বহির্গামী - ইকবাল কবীর রনজু
ডক্টর সেন এর উপর অগাধ বিশ্বাস সজলের। দিনের পর দিন বিভিন্ন কারণে তার এই বিশ্বাস তীব্র হয়েছে। অনেক আগে থেকেই সজল টুম্পাকে ডক্টর সেনের কাছে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। টুম্পা রাজি হয়নি। টুম্পা বার বারই জানিয়ে এসেছে ওর কিছুই হয়নি। কোন সমস্যাই নেই। সজলের অন্য আর দশটার কথার মতো এই কথাটিও শোনেনি টুম্পা। টুম্পাকে সজল বায়ে যেতে বললে টুম্পা ডানে গেছে, ডানে যেতে বললে গেছে বায়ে।
সজলের সাথে কথা বলার পর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে পৃথক ভাবে টুম্পার সাথে কথা বলছেন ডক্টর সেন। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমান সজল দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ঘড়ির কাটার ছুটে চলা পর্যবেক্ষণ করছে। দুপুর বারোটা বাজায় সেকেন্ড মিনিট ও ঘন্টার কাটা যখন মুহুর্তের জন্য একই সরল রেখায় অবস্থান করলো তখন হঠাৎই নিজের বিয়ের কথা মনে পরে যায় সজলের।
যেদিন সজল ও টুম্পা বিয়ের মাধ্যমে চার বছরের প্রেমের সম্পর্কের যবনিকাপাত ঘটায় সেদিন তারা এমনি সরল রেখার মতো মিলিত হয়েছিল। বিয়ের আগের সর্ম্পকটা অম্ল-মধুর হলেও বিবাহ পরবর্তী সম্পর্কটা কেন জানি কেবলি অম্লতায় ভরপুর হয়ে ওঠে। অহেতুক বা খুব তুচ্ছ কারণে রেগে যাওয়ার প্রবনতাটা ক্রমশই বাড়তে থাকে টুম্পার। সজলের সাথে বিয়ে হওয়াটা তার কাছে দুর্ভাগ্যজনক মনে হতে থাকে। এর ফলশ্রæতিতে উদ্বেগ বাড়ে টুম্পার। টুম্পার মানিয়ে চলার প্রবনতা কম হওয়ায় সজলের সাথে তার সম্পর্কে যে ফাঁটল ধরে দীর্ঘ বছরে তার বিস্তৃতি ক্রমশই বাড়তে থাকে। চব্বিশ ঘন্টায় ঘড়ির তিনটি কাটা একাধিক বার মিলিত হলেও বিবাহ পরবর্তী জীবনে মানসিক ভাবে ওরা এভাবে একধিক বার মিলিত হতে পারেনি।
অযৌক্তিক চিন্তার পাশাপাশি শোনা কথায় বিশ্বাস করা টুম্পার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। বিয়ের আগে এমন বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়নি সজলকে। এখন ভাবতে হচ্ছে, আর অন্যরা এ সুযোগটাই নিচ্ছে। কেউ ভয় সংশয়হীন টুম্পার কান ভারী করলে বাছ বিচার না করেই সজলকে একদম অবিশ্বাস করে বসে টুম্পা। নুপুরের কথাই ধরা যাক। সেদিন নুপুরের সাথে কথা বলতে দেখে কে বা কারা টুম্পাকে কি বলেছে তাই নিয়ে হুলস্থুল ফেলে দিল টুম্পা। ছেলে মেয়েদের সামনে তীর্যক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হলো সজলকে।
বিয়ের তেরো বছর পেরিয়ে গেছে ওদের। এই দীর্ঘ সময়ে নিজের বিবেক দ্বারা পরিচালিত সজল কখনোই অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়নি। কিন্তু এতো বছরেও খুঁতখুঁতে টুম্পার কাছে বিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারেনি সজল। টুম্পাকে বাতিকগ্রস্থ মনে হয় সজলের। টুম্পা নিজেকে না বদলালে সর্ম্পর্কটা স্বাভাবিক হবে এমনটাও মনে হয় না সজলের।
এইতো কদিন আগে সময় স্বল্পতায় শেভিং রেজর আর ফোমের কৌটাটি যথাস্থানে রেখে না যাওয়ায়, কাপরগুলো আলনায় না রেখে বিছানায় এলোমেলো অবস্থায় ফেলে যাওয়ায় ক্ষেপে যায় টুম্পা। টুম্পার পদোন্নতির বিষয়টাও ধরা যেতে পারে। ওর পদোন্নতি কয়েক বছর হলো আটকে আছে। কেবল ওর নয় ওর সমকক্ষ সব কলিগেরই। এ বিষয়টি মন থেকে সড়াতেই পারেনা টুম্পা। এ চিন্তাটা বার বার ঘুরে ফিরেই ওর মাথায় আসে। এ নিয়ে সব সময় অস্বস্তিতে ভোগে। এর প্রভাব এসে পরে বাড়িতেও। সহকর্মীরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও আলাদা চোখে দেখে টুম্পাকে। এটি ও বুঝতে চায়না অথবা বোঝার সক্ষমতা নেই।
নিজের বিশ্বাসে অটুট থাকাটা টুম্পার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলের দ্বন্দ্বে হতাশায় প্রায় নিমজ্জিত সজল। দুইয়ের মধ্যবর্তী আর কোন স্তর না থাকায় সব কিছু নিরবে হজম করতে হয় তাকে। উপযোজন ক্ষমতা বিহীন টুম্পা অনিরীক্ষণ বা ভ্রান্ত নিরীক্ষণের উপর ভিত্তি করে যখন কোন বিষয়ে বেফাস মন্তব্য করে বসে তখন চুপ করে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখে না সজল।
এইতো সেদিনের কথা। ভুলতেই পারছেনা সজল। গ্রীস প্রবাসী ওর বন্ধু মানিক দেশে বেড়াতে এসেছিল। মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য মানিককে বাড়িতে দাওয়াত করে সজলের বন্ধু টিপু। টিপু, সজল ও তার অপর বন্ধু মিল্লাতকেও দাওয়াত করেছিল কিন্তু অবাক করে দেওয়ার জন্য মানিক আসছে এ কথাটি বলেনি ওদের। মধ্যাহ্ন ভোজের সময় মানিক উপস্থিত হলে ওকে দেখে রীতিমতো আবেগাপ্লুত হয় সজল ও মিল্লাত। অনেক দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বন্ধু একসাথে হওয়ার সুযোগ ঘটে। টিপুর বউ হরেক পদের খাবারের আয়োজন করেছিল। মধ্যাহ্ন ভোজের সময় হঠাৎই টুম্পা সজলকে ফোন করে। সজল টিপুর বাসায় আছে এবং অনেক দিন পর চার বন্ধু একত্রিত হয়েছে বলে জানায়। টুম্পার স্বভাব জানা থাকায় খুব বেশি কথা না বলে ফোন কেটে দেয় সজল। মেঝেতে মাদুর পেতে পাশাপাশি খেতে বসেছিল ওরা। কি বলতে কি বলে ফেলে নাজানি কি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে এ শঙ্কা কাজ করছিল সজলের মনে।
বাড়ি ফেরার পর সজলের আশংকাই সত্যি হলো। আগের দিন রাতে সজল টুম্পাকে জানিয়ে রেখেছিল পর দিন মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ আছে তার। ঘন্টা দুয়েক আগে টিপু ও ওর বউকে ওদের বাড়ির পাশের বাজারে দেখেছে টুম্পা। ও বিশ্বাসই করতে পারছে না সজলরা চার বন্ধু একত্রিত হয়েছিল। হঠাৎই রেগে গিয়ে টুম্পা বলে তুমি মিথ্যে বলছো। টুম্পার মুখে এমন কথা শুনে হতবাক হয় সজল। উত্তর দেয়না। ঝগড়া ঝাটি এড়াতে কিছু সময়ের জন্য নিঃশব্দে বাড়ির অদূরের তেমাথায় বট গাছের নিচের চায়ের দোকানে যায় সজল। সময় কাটানোর জন্য ফেসবুক, মেসেঞ্জারে মনোনিবেশ করে।
এমন খন্ড দৃষ্টান্তগুলো পর্যবেক্ষণ করে অনন্যোপায় হয়ে জীবনসঙ্গী নির্ধারণে সজল তার অদূরদর্শীতাকে দোষ দেয়। সজলের চুপ হয়ে থাকাটাকে দূর্বলতা মনে করে এটাকে পুঁজি করে যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে ওঠা টুম্পা। বারংবার সজলের চাওয়াকে ছুরিকাঘাত করে প্রকারান্তরে হত্যা করে উল্লাসে মাতে। এতে কি ও সুখ খুঁজে পায়? ও কি বোঝেনা কিসে সুখ! যদি বোঝে তাহলে এমন আচরণ করে কেন? এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সজলের মনে।
আপনার মনে কি হঠাৎ আতংক তৈরী হয়? আপনি অন্ধকারে ভয় পান কিনা? বদ্ধ জায়গায়, ভীড়ের মধ্যে, ট্রেনে বাসে উঠতে, একা ফাঁকা যায়গায় যেতে, রক্ত দেখলে আপনি কি ভয় পান? একি বিষয় নিয়ে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করেন? সাধারণ ঘটনায়ও বেশি উত্তেজিত হন বা রেগে যান? এমন আরো অনেক প্রশ্ন করে ডক্টর সেন জানবার চেষ্টা করেন টুম্পা ওসিডি তে ভুগছেন কিনা।
ডক্টরের ডাক পেয়ে চেম্বারে প্রবেশ করে সজল। ডক্টর সেন জানান, কিছু লক্ষণ মিললেও ওসিডি’র অধিকাংশ লক্ষণই টুম্পার আচরণের সাথে যায় না।
তবে আপনি এটাকে কি মনে করেন? সজলের এমন প্রশ্নে নিরব থাকেন ডক্টর সেন। টুম্পা এবং সজলও বেশ কিছুক্ষণ নিরব থাকেন।
নিরবতা ভেঙ্গে টুম্পা বলে-তুমি কি ভেবেছিলে আমি ওসিডি আক্রান্ত? এবার সজলের দিকে তাকায় টুম্পা। ওর চোখ দুটো জলে টলমল করছে। আটকাতে পারে না সে। নিরবে নিঃশব্দে কয়েক ফোটা ঝরেও পরে। এই প্রথম টুম্পার চোখে জল দেখল সজল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ডক্টর সেন।
ডক্টরের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে একটি রিক্সা ডাকে সজল। কোন বাক্য ব্যয় না করে সজলকে অনুসরণ করে রিক্সায় উঠে বসে টুম্পা। টুং টাং শব্দ করে বেল বাজিয়ে ভীর পেরিয়ে এগিয়ে চলে ওদের বহনকারী রিক্সাটি। কেউ কারো দিকে তাকায়না পর্যন্ত। গুমোট ভাবটা কাটাতে মুখ খোলে টুম্পা। বলে, তোমার সাথে আমি যে আচরণ করি এটি ইচ্ছাকৃত। টুম্পার দিকে তাকায় সজল। সজলের চোখে মুখে একরাশ ঘৃনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করে টুম্পা।
সকল অশান্তির মধ্যেও সুখী হওয়ার মূলমন্ত্রটা আমি পেয়ে গেছি বলেই রিক্সা থেকে নেমে যেতে থাকে সজল।
-তোমার এই মূলমন্ত্রটা কি?
সজল বলে, দূরে থাকা। দেখনা, তুমি যখন অহেতুক ঝগড়া ঝাটি কর, উস্কানীমূলক কথা বার্তা বলো আমি তখন ঝগড়া ঝাটি এড়াতে নিঃশব্দে দুরে চলে যাই। সুখের জন্য মানুষ অন্তর্মুখী হয় আর আমাকে হতে হয় বহির্গামী।
ইকবাল কবীর রনজু
(লেখক- সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সহকারি অধ্যাপক, মির্জাপুর ডিগ্রী কলেজ, চাটমোহর, পাবনা।)
-
গল্প//উপন্যাস
-
06-04-2023
-
-