আত্মহত্যার অন্তরালে - শংকর ব্রহ্ম
সে ছিল আমার একমাত্র পুত্র সন্তান। এমন কিছু সে যে করতে পারে, আমি ভাবতে পারিনি কখনো।
ওর মা বোন ঘরের মধ্যে চলাফেরা করে, ফিসফাস করে কথা বলে, আর আমি ঘরে ঢুকলেই ওরা চুপ করে যায়। চোখ তুলে আমার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। আমাকে এড়িয়ে চলতে চায়। যেন ওরা আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে। নীরবে শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু এতে আমার কি দোষ ?
আমি কি খুব কড়া ধাঁচের মানুষ? না, মোটেই না। আমাকে কড়া হতে হয়েছিল, ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কিন্তু এমনটা ঘটবে আমি বুঝত পারিনি কখনওই।
সে ছিল খুব আমুদে, ভাবপ্রবণ, নরম স্বভাবের।
এখন যারা চুপচাপ আছে, ওর মা-বোন, ওরাই ওকে নষ্ট করেছিল। ওর বয়স যখন চোদ্দ বছর হল, তখন থেকেই ওর শিক্ষার ভার নিলাম আমি। ভাল স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। ওর ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য ওকে তৈরী করতে আমি শুরু করলাম চেষ্টা। ওকে এটা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, অযথা ও কিছুই পাবে না।
ও যখন বছর পনেরোয় পড়ল, তখন আমি ওকে জানালাম, কি ভাবে আমাকে কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, সংসারটা সচল রাখতে হয়েছে এই মন্দার বাজারে।
দু'বেলা দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করতে হয়েছে অক্লান্ত। ক্লান্তি এলে, সর্দির মতাে তা ঝেড়ে ফেলেছি। সংসারের সকলের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, কলের আখ মাড়াইয়ের মতো নিজেকে পিষে রস ঢালতে হয়েছে এই সংসারে।
সে কি বুঝেছিল, জানি না। ভেবেছিলাম, সে এই সব শুনে, তার বাবাকে নিয়ে গর্ব করবে। ভবিষ্যতে সে বাবাকেও ছাড়িয়ে যাবে উন্নতিতে।
স্কুল জীবন তার কাছে খুব কঠিন মনে হয়নি। ইচ্ছে করলেই সে ক্লাসের মধ্যে ভাল রেজাল্ট করতে পারত। কিন্তু সে রকম ইচ্ছা কখনোই তার হয়নি। স্কুলের পড়াশুনায় তার মন বসত না। স্কুলের পড়াশুনা ছাড়া তার মন চাইতাে আরও অনেক কিছু করতে।
ফুল, প্রজাপতি, লজ্জাবতী-লতা কিংবা রূপকথার বই তাকে আকর্ষণ করত। তার আকর্ষণ ছিল আন্তর্জাতিক ফুটবল কিংবা ত্রিকেট ম্যাচে। স্কুলের পড়া না করে, সে দিনের পর দিন সে'সব নিয়ে মেতে থাকত। তা দেখে মনে হত, এটা যেন তার একটা মানসিক ব্যাধি। ফলে আমি তখন ক্যাবল লাইন বন্ধ করে দিতাম। তখন সে আবার পড়াশুনা শুরু করত। তাও মাত্র দিনকয়েক জন্য।
তারপর সে বাজাতে শুরু করল রথের মেলা থেকে কেনা একটি বাঁশের বাঁশি। যেটা ওর মা ওকে কিনে দিয়েছিল। কিছুদিন সেটা নিয়ে কাটল। তারপর সে কবিতা লিখতে শুরু করল পদ্য ছন্দে। কিছুদিন কাটল তা নিয়ে। এরপর সে বিমূর্ত ছবি আঁকতে আরম্ভ করল রঙ তুলি নিয়ে। একা একা নদীর ধারে বেড়াতে যেত সেসময়।
অ্যাকোরিয়ামে মাছ পুষতে শুরু করল কিছুদিন। একটা দূরবীন কেনার জন্য পয়সা জমাতে শুরু করল সে। কখনও কিছু পয়সা চেয়ে নিত ওর মায়ের কাছ থেকে। তখন সে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে নক্ষত্র দেখত। কিত্তু কোনটাই দীর্ঘ দিনের জন্য স্থায়ী হয়নি তার জীবনে। স্থির কোন কেন্দ্র ছিল না তার, ক্ষণিক সুখের মোহে, এটা সেটা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। আমি জানি অনেক ছেলেই এভাবে তাদের হবি পরিবর্তন করে। কিস্তু সে এসব করত পডাশুনায় অবহেলা করে। তার বয়স এভাবে পনেরাে পেরিয়ে যোলোয় পড়ল। তবুও সে মনোনিবেশ করতে শিখল না তার স্কৃল-পাঠ্যসূচীতে।
তারপর তার চোখ পড়ল মেয়েদের দিকে এবং এই প্রথম তার নামে নালিশ এল বাড়িতে। তখন তার হাতখরচ আমি কমিয়ে দিলাম। অকারণ বাইরে বেরনো বন্ধ করে দিলাম। সতেরো বছরের কিশোরের, লম্বা ছিপছিপে গড়ন ছিল তার দেখে মনে হত বয়স আরও বেশি।
একদিন তাকে ডেকে বোঝালাম, এভাবে চললে তুমি পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না। এরপর তাকে আমি একটা দৈনন্দিন রুটিন তৈরী করে দিয়ে বললাম, এই তােমার শেষ সুযোগ। তুমি যদি এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করতে না পার, তবে আমাকে বাধ্য হয়ে তােমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। শুনে সে শিশুর মতোে কাঁদতে লাগল। আমি জানি এটা ছিল তার কাছে চরম শাস্তির ব্যাপার , দারুণ আতঙ্কের বিষয়। তবে আমি কার্যত এটা করতাম কি না জানি না। যাইহােক, সে এতে খুব ভয় পেয়েছিল, আমি তা অস্বীকার করি না।
আমি কি বাবা হিসাবে, তাকে সতর্ক করারও অধিকারী নই, তার সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য?
তার মাকে সে গুরুত্বই দিত না, তাই আমি এসব না করলে সে কিভাবে একজন সফল মানুষ হয়ে উঠবে? কী করে আগামী জীবনে সংগ্রামের জন্য তৈরী হবে?
আমি কি একবারের জন্যই বুঝতে পেরেছিলাম, আমার কথা তার স্নায়ুর উপর এমন ভাবে চাপ সৃষ্টি করবে। তাহলে কি আমি পরােক্ষ ভাবে দায়ী নয় তার মৃত্যুর জন্য? নিজের কাছে প্রশ্ন করে কোনও উত্তর খুঁজে পাই না আমি।
তার মৃত্যুর জন্য একমাত্র আমিই দায়ী, এ কথাটাও আমি মন থেকে মেনে নিতে পারি না। তার প্রকৃতি সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। হয়তো আতঙ্কে সে এমন কাণ্ড করছে। টেস্ট পরীক্ষায় কয়েক নম্বর কম পেয়ে লিস্টে নাম না ওঠার জন্য কেউ মেট্রো রেলের লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে না। নিশ্চয়ই এটা জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার জন্য সঙ্গত কোন কারণ হতে পারে না।
তার সীমাহীন আকাঙ্খার আর একগুয়েমির জন্য। সে কিছু জানতে চেয়েছিল। বুঝতে চেয়েছিল।
যখন সে খুব ছোট ছিল তখন থেকেই সে কী যেন খুঁজে বেড়াত। সে ছিল এই রকমই। আমার মতো তাকে আর কে এত ভাল করে বুঝতে পারবে ? সে ছিল আমার একমাত্র পুত্র সন্তান। ওর জীবনের যােলটা বছর এভাবেই কেটে গেছে। ওর প্রকৃতি ওকে বাঁধতে পারেনি।
কোন ব্যাপারে কখনোই সে গভীর ভাবে মনোনিবেশ করতে পারেনি। ও ছিল খুব অস্থির প্রকৃতির, খামখেয়ালি স্বভাবের। শৈশব থেকেই ওই রকম প্রকৃতির ছিল সে।
কদাচিত তাকে হাসতে দেখা যেত। তার কোন বিশেষ বন্ধু ছিল না। কারও সঙ্গে তেমন ভাবে মিশতই না।
মনে হত ও যেন ফড়িংয়ের জীবন কাটাচ্ছিল। অবশ্য যদি সে খুব ধীরতার স্থিরতার সঙ্গে কাজ করত, আমি তাহলে অবাক হতাম। এতে আমি হতাম আরও চিস্তিত আর সে হত বিচলিত।
সে কি যেন খুঁজে বেড়াত অস্থিরভাবে, বহুদিন আমি তা বুঝতেই পারিনি। কোন ইঙ্গিত পাইনি তার অনুসন্ধিৎসার। মাঝে মাঝে বেড়াতে নিয়ে গেলে, সে খুব খুশি হত। একদিন, তখন তার বয়েস বার কি তেরাে হবে, দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে, সে তার মাকে বলল, আমি একদিন মরে যেতে পারি। সে কথা শুনে, হতবুদ্ধি হয়ে আমি চমকে গেলাম। কিন্তু সেটা তাকে বুঝতে না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এতোটুকু উত্তেজনা না দেখিয়ে সে বলল, হেসাে না, হেসো না, আমি সত্যিই আমার জীবন দিয়ে দিতে পারি।
এতে আমি আরও বিচলিত হলাম। সম্ভবতঃ আমার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছিল সেদিন ওর মুখে সে কথা শুনে। তবুও আমি শান্তভাবে বললাম, কেন? কী এমন কারণ তার?
সে আমার দিকে তাকিয়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতাে বলল, ঈশ্বরকে খুঁজে বের করার জন্য।
এতদিন এই ব্যাপারটা আমি ভুলে গেছিলাম। এখন যেন আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি, আমার সামনে দাঁড়িয়ে সে আবার ওই কথাগুলােই বলছে, তা স্পষ্ট কানের পর্দায় এসে ধ্বনি তরঙ্গ তুলে থেমে যাচ্ছে না। বাজতেই থাকছে।
সে বোধহয় কঠিন ও দূঢ় সংকল্পের সঙ্গে খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার সমস্ত জীবন ধরে এবং সর্বত্র, তার ঈশ্বরকে। তার কবিতায়, তার আঁকা বিমূর্ত ছবিতে, মাছেদের জীবনে, তার বাঁশির সুরে, ক্রিকেট ম্যাচে, আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জে, এমন কি মেয়েদের মধ্যেও। শুধু খোঁজ আর খোঁজ। যদিও জানত না সে, তাকে যে সব জিনিস আকর্ষণ করে, তার কোনটির মধ্য সে তার ঈপ্সিত বস্তুটি খুঁজে পাবে। এই জন্যই এক একটা আকর্ষণের বস্তু চট করে ছেড় দিত, ছুঁড়ে ফেলে দিত। কেননা তার মধ্যে সে তার প্রার্থিত বস্তু খুঁজে পেত না।
তার সে বাক্যটি, আমার কানে এখনও অনুরণিত হচ্ছে, 'ঈশ্বর কে? তা খুজে বের করার জন্য'।
খারাপ নম্বর পাওয়া তার কাছে, কোনও ধর্তব্যের বিষয়ই নয়।
অংকের মাস্টার কয়েকদিন আগেই তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, জীবন সম্পর্কে আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি কি, এবং বলেছিলেন, 'পৃথিবী অনস্ত বটে, কিন্তু সীমাহীন নয়' কিংবা ওই ধরণের কিছু সে এমন মনােযােগ দিয়ে তার কথা শুনছিল যে মনে হচ্ছিল সে নতুন কিছু শুনছে। তারপর সে শাস্তস্বরে তাকে প্রশ্ন করেছিল, পৃথিবীতে ঈশ্বরের অবস্থান কোথায় তাহলে? অংক শিক্ষক এ'কথা শুনে হেসে ফেলেছিলেন এবং তাকে কোন ধর্মগুরুর কাছে যেতে বলেছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে।
এসব জিনিস জোর করে পাওয়া যায় না, তার মা তাকে অনেক বুঝিয়েছিল। কিন্তু তার মায়ের কথায় কোন আস্থা ছিল না। কিন্তু কেন আমি তা জানি না? আমি তাকে একবার বলেছিলাম, এখন এসব ভাবনা ছেড়ে পড়াশুনায় মন দাও। পড়াশুনা শিখলে সব জানতে পারবে।
মেয়েদের সঙ্গে মেশার পরই সে চমৎকার সাবালক হয়ে উঠতে শুরু করল। মেয়েদের ভালবাসা যে কী 'বস্তু, তা অনেকেই জানে না। সেও তেমনি জানত না। যখন সে দেখল মাধ্যমিক টেস্ট লিস্টে তার নাম নেই, তখন তার এক সহপাঠিনী তা জেনে ঠোঁট টিপে হেসেছিল। সেই হাসিই কি তার এই পরিণতি ডেকে আনলো? ছোটখাট ব্যাপারে আমরা তেমন দৃষ্টি দিই না। একটু চোরা চাউনি, হাল্কা নিবিড় হাসি, শরীরী বিশেষ ভঙ্গি, বিশেষ করে এই বয়সের ছেলেদের বিচলিত করতে পারে। মেয়েটি তার বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী ব্যবহার করেছে, যদিও সে তা জানে না। মেয়েটি তাে নিরীহ প্রাণীর মতোেই নিষ্পাপ। তার দোষ কী ! ওই বয়সের মেয়েরা তো একটু প্রগলভ হাসি হেসেই থাকে। তাতে কি?
রাবিশ! সামান্য ঠোঁট টেপা হাসিতে সে বিভ্রান্ত হয়নি। সে তাতে এমন বিপর্যস্ত হয়নি যে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে। সাফল্যে তার তেমন আনন্দ ছিল না, তাহলে কয়েকটা নম্বরের জন্য কেন সে এ পথ বেছে নেবে। আমার এ'কথা বিশ্বাস হয় না। তা আমি মানতে পারি না। যা অসম্ভব ভাবছি, বাস্তবিক তাই সত্যে পরিণত হল। আমার একমাত্র সন্তান আমাকে ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।
সে যা খুঁজছিল তার সারা জীবন ধরে, তা কি আজ পেয়ে গেছে সে?
শংকর ব্রহ্ম। পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
25-04-2023
-
-