অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
মানসিক (Psycho) - ফরিদ তালুকদার

ছরের এই সময়টায় এখানে তীব্র শীত আর হালকা শীতের মাঝে দ্বৈরথটা বেশ জমে উঠে। একটা দিন এর হ'লো তো অন্যদিনটা ওর। এই যেমন গতকাল বিকেলে যে তাপমাত্রা ছিলো ১৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস আজ সকালে তা মাইনাস ১৪ ডিগ্রীতে ডিগবাজী খেয়েছে। সভ্যতার চতুর মানুষ প্রকৃতির এই পালাবদলের সাথে বেশ মানিয়ে নিলেও অন্য প্রাণীরা এটাকে কেমন ভাবে নিতে পারছে বিষয়টা মাঝে মাঝে ভাবায় নরাধমকে। গতকাল এখানে যে সব পাখিরা ঘুমভাঙা ভজনে প্রথমে ঈশ্বরের গুণকীর্তন এবং পরে সংগী খুঁজে নুতন ঘর বাঁধার গান কন্ঠে তুলে মুখর হয়েছিলো তারাই আজ একেবারে চুপচাপ! তাকিয়ে আছে অনিশ্চিত ভবিতব্যের দিকে! নরাধম ভাবে পার্কের দুই প্রান্তে দু'টা টিভি লাগিয়ে আবহাওয়া চ্যানেল খুলে রাখলে হয়তো ওদের অনিশ্চিত অদৃষ্টের ভার খানিকটা কমে যেতো। তবে সেই আবহাওয়া পূর্বাভাসের চ্যানেলটি যদি সি. পি. ২৪ (এখানকার লোকাল টি ভি চ্যানেল) হয় তাহলে তারা মনুষ্য প্রযুক্তি এবং তাদের জ্ঞান গরিমার উপরে শুধু আস্থাই হারাবে না, নিশ্চিত ভাবে ভাবতে শুরু করবে সভ্য(?) মানুষ এখনো এই বিষয়টা সমন্ধে কিছু জ্ঞান আমাদের কাছ থেকে নিলে ভালো হতো! এইসব আবোলতাবোল মামুলি বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে নরাধম তার প্রাতঃভ্রমণের প্রথম রাউন্ড শেষ করে দ্বিতীয় রাউন্ডের রিস্কে যাবে কিনা এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল।

রাস্তার এক চতুর্থাংশ অতিক্রম করেই থমকে গেলো ধূসর রং কাঠবিড়ালিটা। অনতিদূরেই ধীরগতিতে আশা গাড়িটা ওকে দেখে গতি আরও কমিয়ে দিয়েছে। কাঠবিড়ালির সংশয় তবু কাটছে না! রাস্তাটা এই মুহুর্তে পার হবে কি হবে না এখন এ এক জীবন-মরণ সিদ্ধান্ত তার! আর মানুষ নামের ঐ প্রাণীগুলোকে কি আর বিশ্বাস আছে? দু'দিন আগেও তো পাশের বাড়ির ঐ ওকে…!

এই সময়টায় কদাচিৎ দু'একটা গাড়ি তাদের যাত্রা শর্টকাট করতে দুইপ্রান্তের ব্যাস্ত দুই সড়কের সংযোগকারী এই পথটা নেয়। এর বাইরে যারা গাড়ি নিয়ে আসেন তারা কোথাও পার্ক করে হাঁটতে শুরু করেন। তবে প্রাতঃভ্রমণকারীদের বেশির ভাগই হলেন আশপাশের বাসিন্দা। কেউ কেউ দু’তিনজনের গ্রুপ করে আসেন। কেউ আবার তার পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কুকুরটাকে সঙ্গী করে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতোন। কুকুরকে হাঁটানো এবং সাথে নিজের পদ চর্চা! এক মহিলা আছেন যিনি ঝড়-বৃষ্টি যা-ই থাকুক নিয়মিত দুবেলা আসেন। ঠিক বোঝা মুশকিল ভ্রমণের এই অংশের এজেন্ডাটা তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন না কুকুরটি? তবে যতক্ষণ থাকেন অনর্গল তিনি কুকুরটির সাথে কথা বলতে থাকেন!

মানুষ কি কখনোই প্রকৃতপক্ষে একাকী হয়? প্রাতঃভ্রমণের চেয়েও নরাধমের এখানে আসার বড় একটা কারণ হলো একজনের সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটানো। তার সাথে কথা বলা। অন্যদের সাথে তার তফাত হলো অন্যদের সঙ্গীরা শ্রবণ দূরত্বের সীমায় থাকেন কিন্তু তার সঙ্গীর অবস্থান বাহ্য দৃশ্যলোকের ওপারে! নরাধম তার সথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকে। ফুল, পাখি, আজকের ভোর, আবহাওয়া, ঈশ্বর, রাতের ঘুম, শরীরের খুঁটিনাটি... অনেককিছু নিয়েই চলতে থাকে এই কথোপকথন! মাঝেমাঝে একটু বিরতি নিয়ে আবারও সে আকাশের দিকে তাকায়। তারপরে একসময়…!

উন্নত বিশ্বের মানুষগুলো কি একটু বেশিই শীতল চরিত্রের হয়? বিষয়টা নরাধমের কাছে ঠিক পরিস্কার নয়। তবে একটি অঞ্চলের হাজার বছরের জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি যে ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের চরিত্রের উপরে প্রভাব ফেলে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। বেশকয়েক বছর পূর্বের একটি ঘটনা। নরাধমের শরীরে তখনো বিষুবীয় অঞ্চলের গন্ধ লেগে আছে। মেরু অঞ্চলের এই দেশটিতে তখন গ্রীষ্ম চলছে। বলা যায় এই সময়টায়ই পড়শীদের সাথে যা একটু দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয় নরাধমের। সকালবেলা বাসার সামনের লনে টুকটাক বাগান চর্চা করছিলো সে। পাশের বাসার মারিয়া বের হয়ে আসলো খানিক পরে। মহিলা ফিনিশিও (ফিনল্যান্ড) ব্যাকগ্রাউন্ডের। একথা সেকথার পরে বললো ‘তার মা মৃত অবস্থায় তিনদিন বাসায় পড়ে থাকার পরে কোনো এক পড়শীর ফোনকল পেয়ে পুলিশ এসে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে!’ বলাবাহুল্য তার মা একাই থাকতেন বাসায়। ঘটনাটি সপ্তাহ খানেক পূর্বের। খবরটি বলার সময়ে যদিও মারিয়ার চেহারায় এক হালকা কান্নার ছাপ বইয়ে গেলো! বিস্মিত নরাধম শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো ‘উনি কোন এলাকায় থাকতেন'? উত্তরে মারিয়া যা বললো তাতে নরাধমের ধারণা হলো হেঁটে গেলেও মারিয়ার বাসা থেকে তার বাসা দশ মিনিটের বেশি দূরত্বে নয়। অথচ!?----

এই পার্কে হাঁটার সময়েও নরাধম লক্ষ্য করেছে এখানে যে যার মতন সময়টুকু কাটিয়ে চলে যায়। কেউ কারোর দিকে তেমন বিশেষভাবে লক্ষ্য করে না। অনেকদিন একই চক্রে দেখা খুব বেশি পরিচিত মুখ হলে পাশাপাশি অতিক্রম করার সময় বড়জোর হয়তো একটুখানি হাত ওয়েভ (হাত জাগিয়ে নীরব সম্ভাষণ) করা, বা ঠোঁটের দুপাশে শেষ বিকেলের ফিকে রোদের মত এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে গুডমর্নিং বা গুডআফটারনুন বলা এই যা। বিষয়টি নরাধমের জন্যে একদিক থেকে খুবই স্বস্তিকর বলতে হবে। কারণ কেউ তার দিকে মনযোগ দিয়ে তাকালে নিশ্চয়ই তাকে মানসিক (Psycho) ভাববে। একটা লোক একা-একা অস্ফুটে কথা বলে হেঁটে চলছে; সেই কথা ফুল, পাখি কিংবা ঈশ্বর যার সাথেই হোক না কেন তাকে তো এই মহতী(?) সভ্য সমাজ মানসিক রোগী ছাড়া আর কিছুই ভাববে না! বিষয়টা নরাধমের যে বোধগম্য নয় তা নয়। কিন্তু এটাকে সে কোনো আমলেই নেয় না। এ যে তার হৃদয়ের শান্তি! এ যে এক সেই ভালোবাসা যার সাথে জাগতিক কোনো লেনদেনের সম্পর্ক নেই, ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে অতীন্দ্রিয় কোনো এক আলোকে যার উদ্ভাস! এমন মানুষ রাস্তাঘাটেও প্রায়শই চোখে পড়ে। অনেকে বেশ জোরেশোরে চিৎকার করে একা একাই কন্ঠশীলন(!?) করে যায়। কেউ কেউ আবার খিস্তিখেউড় ও আওরায়। কার উদ্দেশ্যে এইসব তা হয়তো একমাত্র ঐ ব্যাক্তি এবং তার ঈশ্বরই জানেন। বছর দুয়েক আগে হলে নরাধমও এদেরকে হয়তো মানসিক ভাবতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা হয় না। হয়তো এখন আর বিশেষ কোনো তাৎপর্য নিয়েই আসে না এইসব তার কাছে। সে নিজেও যে এখন অনেকটা এই গোত্রের ঠিক সেকারণেও এমনটা নয়। বরং তার প্রশ্ন জাগে আসলে মানসিক কারা? এরা তো কারোর বিশেষ কোনো ক্ষতি করে না। যাকিছু ক্ষতি তা তাদের নিজেরই। নিজের প্রতি এমন উদাসীন বলেই কি এরা মানসিক? তাহলে যারা ‘সামান্য লাভ বা প্রতিহিংসার কারণে অবলীলায় আরকেজনকে খুন করে ফেলে, যে নেতা বা নেত্রী শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্যে জবরদস্তি ভাবে কোটি জনতার কন্ঠকে রোধ করে বছরের পর বছর গদিতে আসীন থাকেন, প্রশাসনিক শক্তি বলে বিরুদ্ধ কন্ঠকে খুন, গুম কিংবা জেলে পুরে রাখেন, যে সরকার বা সরকার ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী তাদের অবৈধ মোড়লী শক্তিকে প্রদর্শন তথা সুসংহত করার জন্যে, পার্শ্ববর্তী দেশের ভূমি দখলের জন্যে অকারণ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন, আকাশ বোমা নিক্ষেপ করে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ, নারী-শিশু হত্যা করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর’ তাদেরকে তাহলে কী বলা উচিত? হয়তো বলতে পারেন এরা হলো খুনি। বেশ, তাহলে এদের কোনো বিচার হয় না কেন? না দেশীয় আইনে না বিশ্বের আইনে! কারণ এরা মিথ্যে বানোয়াট ইসতেহারে, একপেশে মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা প্রচারে সবকিছুতেই বৈধতার সিলমোহর মেরে নিতে পারেন! তাই তারাই আবার তাদের হাতে মানবতার নিশান তুলে ধরেন!?

মাঝেমাঝে নরাধমের মনে হয় এরা আসলে শুধু খুনি নয়, এরা হলেন খুনি এবং মানসিক দু’টোই! যার সার অর্থ হলো এই পৃথিবী মাতা আসলে এখন খুনি এবং মানসিক এই দুই বৈশিষ্ট্যের গুনে(??) গুণান্বিত ব্যাক্তিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। হচ্ছে প্রতিমুহুর্তে নির্যাতিতা! আর তাই-ই যদি হয় প্রকৃত বাস্তবতা, তাহলে সে একটু-আধটু মানসিক হলে তাতে সমস্যাটা কোথায়!?

পাঠক---
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনারাও নরাধমকে মানসিক (Psycho) সনদপত্রটি দিয়ে দিয়েছেন!?

ফরিদ তালুকদার 
মার্চ ২, ২০২৩
টরন্টো, কানাডা