অসমাপ্ত প্রেমের গল্প - সুফিয়া ফারজানা
"কেমন আছো, মুমু?"
"এই তো, আছি। আপনি কেমন আছেন?"
"আমার আর থাকা? বেঁচে আছি আর কি।" ম্লান হেসে জবাব দেয় সোহেল।
মুমু একটু হাসে। কি বলবে, ভেবে পায় না। সোহেলের ছোট বোন সাথীর প্রিয় বান্ধবী মুমু। টকটকে ফর্সা গায়ের রং, গোলগাল মুখ, টানা টানা চোখ, লম্বা চুলের মুমুকে খুব ভালো লাগতো সোহেলের। সোহেল তখন স্হানীয় সরকারি কলেজে গণিতে অনার্স পড়ছে। আর মুমু ক্লাস টেনে পড়ে। সোহেলদের ছাদের ঘরে বিকেলে তার কাছে অংক করতো সাথী আর মুমু। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে অনেক গল্প, অনেক মজাও করতো সোহেল। মুমুও সোহেলকে পছন্দ করতো মনে মনে। কিন্তু দু'জনের কেউই ভালো লাগার কথা মুখে বলতে পারেনি কখনও। তবে চোখে চোখে কথা তো হতই।
তখন গ্রীষ্মকাল। কয়েক দিন ধরে বৈশাখের প্রচন্ড তাপদাহের পরে আকাশ কালো করে কালবৈশাখি ঝড় এসেছিল সেদিন। জ্বরে অসুস্থ থাকায় সাথী সেদিন অংক করতে যায়নি তার ভাইয়ের কাছে। মুমু একাই গিয়েছিল। গাঢ় নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ পরেছিল সেদিন মুমু। ভেজা, লম্বা চুলগুলো ছাড়াই ছিল। পাতলা শিফনের নীল ওড়না মাথায় দিয়েছিল। প্রতিদিনের মতই চোখে কাজল পরেছিল সেদিনও। প্রচন্ড শব্দে বজ্রপাত হয়েছিল সেদিন বিকেলে। আকাশ কালো করে বাতাস বইছিল প্রবল বেগে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল হঠাৎ। বিকেল বেলাতেই অন্ধকার হয়ে এসেছিল চারদিক। প্রকৃতির মাঝে কিছু ম্যাজিক আছে। জাদুকরি কিছু মুহূর্ত। মানুষ তো প্রকৃতিরই অংশ। সেই সব মুহূর্তে প্রকৃতির সাথে এক হয়ে যায় মানুষ। ঠিক আদিম মানুষের মত। তাদের সেই বয়সটাও ছিল অন্য রকম ভয়ংকর। সোহেল সেদিন জীবনে প্রথম কাছে টেনে নিয়েছিল কোন মেয়েকে। সেই মেয়েকে, যাকে সে ভালবাসতো মনে মনে। কিন্তু কখনও বলতে পারেনি। বজ্রপাতের শব্দে খুব ভয় পায় মুমু। সোহেলের বুকে ডানাভাঙা পাখির মতই আশ্রয় নেয় সে, প্রবল বেগে আলিঙ্গন করে তাকে। মুমুর এলোমেলো সুগন্ধি চুলের মিষ্টি সুবাসে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সোহেল।
তারপর কেটে গেছে প্রায় দশটি বছর। মুমুর বিয়ে হয়ে যায় সেই ঘটনার দুই মাস পরেই। খুব ভালো একটি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন মুমুর বড় মামা, তিনি তখন রিটায়ার্ড মেজর। পাত্র তার জুনিয়র অত্যন্ত সুদর্শন আর্মি অফিসার, মেজর সাফায়েত। এত ভালো ছেলে পেয়ে আর দেরি করেননি মুমুর বাবা। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে মুমু একবার এসেছিল সোহেলের কাছে। অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে চেয়েছিল সে সোহেলের হাত ধরে। কিন্তু সোহেল সাহস পায়নি। সে তখনো অনার্স শেষ করতে পারেনি। পড়াশোনা ছেড়ে, নিশ্চিত জীবন ছেড়ে কোথায় যাবে সে? কিভাবে সে মুমুর দায়িত্ব নিবে? সোহেল ভয় পায়। মুমুকে সে চলে যেতে বলে।
মেজর সাফায়েতের সাথে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় মুমুর। সাফায়েত অত্যন্ত ভালো, ধার্মিক, সজ্জন প্রকৃতির মানুষ। মুমুকে খুব ভালবাসেন তিনি। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছে মুমু। বিয়ের পর পড়াশোনাও করেছে সে, বিএসসি পাস করেছে। তার দুই ছেলে। মুমুর বড় ছেলে মুহিতের বয়স এবার নয় বছর পূর্ণ হল। আর ছোট ছেলে মুকিতের বয়স পাঁচ। স্কুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শেষে নানাবাড়ি বেড়াতে এসেছে মুহিত আর মুকিত তাদের মায়ের সাথে। ওদের বাবা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে দেশের বাইরে আছেন এখন।
সোহেলের কাছে বিদায় নিয়ে মুহিতের হাত ধরে চলে যায় মুমু। পিছন থেকে তাকিয়ে থাকে সোহেল। মুমুকে আজও ভুলতে পারেনি সে। অন্য কোন মেয়েকেই আর ভালো লাগেনি তার। তাই বিয়েশাদিও করা হয়নি। কিন্তু সোহেল ভাবছিল অন্য কথা। মুহিত চোখ পিটপিট করে কথা বলে, সোহেলও তাই। তার মতই ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলে মুহিত। তার চোখেমুখে অবিকল নিজের চেহারার আদল দেখে চমকে উঠে সোহেল। এই মিল কি কাকতালীয়? তাই যেন হয়।
(সমাপ্ত)
সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ
-
গল্প//উপন্যাস
-
27-04-2023
-
-