লুকোনো মন্দির - তনিমা সাহা
জানিস জলের যে একটা শব্দ আছে!
বিভাসের কথায় একটু বিরক্ত হয়ে সবুজ বললো, 'হ্যাঁ.…না জানার কি আছে। জলের তো হরেকরকমই শব্দ হয়। এই যে কবিদের ভাষায় বলে না 'কুলকুল', 'ঝিলমিল', 'কলকল', 'ঝরঝর' আরো কতো শব্দ। জলের শব্দের কী আর শেষ আছে', বলে আবার নিজের শব্দজব্দে মন দিল।
গত আধঘন্টা একটা শব্দ কিছুতেই মেলাতে পারছে না। সংকেত দেওয়া রয়েছে 'আর্তি'। বিভাস হাল না ছেড়ে বলল, 'ওফফ্! ওই শব্দ নয় রে..এই ধর তোর মনে হবে কেউ যেন কান্না করছে বা কেউ "বাঁচাও বাঁচাও" বলে চিৎকার করছে।'
হঠাৎ লাফিয়ে উঠে সবুজ বলল, 'এই তো পেয়েছি "চিৎকার"। 'চ' দিয়ে শুরু, আর 'র' দিয়ে শেষ। কতক্ষন ধরে ভেবেই যাচ্ছিলাম!'
হঠাৎ সবুজ বিভাসের থতমত খাওয়া চেহারাটা দেখে বলল, 'কী রে, তোর আবার কী হল?'
- কি জোর চেঁচিয়ে উঠলি, আমার যে হার্টফেল হয়ে যায়নি..এটাই সাতজন্মের ভাগ্য।
খিলখিল করে হেসে সবুজ বলল, 'কার ভাগ্য….তোর না আমার।'
বিভাস বলল, 'তোরই..কার আবার।'
বলে দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ওদের হাসির মাঝেই তিতলি, মৃন্ময়, সেঁজুতি আর থিম্পু ঘরে ঢুকলো। তিতলি আর মৃন্ময় ক্লাস সেভেনে পড়ে। বহির্জাগতিক জীবজন্তু নিয়ে সেঁজুতির আগ্রহের শেষ নেই। কোথায়, কোন্ সালে কী ধরনের বহির্জগতের জীবদের বা তাদের স্পেসশীপ দেখা গেছে সেসব সম্পর্কে সব তথ্য তার জানা। সেঁজুতি আর সবুজ পড়ে ক্লাস এইটে। তিতলির আবার মাইথোলজিক্যাল বিষয়ে খুব আগ্রহ রয়েছে। সেঁজুতি তাইকোয়ান্ডোতে অরেঞ্জ বেল্ট। মৃন্ময়ের খুব সুন্দর আঁকার হাত। তিতলি গান গায়। বিভাস ক্লাস নাইনে পড়ে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুব আগ্রহী থাকে। নতুন জিনিস সম্পর্কে জানতে, পড়তে খুব ভালোবাসে বিভাস। থিম্পু স্কুলে পড়েনা। থিম্পু ছোটো থেকেই কথা বলতে পারে না। কানেও হালকা হালকাই শোনে। তবুও তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ওদের সবার থেকে বেশী। হয়তো কথা বলতে পারেনা বলে অন্যান্য ক্ষমতায় সে পরিপূর্ণ। এদের মধ্যে যখন গল্পগুজব হয় তখন পাশ দিয়ে যাওয়া কোনো ব্যাক্তি বলতে পারবেনা যে এরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন বয়সী। সবাই সবাইকে নাম ধরে 'তুই' করে ডাকে। থিম্পু শুধু শোনে আর ওদের মুখের নড়াচড়া দেখে আন্দাজ করে ওরা ঠিক কোন বিষয়ে কথা বলছে। তাইতো আড্ডার মজা নিতে থিম্পুর কোনো অসুবিধে হয়না। তিতলি বাবা তপন একটি বিদেশী ব্যাঙ্কের চাকরি করেন। তিতলির মা প্রমিলার একটি বুটিক আছে। 'প্রমিলা'স বুটিক' নামটি মধ্যবৃত্ত গৃহিণীদের কাছে বেশ পরিচিত। সেঁজুতির বাবা অনিশ পুলিশে চাকরি করেন। সেঁজুতির মা মালতী গৃহিনী। মৃন্ময়ের মা বর্ণালীও একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কে চাকরী করেন। মৃন্ময়ের বাবা অনয় যদিও তাদের সঙ্গে থাকেন না। আলাদা থাকেন আজ দুবছর হলো। বিভাসের বাবা মৃণালের একটা বড়ো ইলেকট্রনিক শপ আছে। বেশ দারুন চলে দোকানটা। বিভাসের মা শাওলি একটি স্কুলে পড়ান এবং এদের সবাইকে টিউশনও দেন। থিম্পুর মা সাংলী ও বাবা সারং থাকেন সবুজদের বাড়ির ঠিক পাশেই। থিম্পুর বাবাও পুলিশে চাকরি করেন আর মা গৃহিনী। সবুজের বাবার প্রত্যুষবাবুর বদলীর চাকরি ছিল। সাংলী সবুজের মা সুরভীকে নিজের দিদির মতোই ভালবাসে। আসলে তাদের তো সেই গ্রামে বাড়ি। সেখানেই তাদের সব আত্মীয়স্বজন থাকেন। থিম্পুর বাবার কাজের জন্য তাদের শহরেই থাকতে হয়।
সেঁজুতি ঘরে ঢুকেই ধপ্ করে একটা বিনব্যাগে বসে বলল, 'ধ্যাৎ ভাল্লাগে না। কেউ সত্যিটা বিশ্বাসই করতে চায়না।'
বিভাস আর সবুজ হাসি থামিয়ে বলল, 'কে আবার কী বিশ্বাস করছে না, তাও আমাদের পেঁজুবুড়ির কথায় বিশ্বাস করছে না।'
সেঁজুতিকে খ্যাপানোর জন্য দলের সবাই ওকে 'পেঁজুবুড়ি' বলে ডাকে।
সেঁজুতি বিভাস আর সবুজের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে, 'এই ভাল হবে না বলছি। এমনিতেই মুন্ডু আমার গরম হয়ে আছে।'
বিভাস ইশারায় মৃন্ময়কে সেঁজুতির রাগের কারণ জিজ্ঞেস করে। মৃন্ময় একটা ক্লু-লেস এক্সপ্রেশন দিয়ে জানায় যে এই ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। এমনসময় বিভাসের মা শাওলি সবার জন্য স্পেশাল ম্যাঙ্গোশেক আর ঘরে বানানো ভেজেটেবল পাফ নিয়ে ঢুকলেন। শাওলি রান্নাবান্না করতে খুব ভালোবাসেন। বিশেষ করে এই কুচোকাচাদের জন্যে রান্না করতে ওনার খুব ভালো লাগে। প্রায়ই কিছু না কিছু বেকিং করে বা রান্না করে এদের এই বৈকালিক আড্ডায় দিয়ে যান। তাতে সবুজদের আড্ডাটা আরো মজাদার হয়ে ওঠে।
শাওলি ঘরে ঢুকে বলেন, 'এই গরমে মাথা গরম করে কাজ নেই সেঁজুতি। এই নাও ম্যাঙ্গোশেকটা খেয়ে মাথাটা একটু ঠান্ডা করো।'
ম্যাঙ্গোশেকটায় একটা বড়ো চুমুক দিয়ে বলল, 'উফ্! কাকিমা...You are a real saviour of mine', বলেই একহাত লম্বা জিভ বার করে বলল, 'sorry, sorry, ভুলে কাকিমা বলে ফেলেছি। Miss বলতে হতো।'
সেঁজুতিকে গাল টিপে শাওলি বললেন, 'আমি স্কুলে Miss; এখানে আমি শুধু তোদের কাকিমা, বুঝলি।'
বিভাস বলল, 'এইকারনেই তুমি এত্তো sweet মা।'
কপট রাগ দেখিয়ে শাওলি বলেন, 'হয়েছে..হয়েছে, আর পাকামো করতে হবে না, খেয়ে নাও চটপট', বলে মিষ্টি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সবাই খাওয়াদাওয়া শেষ করলো।
তারপর মৃন্ময় বলল, 'তা পেঁজুবুড়ি মা..মা..মানে সেঁজুতি, তুই হঠাৎ রেগে কেন গিয়েছিলি রে।'
সেঁজুতি বলল, 'আরে ওই যে শিউলি আছে না, সে বলে রূপকথার সবকিছুই বিশেষ করে যে জন্তু-জানোয়ারের কথা বলা হয়েছে তা সবই নাকি কাল্পনিক, মনগড়া। আমি প্রতিবাদ করে বললাম ওসব মনগড়া, কাল্পনিক পশুপাখি নয়। ওরা সত্যিই ছিল এবং আছে। কিন্তু আমার কথার পাত্তাই দিল না। মাছি তাড়ানোর মতো আমার বলা কথাগুলোকে জাস্ট ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিল জানিস। মনে হচ্ছিল না তাইকোয়ান্ডোর একটা প্যাঁচে শিউলির মুলোর মতো বেড়িয়ে থাকা সবকটা দাঁত ভেঙ্গে দেই। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছেটা দমন করেছি।'
বলে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।
কোনমতে নিজের হাসি সংযত করে বিভাস বলল, 'কিন্তু শিউলি তো কোন অন্যায় কথা বলেনি রে।'
কটমটিয়ে সেঁজুতি বলল, 'বলেছে, আলবাৎ বলেছে। আমরা সবকিছু দেখতে পাইনা বলে তাদের অস্তিত্বই নেই এটা ভেবে নেওয়াটা অনেক বড়ো অন্যায়। এই যে সমুদ্রের তলায় এতো আজব আজব প্রানি বা মাংসাশী মাছ থাকে সেগুলো কি আগে কেউ জানতো। অ্যানিমেল প্ল্যানেট, ন্যাশনাল ডিসকভারির সুবাদে আমরা সেসবের সম্পর্কে জানতে পারি। তারপর এরইমধ্যে ইতালির সিসিলিতে দানবীয় ঘড়াগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো নিয়ে তো বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ইতিমধ্যেই শোরগোল পরে গেছে। মহাকাশের সেটেলাইট থেকে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের ছবি নেওয়ার সময় দেখা গেল যে রোমের এক অখ্যাত প্রান্তরে কিছু বিশাল বিশাল প্রস্থর খন্ডকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন সেটা কোনকিছুর সিগন্যাল। গবেষণায় জানা গেছে সেই অবিন্যস্ত ভাবে সারবেঁধে দাড় করানো প্রস্থরগুলো আসলে বহির্জাগতিক প্রানীদের জন্যে কোনো নির্দিষ্ট সংকেতচিহ্ন। কেননা সেই প্রস্থর খন্ডগুলো এমনভাবে দাঁড় করানো আছে যা কোনো মানুষের পক্ষে কখনোই করা সম্ভব নয়। পিরামিড অফ গিজার গায়ে বিশালাকার রেখাচিত্রগুলো রয়েছে সেগুলোর কোনো এক্সপ্লেনসন কেউ দিতে পারবে। এমন যে আরো কতো টুকরো টুকরো ঘটনা আছে যা অ্যালিয়েনের অস্তিত্বের দিকে চিহ্নিত করে। আর….।'
'ব্যাস...মাতারানী...ব্যাস! আজকের জন্য এইটুকু জ্ঞান আমাদের যথেষ্ট। এবার থামো মা।'
সবুজের হাতজোর করে মাথা নত করে কথা বলার কায়দায় সবাই হেসে উঠলো। এরমাঝখানেই থিম্পু হঠাৎ হাতপা নাড়িয়ে ইশারায় যেসব কথা বলল, সেগুলো বুঝতে পেরে বাকিদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
আজ সবুজদের বাড়িতে বেশ হইহই ব্যাপার। আজ সবুজের মা-বাবা প্রত্যুষবাবু এবং সুরভী দেবীর বিবাহবার্ষিকী। একজায়গায় সবুজ, থিম্পু, সেঁজুতি, বিভাস, মৃন্ময়, তিতলিদের এক জোর আলোচনা চলছে। মৃন্ময়ের মা বাদে বাকিদের অভিভাবকরা এসেছেন। এমনকি থিম্পুর বাবা সারংও ডিউটি সেরে এসে আসরে যোগদান করেছেন। প্রমিলা আজকে নিজের হাতে ডিজাইন করা একটি শাড়ি এবং পাঞ্জাবি সুরভী ও প্রত্যুষবাবুকে উপহার দিলেন। সবুজদের অনেক আত্মীয়স্বজনও এসেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আত্মীয়রা একে একে বিদায় নিলেন। রাতও হয়ে আসছিল তাই বাকিরাও বাড়ির পথে পা বাড়ালেন।
এমনসময় বিভাস বলল, 'আমার না একটা কথা বলার ছিল।'
বিভাসের বাবা মৃণাল বললেন, 'তোর আবার কি বলার আছে?'
মুচকি হেসে তিতলির মা প্রমিলা বললেন, 'থাক না দাদা। ও বলুক না কি বলার আছে ওর।'
তারপর বিভাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, বলো বাবা তোমার কি বলার আছে?'
বিভাস বলল, 'আমাদের তো গরমের ছুটি পরে গেছে আজ পাঁচদিন হয়ে গেছে। আরো তিনসপ্তাহ ছুটি আছে। কিন্তু দুসপ্তাহ পরেই আমার দশমশ্রেণীর সব পড়াশোনা এবং টিউটোরিয়ালগুলো শুরু হয়ে যাবে। হাতে রইলো শুধু এই দুসপ্তাহ। তাই যদি তোমরা অনুমতি দাও তবে এই দুসপ্তাহ ছুটিতে কোথাও একটা থেকে ঘুরে আসি। কারণ এরপর তো আর সময় পাব না আমি। আর এতো লম্বা ছুটিও পাবনা। তাই কটা দিন কাছাকাছিতে একটু ঘুরে আসলে কিন্তু বেশ হয়না।'
সারং বললেন, 'আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয়। কাছাকাছি ঘোরার জায়গা বলতে আমাদের গ্রামটা আছে। খুব সুন্দর নয়নাভিরাম গ্রাম। এ'বছর কাজের চাপে আর গ্রামে যাওয়া হয়নি। তাই সাংলী আর থিম্পুও যেতে পারেনি গ্রামে।'
প্রত্যুষবাবুও বললেন, 'আমরা গিয়েছিলাম গ্রীষ্মের ছুটিতে একবার সেখানে বেড়াতে। ওফ্! যাকে বলে ছবির মতো সুন্দর…...থিম্পুদের গ্রামটা ঠিক তাই। নামটাও ভারী সুন্দর….রঙমছলিতাল।'
সারং খুশি খুশি স্বরে বললেন, 'তবে সেই কথাই রইলো। এখান থেকে গাড়িতে গেলে ঘন্টাপাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছানো যাবে আমাদের গ্রাম রঙমছলিতালে। গাড়ির ব্যবস্থা আমি করে দেব। ঘুরে আসুন আমাদের গ্রাম, দেখবেন ভাল লাগবে।'
ঠিক দুদিন পর দুটো সিক্সসিটারের এস.ইউ.ভি.তে করে বিভাসদের দলটা রওনা হলো। একটা গড়িতে বিভাস, সবুজ, থিম্পু, সাংলী, সুরভী এবং শাওলি; আরেকটি গাড়িতে তিতলি, মৃন্ময়, সেঁজুতি, প্রমিলা, মালতী, প্রত্যুষ, সুরভী। সেঁজুতির বাবা অনিশ ছুটি ম্যানেজ করতে পারেননি। তিতলির বাবা তপন ছুটি পাননি ব্যাঙ্ক থেকে। মৃন্ময়ের মা বর্ণালী থেকে মৃন্ময়ের বাবা অনয়ের যবে থেকে ছাড়াছাড়ি হয়েছে তবে থেকেই বর্ণালী যেন নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছেন। অথচ খুব হইহুল্লোর করতে পছন্দ করতেন বর্ণালী। সমস্তরকম সোস্যাল গেদারিং থেকে দুরে থাকেন। বিভাসের মা শাওলি বর্ণালীর স্কুলমেট। সেও বহুচেষ্টা করেছে বর্ণালীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে গেছে।
রঙমছলিতালে যাওয়ার পথে অনেক ছোটো ছোটো গ্রাম পরে। সবজি এবং ধানের ক্ষেতগুলোর দৃশ্যও অপূর্ব। বিভিন্ন জানা-অজানা পাখি দেখা যাচ্ছে। রাস্তার দুধারে তাকালে মনে হয় এই শান্ত প্রকৃতির জীবনের কাছে শহরের জীবন যেন বড়োই তুচ্ছ। এরমাঝে এক নতুন মজা শুরু হলো। বিভাসদের দলটা যেহেতু দুভাগে গাড়িতে বসেছিল তাই তারা মেসেজ করে করে কথা বলছিল।
ওদের মেসেজের ঠ্যালায় বড়োরা শেষমেষ বলেই ফেললেন, 'তোদের না একসাথেই বসার উচিৎ ছিল।'
তা শুনে ছোটোরাও ফিকফিকিয়ে হেসে উঠলো।
রঙমছলিতালে পৌঁছে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে সকলের মন ভালো হয়ে গেল। কতোরকমের চিত্রবিচিত্র গাছ-গাছালি, পাখিদের কলকাকলি, রঙবেরঙয়ের ফুল, জংলি ফলের ঝোপ সব দেখে ছোটরা তো বটেই বড়োরাও যেন নিজেদের ছোটোবেলায় ফিরে গেলেন। থিম্পুদের গ্রামের বাড়িটাও খুব সুন্দর। বড়ো উঠোন। উঠোনের একধারে থাকার ঘর, আরেক ধারে রান্নারঘর। থাকারঘরের একদম উল্টোদিকের ধার ঘেঁষে গোয়ালঘর। আরেকপাশে ফুলের বাগান। বাগানে বিভিন্ন রঙয়ের গোলাপের পাশাপাশি সূর্যমুখী, বেলী, টগর, গন্ধরাজ আরো কতো কি রয়েছে। একটা শিউলি গাছও আছে তবে এখন ওতে ফুল নেই। বাড়িতে থিম্পুর দাদু বাহাং আর কাকু জিসান থাকেন। বয়সোজনিত কারনে বাহাং খুব একটা চলাফেরা করতে পারেন না। কথা বলার প্রবৃত্তিও খুব কম। তবে তাদের বাড়ি দেখাশোনার লোক আছে, রাধুনি, মালি সব আছে। জিসান এখানকার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। বাহাংকে সুরভী আর প্রত্যুষ জ্যেঠু বলে ডাকে। তাই দেখাদেখি বড়োরা সকলে বাহাংকে জ্যেঠু বলেই সম্বোধন করলেন। এতোলোককে বাড়িতে দেখতে পেয়ে বাহাং তো বটেই জিসানও বড্ড খুশী। তিনদিন হইহই করে পার হয়ে গেল। প্রমিলা তো সারাদিন টুকুস টুকুস করে গ্রামের ছবি তুলে যাচ্ছেন। বলে এগুলো নাকি ইন্সপিরেশন , তার বুটিকের ডিজাইনের জন্যে। প্রত্যুষ তো সুযোগ পেলেই ছিপ নিয়ে পুকুরে চলে যান। সুরভী আর মালতী থিম্পুদের রাধুনি থেকে বিভিন্ন রান্না শিখতে ব্যস্ত। ছোটোরা তো অবাক। বড়োদের হলোটা কি। এখানে এসেই সবাই কেমন যেন শিশুর মতো হয়ে গেছে। অবশ্য এতে ছোটোদের সুবিধা হয়েছে। ওরা ওদের গোপন বৈঠকগুলো সেরে ফেলতে পারছে।
একদিন শাওলি, সাংলী, প্রমিলা, সুরভী, মালতী মিলে চা পকোরার সহযোগে সান্ধ্য আড্ডা দিচ্ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তার ফাঁকে টুকটাক মস্করাও করছিলেন।
মালতী তো বলেই ফেললেন, 'ভাগ্যিস এখানে এসেছিলাম। নইলে কখনো জানতেই পারতাম না যে কাছাকাছিতে এতো সুন্দর একটা ছোটো গ্রামও আছে।'
মালতীর কথায় সায় দিয়ে প্রমিলাও বললেন, 'যা বলেছো! এখানে এসে মনে হচ্ছে আবার যেন ছেলেবেলাতে ফিরে গেছি। শহরে যেন এই প্রানটাই নেই।'
সাংলী মুচকি হেসে বললেন, 'এই জিনিসটাই এই গ্রামের বিশেষত্ব।'
তারপর হঠাৎই বললেন, 'তোমরা গল্প করো….আমি একটু আসছি। বাবা মনে হয় ডাকছেন', বলে চট করে উঠে চলে গেলেন।
সাংলী বেরিয়ে যাবার পর মালতী বললেন, 'জ্যেঠু না কথা বলতে পারেন না। তাহলে সাংলী 'বাবা ডাকছে' কেন বললো?'
সুরভী বললেন, 'আসলে বাহাং জ্যেঠুর এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। উনি মেন্টাল কমিউনিকেশন করতে পারেন…।'
মানে টেলিপ্যাথি…', বিস্মিত স্বরে শাওন জিজ্ঞেস করলেন।
'হ্যাঁ, ঠিক তাই। প্রথম প্রথম আমরাও ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরে সাংলী আর সারং বললো জ্যেঠুর এই অদ্ভুত ক্ষমতার কথা', সুরভী বললেন।
এদিকে থিম্পু বিভাসদের নিয়ে বাহাংয়ের ঘরে গেল। যাবার আগে থিম্পু বারবার বলল যাতে কোনকিছু শুনে বা দেখে ওরা যেন ভয় না পায়। বাহাংয়ের ঘরে গিয়ে থিম্পু আলতো করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
তারপর ঘুরে গিয়ে বাহাংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, 'দাদুভাই আমি এসে গেছি। এবার বলো তুমি কি বলবে?'
থিম্পুকে কথা বলতে দেখে বিভাসরা প্রচন্ডভাবে যেন 'শক্' খেল।
বিভাস বলল, 'তুই...তুই কথা বলতে পারিস থিম্পু। সেই ছোট্ট থেকে তোকে কোনদিন কথা বলতে দেখিনি আমরা। কাকিমা আড়ালে কত চোখের জল ফেলে তোর জন্য, তা কি তুই জানিস। দাঁড়া, আমি এক্ষুনি কাকিমাকে বলি যে তুই কথা বলতে পারিস।'
বিভাস বাইরে যেতে উদ্যোত হলে থিম্পু তার হাত ধরে বলল, 'লাভ নেই ভাই। এই ঘর থেকে বাইরে গেলেই আর আমি কথা বলতে পারবো না। তোদেরকে এইঘরে আনার আগে বলছিলাম না যে কোনকিছু শুনে বা দেখে না ঘাবড়াতে। ঘাবড়ানোর জিনিসটা শুনে নিলি এবার ঘাবড়ানোর জিনিসটা দেখ।'
বাহাং বরাবরই হুইল চেয়ারেই বসে থাকেন। একটা ভারী চাদরে বাহাংয়ের কোমর থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা থাকে। বাহাং একটানে চাদরটা টেনে খুলে দিলেন। বিভাসরা দেখলো বাহাংয়ের শরীরের উপরের অংশটি ঠিক মানুষের মতো হলেও ওনার শরীরের নিচের অংশটা ঠিক মানুষের মতো নয়। কোনো জলীয় জীব বা উদ্ভিদের মতো। কোমর থেকে পায়ের বদলে সেখানে রয়েছে সামুদ্রিক ঘাসের মতো কতগুলো লতাপাতা। যা একটা স্বচ্ছ অচ্ছেদ্য আবরনে আবরিত হয়ে আছে। তিতলি তো ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো।
সেঁজুতি তাড়াতাড়ি তার মুখ চাপা দিয়ে বলল, 'শশশশশ্! করছিস কি। সবাই জানতে পেরে যাবে।'
বাহাং বললেন, 'কী খুব ভয় পেয়ে গেছো তোমরা! তাই না।'
মৃন্ময়, সবুজ দেখলো বাহাং কথা বললেন ঠিকই কিন্তু ওনার ঠোঁট নড়লো না। এতক্ষন পর্যন্ত যা সব আজব আজব ঘটনা তারা দেখেছে, তাই এই ঘটনাটাও ওদের স্বাভাবিকই মনে হল।
শুধু বিভাস ফিসফিসিয়ে বলল, 'টেলিপ্যাথিক্যাল টেকনোলজি।'
বাহাং ধীরে ধীরে বললেন, 'থিম্পুর কাছে তোমাদের অনেক গল্প শুনি। থিম্পুর কাছে আমি টেলিপ্যাথিক্যাল সিগন্যাল পাঠিয়ে তোমাদের সকলকে এখানে ডেকে আনি। তোমাদের আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে দিতে হবে। থিম্পুর কাছে নিশ্চয়ই শুনেছো 'ঝিলতামাংয়ের গল্প'। আর ঝিলতামাংয়ের যে কথা শুনেছো তোমরা থিম্পুর কাছে তা সবই সত্য। ঝিলতামাংয়ের কৃপাতেই এই গ্রামের লোকেদের মধ্যে কোন অনিষ্টচিন্তা বা পাপবোধ নেই। এখানকার গ্রামবাসীদের মনটা একদম শিশুর মতো সরল, এমনকি এখানে যদি বাইরে থেকেও কেউ আসে তাদের মনও শিশুর মতো হয়ে যায়।'
বিভাসরা এতক্ষণে বুঝতে পারলো যে বড়োরা হঠাৎ কেন অত আজব ব্যবহার করছিল এখানে এসে।
একটু থেমে বাহাং আবার বললেন, 'ঝিলতামাংয়ের নির্দেশেই আমি সারাংকে শহরে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে যোগদান করতে পাঠিয়েছি। এতদিন পর্যন্ত আমিই ঝিলতামাংয়ের পুজো করে এসেছি। ঝিলতামাংয়ের কথা একমাত্র আমাদের বংশের লোক ছাড়া আর কেউ জানে না। কিন্তু তোমাদের আমি জানালাম কারন থিম্পুকে সাহায্য করতে তোমাদের প্রয়োজন হবে। এতোদিন আমি ঝিলতামাং মন্দিরের পুজারী থাকলেও এখন আমার শরীর জবাব দিতে শুরু করেছে। তাই মন্দিরের একজন পুজারী নির্বাচন করা অতি আবশ্যক। আমি এখন থেকে থিম্পুকে মন্দিরের পুজারী নির্বাচিত করলাম। কিন্তু একটি সমস্যা আছে। তা হলো থিম্পুকে মন্দিরের পথ নিজে খুঁজে বার করতে হবে। তাতে তোমরা ওকে সাহায্য করবে।'
সেঁজুতি বলল, 'কিন্তু দাদু আমরাই কেন? আপনি কেনই বা আমাদেরকে নির্বাচন করলেন। এটা তো অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়। সেখানে এতবড় একটা কথা আমাদের সামনে ফাঁস কেন করলেন?'
বাহাং একটু হেসে বলেন, 'জানো তো দিদিভাই শব্দের অর্থ অনেকেই বোঝে। কিন্তু না-বলা শব্দের অর্থ কেউ বোঝে না। কিন্তু তোমরা সেই না-বলা শব্দ শুনতে পারো, বুঝতে পারো। আমি জানি না কিভাবে! আমার কাছে সময় বড় কম। আমার পা যেমন দেখছো এমন কিন্তু ছিল না। এখন জলজ প্রাণীর মতো হয়ে যাচ্ছে পা'দুটো। তার মানে কিছু একটা অঘটন ঘটতে পারে! তাই তড়িঘড়ি করে থিম্পুকে মন্দিরের পুজারী নির্বাচন করতে হচ্ছে। থিম্পু ছোট, ওর সাহায্যের প্রয়োজন হবে। আর বন্ধু থেকে বড় সাহায্য আর কী হতে পারে। থিম্পুর সাথে তোমাদের আত্মিক সম্পর্ক। তাই তোমাদেরকে এখানে ডাকা।'
একথা বলে বাহাং গলা থেকে একটা লকেটসহ হার খুলে থিম্পুকে পড়িয়ে দিলেন। হারটা সঙ্গে সঙ্গে থিম্পুর শরীর ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল ঠিক যেভাবে বাহাংয়ের শরীরে হারটা ঢুকে ছিল। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে বিভাসরা কিছু ঠাহরই করতে পারলো না। শুধু দেখলো যে একটা দিব্য আলোর বিচ্ছুরণ বাহাং থেকে থিম্পুর দিকে এগিয়ে গেল।
বাহাং বললেন, 'আগামীকাল তাহলে তোমাদের অভিযান শুরু হবে।'
সবাই এরপর বাহাংয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সারাদিন বিভাস, তিতলি, মৃন্ময়, সেঁজুতি, সবুজ আর থিম্পু উত্তেজনায় শিরশির করতে লাগলো। রাতে ওরা একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন যখন ভোর তিনটে বাজে তখন বিভাস, সেঁজুতি, তিতলি, মৃন্ময়, সবুজ, থিম্পু চুপিচুপি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। সকালে এখানে ঠান্ডা থাকে বেশ। তাই ওরা যথোপযুক্ত জামাকাপড় পরে নিল। প্রত্যেকে পিঠে একটা ছোটো কিটব্যাগ নিয়ে নিল যাতে একটা করে জলের বোতল, কিছু শুকনো খাবার, একটা বড়ো টর্চ, একটা দড়ি নিয়ে নিল। তারপর বাহাংকে প্রনাম করে ঈশ্বরের নাম স্মরণ
করে বেরিয়ে পড়লো তারা। পা চালিয়ে চলে এলো গ্রামের একেবারে বাইরে। বাহাংয়ের নির্দেশ অনুযায়ী এখান থেকে পঞ্চাশ পা এগিয়ে যেতে হবে। ঘড়িতে বাজে তখন সওয়া চারটে। আর মিনিট পনেরোর পরেই সূর্যোদয় হবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সূর্য্যের প্রথম কিরণটি যে জায়গায় পড়বে সেটাই হল ঝিলতামাংয়ে প্রবেশ দ্বার। গ্রামের বাইরে এই জায়গাটি একদম ফাঁকা জায়গা। গ্রামের ভেতরে বা অন্যান্য দিকে ফসলের ক্ষেত থাকলেও এখানের রুক্ষ মাটির জন্য কোনো চাষবাস হয়না। এখানে ছোটোরা খেলাধুলা করে শুধু। জায়গাটির চারিদিকে কিছু গাছপালা থাকলেও ঠিক মাঝবরাবর বেমানান ভাবে দুটো টিলা দাঁড়িয়ে আছে। টিলাদুটোর পেছনেও সেই রুক্ষ মাটি। গ্রামের বাচ্চারা সেই টিলার মাথায় চড়েও খেলা করে। এখানে আসতে আসতে এসব থিম্পু হাতের ইশারায় সব বলেছে বিভাসদের।
গ্রামের বাইরে এসে গুনে গুনে পঞ্চাশ পা এগিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়ালো বিভাসদের দলটা। সূর্যোদয় হতে ঠিক আর তিনমিনিট বাকি। সবাই উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছে। উত্তেজনার পারদে ভোরের ঠান্ডার হীমটা ওদের গায়েই লাগছে না। ঠিক তিনমিনিট পর সূর্যোদয় হল। সমস্ত আকাশ যেন এক সোনালী কমলা আভায় সেজে উঠলো। ভোরের পাখিরা সূর্য্যের আলোর বিকিরণের সাথে সাথে পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল নিজ নিজ গন্তব্যে। হতাশার অন্ধকারকে দূর করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পরলো এক আশার আলো। কিন্তু থিম্পুদের তো ভোরের আলো উপভোগ করার মতো সময় নেই। তাদের যে সিদ্ধ করতে হবে এক বড়ো কাজ। সূর্য্যটা যেদিক থেকে ওঠে সেদিকে পাশাপাশি ভাবে তিনটে বড়োবড়ো আমগাছ রয়েছে। তাই সূর্য্যের রশ্মি সোজাসুজি না পরে একটু তেরচাভাবে পরে। থিম্পু দেখলো যে সূর্য্যের প্রথম রশ্মটি একটু তেরচাভাবে পরে টিলাদুটোর মাঝখানে একটা জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। থিম্পুরা সেই আলোকরশ্মিকে লক্ষ্য করে ছুট দিল। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখলো যে জায়গায় আলোটা কেন্দ্রীত হয়ে আছে সে জায়গায় একটা জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সেখানে গতকাল পর্যন্তও কোন জলাশয় ছিলনা। আলোকরশ্মিটা জলাশয়ের ভেতরে ঢুকে গেল। কী মনে হতে থিম্পু জলাশয়ে ঝাঁপ দিল। বিভাস তাকে অনেক ডাকলো। শেষে সাড়া না পেয়ে সেও ঝাঁপিয়ে পড়লো জলাশয়ে। তা দেখাদেখি একে একে সেঁজুতি, তিতলি, মৃন্ময় এবং শেষে সবুজ ঝাঁপ দিল জলাশয়টিতে। ওদিকে সূর্য্য তখন ধীরেধীরে নিজের আলমোড়া ভেঙ্গে উদয় হচ্ছে। সূর্য্যের আলো প্রখর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণ আগের জলাশয়টি আবার রুক্ষ মাঠে পরিনত হয়ে গেল।
সাংলী বরাবর একটু সকাল সকালই ঘুম থেকে ওঠেন। সকালের যাবতীয় কাজ করার পর গোয়ালঘরের তদারকি সেরে রান্নাঘরে এসে রাধুনিকে সকালের জলখাবারের এবং বাদবাকি রান্নার নির্দেশ দেন। তারপর নিজের হাতে পরম যত্নে বাহাংয়ের জন্য খাবার বানান। তিনি শহরে থাকায় বাহাংকে ঠিকভাবে যত্ন করতে পারেন না। তাই যতদিন গ্রামে থাকেন ততদিন নিজের হাতে বাহাংয়ের যাবতীয় কাজগুলো করেন। বাহাংয়ের ঘরে এসে সাংলী দেখেন যে বাহাং আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছেন।
সাংলী বললেন, 'কখন উঠলে ঘুম থেকে বাবা।'
বাহাং টেলিপ্যাথিতে জবাব দিলেন, 'এইতো মা, আজ একটু আগেই উঠে গেছি।'
বাহাং বরাবর টেলিপ্যাথিতেই কথা বলে থাকেন। কিন্তু এবার সাংলীর যেন মনে হল বাহাংয়ের যেন ঠোঁট নড়ে উঠলো। মনের ভুল ভেবে তা নিয়ে আর বিশেষ ভাবলেন না।
বললেন, 'চলো বাবা হাতমুখটা ধুয়ে নেবে।'
যত্ন করে সাংলী বাহাংয়ের মুখ ধুইয়ে পড়নের জামাটা পাল্টে দিলেন। খাওয়ানো হয়ে গেলে সাংলী যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন কি মনে হতে সাংলী পেছন দিকে তাকালেন। দেখলেন যে বাহাং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাংলী কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এই হঠাৎ আকস্মিকতায় তার যেন মুখ থেকে কোন কথা বেরোচ্ছে না।
এবার বাহাং স্পষ্ট ভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে বললেন, 'বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত মানুর অপেক্ষা করবে', বলেই তিনি লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে।
বাহাং থিম্পুকে 'মানু' বলে ডাকতেন।
সাংলী চিৎকার করে উঠলেন, 'ওরে কে কোথায় আছিস। তাড়াতাড়ি আয়….।'
জমাটবাঁধা কালো অন্ধকার চারিদিকে। সেঁজুতি চোখ মেলে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই ঠাহর করতে পারলোনা। আশপাশে হাতরে বুঝলো যে সে যেখানে শুয়ে আছে তার জমিটা খুব নরম আর শীতল। জমিটা এতটাই নরম যে হাত দিয়ে হালকা চাপ দিলেই হাত মেঝেতে ডেবে যাচ্ছিল। অন্ধকারটা এতটাই ঘুটঘুটে যে আধহাত দূরের জিনিসও কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফিসফিসিয়ে সেঁজুতি বাকিদের ডাকলো। কিন্তু কেউ কোনো জবাব দিল না। এই প্রথমবার সেঁজুতির ভয় করতে লাগলো। আতঙ্কে আর ভয়ে সেঁজুতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
ঠিক এমনসময় এক অচেনা কন্ঠে কেউ বলে উঠলো, 'ভয় পেও না সেঁজুতি। আমি আছি তো। আমি জুপাং, তোমার বন্ধু।'
সেঁজুতি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না।
চোখের জল মুছে সে বলল, 'কোথায় তুমি? আমি তো তোমায় দেখতে পারছি না।'
'এই তো, নিচে তাকাও', অচেনা স্বরটা বলল।
সেঁজুতি দেখল একটা সামুদ্রিক ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। তবে অন্যান্য সামুদ্রিক ঘোড়ার মতো তার শরীরটা মসৃণ নয় বরং ভীষণ কন্টকময়। আর তার পিঠ থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটো ছোট ছোট পাখা। জুপাংয়ের চোখ থেকে একটা নীল আলো সেঁজুতির চোখে ঢুকে গেল এবং সেঁজুতি মোহাগ্রস্থের মতো জুপাংয়ের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর একে একে তিতলি, বিভাস, সবুজ, মৃন্ময় এবং থিম্পু উঠে বসলো। ওদেরও গাঢ় অন্ধকারের জন্য একজন আরেকজনকে দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল। এমনসময় থিম্পুর গলায় পড়া লুকোনো লকেটটা থেকে উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরিত হল। এখানে এসে থিম্পু আবার কথা বলতে শুরু করলো। সবাই একে অপরকে দেখতে পেলেও কেউ সেঁজুতিকে দেখতে পেল না। শত ডাকাডাকিতেও উত্তর মিলল না। থিম্পু দেখলো একজায়গায় গোলাকার চ্যাটচ্যেটে জাতীয় কিছু রয়েছে।
তা দেখে থিম্পু বলল, 'সেঁজুতি হয়তো জুপাংয়ের কবলে পড়ে গেছে।'
বিভাস আবেগতাড়িত হয়ে বলল, 'জুপাং কে? সেঁজুতির কি তবে কোন বিপদ হয়েছে।'
থিম্পু বলল, 'জুপাং হল একটি জলীয়জীব যা নিজের আকৃতি ইচ্ছেমতো পাল্টে ফেলতে পারে। কিন্তু সে সেঁজুতিকে কেন নিয়ে গেল তা তো বুঝলাম না।'
মৃন্ময় বলল, 'জলীয়জীব তো জলে থাকে, সেটা এখানে কি করে এল?'
থিম্পু বলল, 'সেটা এখানে এসেছে তার কারণ আমরা এখন ওর জায়গাতেই আছি….জলের তলায়।'
সবুজ বলল, 'জলের তলায়...তাহলে আমরা শ্বাস কী করে নিচ্ছি বা আমাদের জামাকাপড় ভিজছে না কেন?'
থিম্পু শুধু অর্থপূর্ণ ভাবে একটু হাসলো।
তিতলি বলল, 'সেঁজুতিকে খোঁজা খুব প্রয়োজন।'
থিম্পু বলল, 'না এখন নয়। আগে ঝিলতামাংয়ের মন্দির খুঁজে বার করতে হবে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সূর্য্যের আলো থাকতে থাকতেই ঝিলতামাংয়ের পুজো করা আবশ্যক। এটা দাদু আমায় বলেছিলেন। তারপর আমরা সেঁজুতিকে খুঁজবো।'
ওরা তারপর থিম্পুর লকেটের আলোতে পথ দেখে চলতে লাগলো। যেতে যেতে তারা আশেপাশের জীবজন্তুদের দেখে প্রচণ্ড আশ্চার্য্যান্বিত হয়ে যাচ্ছিল। ওদের মনে হচ্ছিল ওরা যেন কোথাও লাইভ সি লাইফের প্রোগ্রাম দেখছে। মাঝেমাঝে কিছুকিছু প্রাণী তো এতো কাছ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে যে তিতলি বারেবারে ভয় পেয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা গোলাকার গম্বুজের ভেতরে চলে এল। গম্বুজটির দেওয়ালজুড়ে সামুদ্রিক ঘাসে ঢাকা। জায়গাটা একটু স্যাঁতস্যাঁতে। গোটা গোম্বুজের দেওয়াল জুড়ে মোট দশখানা গোল গোল দরজা রয়েছে।
থিম্পু বলল, 'এর কোন একটি দরজা দিয়ে গেলেই মন্দিরের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হল কোন দরজাটা সঠিক দরজা?'
বিভাস ধীরেধীরে একটা দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে খোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু দরজা খুললো না। একটু পরেই দরজার পেছন থেকে কেউ জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দিতে দিতে একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ করতে লাগলো। তিতলি দৌঁড়ে গিয়ে বিভাসকে টেনে পেছনে নিয়ে এল। বিভাস পেছনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় ধাক্কা দেওয়াটা বন্ধ হয়ে গেল। যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে হালকা বালির প্রলেপ ছিল। কি মনে হতে তিতলি সেখানে ফুঁ দিতে দিতে হাত দিয়ে বালির প্রলেপটা সরিয়ে দিল। মেঝে থেকে বালি সরে যেতেই সেখানে ফুটে উঠলো একজোড়া খুব সুন্দর চোখের ছবি এবং তার চারধার ঘিরে অসংখ্য পদ্মফুলের চিত্র। ছবিটির কোনাকুনি করে একটু দূরে একটি উদীয়মান সূর্য্যের ছবি। সে দৌড়ে দরজাগুলো কাছে গিয়ে দেখলো প্রতিটি দরজার পাশে একটি করে পদ্ম এবং সূর্য্যের চিত্র রয়েছে। এখন সবকিছু স্পষ্ট হল তিতলির কাছে।
সে বলল, 'এই মন্দিরটি সূ্র্য্য এবং বিষ্ণুর বন্ধুত্বের ইঙ্গিতবাহক। এখানে এই যে চোখজোড়ার চিত্র রয়েছে তা ভগবান বিষ্ণুকে বোঝানো হচ্ছে। কারণ এই চোখের চারিদিকে অনেক পদ্মফুল রয়েছে। আর পূরাণ অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণুর চোখকে কমল বা পদ্মের সাথে তুলনা করা হয়। আর এখানে সূর্য্যের একটি ছবি আছে । আমি দৃঢ় নিশ্চিত যে যখন সূর্য্যের প্রথম কিরণ এখানে পরে তখন এর থেকে একধরনের দ্যুতি বের হয়। কারণ সূর্য্যের এই ছবিটি খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি।'
তিতলি হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে গম্বুজের দেওয়াল থেকে সামুদ্রিক ঘাসগুলো একটু সরিয়ে দিল।
তারপর বলল, 'যদি আমার হিসেব ঠিক হয় তবে এক্ষুনি জানতে পারবো যে আমাদের কোন দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে।'
এমনসময় কোথা থেকে একটি ক্ষীণ আলোর রেখা একটি নির্দিষ্ট দরজার উপরে গিয়ে পড়লো।
তিতলি বলল, 'কুইক। তাড়াতাড়ি চল সবাই।'
ঐদিকে থিম্পুর বাড়িতে বাহাংয়ের শরীর তখন অনেকটা স্থিতিশীল হয়েছে। পারিবারিক চিকিৎসক এখন ওনার দেখাশোনা করছেন। সকাল ১থেকে হট্টগোলের মধ্যে কারোরই বাচ্চাদের কথা খেয়াল হয়নি।
হঠাৎ শাওলি বলল, 'এই বাচ্চাগুলো কোথায় গেল বলো তো! দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেল এখনো ওদেরকে দেখা যাচ্ছেনা।'
শাওলির কথায় সকলের মুখে চিন্তার ছাপ পড়লো। শুরু হল বাচ্চাদের খোঁজ।
থিম্পুরা নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে কিছুদূর এগুতেই দেখলো যে একটু দূরেই এক নীলাভসবুজ রত্নে এক অপূর্ব সুন্দর সামুদ্রিক জীবের মর্তি রয়েছে যার থেকে এক অপার্থিব আলো বেরোচ্ছে। কিন্তু মূর্তিটির ঠিক পাশেই সামুদ্রিক ঘোড়ার মতো দেখতে সারা শরীরে কাঁটাযুক্ত একটি প্রাণী সেঁজুতিকে বন্দি করে রেখেছে। সেঁজুতিকে ওই অবস্থায় দেখে সবুজ চিৎকার করে বললো, 'দেখ...ওই….দেখ, সেঁজুতিকে কে বন্দি করে রেখেছে।'
থিম্পু ধমকের সুরে বলল, 'জুপাং, সেঁজুতিকে ছেড়ে দাও। ওকে কেন তুমি বন্দি করে রেখেছো।'
যেন কিছু মজার জিনিস হয়েছে এমনভাবে নাচতে নাচতে জুপাং বলল, 'পারো তো ছাড়িয়ে নিয়ে যাও।'
একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে থিম্পুদের এবং জুপাংদের মাঝখানের জমিটা হঠাৎই জ্বলন্ত লাভায় পরিনত হয়ে গেল। দুপা পিছিয়ে এলো থিম্পুরা। সেঁজুতি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো।
বিভাস বললো, 'ভয় পাসনা পেঁজুবুড়ি। আমরা আসছি তোকে বাঁচাতে', বলে সেই লাভার মধ্যে পা রেখে দিল। তার দেখাদেখি বাকিরাও একইভাবে লাভার উপর দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর হেঁটে এগিয়ে গেল সেঁজুতির দিকে। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল লাভার উপর হেঁটে আসা সত্ত্বেও ওদের কোন ক্ষতি হল না।
জুপাং বলল, 'তোমরা পরীক্ষায় পাশ করেছো। তোমরা এই বন্ধুত্বের মন্দিরে আসার যোগ্য। আর থিম্পু তুমিও যোগ্য পুজারী এই মন্দিরের। বাহাং সঠিক লোককেই নির্বাচিত করেছে। এখন যাও তোমার লকেটে রাখা মুক্তোরস দিয়ে ঝিলতামাংকে আবাহন করো।'
সবাই খুশী মনে ভক্তিভরে ঝিলতামাংয়ের পুজো করলো।
সন্ধ্যার কিছু পরেই বিভাসরা ফিরে এল থিম্পুদের গ্রামের বাড়িতে। ওখানে তখন সবার মুখ দুঃশ্চিন্তায় ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ওদের আসতে দেখে সবাই ঘিরে ধরলো।
তাদের সবার মুখে এক প্রশ্ন, 'কোথায় ছিলি এতোক্ষন?'
সবুজ কাঁচুমাচু মুখে বলল, 'আসলে আশেপাশে একটু ঘুরে দেখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু পথ হারিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ি। সেখান থেকে কোনমতে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। সারাদিন কিছু খাইনি। একটু খেতে দেবে গো।'
সবুজের কথায় সবার চোখ ছলছলে হয়ে গেল।
প্রমিলা বললেন, 'যাও স্নান সেরে আসো। তারপর খাবে।'
নিজেদের ঘরে যেতে যেতে বিভাসরা নিজেদেরকে ইশারায় চোখ টিপে হেসে উঠলো।
তনিমা সাহা
কোলকাতা, ভারত
-
গল্প//উপন্যাস
-
30-07-2022
-
-