অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
বেলা সাঁঝের পাণ্ডুলিপি (পাঁচ) - দীপিকা ঘোষ

     মাঝখানের চার সপ্তাহ চার বন্ধুর আলোচনার আসর বসেনি নানা কারণে।  মনীশ হাত ভেঙে প্রায় মাসখানিকের মতো  বিছানায় কাটিয়েছেন।  জগদীশ ভ্রাতৃবধূ মৃণালকে নিয়ে কয়েকবার মউদের বাড়ি যাতায়াতে ব্যস্ত ছিলেন।  দিলদারের বাইশ বছরের ছোট মেয়ে আবার কোন এক সুদর্শন ছোকরা ফেরিওয়ালার সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়েছিল হঠাৎ।  সংসারের বিচিত্র নাটকের অভিনয়ে অংশ নিতে নিতে কারুরই তাই নিজের মতো করে সময় কাটানোর অবসর ছিল না।  আজ সকালবেলা প্রত্যেকে প্রতাপ চ্যাটার্জির বাড়িতে মনের স্বাস্থ্য উদ্ধারের তাগিদে উপস্থিত হয়েছেন।  কারণ জীবনের এমন এক সময়প্রান্তে এঁরা সবাই দাঁড়িয়ে, যখন ভালো থাকার, ভালো লাগার বিষয়গুলো সংসারের মামুলি প্রয়োজনের মধ্যে দীর্ঘদিন আটকে রাখতে গেলে দেহমন রুদ্ধশ্বাস হয়ে পড়ে।  সঙ্গীসাথী ফিরে পেয়ে প্রতাপও বেশ প্রসন্ন আজ।  মুখে স্নিগ্ধতার হালকা আভাস ছড়িয়ে অতিথি অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা জানালেন একে একে।  প্রতাপের কাছেই একটা চেয়ারে বসতে যাচ্ছিলেন মনীশ।  ব্যস্ত হয়ে বাধা দিলেন জগদীশ –
     না না না, ওখানে নয়! ওখানে নয় মনীশ স্যার! ওখানে বসতে আপনার অসুবিধে হবে! আপনি বরং এখানটায় বসুন!  খোলামেলা আছে! বলেই আরেক প্রান্ত থেকে একটি বড়সড় লেদারের চেয়ার দিয়ে সন্তুষ্টি নিয়ে হাসলেন। 
     মনীশ মুচকি হাসলেন প্রীত হয়ে –
     ধন্যবাদ স্যার! ডান হাতটা নাড়ানোয়েএখনো নিষেধ আছে! বুড়ো বয়সের হাড় কিনা ভারি সময় নিচ্ছে জুড়ে যেতে! ব্যথাও প্রচুর! মাঝে মধ্যে ব্যথার ওষুধও খেতে হয়!
     তবু ভাগ্য ভালো, অপারেশনের দরকার পড়েনি!
     সে আর বলতে! প্রথম দিকটায় তাই বড় মুষঢ়ে পড়েছিলাম ভয়ে!  আমাদের বিপিনবাবুর মাকে দেখেছিলাম কিনা, তাঁর পায়ের হাড় ভাঙার পরে সিলিং ফ্যানের সংগে টানা এক মাস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল!
     জগদীশ হাসলেন –
     আপনার সেমনটা হতো না! তাঁর তো শুনেছি পঁচাশির ওপর বয়স হয়েছিল! কিন্তু আমি ভাবছি পরের ঘর সামলাতে গিয়ে নিজের কতবড় বিপদখানাই না বাধিয়েছেন!
     দিলদার এই প্রসঙ্গে কিছু জানতেন না।  তাঁর নিজের ঘর সামলাতেই অনেকগুলো দিন পেরিয়েছে।  বিবাহিত কন্যার নতুন কলংকিত অধ্যায় শ্বশুরবাড়িতে যাতে জানাজানি না হয় তার সব ব্যবস্থা পাকা করতে বিস্তর কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে তাঁকে।  অবশেষে সবকিছু যথাসাধ্য গোপন করে পুলিশফোর্সের সাহায্যেই তাঁর উদ্বিগ্নতা কেটেছে।  অপমান আর যন্ত্রনা অবশ্য অন্তররাজ্য ছাড়েনি।  কথাবর্তায় এখনো অসতর্ক মুহূর্তে মনের জ্বালা তাই আগুনের ধোঁয়ার মতই বেরিয়ে আসে।  তবে কিনা ছেলের অসহনীয় ঘটনার পরে বন্ধুদের কাছে কিছু লুকোনোর প্রয়োজন আগের মতো আর অনুভব করেন না।  বরং মনে হয়, জগতে এটাই তাঁর ভরসার স্থান, যেখানে অকপটে সব বলতে পারলে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে জীবনে।  একদিন তাই ফোন করে না আসার কারণ বিস্তারিতভাবেই জানিয়েছিলেন প্রতাপকে।  অবশ্য ভরসা ছিল, প্রতাপ স্বভাবে চাপা।  অন্যের গোপন প্রসঙ্গ শতভাগ গোপন রাখতে সক্ষম।  সেজন্যই দিলদারের মনে অনিশ্চয়তার দোলাচল নেই আপাতত। 
     মনীশের কাহিনী শুনতে এবার তিনি উৎসুক হলেন –
     পরের ঘর সামলাতে গিয়ে মানে? কী হয়েছিল?
     মনীশ উত্তরে হাঃ হাঃ করে হাসলেন খানিকটা।  তিনি স্বভাবে সদাহাস্যময়।  রহস্যভরে বললেন –
     পরকীয়া প্রেমের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে স্যার!
     দিলদার নড়েচড়ে উঠলেন –
     কী ব্যাপার বলুন তো?
     আমাদের ফ্ল্যাটের দুই তরুণ প্রতিবেশি মারামারি করছিলেন!  দুই স্ত্রীও তখন খড়গহস্ত! আমি ঘরে ফিরছিলাম বাইরে থেকে।  ভাবলাম, সিনিয়র প্রতিবেশি হিসেবে একটা কর্তব্য তো আছে।  দেখা যাক, এদের বিষম লড়াইপর্ব সৎবাক্য দিয়ে ঠেকানো যায় কিনা! কিন্তু সবার চোটপাট উল্টে শেষ অবধি এই বুড়োটার ওপর দিয়েই গেলো স্যার!
     মনীশের এমন ব্যাখ্যায় ঘটনার রহস্য ঘনীভূত হলো।  কিন্তু দিলদারের বোধগম্য কিছুই হলো না।  জগদীশের মুখে বিহ্বল চোখে তাকালেন দিলদার।  জগদীশ বললেন –
     এভাবে বললে কিছু বোঝা যায় মনীশ স্যার? ওই জন্যই আপনার সৎবাক্যে কোনো কাজ হয়নি! আমি খোলসা করে বলছি শুনুন।       জগদীশ এরপরে মনীশের ফ্লাটের পরকীয়া প্রেমের পুরো উপাখ্যান বিবৃত করলেন।  মনীশের ফ্লাটের এক প্রতিবেশির স্ত্রীর সঙ্গে আরেক প্রতিবেশিনীর স্বামীর প্রেমপর্ব সবার চোখের আড়ালে কবে থেকে কিভাবে শুরু হলো, তার গল্প শেষ করে বললেন –
     শেষ পর্যন্ত ওই চিঠিগুলোই ওদের কাল হলো, বুঝলেন? ভদ্রমহিলা চিঠিপত্র গোপন জায়গাতেই রেখেছিলেন।  তবে তার স্বামী একদিন অফিসের কোন ফাইল নাকি খুঁজে পাচ্ছিলেন না! ওদিকে সে সময় স্ত্রী গিয়েছিলেন বাইরে! ব্যস, জরুরি ফাইল খুঁজতে-খুঁজতে গোটা ঘরটাই তচনচ হয়ে গেলো।  তারপর গারবেজের জন্য ফেলে রাখা এক পুরনো স্যুটকেসের ভেতর থেকে স্ত্রীকে লেখা প্রতিবেশি ভদ্রলোকের চিঠির বাণ্ডিল হঠাৎই সাপের ছোবল হয়ে বেরিয়ে এলো! তারপরের ঘটনাই হচ্ছে ওই মহামল্লযুদ্ধ! আমাদের নীতিবান স্যার সেই যুদ্ধই ঠেকাতে গিয়েছিলেন।  কিন্তু প্রেমিকার স্বামী তো তখন যুদ্ধক্ষেত্রের উন্মত্ত হস্তি! আপ্ত বাক্য কানে তুলবেন কেন? এমন ধাক্কা মারলেন যে পড়ে গিয়ে মনীশের হাত ভাঙলো!
     সব শুনে দিলদার একটি সদুপোদেশ শোনালেন –
     কেন গিয়েছিলেন স্যার? আজকের যুগে সেধে কারুর উপকার করতে আছে? ভক্তি, শ্রদ্ধা, কর্তব্য, সংযমের মাহাত্ম্য আজকালকার মানুষজন বোঝে না, বুঝলেন? চারপাশে শুধু জঞ্জালের স্তূপ বাড়ছে! আমার নিজের ঘরেই দেখুন না! শিক্ষা সহবত কোনোটাই কি কারুর শিক্ষে হয়েছে?
     মনীশ অভ্যাসবশে বিস্ময় নিয়ে তাকালেন –
     কেন, আবার নতুন কী হলো?
     নতুন কেন হবে? স্যার সবই জানেন, বলে প্রতাপের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন দিলদার!
     প্রতাপ অবশ্য নীরব হয়েই রইলেন।  তাঁর বিশ্বাস, সংসারের স্পর্শকাতর গোপন বিষয়গুলোর গোপন থাকাই শ্রেয়।  প্রয়োজনের বাইরে তাদের নাড়াচাড়া করতে গেলে উপকারের চাইতে অপকার বেশি হয়।  মনীশ উত্তর না পেয়ে বুঝলেন, দিলদার তাঁর সন্তানদের নিয়ে ক্ষুব্ধ থাকার কারণেই কথাগুলো সাধারণভাবে উচ্চারণ করলেন মাত্র।  মনীশ তাই বললেন –
     ঠিকই বলেছেন! এ যুগে সেধে কারুরই উপকার করতে নেই! এই তো দেখুন না, কাল খবরের কাগজে পড়ছিলাম, পরীক্ষায় ছেলেকে নকল করতে না দেয়ায় এক বড়লোক ছাত্রের মান্যিগণ্যি বাবা, কলেজ শিক্ষককে রাস্তায় পেয়ে সাইকেলের চেন দিয়ে পিটিয়ে আধমরা করেছেন! দেখেছেন সমাজের হাল? শিক্ষক হলেন শ্রদ্ধার পাত্র! তাঁকে পথে পেয়ে পিটিয়ে সাইজ করতে চাওয়ার কথা ভাবা যায়?
     প্রতাপের বাড়ি যে আজ নিঃশব্দ নীরবতায় শুনসান, সেটা অন্য তিন বন্ধু বহু সময় পরে অনুভব করলেন।  জগদীশ কথার মাঝখানে একসময় জিজ্ঞেস করলেন –
     কী ব্যাপার স্যার? ছুটির দিনেও বাড়ি শান্ত! এষাদিদিকে দেখছি না! আমাদের করুণাময়ীর আওয়াজ পর্যন্ত পাচ্ছি না আজ! পথিকরা কোথাও গেছে নাকি?
     পথিকের এক বন্ধুর বাড়ি সবাই বিয়ের নিমন্ত্রণে গেছে।  ফিরতে সন্ধে হবে! আর করুণা ফাঁকা বাড়ি পেয়ে সব সঙ্গী সাথীদের সাথে বোধকরি সৌজন্যসাক্ষাৎ সারতে গেছে! এসে পড়বে। আপনারা আসছেন, জানে!
     সঙ্গীসাথী? তারা সব থাকে কোথায়?
     কে জানে! এ পাড়াতেই হয়তো আছে দু’চারজন!
     জগদীশ হাসলেন –
     ওঃ এই কথা! তবে স্যার, করুণাময়ী আমার ডায়াবেটিস চা কিন্তু বেশ ভালোই বানায়!
     রান্নাও ভালো করে! মামণি ওকে দাঁড়িয়ে থেকে শিখিয়েছে!
     জগদীশ এবার অসহিষ্ণু হলেন –
     এই আজকাল দেখছি সব ঘরে ঘরে! রান্না জানে, তবুও করবে না! আমাদের বাড়িতেও ওই একই দশা! মৃণাল ছাড়া রান্নাঘরের ছায়া পর্যন্ত কেউ মাড়ায় না! সে বেচারার একদিন অসুখ করলে হয়তো বাইরে থেকেই খাবার আনিয়ে খেতে হবে!
     জগদীশের কথায় প্রতাপকে গম্ভীর দেখালো।  বললেন – 
     এ যুগের মানুষের সবরকম চাহিদা বাড়ার পাশিাপাশি নিজের ধর্মের প্রতিও অশ্রদ্ধা বেড়েছে জগদীশবাবু! তাই এমন অবস্থা! অথচ শাস্ত্র বলেছেন, ‘শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ অনুষ্ঠিতাৎ।  স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।’  জগদীশ সঙ্গে সঙ্গে বললেন –
     হ্যাঁ, এ কথা আপনার মুখে শুনেছি স্যার।  নিজের ধর্ম যেমনই হোক, সেটা পালন করাই শ্রেয়।  কারণ অন্যের ধর্ম অনুকরণ করার পরিণতি কখনো শুভ হয় না!      দিলদার অনেক সময় নিঃশব্দে ছিলেন।  জগদীশের ব্যাখ্যায় এবার কুণ্ঠাভরা সংশয় নিয়ে তাকালেন –
     সত্যিকারের ধার্মিক এখন আর কজন! মন্দির, মসজিদে যাওয়াই সার! সততা না থাকলে ধর্মপালন করলে কী হয়? কবি কাজী নজরুল ইসলামও সে কথা বারবার বলেছেন!
     প্রতাপ নিজের মন্তব্যের ব্যখ্যা দিতে তৎপর হলেন এবার –
     সনাতন শাস্ত্র ‘রিলিজিয়নকে’ ধর্ম বলে না দিলদার সাহেব।  এখানে ধর্ম মানে ডিউটি।  রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা পরিবারে যার যার অবস্থান থেকে জীবনের কর্তব্য পালন।  যেমন রাজা এবং প্রজার জীবনের কর্তব্য বা ধর্ম এক রকম হয় না।  কৃষক এবং শিক্ষকের ধর্মও আলাদা।  সনাতন ধর্ম, কর্ম অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগের কথা বললেও রিলিজিয়নের নামে জাতিবিভেদের কথা বলেনি।  মানুষ যদি শতভাগ সততার সঙ্গে কর্তব্য পালন করে, তাহলেই সমাজ সুশৃঙ্খল হয়।  সতরাং পরিণতি শুভ ফল আনে!
     উত্তরে দিলদারের সপ্রশ্ন দৃষ্টি আরও উতরোল হলো –
     তাহলে আপনাদের ধর্মে যে এত ঠাকুর দেবতার পূজোটুজো করা হয়, সেটা কিসের জন্য?
     তার ব্যাখ্যা অন্য।  সেটাও জীবনের ধর্মপালনই।  কারণ বিশ্বস্রষ্ট্রাকে ভালোবাসা, ভক্তি করা মানুষের পবিত্র কর্তব্য।  ঈশ্বর এক অদ্বিতীয় নিরাকার হলেও তাঁর নিজের সৃষ্টির বাইরে নন।  বিশ্বসৃষ্টিতে যা কিছু রয়েছে, সব তাঁর থেকেই হয়েছে।  শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা থেকে সনাতন ধর্মের অনুসারিরা তাই তাঁকে সাকাররূপে আরাধনা করেন।  আধুনিক বিজ্ঞান “God Particle” থিওরিতে নিশ্চিত করেছে, জগতে বৃহত্তম, অণুতমরূপে যা কিছু দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান, সবের মূলেই রয়েছে “God Particle” বা ঈশ্বর কণা। 
     স্বাধীনতা পেয়ে করুণাময়ী অনেকটা দেরি করে ফিরলো আজ।  যখন দাদাদের সামনে এসে দাঁড়ালো, চোখেমুখে বিস্ময়, উত্তেজনা, মুগ্ধতা একসঙ্গে উত্তাল হয়ে ফুটছে।  বাড়ি ঢুকে সে আগেই রান্নাঘরে চায়ের জল বসিয়েছিল।  দ্রুতহাতে টুকটাক খাবার সাজিয়ে নিয়েছিল ট্রেতে।  কর্তব্য পালনের অবহেলা কোথাও যাতে নালিশ হয়ে না ওঠে, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি ছিল না কোথাও।  এখন প্লেটগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে কেউ প্রশ্ন করার আগেই বললো –
     এক্কেবারে ছুট্টে এসেছি দাদা! জানি তো, আপনাদের চায়ের সময় হয়ে গেছে!      মনীশ বললেন –
     সময় হয়েছে কী করুণাময়ী? সময় তো পেরিয়ে গেছে! ক’টা বাজে জানো? এগারোটার ওপর! বাড়ি ফিরে এরপর স্নানটান করে খেতে হবে না?
     সে হবে’খন ছোটদাদাবাবু! আগে এইটুকু মুখে দিন, চা এনে দিচ্ছি বলে!
     চলে যাচ্ছিলো করুণা।  প্রতাপ ডাকলেন – 
     ফিরতে এত দেরি করলি যে?
     করুণা এবার মুখর হলো – 
     সে এক বিত্তান্ত দাদা! মানুষ ছুটছে ঝাঁকে ঝাঁকে! মানুষ ঠেকাতে এখন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে!
     কিসের বৃত্তান্ত? কেন মানুষ ছুটছে? কিসের কথা বলছিস?
     দাঁড়ান দাদা, চা নিয়ে এসে বলছি সব!
     করুণা ফিরে এসে যা বললো তার মর্মার্থ হলো, মাইল দুই দূরে মথুরাপুর রেলস্টেশনের বস্তিতে সাতদিন আগে এক কিশোরী ঘোরতর জ্বরে জ্ঞান হারায়।  চেতনা ফেরে তিনদিন পরে।  কিন্তু তারপর থেকে নিজের চারপাশে সে অদ্ভূত  অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে।  আগে লিখতে পড়তে জানতো না।  এখন প্রশ্ন করা মাত্রই ক্ষিপ্র হাতে উত্তর লিখে দিচ্ছে।  তার শরীর থেকে মিষ্টি সুগন্ধ পারফিউমের মতো ছড়াচ্ছে সারাক্ষণ।  চেহারা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে উজ্জ্বল চাঁদের জ্যোতি।  মরমর অসুস্থ মানুষকেও কিশোরী শুধু হাতের স্পর্শে সুস্থ করে দিচ্ছে।  তার ক্ষিধেতৃষ্ণা নেই।  তবুও টাটকা সতেজ ফুলের মতো সারাক্ষেই ঝলমল করছে চেহারা।  মানুষ তাই টাকাপয়সা, চাল ডাল, যে যেমন পারছে নিবেদন করছে তার সামনে।  সমস্তটা শুনে দিলদার বললেন –
     আমার স্ত্রীকে জানাতে হবে ব্যাপারটা! জ্বীনপরীতে তার অগাধ বিশ্বাস!
     মনীশ হাসলেন –
     এর কতখানি সত্যি আর কতটা ভেজাল কে জানে স্যার! তিলকে তাল করা মানুষের স্বভাব কিনা! আপনার কী মনে হয় দাদা?
     প্রতাপ মাথা নাড়লেন –
     সংসারে অনেক সময় চোখে দেখেও সবকিছু বোঝা যায় না মনীশবাবু! আর এতো করুণার মুখে শোনা গল্প!
     মনীশ উত্তেজিত হলেন -
     গল্প? ঠিক বলেছেন দাদা! করুণাময়ীর গুলও হতে পারে!
     করুণা কাছেই দাঁড়িয়েছিল।  শুনেই ফোঁস করে উঠলো –
     মোটেই না ছোটদাদাবাবু! আমি নিজের চোখেই তো দেখে এলাম সব!
     প্রতাপ হেসে উঠলেন –
     তুই গিয়েছিলি সেখানে? একটু আগেই যে বললি, সঙ্গীদের সঙ্গে যেতে পারিসনি?
     উত্তরে করুণা দ্রুত চলে যেতে যেতে বললো –
     যারা গিয়েছিল, তারাই বলেছে এসব! মিছে কথা নয় গো!
     মনীশ এবার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে উঠলেন জোরে জোরে –
     মথুরাপুর রেলস্টেশনে অলৌকিক কিছু ঘটছে কিনা জানিনে!  তবে এটা নিশ্চিত জানি, লেখাপড়া শিখলে আমাদের করুণাময়ী খাসা গল্প লিখে বিখ্যাত গল্পকার হতে পারতো দাদা!

দীপিকা ঘোষ। যুক্তরাষ্ট্র