লস্করের ঈদের কেনাকাটা - খুরশীদ শাম্মী
অভাবের সংসারে আনন্দ অনেকটা অমাবস্যার চাঁদ, অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও তাহা খুঁজে পাওয়া যায় না। অভাবী সংসারের সদস্যরা চরম এই নির্মম সত্যটা জানে বলেই তারা আনন্দ খুঁজতে নয়, বরং জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতেই ব্যস্ত থাকে সদা। জীবন ও সংসার থেকে অমাবস্যার ঘোর আঁধার অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে লস্কর দুই বছর পূর্বে হয়েছিল নগরমুখী। অর্থকষ্টে বেড়ে ওঠা লস্কর বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। নগরীয় জীবন তার ভালো লাগে না। তবুও জীবনের প্রয়োজনে সে চাকরি খোঁজে। পেয়েও যায় একটা চাকরি। একটা কাপড়ের দোকানে। মাকে নিয়ে বর্তমানে থাকে সে বস্তির দুই কামরার এক ঘর ভাড়া করে।
চলছে রমজান মাস। ব্যাপক আয়োজনের মাস। খরচের মাসও বটে। মাসব্যাপী ইফতার ও সেহরির প্রস্তুতি মুসলমানের ঘরে ঘরে। ধর্মপরায়ণ লোকসকল বাড়িয়ে দিয়েছেন তারাবীহসহ অন্যান্য ইবাদত। মসজিদে ইবাদত-বন্দেগির সংখ্যা বেড়েছে অনেক। পথঘাটে ভিখারিদের ভিক্ষা চাওয়ার বোল পরিবর্তন হয়েছে, 'ও আমার আম্মাগো, ও আমার আব্বাগো, রোজার মাসে ভিক্ষা দিলে সত্তুরগুণ সওয়াব পাইবেন গো। আফাগো, স্যারগো দুইডা ভিক্ষা দিয়া যানগো।' প্রচলিত আছে, রমজান মাসে মহৎ কাজের পুণ্য সত্তরগুণ। সুতরাং দান-খয়রাতও বেড়েছে। প্রচার ও প্রচারণার যুগে যাকাতের কাপড় বিক্রি হয় গাঁটরি ধরে।
দানের পাশাপাশি ঘরে ঘরে চলছে ঈদের প্রস্তুতি। পোশাকের দোকানগুলোর বিক্রয় বেড়েছে শতগুণ। অন্যান্য কেনাকাটাও চলছে দস্তুরমত। খরিদ্দারদের চাহিদামত পণ্য নির্বাচনে সহায়তা করে বিক্রেতাগণ। লস্কর একজন বিক্রেতা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতাদের কাপড় দেখাতে দেখাতে প্রথম দর্শনে ক্রেতার রুচিবোধ কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারে সে। বলা যায়, এটা তার অভিজ্ঞতা। অধিকাংশ ক্রেতাই ক্রয় শেষে খুশি মনে ফিরে যায় দোকান থেকে। বিষয়টি লক্ষ্য করে দোকানের মালিক শরীফুদ্দিন। সে মনে করে এটা লস্করের দক্ষতা। সুতরাং রমজান মাস শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ পূর্ব থেকেই সে লস্করকে সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া থেকে বিরত থাকে। বিনিময়ে সে তাকে অতিরিক্ত বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি করে।
হিসেব করে খরচ করার অভ্যাস লস্করের আজন্ম। তিনবেলা খাবার ও মোটা কাপড়ের পোশাক ছাড়া অন্যান্য চাহিদা তার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠেনি কখনো। হঠাৎ অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের নিশ্চয়তা পেয়েও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো খরচ নিয়ে মোটেও ভাবে না সে। মাকেও তেমন কিছু বলে না। শুধু তার টিনের বাক্সটা খালি করে রাখে।
ঈদের বাকি মাত্র সাতদিন। দোকানে ব্যস্ততা চরম পর্যায়ে। অন্যান্য সকলে ইবাদতের জন্য কাজ থেকে বিরতি নিতে পারলেও তার সেই ফুরসৎ মেলে না প্রায়ই। কোনো-কোনোদিন সে শুধু জল পান করে পার করে দিনের অধিকাংশ সময়, তা-ও রোজাদারদের চোখের আড়ালে। বিষয়টি সকলে অবগত থাকলেও, কারোই বিবেক নড়ে না। বরং তাদের ভাব দেখে মনে হয়, রোজা না রাখায় কাজের প্রতি লস্করের কর্তব্য যেন সর্বাধিক। লস্করও মুখ বুজে পুরো রমজান মাস পালন করে যায় তার কর্তব্য।
ঈদের তিনদিন পূর্বে দোকানের কর্মচারীদের হাতে বেতন ও ঈদ-বোনাস তুলে দেয় মালিক। লস্কর বঞ্চিত হয় ঈদ বোনাস থেকে। মালিক একপাটি সাদা দাঁতে হাসি দিয়ে বলে, 'লস্কর, তোর তো আর ঈদের খরচ নাই। তারপর, ছয় সপ্তাহে ছয়দিন অতিরিক্ত কাজ করার জন্য তো তোকে অতিরিক্ত বেতন দেওয়া হয়েছে, যা এই রোজাদাররা পায় নাই। বুঝিস-ই-তো ঈদের খরচ কেমন চান্দিফাটা; বাজার-সদাই, বাড়ির সবার জন্যে জুতা থেকে টুপি পর্যন্ত নতুন পোশাক, যাকাত, দান-খয়রাত, ফিতরা, সালামী সবকিছু মিলিয়ে মহাপ্রলয়। মনে কিছু করিস না তুই।'
লস্কর নতশিরে বিষটি মেনে নেয়। পরেরদিন সে তিনঘণ্টা ছুটির অনুমতি চায়। মালিক গরম তেলে জলের মতো ছিটকে ওঠে, 'তোর আক্কেল দেখে তো আমি মরি মরি! জানিস যে এই সময় শ্বাস নেওয়ার সময় থাকে না, সেই সময় তুই ছুটি চাইস কোন আক্কেলে?' লস্করও নাছোড়বান্দা, তার ছুটি দরকার। সে মাথা নিচু করে বলে, 'আমার ঈদের বাজার শেষ করতে হবে।'
মালিক রেগে হুলোবিড়ালের মতো ফোঁসফোঁস করে বলে, 'ঈদের বাজার! তোর আবার ঈদের বাজার হয় কেমনে? তুই কি আমার লগে মশকরা করোস, বেইমান?'
লস্কর এবার উন্নতশিরে বলে, মালিক, আমি বেইমানি করিনি কোনো। আমি ঈদের বাজারই করব। আমার বাজার করতে দুই-তিন ঘণ্টা সময় লাগবে মাত্র। ছুটি চেয়েছি, পারলে দেবেন, না পারলে না। গালাগালি করবেন না। লাগবে না আমার ছুটি। আমি আজ লাঞ্চের সময় পুরা এক ঘণ্টা বিরতি চাই। তার আগে লিনেন বেগুনি প্রিন্টের থান থেকে আমার দশ গজ কাপড় চাই কেনা দামে।
চোখের ইশারায় পুরাতন একজন কর্মচারী বিষয়টি মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। মালিক নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ঠিক আছে যাইস। এক ঘণ্টা না, দুই ঘণ্টার জন্য-ই যাইস। আর দশ গজ কাপড়ের দাম চুকাইয়া দিস গদিতে, সাথে আগের বাকি পাঁচটা সাদা থান কাপড়ের দাম দিতে ভুলিস না।
লঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে টাকা বের করে মালিকের হাতে দিয়ে বলে, গদিতে যখন আপনি নিজেই আছেন, এখনই দেনাপাওনা মিটিয়ে ফেলি।
চাঁদরাত। ঈদের আনন্দ শুরু। দোকানে দোকানে বাজছে, 'রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।' লস্করের বস্তিতেও পটকা ফুটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে কিশোর, তরুণেরা। লস্কর এই আনন্দের কিছুই জানে না। দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরতে তার বেজে যায় রাত একটা। তখনও তার মা চোখ খুলে পঁয়তাল্লিশ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতির মরা আলোয় সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করে। লস্কর মাকে এতরাতে এভাবে জেগে থাকতে দেখেই হাতের ব্যাগটি আড়ালে নিজের কামরার রাখে। আরাম করে বসে খাবার খেতে খেতে সে তার মাকে বলে, 'কাল দোকান বন্ধ। আমরা গ্রামে যাব।'
সন্তানের কথা শুনে দরিদ্র মায়ের বুক ভরে ওঠে কান্না। কেননা গত দু'বছরে এমন একটি দিন যায়নি, যেদিন সে আবডালে গ্রামের জন্য কাঁদেনি। দু'হাতে অশ্রু মুছে সন্তানকে জিজ্ঞেস করে, গেরামে যাবা বাবা, খুব খুশির কথা। কিন্তু, যাবা কার বাড়ি? আমাগো তো আর কিছু নাই গেরামে। ভিটাডাও মুন্সি তার কামলাগো দখলে রাখছে।
লস্কর মাথা নেড়ে বলে, মা, ঈদের দিন। কেউ না কেউ ডেকে খাওয়াবেই। না হয় আমাদের ভিটা দেখেই ফিরে আসলাম।
লস্করের মা মাথা ঠোকে, একা একা বিলাপ বকে, আমরা তো মোসলমান না। তুমি বাবা ভুইলা গেলা কেমনে যে আমাগো যাকাতের লাইন থেইক্কা বাইর কইরা দিছিল। অভাবের যন্ত্রণায় সবাইর পরামর্শে একবারই তো লাইনে দাঁড়াইছিলাম।
- ভুলি নাই, মা। যাকাতের লাইন থেকে বের করে দিলেও মুন্সির কাজের বেটি শেফালী কিন্তু তার ছাওয়ালের সাথে আমাদের বাসন ভরে সেমাই দিত। পোলাও কোরমা দেয় নাই, আমরা গরুর মাংস খাই না বলেই তো।
- হয়, শেফালীর মায়া আছিল।
- আমরা না হয় গ্রামে শেফালীর সাথে দেখা করে দিনেদিনে ফিরে আসব।
- সে এখন আমাগো ভিটায় থাকে তার পরিবার লইয়া, এখন কি আর আগের মতো মায়া করবে আমাগো?
- না করলো। অন্তত ভিটা তো দেখে আসতে পারবা। এখন রাত হয়েছে, ঘুমাও।
ভোর হতেই পাশের বস্তির নারায়ণ তার ভ্যানগাড়ি নিয়ে হাজির। তার বেশ তাড়া, দিনেদিনে ফিরে আসার তাড়া। লস্কর তার মাকে নিয়ে ভ্যানগাড়িতে উঠে বসে। সাথে করে নিয়েছে তার টিনের বাক্স। বাক্সটি নিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করে মা ও নারায়ণ উভয়ে। তাদের সকল প্রশ্নের উত্তরে লস্কর শুধু বলে, 'এই বাক্সটা খুশির বাক্স। এর মধ্যে আছে এক গ্রাম খুশি। মায়ের খুশি, বন্ধুর খুশি, প্রতিবেশির খুশি, বেদনার স্মৃতি ঠকানোর খুশি।'
লস্করের মা সন্তানের কথার অর্থ বুঝে না। সে হতাশ মনে ভাবে, সন্তান আমার শেফালীর প্রেমে পড়ে নাই তো? তার তো স্বামী, সন্তান সবই আছে। তবু্ও ছাওয়াল আমার কয়, ‘শুধু শেফালীর লগে দেখা করবা!' তয় কি সে তার জন্য ঈদের বাজার কইরা লইছে? তার খুশির কথা কইছে?
নারায়ণের ভাবনা অন্য মাত্রায়, যেমনে খুশির কথা বকতাসে, গেরামে পৌঁছাইয়া আবার আমারে একলা পাঠাইয়া দেবে না তো? তারা ফিইরা না আইলে তো ফিরতি ভাড়াও দেবে না আমারে।
লস্কর দু'জনের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলে, রাস্তাঘাট যদি বারোমাস এমন খালি থাকতো, তবে তো আমাদের শহরমুখী হতে হতো না। দিনেদিনে কাজ করে বাড়ি ফেরা সহজ হতো।
এতক্ষণে নারায়ণ সুযোগ পায় তার ভাবনাগুলো শব্দমালায় প্রকাশ করার। সে গম্ভীরমুখে বলে, পথঘাট খালি রাখনের জন্যে তো আমাগো কাম-কাজ বাদ দেতে হইবে। দাদা, তুমি মাত্র একবেলার জন্য গেরামে যাইতে আছো, কিন্তু এত্তবড় টেরাংক লইয়া যাইতেছো ক্যান? এর মধ্যে আছেডা কী?
বললাম না, ট্রাঙ্ক ভর্তি খুশি। এর মধ্যে আছে মায়ের খুশি, আমার ঈদের কেনাকাটা।
মা আশ্চর্যান্বিত চাহনিতে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, ঈদের কেনাকাটা! কার জন্যে ঈদের কেনাকাটা করছোস, বাজান? গেরামে আমাগো আছেই বা কেডা যে ঈদের বাজার করছো টেরাংক ভইরা?
- মা, পুরা গ্রামটাই তো আমাদের নিজেদের। বড় আপন। স্বপনের মা-বোন, সাধনদা'র পুরা পরিবার, জ্যাকোবের ভাই-ভাবি, লাবিব-হাবিবের পরিবার, শেফালী বু'র পরিবার,.....।
- বাজান, তুই কি যে কস্, কিচ্ছু বুঝি না। এই শহরে আওয়েনের পর তোর কথাবাত্তা যেমন শুদ্ধ হইছে, তেমন কাম-কাইজও আউলা-ঝাউলা হইছে, পরের লইজ্ঞা তোর জান পোড়ে।
- তুমি ভুল বললে, মা। আউলা-ঝাউলা নয়, বলো, শুদ্ধ ও গোছানো হয়েছে। আমার স্মৃতিতে একটি মাত্র গ্রাম, যে গ্রামে আমার জন্ম, আমার বাবার জন্ম, যেখানে এখনো আমাদের একমাত্র সম্বল একটা ভিটে রয়েছে। বাবা সময়মতো ঋণ শোধ করেনি বলে দখল হয়েছে, থাকুক অন্যের দখলে, দলিলে তো এখনো আমার পরিবারের নাম। সেই গ্রাম পর হতে পারে না কখনো। সেই গ্রামের সবকিছুই আপন। তোমার মনে আছে? রোজার শেষে ঈদের আগে মুন্সি বাড়ির যাকাত বিলানোর দিনগুলো, আমাদের মতো হিন্দুদের মালাউন বলে বাড়ির চারপাশে যেতে দিত না। মিঞা বাড়ির বড় মিঞা বলত, 'আমরা যাকাতে ধুতি দেই না।' ছোট মিঞা গলা খেঁকিয়ে বলত, 'রাঁড়ি মাগীর জন্যে সাদা থান নাই।' তোমার চোখের জল এখনো আমার মনের আয়নায় জ্বলজ্বল করে। সেইসব স্মৃতিতে আমার জান পোড়ে। ওই বেদনাদায়ক স্মৃতিটুকুও আমার বড় আপন, বড় উপকারি। মা, ওই স্মৃতির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
- দাদা, আপনে কি তয় গেরামের সব হিন্দুগো জন্যে ঈদ বাজার করছেন? এইডাই যদি করবেন, তয় পূজার সময় করতেন।
- ঈদ ও পূজা দু'টোই উৎসব। পূজার সময় প্রয়োজনে আবার হবে। গ্রামের দু'টো ধনী পরিবারের লোকেরা আমাকে ঈদ বাজার করতে শিখিয়েছে, নারায়ণ। আমি আমাদের এই ছোট গ্রামের গরীব ও দয়া বঞ্চিত মাত্র ষোলোজন মানুষের জন্য কেনাকাটা করেছি। এর থেকে বেশি সামর্থ্য আমার নেই। ধর্ম আমার বিবেচনায় ছিল না কখনোই। আমার বিবেচনায় ছিল শুধু কয়েক ফোঁটা চকচকে অশ্রু। যারা আমার উপহার পাবে, তাদের মধ্যে আছে আমার মায়ের মতো দু:খী পাঁচজন নারী, ছয়জন শিশু-কিশোর ও পাঁচজন অসুস্থ হত-দরিদ্র পুরুষ, যারা গ্রামের ধনীদের যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত কিন্তু বঞ্চিত।
- বাজান, তুই কি গেরামে যাইয়া কাইজ্জা করবি?
- না, মা। আমরা আমাদের ভিটায় যাবো মাত্র। আমরা যাওয়ার পর তোমাকে দেখতে ওই হতদরিদ্র দশ-পনেরোজনই আসবে মাত্র। তুমি উঠানে দাঁড়িয়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে একটা করে উপহার দেবে। তারা খুশি মনে ফিরে যাবে। তুমি খুশি হবে। এই ঈদে তোমার খুশি কেনাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য।
খুরশীদ শাম্মী
এপ্রিল ১২, ২০২৩
টরন্টো, কানাডা
-
গল্প//উপন্যাস
-
20-04-2023
-
-