মিথ্যা - সুফিয়া ফারজানা
অপর্ণা আজ সত্যিই ভয় পেয়ে গেল খুব। তার গলার স্বর্ণের চেইনটা কোথায় যেন খুলে পরে গেছে। কি হবে, যদি চেইনটা আর পাওয়া না যায়? আট আনা স্বর্ণের চেইন। তার নানী মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে অপর্ণার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। চেইনটা তার খুবই প্রিয়। তার প্রাণপ্রিয় নানীর শেষ স্মৃতিচিহ্ন। এটা সে হারিয়ে ফেললো? সে কি এতটাই অপদার্থ, অপয়া?? তারচেয়েও বড় কথা, তার মামীকে সে কি জবাব দিবে? মামী তো আজ মেরেই ফেলবেন তাকে। এমনিতেও মামী তাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না।
অপর্ণার মায়ের মৃত্যুর পরে অপর্ণার বাবা বিয়ে করেছেন আবার। তিনি মেয়ের খোঁজ রাখেননি কখনোই। তিন বছর বয়স থেকে অপর্ণা নানীর কাছেই মানুষ। সে যখন ক্লাস ফোরে পড়ে, তখন নানীও মারা গেলেন। তারপর থেকে মামার বাড়িতেই ঠাঁই হয় অপর্ণার। সেই অপর্ণার বয়স এখন চৌদ্দ, ক্লাস এইটে পড়ে সে। তার মামী অবশ্য কখনোই ভালবাসতে পারেননি এই মা মরা মেয়েটিকে।
মামীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। মামার নিজেরই তিন ছেলেমেয়ে, তাদের খরচ চালাতেই হিমশিম মামা আর মামী। মামার গঞ্জে কাপড়ের দোকান, তবে ভালো চলে না। করোনার কারণে অনেক দিন তো বন্ধই ছিল দোকান। মামী বাসায় দর্জির কাজ করে, সবজি বাগান থেকে সবজি বিক্রি করে অতি কষ্টে সংসার চালান। তবে অপর্ণাকে খুবই ভালবাসেন তার মামা আশরাফ। তাই দরিদ্র মামার প্রতি অপর্ণাও খুব কৃতজ্ঞ। সেও ভাবে, একদিন বড় হয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মামার সংসারের সব কষ্ট, সব অভাব দূর করবে সে। কিন্তু সে তো মেয়েমানুষ, সে কি পাবে সেই সুযোগ?
আজ স্কুল ছুটির পর চেইনটা হারিয়ে বাসায় ফেরার সাহস পেল না অপর্ণা। সোজা চলে গেল গঞ্জে, মামার দোকানে। আজও মামা একাই শুকনো মুখে বসে ছিলেন দোকানে। এখন দোকানে বেচাকেনা খুবই সামান্য, তাই কর্মচারী রাখারও সামর্থ্য নেই। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই উঠে আসলেন মামা, "কি রে মা, তুই এখানে কেন?"
অপর্ণা আর বলতে পারে না কিছু। কেঁদে ফেলে হু হু করে, "মামা।।"
"কি রে, মা? কি হইছে?"
কান্নাজড়িত স্বরে কি বলতে কি বলে, অপর্ণা নিজেই জানে না। তবে আশরাফ ঠিকই বুঝতে পারেন, কি মারাত্মক ঘটনা এটা তাদের মত দরিদ্র মানুষের জন্য।
"ওহ্, এই কথা? দূর পাগলী! কিচ্ছু হইবো না। চল তো, স্কুলের মাঠে গিয়া খুঁইজা দেখি। খেলার সময় গলা থেইকা খুইলা পরে নাই তো?"
অপর্ণা জানে না। সে খেয়ালই করেনি। হঠাৎ ছুটির পর কি মনে করে গলায় হাত দিয়ে দেখে, চেইনটা নেই।
দোকান বন্ধ করে অপর্ণার সাথেই বাসায় ফিরলেন আশরাফ। পথে তন্ন তন্ন করে খুঁজলো দুজনে, স্কুলের মাঠেও খুঁজলো। কোথাও কিছু নেই।
স্কুলের দারোয়ান হরিপদ সব শুনে বললো,"আর পাইবা না। এত দামী জিনিস, কেউ পাইলেও কি আর ফেরত দিবো?"
অপর্ণা আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। আশরাফ এবার এক ধমক দিলেন তাকে,"চুপ কর, গাধা মাইয়া। চল, বাসায় চল। তোর মামীরে তুই কিচ্ছু কইবি না, বুঝলি? যা কওয়ার, আমি কমু।"
তারা বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। প্রতিদিনের মত আজও মামাকে দেখেই মুখ ঝামটা দিলেন মামী,"কি এমন জমিদারি তোমার যে, দুপুরে খাইতে আসারও সময় নাই? ওই তো সারাদিনে একজন খরিদ্দার আসে এক গজ কাপড় কিনতে। জানি তো অবস্হা। নাকি আদরের ভাগনিরে নিয়া দাওয়াত খাইয়া আইলা? তাইলে তো ভালাই হয়। দুই জনের খাবার আইজ বাইচা যায় তাইলে।"
"শোন, ময়না, ঘরে আসো একটু। কথা আছে, জরুরি কথা। অপু, তুইও আয়।"
অপর্ণাকে ছোট করে অপু ডাকেন মামা। অপর্ণার মামীর নাম ময়না। তবে এই নামে মামা আর ডাকেন না মামীকে। মামার বড় মেয়ের নাম কেয়া। সবাই কেয়ার মা'ই ডাকে মামীকে আজকাল। মামাও তাই ডাকেন সচরাচর।
ঘরে ঢুকেই বিছানায় বসে পরলেন মামা। মামীকেও হাত ধরে বসালেন পাশে।
"আইজ কি যে বিপদে পরছিলাম!"
"কি হইলো আবার?"
"হঠাৎ রহমত মিয়া আইসা হাজির।"
"কি কও?"
"হ। অনেক দিন পর গন্জে আইছিল হঠাৎ।"
"উনি না নিরুদ্দেশ হইয়া গেছিলেন?"
"হ। আইজ একটু সময়ের লাইগা হঠাৎ আইছিল, চইলাও গেছে আবার।"
"টাকা চায় নাই? টাকা পায় তো তোমার কাছে।"
"হ। মেলা টাকাই তো পায়। দুই লাখের মত। কইলো, বিপদে পরছে খুব। কিছু টাকা চাইলো আমার কাছে। এক লাখ টাকা নাকি খুবই দরকার।"
"তুমি কি কইলা?"
"আমি তো কইলাম, বড়ই অভাবে আছি আমিও। পরিবার না খাইয়া আছে বলতে গেলে। কোন কথাই শুনলো না। বাধ্য হইয়া অপুর গলার চেইনটা বেইচা ৩০ হাজার টাকা দিলাম। তাও মানে না। অনেক কষ্টে ম্যানেজ করছি। টাকা নিয়া আবার চইলা গেল ঢাকায়।"
"কও কী?"
"হ, ময়না। কি আর কমু? কত মানুষ যে টাকা পায়! এত পাওনাদার রাইখা মইরাও তো শান্তি পামু না।"
মামী আর কিছু বললেন না। চুপচাপ ভাত বেড়ে দিলেন। আদর করে খেতে ডাকলেন অপর্ণাকেও। বহুদিন মামী এত নরম স্বরে কথা বলেননি তার সাথে। খাবারের আয়োজন অবশ্য সামান্য। ডিম ভুনা, ডাল আর বেগুন ভর্তা। একটাই ডিম। মামী চোখের আড়ালে যেতেই ডিমের অর্ধেকটা ভেংগে অপর্ণার পাতে তুলে দিলেন মামা। বাকী অর্ধেক নিজের পাতে নিলেন।
অপর্ণা অবাক হয়ে বললো, "মামা, তুমি মিছা কথা কইলা?"
"চুপ, চুপ। কথা কইস না। ভাত খা চুপচাপ।"
অপর্ণা চুপচাপ ভাত খেতে লাগলো। কিন্তু চোখের পানি আজ আর বাঁধা মানলো না তার। টপ টপ করে পরতে লাগলো ভাতের থালায়। ঝাপসা চোখে অপর্ণা তাকিয়ে দেখে, মামার চোখেও পানি।
বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে অপর্ণার মামা আশরাফও তাকিয়ে রইলেন অবাক হয়ে। অপর্ণা দেখতে অবিকল তার মায়ের মত। ঠিক যেন তার অকালমৃত ছোটবোন আয়েশা, ভাত খেতে খেতে কাঁদছে আর বলছে,"ভাইজান, আমারে একদিন মেলায় নিয়া যাইবা??"
সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ
-
গল্প//উপন্যাস
-
24-04-2023
-
-