অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
আয়না - তনিমা সাহা

দৃশ্য ৷১৷

এক ভগ্নপ্রায় পোড়া বাড়ি! বাড়িটাকে দেখে তার বয়েস নির্ধারণ করা মুস্কিল। বাড়িটাকে দেখে মনে হয় যেন সহস্র যুগের অতৃপ্তি আর কান্না নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের আঁধারে তো অবশ্যই, দিনের আলোতেও যেন বাড়িটা এক অন্ধকুটির হয়ে থাকে। মনে হয় বাড়িটা যেন তার অদৃশ্য চোখ দিয়ে সবার উপর নজর রাখে। তাই পারতঃপক্ষে কেউই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁসে না! 

রাতের আকাশের যখন তারাদের লুকোচুরি খেলাটা মেঘের আড়ালে ঢেকে গেল, ঠিক সেইসময় দেখা গেল খুব দূউউর থেকে একটি লোক স্লথপায়ে এগিয়ে আসছে এই নিস্তব্ধ, প্রাণশূণ্য, নিঃসার বাড়িটার দিকে। লোকটির চোখ খোলা কি বন্ধ আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। পায়ে কোন জুতো বা চপ্পল নেই। অনেকটা রাস্তা খালিপায়ে হেঁটে আসায় পায়ের তলাটা জায়গায় জায়গায় কেটে ছড়ে গেছে! হয়তো কোন কাঁটা ঝোপের ওপর দিয়ে হেঁটে এসেছে অনেকটা। আধবোজা চোখ তার। এক অদ্ভুদ আকর্ষণে সে এগিয়ে যাচ্ছে ভগ্নপ্রায় পোড়া বাড়িটার দিকে। বাড়িটি ঢোকার মুখটা সরু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকানো। লোকটির কানে কেউ ফিসফিসিয়ে বলল, 'এসেছো এতোদিন পর তুমি এসেছো! এসো, ভেতরে এসো! চলো খেলবো, আনন্দ করবো আমরা।'
লোকটি হাত বাড়িয়ে বেড়াটা সরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সরু কাঁটাতারের বেড়াটা সরাতে গিয়ে লোকটার হাতও কেটে গেছে গভীর ভাবে। গলগলিয়ে ঝরে পড়ছে রক্ত! পোড়াবাড়ির চত্ত্বরটা যেন আরো ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। লোকটা সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই হারিয়ে গেল…।

সকালে বৃন্তমালা নিজের ছাগল দুটোকে চড়াতে বের হয়। গ্রামের উত্তর দিকে একটু মেঠো জমি আছে। ওদের গুটিকয়েক গ্রামবাসীর গরু-ছাগলকে এখানেই চড়ানো করা। জমি থেকে হাত বিশেক দূরেই রয়েছে সরুগঙ্গা নদী। এই নদীতে মাছ আছে। কিন্তু কেউ সাহস করে মাছ ধরে না। গ্রামের সবাই নদীটিকে সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে। বৃন্তমালার ছাগলদুটো ঘাস খেতে খেতে একটু দূরে চলে গিয়েছিল। ষাটের ওপর বয়স্কা বৃন্তমালার শরীরটা একটু স্থূলকায়। নদীর শীতল হাওয়া আর গাছের ছাওয়া দুইয়ের সংযোগে বৃন্তমালার চোখটা একটু বন্ধ হয়ে এসেছিল। হঠাৎ ছাগলদের চেঁচামেচি শুনে চমকে উঠল বৃন্তমালা! চোখ মেলে দেখে যে ওর ছাগলদুটো কি যেন একটা শুঁকছে। একটু এগোতেই সে দেখে সকালের রোদ কিছু একটা জিনিসের ওপর পড়ে ঝকমক করছে। কোন দামি কিছুর পাওয়ার আশায় আরো তিন/চার পা সে এগিয়ে দেখে সামনের জমিটা লালে লাল হয়ে আছে। তাঁর ছাগলদুটো ওই লাল জমিটাকেই শুঁকে যাচ্ছিল। লালরঙটার উৎসের খোঁজে এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাতেই নজরে এল একটা লোকের মৃতদেহ। শহুরে পোশাক, গলার নালি কাটা, হাতে ধরা একটা ধারালো কাঁচের টুকরো! লোকটার শরীরের রক্তক্ষরণের জন্যই আশেপাশের জায়গা লাল হয়ে আছে। বৃন্তমালা এসব দেখেই "লাশ, লাশ" বলে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে আছড়ে-পিছড়ে গ্রামের দিকে দৌড়ে গেল খবর দিতে।

দৃশ্য |২|

উজানপুরের লোকসংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। কারণটা খুব স্বাভাবিক। উজানপুরের মাটি খুব একটা উর্বর নয়। সেরকম কিছুই চাষ হয় না প্রায়। গ্রামের জোয়ানরা এখন পেটের যোগান জোগাড় করতে এখন শহরমুখী হয়েছে। গ্রামে শুধু অল্পকিছু বয়স্ক মহিলা-পুরুষ থাকেন। কেননা শহরের জটিল জীবনে তাঁরা মানাতে পারবেন না। তাঁদের ছেলে-মেয়েরা আসে মাসে দুমাসে এক/দুদিনের জন্য। বাড়িতে টাকা-পয়সা, ওষুধ-জামাকাপড় দিয়ে আবার দিনে দিনেই শহরে ফিরে যায়। সন্ধ্যার পরে  গ্রামের কেউই বাড়ি থেকে বেরোয় না। কারণ একটাই; উজানপুরের 'অভিশপ্ত কুন্তলবাটি'। দিনের আলোয় কুন্তলবাটিকে দেখলে অতোটা ভয়ঙ্কর মনে হয় না। কিন্তু সন্ধ্যার পর রহস্যময় হয়ে ওঠে পুরো কুন্তলবাটি চত্ত্বরটা। এক অজানা অন্ধকারের বড়ো পিণ্ড ঘিরে ধরে সমস্ত বাড়িটিকে। উজানপুরে ঢোকার মুখেই পড়ে অভিশপ্ত কুন্তলবাটি! গ্রামবাসীরা তাই একটা ঘুরপথ বানিয়েছে গ্রামে ঢোকার জন্য। 

আজ সকাল থেকেই বুড়ো বটতলায় গ্রামের প্রায় সকলেই জমায়েত করে আছে। আলোচনার বিষয়, 'সকালের বৃন্তমালার দেখা লাশ'। একজন বলল, 'বৃন্তমালার কথার ওপর কি বিশ্বাস করা যায়! ওর তো মাথার ব্যামো আছে।'

জমায়েত লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ যদু ঘোষ। সে বলে, 'তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে যে বৃন্তমালা কিন্তু কুন্তলবাটির কাছাকাছিই দেখেছে লাশটাকে।'

অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক বরুণের আবার সবেতেই খোঁচানো স্বভাব। 
সে বলে, 'কিন্তু যদু জ্যাঠা আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে ওই অভিশপ্ত বাড়ির দিকে আমরা কেউই যাইনা। তাহলে বৃন্তমালা কাকি ওইখানেই কেন গেলেন ছাগল চড়াতে? আর সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হল আমরা যখন ছুটে গেলাম সরুগঙ্গার পাড়ে তখন তো সেখানে কিছুই ছিল না। না তো ছিল কোন লাশ...না তো ছিল কোন রক্তের দাগ! ভাগ্যিস, আমরা পুলিশকে খবর দেওয়ার আগে নিজেরা গিয়ে ঘটনাস্থলটা দেখে এসেছিলাম। নইলে পুলিশ আমাদেরকেই হেস্তনেস্ত করে ছাড়তো।'

বুড়ো লেঠেল বিরু সর্দার হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকে বলল, 'একদম ঠিক বলেছিস বরুণ। এই তো মাস পাঁচেক আগে ভর সন্ধ্যেবেলায় আমার বাড়ির দরজায় চরম ধাক্কাধাক্কি আওয়াজ! আমার বউ তো ভীষণ ভয় গিয়েছিল। এমনিতে কুন্তলবাটির জন্য আমরা সকলেই ভয়ে ভয়েই থাকি। তার ওপর যদি সন্ধ্যায় ওরকম দরজায় ধাক্কাধাক্কি হয়...। তাহলে যে কি মনে হয় সেকথা আমাদের কারোরই অজানা নয়! যাই হোক মা দশভূজাকে স্মরণ করতে করতে দরজা খুলে দেখি বৃন্তাপাগলী হাত-পা নাড়িয়ে চোখগুলো ছানাবড়া করে হাউ-হাউ করে যা বলল তার মর্মার্থ হল যে সে নাকি কিছু আগেই একটি মেয়েকে কুন্তলবাটিতে ঢুকতে দেখেছে। কিন্তু অনেক্ষণ সময় পেরিয়ে যাবার পরও মেয়েটিকে বের হতে দেখতে পায়নি। আর মেয়েটি ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই বৃন্তাপাগলী তার চিৎকার শুনতে পায়। একসময় লেঠেল ছিলাম...ভাবলাম...একা মেয়ে..কার না কার ঘরের প্রদীপ...লন্ঠন নিয়ে একদুজনকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। কিন্তু কোথায় কী! কিচ্ছু দেখতে পাইনি! সত্যি কথা বলতে প্রথমে বেশ সাহসের সঙ্গে গেলেও পরে বেশ ভয়ই লাগছিল। খুঁজে-বেড়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। বেরিয়ে আসতেই দেখি ওই 'অন্ধকারে ভূতুরে গোলাটা' তৈরি হতে শুরু হয়ে গেছে। কোনমতে দৌড়ে পালিয়ে আসলাম। কুন্তলবাটি থেকে বেরিয়ে এসে আমরা কেউই কিন্তু বৃন্তাপাগলীকে দেখতে পাইনি। রেগেমেগে তার বাড়ি গিয়ে ওখান থেকে চলে আসার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে হাত উল্টে বলে সে নাকি আমার বাড়িতে গত দুদিন ধরে যায়ই-নি। বোঝো ঠ্যালা!'

হরেণ সমাদ্দার বলে, 'বিরুদা তোমার সাহসটা চিরকালই বেশি! কিন্তু এখন তো গ্রামের পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। এই বিশ বছরে অনেক বদলে গেছে। আর তাছাড়া তোমার তো বয়েসও হয়েছে নাকি! এভাবে যার-তার ডাকে হুটহাট করে চলে যেও না।' 
বুড়ো বটতলায় আরো বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা প‍র্যালোচনা চলার পর একটা সময় সভা ভঙ্গ হল। 

বৃন্তমালা আর সুপ্রভা পাশাপাশি ঘরেই থাকে। বৃন্তমালার পরিবারে কেউ নেই। স্বামী গত হয়েছে সেই কোন্ কালে। ছেলেপুলে হয়নি তার! কিন্তু পাশেরবাড়ির সই সুপ্রভা এবং সুপ্রভার স্বামী সুখে-দুঃখ সবসময়ই বৃন্তমালাদের পাশে থাকতেন। সুপ্রভার স্বামীও ইহলোক ছেড়েছেন আজ তিনবছর হল। সুপ্রভার স্বামী গত হওয়ার পর ওরা দুই সই হৃদয়ের আরো কাছাকাছি চলে এসেছেন। দুবছর আগে সুপ্রভার ছেলে প্রবির যখন উজানপুরে এসেছিল তখন দুই বাড়ির মাঝখানটা জুড়ে দিয়েছিল। প্রবির শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। তাই দুটো বেড়ার তৈরি বাড়িকে একটা বাড়ি বানাতে তার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এই ব্যবস্থাপনায় দুই সইয়েরই বেশ সুবিধে হয়েছিল! সংসারের যাবতীয় কাজ দুজনে মিলে-বেটে করে নিতেন। কয়েকবছর আগে বৃন্তমালার মাথায় দোষ ধরা পড়ে। অবশ্য দোষ না গুণ সেটা সুপ্রভা ঠিক জানেন না। কারণ বৃন্তমালা সেটা দেখতে পান যা আর পাঁচজন দিনের আলোতেও দেখতে পান না।

দৃশ্য |৩|

সকাল থেকে আকাশটা মুখ ভার করে আছে! বৃন্তমালার শরীরটা আজ বিশেষ ভাল নেই। ছাগলদুটোর দুধ দুইয়ে এনে উনুনে গরম বসিয়ে কলপাড়ে বাসনকটা মাজতে যেতেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলেন। সুপ্রভা কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দেখে বৃন্তমালা লুটিয়ে পড়ে আছেন কলতলায়। হাঁকডাক করে পাশের বাড়ির নমিতা, সবিতা, হারুনকে ডেকে এনে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলেন। হারুন ছুটল গ্রামের ওঝা রাজেন সামন্তর কাছে। রাজেন সামন্তর গাছ-গাছড়া সম্বন্ধে অপরিসীম জ্ঞান! গ্রামের লোকেদের কোনকিছু হলে প্রাথমিক ভাবে রাজেন সামন্তই চিকিৎসা করেন। রোগ গুরুতর হলে তখন শহরে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীকে। কিন্তু শহর বেশ দূরে বলে এখানকার লোকের প্রধানতঃ রাজেনের ওপরই নির্ভরশীল।

রাজেন এসে নাড়ি পরীক্ষা করে বলল, 'এঁনাকে একটু নজরে নজরে রাখবেন! নাড়িটা বড়োই দূর্বল ঠেকছে।' 

বিকেল হতে না হতেই বৃন্তমালার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এল। সুপ্রভা সকাল থেকে বৃন্তমালার শিয়রের কাছেই বসে আছেন। সময়ে সময়ে একটু বার্লি, একটু খিচুড়ি খাইয়ে দিচ্ছেন। সুপ্রভারও বয়েস হয়েছে‌। সকাল থেকে একটানা করতে করতে সে-ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাতের দিকে বৃন্তমালার  জ্বরটা একটু কমলে দুই সই মিলে দুটো খেয়ে শুয়ে পড়লেন। বৃন্তমালার শরীরটা একটু ঠিক হওয়ায় সুপ্রভা একটু নিশ্চিন্তে ছিলেন; তাই হয়তো অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ভোর হতে তখনও ঢের দেরি আছে। হঠাৎই সুপ্রভার কানে এল কেউ যেন কথা বলছে! চোখ মেলে দেখেন পাশে বৃন্তমালা নেই। এক কুচিন্তায় বুকটা 'ছ্যাৎ' করে উঠল সুপ্রভার। বিছানা থেকে নেমে এসে বৃন্তমালাকে খুঁজতে গিয়ে দেখেন যে দরজা খোলা রেখে বৃন্তমালা হাসি হাসি মুখে কার সাথে যেন কথা বলছেন। কিন্তু দরজার ওপারে কেউ ছিল না। এক হীমস্রোত গড়িয়ে গেল সুপ্রভার পিঠ বেয়ে! খানিকপরেই বৃন্তমালা দরজায় খিল দিয়ে পেছনে সুপ্রভাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একগাল হেসে উঠলেন। গতসকালে ওইরকম শরীর খারাপের পর এখন সইয়ের মুখে হাসি দেখে সুপ্রভার বেশ ভাল লাগলেও মন থেকে কিছুতেই খচখচানি ভাবটা কাটাতে পারলেন না। শোয়ার ঘরে এসে দেখলেন বৃন্তমালা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভাবলেন, 'থাক্, অসুস্থ মানুষ! এখন ঘুমোক। সকালে বরং কথা বলবো।' 
সুপ্রভা আর বেশী কিছু চিন্তা না করে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন‌।

পরদিন সুপ্রভা ঘুম থেকে উঠে দেখেন বৃন্তমালা পাশে নেই। গতরাতের আতঙ্কটা আবার চেপে বসলো সুপ্রভার মনে। দূরুদূরু বুকে বিছানা ছেড়ে উঠে সুপ্রভা দেখেন যে ঘর-দোর সব পরিস্কার করা, এঁটো বাসন সব ধুয়ে কলপাড়ে রাখা, উঠোনবাড়ি পরিষ্কার করা। সব দেখে-শুনে তিনি বেশ আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন। রান্নাঘরে উঁকি দিতেই তিনি দেখেন বৃন্তমালা চা-জলখাবার বানাচ্ছেন। ভারি অবাক হয়ে গেলেন তিনি। বললেন, 'হ্যাঁ রে বৃন্তো(বৃন্তমালাকে এই নামেই ডাকেন সুপ্রভা)! কাল অতো শরীর খারাপ ছিল..মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলি...আর আজ কিনা সকালে উঠেই কাজকম্ম শুরু করে দিয়েছিস! আবার যদি শরীর খারাপ হয়ে যায় তখন কি হবে, ভেবে দেখেছিস একবারও?'

একগাল হেসে বৃন্তমালা বললেন, 'অতো চিন্তা করিস না সুপ্রভা। আমি ঠিক আছি রে! আমার মেয়ে এসেছে না। এখন আর আমার কোন অসুখ নেই! এখন আমি বেশ ভাল...বেশ ভাল।'

সুপ্রভা দৌড়ে এসে বৃন্তমালার কপালটা ধরে বললেন, 'আবার জ্বর এসেছে নাকি! কি আবোল তাবোল বকছিস বৃন্তো! তোর মেয়ে কি করে আসবে এখানে। তোর তো..।'

সুপ্রভার কথা শেষ হওয়ার আগেই বৃন্তমালা তার মুখ চেপে বলে, 'না, না...অমন করে বলিস না সই। জানিস না ও খুব কষ্ট পায়! জানিস তো যখন গলায় জড়িয়ে আবদার করে বলে মাথায় তেল দিয়ে দিতে অথবা শাড়ির কুঁচিটা ধরতে তখন আমার বুকটা খুব জুড়িয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলেই তার টোল পড়া হাসি-হাসি মুখটা ভেসে ওঠে। তুইও তো চিনিস রে আমার মেয়েকে! নাকি এরইমধ্যে ভুলে গেলি তাকে।' 

সুপ্রভার পিঠে যেন চাবুক পড়লো। বললেন, 'কার কথা বলছিস তুই বৃন্তো..।'

কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বৃন্তমালা বললেন, 'আমার মেয়ে, মণিকুন্তলা!' 

মণিকুন্তলার নাম শুনে আতঙ্কে সুপ্রভার মুখটা নীল হয়ে গেল।

দৃশ্য |৪|

বিশ বছর আগে …

উজানপুরে আজ সাজো সাজো রব! আজ উজানপুরের বড়ো শিবতলা মন্দিরে পুজো। আশেপাশের গ্রামের লোকেরাও আসে এখানে পুজো দিতে। এই পুজো উপলক্ষ্যে তিনদিন ব্যাপী মেলা হয়। খুব আনন্দ করে গ্রামবাসীরা এইক'টা দিন। মন্দিরটা খুব বড়ো নয়। কিন্তু যখন পুজোর সময় ফুল দিয়ে সাজানো হয় তখন মন্দিরটি অভাবনীয় স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যে সেজে ওঠে। আর সেই সৌন্দর্য্যকে আরো দ্যূতিময় করে তোলে মন্দিরের পুরোহিত কুন্তল চক্রবর্তীর মেয়ে মণিকুন্তলার গান। কি অপূর্ব তার সুর, কি মধুর তার ধ্বনি, কি শ্রুতিসুখ তার শিবস্তোত্র উচ্চারণে। সে যে না শুনবে তার জীবনই বৃথা! গ্রামবাসীরা মণিকুন্তলার রাগস্তোত্র শোনার জন্য সকাল থেকেই মন্দির প্রাঙ্গণে জমায়েত করে যায়। জন্মকালে একঢাল চুল নিয়ে জন্ম হতে দেখে পুরোহিত কুন্তল চক্রবর্তী আদর করে মেয়ের নাম রাখলেন মণিকুন্তলা। মণিকুন্তলার নামানুসারেই পুরোহিত বাড়ির নাম 'কুন্তলবাটি' রাখা হয়। মণিকুন্তলার ধাইমা ছিলেন বৃন্তমালা। তাই ছোটো থেকেই মণিকুন্তলা বৃন্তমালাকে 'মণিমা' বলে ডাকতো। বৃন্তমালার মরুভূমির মাতৃহৃদয়টা মণিকুন্তলার 'মণিমা' ডাকে স্নেহের বৃষ্টিতে ভিজতো! আবার তার মাতৃত্বের স্বাদও মিটতো। মণিকুন্তলার যখন দশবছর বয়েস তখন তার মা মারা যায়। সেসময় সে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে বৃন্তমালার সাথে। বেশ চলছিল সময়। 

মন্দিরের সব গোছানোর কাজ চলছে। মণিকুন্তলা বীণা নিয়ে বসেছে। ওদিকে কুন্তল পুরোহিত পুজোর যাবতীয় আয়োজন শেষ করে সবে নৈবেদ্য সাজাচ্ছিলেন। এমন সময় বাইরে থেকে কয়েকজনের আওয়াজ শোনা গেল, 'বাবুমশাই এসেছেন...বাবুমশাই এসেছেন!' 

কুন্তলবাবু বুঝতে পারলেন যে গ্রামের জমিদার এসেছেন। কুন্তলবাবু বড়ো নিষ্ঠাবান পুরোহিত। একবার পুজোয় বসে গেলে পুজো শেষ না করে ওঠেন না। মণিকুন্তলার গান ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। কুন্তলবাবুও পুজো শুরু করলেন। প্রায় আড়াই/তিন ঘন্টার পর পুজো শেষ করে উঠে দেখেন জমিদারবাবু তখনও মন্দিরে বসে আছেন। আর সাথে দুজন ছেলে ও একটি মেয়ে বসে আছে। জমিদারবাবু লোকটা বেশ ভাল। 
নমস্কার জানিয়ে কুন্তলবাবু বললেন, 'কেমন আছেন বাবুমশাই।' 

জমিদারবাবু বললেন, 'ভাল আছি কুন্তল। ভাবলাম পূণ্য দিনে একটু পুজো দিয়ে যাই। এখানে এসে মণিকুন্তলার গান শুনে আর নড়তেই পারলাম না। আহাহা কি দারুণ গায় তোমার মেয়েটা। একেবারে গুণে সরস্বতী আর রূপে লক্ষ্মী। বেঁচে থাক মা...এই বুড়োর জীবন ধন্য হয়ে গেল!' 

কুন্তলবাবু বললেন, 'আশির্বাদ রাখবেন বাবুমশাই!' 
তারপর ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে কুন্তল পুরোহিত জিজ্ঞাসা করলেন, 'এরা কারা বাবুমশাই? এদের তো ঠিক চিনলাম না।' 

একটু হেসে জমিদার বাবু বললেন, 'এ আমার ছেলে প্রসুন আর ওরা ওর কলেজের বন্ধু সুজয় আর শিউলি। এদের কলেজ শেষ। সকলের চাকরি হয়ে গেছে। প্রসুন তো বিদেশে চলে যাবে। ছোটো থেকেই ছেলের পড়াশোনার যাতে ক্ষতি না হয় সেকারণে বুকে পাথর চেপে শহরে ছোটোভাইয়ের কাছেই রেখে দিয়েছিলাম। এবছর সে বিদেশ চলে যাবে। আবার কবে আসবে তার তো ঠিক নেই। তাই বললাম গ্রামে ঘুরে যা একবার। বললে, দুজন বন্ধুকে নিয়ে আসছি। ভাবলাম তা-ই ভাল। নইলে বুড়োদের মাঝে শুধুশুধু বিরক্ত হয়ে যাবে।' 

কুন্তল পুরোহিত বললেন, 'না না। ভালই করেছেন।' 

ওদিকে একজোড়া লোলুপ চোখ পঞ্চদশী তন্বী মণিকুন্তলাকে আপাদমস্তক মেপে যাচ্ছিল। মণিকুন্তলার বড্ড অস্বস্তি হওয়ায় সে বলল, 'বাবা, চলো। তোমার মধ্যাহ্ন আহারের সময় হয়ে গেছে।'
কিছুটা এগিয়ে এসে মণিকুন্তলা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কিছু একটা টের পেয়ে কুন্তল পুরোহিত বললেন, 'কি রে মা..কি হল! অমন হাঁপিয়ে উঠলি কেন?'

মণিকুন্তলা বলে, 'কিছু না বাবা। এমনিতেই।'
বাকি পুজোর দিনগুলো ভালয় ভালয় কেটে গেল। একদিন সরুগঙ্গার আয়নার মতো জলের ধারায় নিজের ছবি দেখতে দেখতে আপনমনে গান গাইছিল মণিকুন্তলা। এমন সময় সেখানে শিউলি উপস্থিত হয়ে বললো, 'বাহ ভারী মিষ্টি গলা তো তোমার…।'
আওয়াজ শুনে মণিকুন্তলা পেছনে ফিরে দেখে শিউলি, সুজয়, প্রসুন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। 

শিউলি আবার বলল, 'কি নাম গো তোমার।' 
শহর থেকে গ্রামে এসেছে এরা, গ্রামের অতিথি। উপরন্তু বাবুমশাইয়ের ছেলের বন্ধু! তাই ইচ্ছে না থাকলেও মণিকুন্তলা নিজের নাম বলল। এটা-সেটা কথা বলার পর শিউলি বলল, 'আমরা আগামীকাল ফিরে যাব শহরে। তাই ভাবলাম গ্রামটা ঘুরে দেখি। কিন্তু এখানে তো কিছুই চিনিনা। সেদিন মন্দিরে তোমার গান শুনে একবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম! কি ভাল গান করো তুমি! তাইতো তোমাকে এখানে দেখেই চিনতে পেরে গেলাম। শোনো না আমাদের তুমি গ্রামটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে, প্লিজ।' 

মণিকুন্তলা ভাবল, শুধু গ্রামই তো দেখবে। তাছাড়া আরেকটা মেয়েও তো আছে সঙ্গে। এতক্ষণ কথা বলে তো বেশ ভালই লাগল মেয়েটিকে। একটু ভেবে তখন মণিকুন্তলা বলল, 'ঠিক আছে, চলুন।'

মণিকুন্তলা একটু এগিয়ে গেলে সুজয় শিউলিকে চোখ টিপ দিয়ে বলল, 'কি বুদ্ধি রে তোর! সেই কবে থেকে চেষ্টা করছিলাম মেয়েটাকে পটানোর। পাত্তাই দিচ্ছিল না। তুই তো ফুৎকারেই সব সেট ক‍রে দিলি।' 

একটা বাঁকাহাসি দিয়ে শিউলি বলে, 'হেঃ হেঃ হেঃ! লোক পটানোর গুণটি আছে বলেই তো পি.আর.ও.র চাকরিটা পেয়েছি।' 

প্রসুন বলে, 'আমি জমিদারের ছেলে, তা-ও কিনা আমায় পাত্তা দেয় না। আজ দেখবো, কেমন করে পাত্তা না দিয়ে যায়।' 

গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে শিউলি, সুজয়, প্রসুন ইচ্ছে করে মণিকুন্তলাকে শহরের বিভিন্ন গল্প শোনাতে থাকে। টুকটাক মজার কথা বলে। হাসি-ঠাট্টার মধ্যে মণিকুন্তলা লক্ষ্য করল না যে সে গ্রামের বাইরে 'বুড়িমার জঙ্গলে'র কাছাকাছি চলে এসেছে! সরুগঙ্গা এই বুড়িমার জঙ্গলের কাছে এসেই খরস্রোতা হয়ে যায়। এমনিতেও নদীটা যথেষ্ট গভীর। বুড়িমার জঙ্গল ঘেঁষে সরুগঙ্গা সোজা গিয়ে পরে বড়ো নদীতে। বেলা পড়ে আসতে দেখে মণিকুন্তলা বলে, 'চলুন, ফিরে যাই। এরপর দেরি হলে বাবা চিন্তা করবেন।'

প্রসুন বলে, 'আরেকটু পর ফিরি মণি! এই তো সবে আনন্দ করতে শুরু করলাম।'

শিউলি আর সুজয়ও সুর মেলায়। কিন্তু মণিকুন্তলার ওই এক জেদ, যে অনেক বেলা হয়েছে এখন ফিরে যাওয়া উচিৎ। হঠাৎ শিউলি নিজের ক্রিসক্রস ব্যাগ থেকে একটা সুদৃশ আয়না মণিকুন্তলার হাতে দিয়ে বলল, 'দেখো, এটা তোমার জন্য।' 
আয়নাটা সাধারণ হাত আয়নার মতো নয়, একটু বড়ো। কিন্ত যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় সেটা হল আয়নার চারপাশে লাল-নীল পাথরের অদ্ভুত কারুকার্য! সন্ধ্যার পড়ন্ত আলো পাথরগুলোর ওপর পড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। খানিকের জন্য পঞ্চদশী মণিমালা আয়নাটির সৌন্দর্য্যে হারিয়ে গেল! এরকমই একটা মুহুর্তের অপেক্ষা করছিল সুজয় আর প্রসুন। দুজনেই মণিকুন্তলাকে পেছন থেকে জাপটে ধরলো। এই অকস্মাৎ আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। পরিস্থিতিটা বোঝার পর মণিকুন্তলা চিৎকার করে ডাকলো শিউলিকে। কিন্তু তখন শিউলি হাসতে হাসতে বলল, 'আরে ভয় পাচ্ছ কেন মণি? জীবনে একটু এনজয় করো।' 

মণিকুন্তলার চিৎকার তার মুখেই আটকে রইল। প্রসুন আর সুজয় মিলে যখন জাপটা-জাপটি করছিল তখন মণিকুন্তলার হাত থেকে সুদৃশ আয়নাটা পড়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল। মণিকুন্তলা দেখলো মাটিতে কাঁচের টুকুরো পরে আছে। গায়ের সব শক্তি জড়ো করে ওদেরকে ধাক্কা দিয়ে মাটি থেকে একটা বড়ো কাঁচের টুকরো হাতে নিয়ে সরুগঙ্গার দিকে দৌড় দিল! সুজয় আর প্রসুনও পেছন পেছন দৌড়ে এল। মণিকুন্তলা হাতে ধরা কাঁচের টুকরোটাকে উদ্যত করে চিৎকার করে বলল, 'তোমাদের নোংরা অভিসন্ধি কিছুতেই পূরণ হবে না। আমার মহাদেব সাক্ষী রইলেন...তোমাদের জন্য আমাকে আমার বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে! এর শাস্তি তোমরা পাবে। আমি দেবো তোমাদের শাস্তি। আমি আবার ফিরে আসবো।' 
একথা বলেই মণিকুন্তলা কাঁচের টুকরোটাকে পুরো বিঁধিয়ে দিল নিজের শরীরে আর গড়িয়ে পড়ল সরুগঙ্গার ধারায়। তার দেহটা সরুগঙ্গায় ভেসে চলে গেল বহুদূর। এই ঘটনায় প্রসুনরা হতভম্ব হয়ে গেল! এরকম কিছু হবে তারা আশাই করেনি। ত্রস্ত পায়ে ওরা তিনজন সোজা ফিরে গেল জমিদার বাড়ি। প্রসুন জমিদারবাবুকে বলল, 'বাবা আমরা ফিরে যাচ্ছি। খুব আর্জেন্ট।' 

জমিদারবাবু বললেন, 'রাতটা থেকে গেলে হত না।'

'না, না মেশোমশাই। তাহলে খুব দেরি হয়ে যাবে যে', শিউলি বলল। 

জমিদারবাবু আর কিছু বললেন না। ওরা বেরিয়ে যাবার খানিক পরেই কুন্তল পুরোহিত, বৃন্তমালা, সুপ্রভা, লেঠেল বিরু সহ আরো কিছু গ্রামবাসী মণিকুন্তলার খোঁজে জমিদার বাড়ি এল। জমিদারবাবুর আর বুঝতে অসুবিধা হল না কেন প্রসুনরা তড়িঘড়ি করে শহরে ফিরে গেল। দুদিন পর সরুগঙ্গায় মণিকুন্তলার লাশ ভেসে উঠল। কুন্তল পুরোহিত সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। বৃন্তমালা পাগলের মতো হাহাকার করতে করতে শিবমন্দিরেই পড়ে থাকতেন। ঠিক একসপ্তাহের মধ্যেই জমিদারবাবু আত্মহত্যা করলেন। অযত্নের ফলে শিবমন্দিরে আগাছার জঙ্গলে ছেয়ে গেল। পুরোহিতের বাড়িটা দেখতে দেখতে কেমন যেন পোড়াবাড়িতে পরিণত হয়ে গেল। তারপর গ্রামজুড়ে দেখা দিল মরক। অজানা রোগে লোক মরতে লাগল। গ্রামের সব উর্বর জমি হঠাৎই অনুর্বর হয়ে গেল। এক অজানা অভিশাপে ছেয়ে গেল পুরো উজানপুর। গ্রামবাসীরা এর কারণ হিসাবে মণিকুন্তলার আত্মাকে দায়ী করল! গ্রামের জোয়ানরা তখন রোজগারের খোঁজে শহরের দিকে রওনা দিল। এরইমধ্যে কিছু কিছু ঘটনা কুন্তলবাটিকে অভিশপ্ত ভাবতে বাধ্য করছে। মাঝে মাঝে লোক কুন্তলবাটি ঢুকলে আর ফেরৎ আসে না। পরে লোকজন বাড়ির ভেতরে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেত না। ধীরে ধীরে উজানপুরের মতো এক সমৃদ্ধশালী গ্রাম এক উজাড় বস্তিতে পরিণত হয়ে গেল।

দৃশ্য ।৫।

বিশ বছর পরে…

প্রায় কুড়ি বছর পর ভারতে এল প্রসুন। বাবা মারা যাওয়ার খবর যখন পেয়েছিল তখন সে সদ্য এডিনবার্গে পৌঁছিয়েছে। সেসময় ভারতে ফেরা সম্ভব ছিল না! বা বলতে গেলে সে ফিরতেও চায়নি।  সেদিনের পর থেকে জেনেশুনেই সুজয় আর শিউলির সাথে প্রসুন কোন যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু আজ বিশ বছর পর সে ফের ভারতে ফেরার টান অনুভব করল। শুধু যে ভারতে ফেরার টান তা নয়, উজানপুরের জন্যও মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠছিল! তাই ভারতে ফিরে আর একটুকুও দেরি না করে পৌঁছে গেল উজানপুর। অমাবস্যার ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারের রাতে কুন্তলবাটির সামনে  মহোগ্রস্থের মতো প্রসুন দাঁড়িয়ে বলল, 'তুমি ডাকছিলে না! দেখো আমি চলে এসেছি মণি।' 

কেউ যেন কানে কানে বলল, 'ওমা! তবে বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছো? ভেতরে এসো! এই যে বললে আনন্দ করবে..।' 

'আসছি আমি মণি…', বলে সরু কাঁটাতারের বেড়াটাকে হাত দিয়ে সরিয়ে অন্ধকারের পিণ্ডের ভেতর হারিয়ে গেল প্রসুন। 

বাড়ির ভেতর একজায়গায় আলো জ্বলতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যেতেই প্রসুন দেখে একজন পঞ্চদশী মেয়ে লাল-নীল পাথরের কারুকার্য করা সুদৃশ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গুনগুন করে গান গাইছে। প্রসুন সামনে এসে দাঁড়াতেই গান গাওয়া বন্ধ করে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে প্রসুনের দিকে তাকালো সে। সঙ্গে সঙ্গে সুদৃশ আয়নাটা কড়কড় করে ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়লো। মণিকুন্তলার বিদেহী অবয়বটা বলল, 'তুমি তো জানো, তোমায় কি করতে হবে!' 

সম্মোহিতের মতো মাথা নাড়িয়ে প্রসুন একটা তিক্ষ্ণ ভাঙ্গা কাঁচ নিয়ে গলার নালি বরাবর একটা গভীর পোচ দিল। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসতেই কাটা কলাগাছের মতো ধপ্ করে নিচে লুটিয়ে পড়ল প্রসুন। ছটফট করতে করতে একসময় নিথর হয়ে গেল প্রসুনের দেহ। সঙ্গে সঙ্গে এক অট্টহাসিতে গুঞ্জরিত হয়ে উঠল গোটা কুন্তলবাটি।

পরদিন সকালে বৃন্তমালা আবার গ্রামের উত্তর দিকের মেঠোজমিতে ছাগলদুটোকে চড়াতে নিয়ে গেলেন। ছাগলদুটোকে ঘাস খেতে দিয়ে নিজে ধীরে ধীরে সরুগঙ্গার ধারে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলেন সেখানে পড়ে আছে প্রসুনের রক্তাক্ত সারহীন দেহ। তার অদূরেই রয়েছে মণিকুন্তলার ধোঁয়া ধোঁয়া শরীর। মুখে তার তৃপ্তির হাসি! বৃন্তমালার চোখদুটোও চকচকিয়ে ওঠে। আর মুখে ফুটে ওঠে হাসির ঝলক। বিরবিরিয়ে বললেন, 'তুই পেরেছিস মা...প্রতিশোধটা নিতে পেরেছিস..।' 

এবার তার দায়িত্ব এই খবরটা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া। মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো করে "লাশ..লাশ" বলে চিৎকার করতে করতে বৃন্তমালা গ্রামের দিকে ছুটলেন।

তনিমা সাহা
কোলকাতা, ভারত