অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
একটি ছোট্ট নীড়ের গল্পকথা – চিরঞ্জীব সরকার

গের দিনের রাজারা নানারকম ইচ্ছে পোষন করতেন এবং সে ইচ্ছেগুলি ব্যক্ত হওয়া মাত্র তা তামিল হয়ে যেত। সেরকমি এক রাজার একদিন ইচ্ছে হল তাঁর  রাজ্যের যে সেরা চিত্রকর তাঁকে সে পুরস্কৃত করবে প্রচুর ধন সম্পদ দিয়ে। যেমন হুকুম তেমন কাজ। রাজ্যজুড়ে এলান করে দেয়া হল সমস্ত চিত্রশিল্পী যেন তাঁদের সেরা চিত্রটি এঁকে একসপ্তাহের ভিতর রাজদরবারে  জমা দেয়। এক সপ্তাহ পর দেখা গেল রাজদরবারে হাজার হাজার ছবি জমা হয়েছে। রাজা চিত্রকলায় সমঝদার কয়েকজন মন্ত্রিকে দায়িত্ব দিলেন এ সমস্ত ছবিগুলি থেকে সবচেয়ে সুন্দর দুটি ছবি প্রাথমিকভাবে বাছাই করে রাখতে। এ ছবি দুটি থেকে রাজা নিজেই সবচেয়ে সুন্দর ছবিটি মনোনয়ন করবেন।
     জমাকৃত ছবিগুলি নিয়ে এ কাজে নিয়োজিত মন্ত্রীদের প্যানেল  যাচাই বাছাই শুরু করলেন। বিভিন্ন আঙ্গিকে ছবিগুলি বিশ্লেষন করে অবশেষে তাঁরা দুটো ছবিকে রাজা বরাবর পেশ করার জন্য নির্বাচিত করলেন। দুটো ছবিই প্রকৃতিনির্ভর। একটি ছবি রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক দুপুরের অনুপম একটি সরোবরের। সরোবরটিতে ফুটে আছে নয়নাভিরাম সব পদ্ম।সরোবরের স্বচ্ছ টলমল জলে রাজহাঁসেরা আনন্দে জলকেলী করছে পদ্মকর্নিকাকে কেন্দ্র করে। উপরে নীল আকাশ। একঝাক সাদা পায়রা উড়ে যাচ্ছে ডানা মিলে দিগন্তের দিকে। সরোবরের অগভীর জলে কিছু মাছ দলবেধে  একপাশ থেকে অন্যপাশে যাচ্ছে নিরুদ্বেগভাবে। জলাশয়টির পাশে বন-বনানী লতাগুল্মের সমাহার। বনের একটি বৃক্ষশাখায় বড় একটা  মৌচাক ঝুলে আছে। এর আশেপাশে উড়ছে অজস্র মৌমাছি। লতাগুল্মগুলির গায়ে রঙ্গীন ডানার অনেক প্রজাপতি। কোন কোন বৃক্ষে  বিচিত্র বর্নের পুস্প ফুটে আছে। দুএকটি বর্নবিচিত্র হরিণকেও দেখা যাচ্ছে মাথা নীচু করে সরোবরের জলে তৃষ্ণা নিবারনে। একটি কিনারে লম্বা গলার শ্বেত বর্নের দুটি বকও এসে কিসের প্রতীক্ষায় যেন দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটি খরগোস চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে সবুজ ঘাস। বাবার হাত ধরে একটি ছোট কন্যা সরোবরের দিকে একদৃষ্টে তাঁকিয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
     দ্বিতীয় চিত্রটির দৃশ্যপটও পুরোটাই প্রাকৃতিক। একটি ঝড়ো আবহে উঁচু পাহাড় থেকে প্রবল শক্তি নিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে নীচের কালো কালো বিশাল কিছু প্রস্তরখণ্ডের উপর। প্রস্তরের সাথে পতিত জলের সংঘর্ষে জলকনাগুলি চারদিকে ছিটকে যাচ্ছে। এদিকে আকাশে  বড় বড় মেঘখণ্ড উড়ছে। বিদ্যুৎ চমকানির রূপালী রেখা জলপ্রপাতটির পাদদেশের একটি প্রস্তরখণ্ডে আঘাত করেছে। ঝড়ো বাতাসে এলোমেলো ডালপালা এদিক ওদিক ছিটকে আছে। একটা অন্ধকার অন্ধকার আবহ। এর মাঝেই পাহাড়ের ছোট্ট দুটি প্রস্তরখণ্ডের ফাঁকে বুনোলতাপাতা দিয়ে দুটো পাখি একটা সংসার পেতেছে। পাহাড়ের গাঘেষে বানানো তাদের নীড়টি একেবারে জলপ্রপাতের প্রবাহমান জলধারা সংলগ্ন। ঝড় থেকে তাঁদের ছানাদের বাঁচাতে মা পাখিটি পাহাড়ের গর্তে বানানো  নীড়টির মুখটি নিজের ক্ষুদ্র  দুটি ডানা প্রসারিত করে ধরে রেখেছে যাতে ঝড়ো বাতাসে তাদের ছানারা  না পড়ে যায়।
     যথাসময়ে রাজার বরাবর তাঁর মনোনীত মন্ত্রিদের প্যানেল এ ছবিদুটি পেশ করল। এখন রাজার নিজেকেই এ দুটি ছবি থেকে একটি ছবি মনোনীত করতে হবে। রাজা নিজেও সংশয়ে পড়ে গেলেন, কোন ছবিটিকে তিনি সেরা পুরস্কারের জন্য পছন্দ করবেন। অনেক চিন্তা করেও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পেরে রাজা আবার সে মন্ত্রীবর্গকেই বললেন সবচেয়ে সুন্দর ছবি কোনটি সেটি নির্ধারন করে দিতে।
     মন্ত্রীরা নিজেদের ভিতর শলা-পরামর্শ করে প্রথম ছবিটিই সর্বোচ্চ সুন্দর বলে সিদ্ধান্ত নিলেন এবং রাজাকে গিয়ে তাদের মতামতের কথা বললেন। রাজা বললেন, ‘আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে কেন আপনারা এ ছবিটি সবচেয়ে সুন্দর বলে মনোনীত করেছেন’। মন্ত্রীবর্গ তখন তাঁদের সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে যুক্তিগুলি তুলে ধরল। যেমন এ ছবিটি দেখলে সবার মনে এক ধরনের প্রশান্তির ভাব চলে আসবে, এছাড়াও প্রকৃতির অপরূপ রূপের বিন্যাসও এ ছবিটিতে প্রকাশ হয়েছে। অন্য ছবিটি সুন্দর হলেও একধরনের গুমোট ও অন্ধকার আবহ লেগে আছে ছবিটিতে যা থেকে মনে ভয় ও উদ্বেগ সঞ্চারিত হয়। তাই দ্বিতীয় ছবিটির চেয়ে প্রথম ছবিটিকেই তাঁরা পছন্দ করেছে।
     মন্ত্রীদের কথা শুনে রাজা বলল, ’আমি দ্বিতীয় ছবিটিকেই প্রথমে স্থান দিব। জীবন ও প্রকৃতির স্বাভাবিক ও সাবলীল প্রবাহে সবকিছুতো ছন্দমাফিক চলবেই, যেটার প্রতিফলন ঘটেছে প্রথম চিত্রটিতে। কিন্তু জীবন ও প্রকৃতি যখন ছন্দে চলে না সে প্রতিকুল পরিবেশেও যাঁরা ছন্দ তৈরী করতে জানে সেখানেই তো প্রকৃত গৌরব। এত ঝড়-ঝঞ্ছার মাঝেও ছোট্ট দুটি পাখি একটা নীড় তৈরী করে জীবনটাকে চালিয়ে নিচ্ছে আপনমনে আর সাধ্যমত চেষ্টা করছে ছানা দুটিকে রক্ষা করতে কত মমতায়। ভালবাসায় সিক্ত এর চেয়ে সুন্দর ছবি পৃথিবীতেতো আর হতে পারে না।‘
     আসলে এ জীবনের চলার পথের বড় অংশটাই দূর্গম। এ দূর্গম পথটাকে হাসিমুখে অতিক্রম করার প্রবনতার মাঝেই সুখ ও শান্তির বীজ রোপিত। বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষের জীবন এতটাই উদ্বেগ ও আশঙ্কায় কাটে যে সে ভুলেই গেছে শান্তিপূর্ন একটা জীবন যাপন করা যায়। দ্বিতীয় চিত্রের পাখিযুগল দেখছে যে চারদিকের পরিবেশ বিক্ষুদ্ধ। একটু এদিক ওদিক হলেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। এ শঙ্কার মাঝেও নিজেদের সাধ্যমত কিছু শুকনো লতাপাতা সংগ্রহ করে একটি সুখের ও সাধের বাসা বেঁধেছে। ঝড়ো বাতাসে ছানারা পড়ে যেতে পারে তাই ডানা মেলে চেষ্টা করছে তাদের সুরক্ষা দিতে। জীবনকে তারা থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেনি বরং জীবনের প্রবাহমানতায় তারা সামিল হয়েছেন। নিরন্তন সংগ্রামের মাঝে চলতে চলতেই আমাদের আনন্দ ও সুখ খুঁজে নিতে হবে। তা না করতে পারলে বিষাদের চাদরই এ সুন্দর জীবনটাকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে রাখবে আমৃত্যু।
চিরঞ্জীব সরকার। মুম্বাই