অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
হ্যাভ অ্যা কাপ অফ কফি – চিরঞ্জীব সরকার

টোয়াতে থাকাকালীন  কর্মস্থলে যাওয়া আসা পদব্রজেই করতাম। মেইন স্ট্রীট থেকে কর্মস্থল ৩৫০ স্পার্ক স্ট্রীটে যেতে মোটামুটি মিনিট পঁয়তাল্লিশের মত সময় লাগত। বাসার কাছেই  সেন্ট পল ইউনিভার্সিটির সামনে বাস স্টপেজ, মেট্রো স্টেশনও খুব একটা দূরে ছিল না। ইচ্ছে করলেই ওগুলিতে চড়ে কর্মস্থলে যাওয়া আসা করতে পারতাম। কিন্তু আমিতো হাঁটতে ভালবাসি, তাই হাঁটাকে তো আমি কোনভাবেই ছেড়ে দিতে পারি না। গ্রীস্মে যখন মাটি ফুঁড়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘাসফুলগুলি ফুটে হাসতে থাকে তখন ওদের হাসির রাজ্যে সামিল হতে হেঁটে হেঁটে ওদের সামনে এসে কিছুক্ষন তো থামতে হবেই। ঝোপ ঝাড়ের ছোট ছোট পাখিগুলি যখন কিচির মিচির করে সরু সরু ডালে নাচাচাচি করতে থাকে তখন ওদের নৃত্যশালায় অতিথি হয়ে আসতে হাঁটার তো কোন বিকল্প ছিল না। ছোট ছোট বাচ্চারা যখন হৈ হুল্লোড় করে স্কুল ছুটির পর মহাআনন্দে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরতে থাকে তখন কিছুটা দূর থেকে স্বপ্রনোদিত হয়ে সে আনন্দধারায় কিছুটা অবগাহনের সুযোগ আসলে হাঁটাই তৈরী করে দেয়। ভূপৃষ্ঠে প্রবাহমান এ জীবনধারার  বিচিত্র স্পন্দন যাতে মিশে আছে এক নান্দনিক ছন্দ তা গভীর ভাবে অনুভব করি যখনি হাঁটি। তাকে কি এত সহজেই ছেড়ে দেয়া যায়।

আমি কর্মস্থলে যেতাম এলগিন স্ট্রীটের প্রশস্ত ফুটপাথ ধরে হেঁটে হেঁটে। এর দুপাশে রয়েছে নানান ধরনের দোকান, তবে এর ভিতর রেষ্টুরেন্টের সংখ্যাটাই বেশী। এলগিন স্ট্রীটে উঠতে একটা ব্রীজ পেরোতে হত যেটা রয়েছে রিডো ক্যানেলের উপরে। গ্রীস্মে রিডো ক্যানেলে যখন প্রমোদ ভ্রমনের জন্য বড় বড় স্পীডবোটগুলি চলত তখন ওগুলোর মাস্তুলে যাতে ব্রীজের সাথে ধাক্কা না লাগে সেজন্য  লৌহ নির্মিত দুখণ্ডে বিভক্ত ব্রীজটি ঢাকনার মত তখন উপরে উঠে যেত। স্পীডবোটগুলি চলে গেলে ব্রীজটির দুটি পার্ট আবার একসাথে নেমে এসে সেট হয়ে আবার অবিকল পিচঢালা রাস্তার মত হয়ে যেত। আমার এ দৃশ্যটি দেখতে খুবই ভাল লাগত। রাশিয়ার সেন্ট প্রিটাসবার্গের  নদীতে এরকম ব্রীজ আছে। যখন সেখানে কোন বড় জাহাজ চলাচল করে তখন ব্রীজের কিছু অংশ জানালার মত খুলে উপরে উঠে জাহাজগুলির চলাচলের জন্য পথ করে দেয়। শীতকালে রিডো ক্যানেলটি বরফে আচ্ছদিত হয়ে যায়। তখন হাজার হাজার ছেলে মেয়ে স্কীবুট পড়ে আইস স্কীতে সামিল হয় ক্যানেলটির বরফের পথ ধরে এবং রিডো ক্যানেলটির ভাগ্যে জুটে তখন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্কী রিঙ্ক হওয়ার খেতাব। আমিও কয়েকবার এ সময় ওখানে নেমে হেঁটেছি আর প্রানভরে অবলোকন করেছি ছেলে মেয়েদের এ আবেগ উচ্ছাস যা ছিল  এক আনন্দঘন অনুভূতির নির্মল আস্বাদন।

এলগিন স্ট্রীটেই অটোয়া পুলিশের  সদর দপ্তরটি অবস্থিত। মাঝে মাঝেই দেখতাম পুলিশের গাড়ি থেকে আসামীদের নামানো হচ্ছে। কখনো কখনো দেখতাম কোন কোন আসামীদের হাতকড়া পড়িয়ে এখানে নিয়ে আসা হচ্ছে যদিও সেরকমটা দেখেছি একেবারেই কম। একদিন শীতকালে এরকম হেঁটে হেঁটে পুলিশের এ ভবনটির সামনের দিকের ফুটপাথ ধরে অতি সাবধানে এগোচ্ছি। এখানে শীতকালে খুব সাবধানতার সাথে হাঁটতে হয়। একটু অসাবধান হলে বোন ফ্রাকচারের মত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যদিও অটোয়ার ফুটপাথগুলি লবন ছিটিয়ে বরফমুক্ত করে চলাচলের উপযোগী করে রাখা হয় তবুও ডিপফ্রিজের বরফের মত কিছু পিচ্ছিল বরফ রাস্তায় লেপ্টে থাকে যার উপর পা রাখলে আর রক্ষে নেই। অটোয়াতে আমার প্রথম বছরের অবস্থানকালে অনভিজ্ঞতার কারনে আমি কয়েকবার  না বুঝে এরকম পিচ্ছিল বরফে পা রেখে ছিটকে পড়ে আহত হই। প্রচণ্ড ব্যথা পেলেও হাড় ভাঙ্গার বিড়ম্বনা থেকে প্রতিবারই রক্ষা পাই। এরকম ব্যথা পেয়ে কাতরাতে কাতরাতে প্রতিবারই সংকল্প করি এরকম ভুল আর করা চলবে না। কিন্তু সংকল্প রক্ষা করা আর হয় না। কখন যে অজান্তে পা রেখে বসি এ চোরাগোপ্তা পিচ্ছিল বরফের ফাঁদে তা নিজেও ভালভাবে বুঝিনি।মনে মনে ভাবি নেড়া নাকি দুবার বেলতলায় যায় না এ প্রবাদটি আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নহে। কোন কোন নেড়া বারবার বেলতলায় গিয়ে পতিত পক্ক বিল্বফলে মস্তিস্কে বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হলেও বেলতলায় যাওয়া বন্ধ করে না। আমি দ্বিতীয় দলটির সন্মানিত অ্যালামনি।

ওদিন যখন পুলিশ সদর দপ্তরের সদর দরজার একেবারে সামনের ফুটপাথে আমি তখনি দেখলাম একটি যুবককে পুলিশ গাড়ি থেকে নামাচ্ছে। আমার সাথে যুবকটির চোখাচোখি হতেই সে আমাকে বলে বসল, ’ক্যান আই গেট ইওর মোবাইল টু হ্যাভ এ কল’? আমি তাকে কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অন্য কেউ হলে সিওর বলে সাথে সাথে দিয়ে দিতাম। কিন্তু এখানে তো পরিস্থিতি ভিন্ন। সে এখন কোন একটা অপরাধ করে পুলিশের জিন্মায় আর আমি একজন বিদেশী পথচারী। এ অবস্থায় পুলিশের সামনে আমার মোবাইলটি তাকে দেয়া সমীচিন হবে কিনা সেটা নিয়ে একটা দোটানায় পড়ে গেলাম। আবার একটা মানুষ বিপদে পড়ে সামান্য একটা কল করতে চাচ্ছে সেটা প্রত্যাখানও সুখদায়ক কোন ঘটনা নহে। আমার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব পুলিশ হয়ত বুঝতে পেরে আমাকে বলল, ’ইউ ক্যান গিভ ইওর মোবাইল টু হিম, নো প্রবলেম’। আমি পুলিশকে থ্যাঙ্কস বলে মোবাইলটি যুবকটির হাতে দিয়ে দিলাম।

এবার মোবাইলটি হাতে পেয়েই যুবকটি পুলিশদের বলল, ’আই নিড টু টক প্রাইভেটলি’। যুবকটির একথা শুনে পুলিশ একটু দূরে আঙ্গুল দিয়ে একটা স্থান দেখিয়ে বলল, ’ইয়েস ইউ ক্যান গো দেয়ার এণ্ড টক’। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ কথোপকথন শুনছিলাম। যুবকটি কথা বলার জন্য ওইদিকে চলে যাবার পর আমি পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম সে যদি এখন দৌড়ে পালিয়ে যায় তখন তোমরা কি করবে। উত্তরে বলল এরকম সম্ভাবনা খুবই কম আর যদি করেই বসে তাহলে আমরা তাকে চেজ করে ধরে ফেলব, আমরাতো তাকে সতর্ক পর্যবেক্ষনে রেখেছি। একথা শুনে আমি বললাম, ‘ধরো তোমরা তাকে চেজ করে ধরতে পারলা না তাহলে কি হবে’। তখন সেখানের একজন পুলিশ যে উত্তরটি দিল তা বেশ শিক্ষনীয় ও মনে রাখার মত। সে বলল, ‘আওয়ার অথরিটি উইল জাজ হোয়েদার উই হ্যাড অনেষ্ট এণ্ডেভার টু ক্যাচ হিম, নট দি অ্যাচিভমেন্ট’। বুঝতে পারলাম একটি জাতি যখন শিক্ষিত হয় তাদের ভিত্তিগুলি অনেক মজবুত, আর এ মজবুত ভিত্তি রাতারাতি একদিনে তৈরী করা যায় না, এটা করতে অনেক সময় দরকার, অনেক মেধা ও মননের চর্চায় এ জায়গাটা বিনির্মিত হয়।

এদিকে মিনিট পাঁচেক পর লক্ষ্য করলাম যুবকটি হাতের ঈশারায় আমাকে তার দিকে আসতে বলছে। আমি তার কাছে গিয়ে বুঝলাম সে আমার ফোনটি ব্যবহার করতে পারছে না পাসওয়ার্ডের জন্য যেটা আমাকে এখন  আনলক করে দিতে হবে। আমি যখন ফোনটি ওপেন করে তার হাতে দিতে যাব তখন সে নিজে নিজেই আমাকে তার ঘটনাটা বলল যার জন্য পুলিশ তাকে এখানে ধরে এনেছে। সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে তার স্ত্রীর বানানো কফি সে পান করছিল। কিন্তু বাসায় চিনি না থাকায় সে কফিটি উপভোগ করতে পারছিল না। এ নিয়ে স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটির একটি পর্যায়ে সে কফির কাপটি কাচের টেবিলে ছুড়ে মারলে তার স্ত্রী আতঙ্কিত হয়ে নাইন ডাবল ওয়ানে ফোন করে বসে। আর এ কারনেই এ সমস্ত ঘটনার অবতারনা। যুবকটির কথা হল সে তার স্ত্রীকে খুবই ভালবাসে এবং তাকে কোনভাবেই হার্ম করার জন্য সে কাপটি নিক্ষেপ করেনি। এখন সে তার স্ত্রীকে ফোন করে সরি বলবে।

যুবকটি যখন তার প্রভাতকালীন কাহিনী আমাকে বলছিল তখন দেখি একটি সাদা গাড়ি থেকে একজন তরুনী নেমে পুলিশের সাথে কি যেন কথাবার্তা বলছে। আমি যুবকটিকে বললাম তুমি তোমার স্ত্রীকে ফোন করছ না কেন, ফোন তো এখন ওপেন। সে বলল পুলিশের সাথে যে রমনীটি এ মুহূর্তে কথা বলছে সেই তার স্ত্রী। ইতোমধ্যে যুবকটিকে পুলিশ তাদের কাছে যেতে বলল। আমিও আর অপেক্ষা না করে আমার গন্তব্যে আবার হাঁটা শুরু করলাম। কয়েক মিনিট পরে দেখলাম একটা সাদা গাড়ি এসে আমার পাশে থামল এবং সে যুবকটি ও তার স্ত্রী হাসতে হাসতে নেমে আমাকে থ্যাংকস্ দিতে লাগল। তার স্ত্রী তাৎক্ষনিকভাবে অভিযোগ তুলে নেয়ায় সে সময়ই যুবকটিকে পুলিশ ছেড়ে দেয়। আমরা তিনজনই একটা ক্যাফের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি ওদেরকে বললাম, ‘ক্যান উই হ্যাভ অ্যা কাপ অফ কফি’? ওরা বলল, অফ কোর্স হোয়াই নট। দিস কফি উইল বি এ সেলিব্রেশন’।

চিরঞ্জীব সরকার। মুম্বাই