাহসিনী করে তুলেছে। একদিন:
~ মালবিকা, তুমি কি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না।
~ মানে? কী বলতে চাইছো সোজাসুজি বলো।
~ সোজাই তো বললাম। তুমি কি আমাকে আগের মতো...
~ কোথায় খামতি দেখলে? তাছাড়া তুমি কি কোন'দিনও আমাকে ভালোবেসেছিলে? বিয়ে হয়ে এসে পর্যন্ত তো বাড়ি/মাবাবা/ভাইবোন... আর কাজ। একদিনও আমার মনের খবর নিয়েছিলে?
~ মালবিকা! কী বলছো?
~ যা বলছি, ঠিকই বলছি। তোমার কাছে কোন' জবাব আছে?
~ তুমি সেন-বাড়ির বৌ...
~ হ্যাঁ, ইঁট-কাঠ-পাথর-আসবাবের মত একটা নিষ্প্রাণ সম্পত্তি। তাও তো দয়া করে একটা সন্তান দিয়েছো। সেটা কতটা ভালোবাসার আর কতটা অধিকারের দলিল কখনও ভেবেছো?
~ আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।
~ কী আন্দাজ করেছিলে শুনি?
~ কী যেন নাম... হ্যাঁ অনিকেত দত্ত। সেই তোমার মাথাটা...
~ খবরদার। মুখ সামলে কথা বলবে পরেশ। এখন আর আমি তোমার সেই নববধূ নই। অধিকারের গণ্ডি আমারও জানা আছে। কুড়িটা বছর একাকীত্বের আস্তাকুঁড়েতে ফেলে, আজ বেশি অধিকার ফলাতে এলে, আমারও আদালতের যাওয়ার অধিকার আছে। আর যদি বাঁদী বা পণ্য ভেবে থাকো ভুল ভেবেছো।
~ আস্তে মালবিকা...
~ আস্তে কেন? আমি যদি বলি রাঁচিতে কোন' ললনা তোমার মাথাটা খেয়েছিল। আজ অবসর নেওয়ার পর আমার প্রতি দরদ উথলে উঠছে...
~ চুপ করো মালবিকা।
~ মিস্টার পরমেশ্বর সেন, জেনে রাখো: একটা সজীব বস্তু আনলে, তার পরিচর্যা করতে হয়। দেখভাল করতে হয়। তার সুবিধা-অসুবিধা-চাহিদা-সমর্পণ বুঝতে হয়...
আলোচনার মোড় তুঙ্গে চড়ছে, বুঝে দুজনেই নীরব হয়ে গেল। কিন্তু চেরা দাগটা কিছুতেই মুছছে না।
মালবিকার মন বলছে, "যত প্রতিকূলতাই আসুক অনিকে আমি ভুলতে পারবো না। প্রকৃতপক্ষে অনিই আমার নারীমনে বসন্ত এনেছে। সমাজে একটা পরিচিতি দিয়েছে। তাছাড়া সে তো কোন' জোরজুলুম করেনি। সবটুকু ভালোবাসা উজার করে দিয়েছে তাঁর 'মলি'র জন্য। বদলে কোন'দিন কিচ্ছুটি আশা/দাবী করেনি। নাহ্, আমি অকৃতজ্ঞ হ'তে পারবো না। আমি মানুষ হিসেবে অপরাজিতা থাকতে চাই।"
পরেশের মন বলছে, "সত্যিই তো, সেই অর্থে মালবিকাকে তো আমি সেইভাবে সময়ই দিতে পারিনি। মা-বাবা-দাদা-বৌদির উপস্থিতিতে মালবিকার স্বাভাবিক চাহিদাও তো মেটাতে পারিনি। একটা মেয়েও তো বছরের পর বছর গৃহবন্দি হয়ে থাকতে পারে না। বিয়ের পরে, একমাত্র স্বামীই তো তার ভরসা! আমি যদি ওর শখ-আহ্লাদকে গুরুত্ব দিতাম, তবে হয়তো আজ অনিকেতবাবুর অনুপ্রবেশ ঘটতোই না। নাহ্! এভাবে নয়, মালবিকাকে ভালোবাসা দিয়েই কাছে টানতে হবে।"
অনিকেত। অনিকেত দত্ত। একটু দরিদ্র পরিবারেই যার জন্ম। কলেজজীবনে একটু মেয়েলি স্বভাবের জন্য বান্ধবীদের রসিকতার পাত্র ছিল। নিজের নাচের জন্য পূর্ণপ্রেক্ষাগৃহের হাততালি পেলেও, কারোর মনে দাগ কাটতে পারেনি। কলেজের পরে চাকরির পরীক্ষায় সুবিধা করতে না-পেরে নৃত্যগুরুর আশীর্বাদ নিয়েই "নৃত্যকুঠি"-র সূচনা করেছিল। সহোদরা বনানীর বান্ধবী নন্দিনীর সাথে সেখানেই পরিচয় হয়েছিল। নন্দিনীর চোখেও, অনিকেত প্রেমের প্রদীপ দেখেছিল। নিজেকে পুরুষ হিসেবে আবিষ্কার করেছিল। বনানীরও তা' অজানা ছিল' না। এইভাবেই বছরখানেক ধ'রে ওদের ভালোবাসা পরিপক্কতা লাভও করেছিল। কিন্তু হঠাৎ নন্দিনী " নৃত্যকুঠি" ছেড়ে দিল। বিলেতফেরত পাত্র পাওয়ায়, ওর মা-বাবা তড়িঘড়ি কন্যাদান সেরে ফেলল। নাহ্, নন্দিনী এসব কথা অনিকেতকে বা বনানীকে জানায়নি। এমনকি নিজেও কোন' প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করলেও হয়তো টিঁকতো না, তবে অনিকেতের মানসিক শান্তি মিলত'। সেই থেকেই নারীজাতির প্রতি অনিকেতের একটু বিতৃষ্ণাই আছে। বনানীও বহুবার বিয়ের কথা তুলেছে, কিন্তু ধোপে টেঁকেনি। সেই থেকেই, অনিকেতের আজকের প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত দীর্ঘপথ একাকীত্বেই মোড়া।
কিন্ত বিগত যৌবনা মালবিকাকে দেখে কোথাও যেন মাদল বেজেছিল। সামাজিকতার রক্তচক্ষুকে এড়িয়ে গেলেও একটা দুর্বল অনুভব ক্রমশ সবল হয়ে উঠছিল। মালবিকার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও, অমরাবতীতে একটা স্বপ্ননীড় গড়তে সাহায্য করেছিল। কিন্তু, অনিকেত নিজে অবিবাহিত হলেও, মলি তো সংসারী গৃহবধূ। অনিকেত বারবার স্বপ্ননীড়ের গলা টিপে ধরেছে ঠিকই, কিন্তু কোন'বারই চিরনিদ্রায় পাঠাতে পারেনি। অবসর সময় পেলেই হয় ফোন, নয় চ্যাটিং। অনিকেতের সমস্ত কর্মকাণ্ডেই মলির ছায়া! হয়তো মৃতপ্রায় অনিকেতের গোপন নিকেতনে, অজান্তেই কেউ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলেছিল! হয়তো নয়!
অবসরপ্রাপ্তির পর পরেশ সারাদিনই বাড়িতে। সেধে সেধে মালবিকার হাতেহাতে সাহায্য করে। মালবিকার একটু আশ্চর্য লাগলেও বেশ উপভোগ করে। বিকেলের দিকে পাড়ার ক্লাবে আড্ডা। প্রতীক একটা চাকরিও পেয়েছে। বয়সের কারণে মালবিকারও শরীরে ক্লান্তি এসেছে। এখন আর নৃত্য পরিবেশন করতে পারে না। তবে আপন মনে নৃত্য অনুভব করে। একদিন:
~ পরেশ, বিকেলে আমার সাথে একটু বেরোতে পারবে?
~ সে তো আমার সৌভাগ্য, মালবিকা। কিন্তু কোথায়?
~ আরে একটু "নৃত্যকুঠি"-তে যাবো। অনিদা ডেকেছে।
~ অহ্! কিন্তু কেন?
~ কেন তা কী জানি! নিশ্চয়ই কোন' কাজ আছে।
~ তা বেশ! এই, একটু কাছে এসো না!
~ আরে আরে কী করছো? বয়সটা খেয়াল রাখো।
যখন দরকার ছিল তখন তো ফিরেও তাকালে না। আর এখন...দিনদুপুরে... ছাড়ো পরেশ। ছাড়ো আমার লাগছে।
নাহ্, পরেশ মালবিকাকে ছাড়েনি। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছে মালবিকার সারা তনুমন। মালবিকার বাগানেও যেন অকালবোধন। এটাই নারীমন! অল্পেতেই পরিতৃপ্ত। পরেশের কানে কানে বলে, "তুমি না দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছো। এখন কি আর সেইসব দিন আছে গো। উমমমমহহহ... যাও স্নার সেরে এসো। আমিও চাটনিটা রেঁধে ফেলি। বিকেলে আবার নাক ডেকো না যেন। সাড়ে চারটে নাগাদ!" পরেশের সবিনয় জবাব, "মহরানীর যেমন আদেশ!"
পরেশ-মালবিকার মাঝের ব্যবধান একটু একটু ক'রে কমছে। যদিও, বয়সের কারণে সেই উত্তেজনা আর নেই, তবুও নিষ্কাম প্রেমটাই দৃঢ় হচ্ছে। সবটাই পরেশের আত্মোপলব্ধি আর মালবিকার মানিয়ে নেওয়ার ফসল। এখন আর মালবিকার একাকীত্ব অনুভব হয় না। আবার পরেশের লেগপুলিং করতেও ছাড়ে না। পরেশও কম যায় না। যেন মরুভূমির বুকে একটা মরুদ্যানের সৃষ্টি। খুব দরকার না হলে, "নৃত্যকুঠি"-তেও যাওয়া হয় না। অবশ্য শরীরও সাথ দেয় না। কালেভদ্রে অনিকেতের সাথে কথা হয় বটে, তবে সেটা নিতান্ত সৌজন্যমূলক বা কোন কাজের কথা। অনিকেতও সবই বোঝে। পরেশ-মালবিকা, বাকি জীবনটা সুখে থাকুক, এই প্রার্থনা করে।
আর অনিকেতের নিজের কথা?
নিকেতন যার ভেঙেচুরে গেছে,
সাগরের কোন' অজানা স্রোতে।
অনিকেত' সে তো সবাই জানে,
পারবে না আর নীড় গড়তে।
একলা চলারই পথ সম্মুখে,
থাকবে না কেউই সঙ্গে তার।
রসায়নের অনুঘটক সে,
বিক্রিয়াতেই প্রয়োজন তার।
"জানি না আজ যে আপন
কাল সে কেন পর হয়ে যায়!
যে বাতাস ফোটাল' ফুল
সেই তো আবার ঝড় হয়ে যায়!"
সঞ্জয় কুমার দাস
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
02-05-2023
-
-