অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
নায়িকা সংবাদ - সুনির্মল বসু

     ছায়াচ্ছন্ন গ্রাম। আঁকা বাঁকা মেঠো পথ। চারদিকে সবুজের বর্ণময় সমারোহ। পাখির ডাকে এখানে সকাল আসে। রাতে বাঁশবনের ওপর অজস্র তারার মালা। দূর আকাশে ঘুম ঘুম চাঁদ জেগে থাকে। দূরে তাল সুপারি গাছের সারি। সামনে তরমুজ ক্ষেত। কাছেই চলনবিল। বিলের জলে শাপলা শালুক। এপারে ঘাটে বাঁধা নৌকো।
     এ গ্রামের ছেলে বিজন মা বাবা মারা যাবার পর, মামা বাড়িতে থেকে মানুষ হচ্ছিল। বরাবর পড়াশোনায় গভীর মনোযোগী ও। প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করছিল। এবার তাঁর বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেবার কথা। বিজন সিরিয়াসলি পড়াশোনা করছিল। পড়াশোনার বাইরে ওর একটা বিশেষ শখ আছে। তা হল, রবি ঠাকুরের গান।
     বিকেল বেলায় বসন্ত দিনে যখন উদাস হাওয়া কৃষ্ণচূড়া বনে বয়ে যায়, তখন বিজন নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনে রবি ঠাকুরের গানের কলি গেয়ে ওঠে। কারো কাছে কখনো গান শেখেনি বিজন। অথচ দুঃখে-কষ্টে এই গানগুলো ওর বাঁচার প্রেরণা। সেদিন সন্ধ্যায় আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল। বিজন বাড়ি ফিরছিল। পথে ললিতার সঙ্গে দেখা। ললিতা পাশের গ্রামের মেয়ে। কেমন একটা দূরের সম্পর্ক আছে ওদের দুই পরিবারের মধ্যে। ওই লতাপাতার সম্পর্ক।
     ললিতাই প্রথম কথা বলে, ভালো আছো, বিজন দা,
     বিজন বলে, হুঁ। তারপর জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো তোমরা, তোমার পড়াশোনার কি খবর,
     আমি তো তোমার মত পড়াশোনায় ভালো নই, এবার মাধ্যমিক ফাইনাল দেবো।
     বিজনের মনে পড়ে, ছোটবেলার কথা। মায়ের সঙ্গে ওদের বাড়িতে কতবার গিয়েছে। ললিতার মা বড় ভালোবাসতেন বিজনকে। ললিতা তখন খুব ছোট।
     ললিতা বলল, তুমিতো অঙ্কে ভালো, আমাকে একটু অঙ্ক শেখাবে,বিজন দা,
     বিজন রাজি হয়।
     বিকেলের দিকে অংক শিখতে আসতো, ললিতা। সন্ধ্যে হয়ে গেলে, নদীর পাড় ধরে বিজন প্রতিদিন ওকে এগিয়ে দিত। প্রতিদিন একই রুটিনে জীবন এগোচ্ছিল। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করল  ললিতা। সেদিন অদ্ভুত ভালো লাগা ছুঁয়ে গিয়েছিল বিজনকে। ধানক্ষেতের পাশে আলের উপর দিয়ে হলুদ শাড়ি পরে প্রজাপতির মতো ছুটতে ছুটতে এসেছিল ললিতা।
     আমি ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ করেছি বিজনদা, অঙ্কে লেটার পেয়েছি। সব তোমার জন্য।
     মুহূর্তে কি যে হয়েছিল বিজনের, ললিতার জন্য মনের মধ্যে অদ্ভুত ভালোবাসা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। সেদিন মুখে কিছু বলতে পারেনি বিজন। বলেছিল, এক দুর্গাপূজার নবমীর সন্ধ্যায়।
     সার্বজনীন দুর্গাপুজো গ্রামের। সকালবেলায় অঞ্জলি দিয়ে পূজো মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে আসছিল ললিতা। পাঞ্জাবী পাজামা পরে প্যান্ডেলে ঢোকার মুখে দেখা হয় দুজনের। ততদিনে বিএ পাস করে, একটা প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে বিজন।
     ললিতা ওকে দেখে হাসলো। বিজন বলল, অঞ্জলি দিতে এসেছিলে,
     হ্যাঁ,
     সন্ধ্যেবেলায় বের হবে,
     কেন,
     একটা কথা বলার ছিল,
     আসবো,
     আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো,
     সন্ধ্যেবেলায় বড় দীঘির পাড় ধরে যাবার পথে, বিজন ওকে ভালোবাসার কথা জানায়।
     পূজোর দিনে ললিতাকে দেবী প্রতিমার মতো লাগছিল। গোলাপি বেনারসি শাড়িতে ও যেন তখন রমেশ পালের দুর্গা। স্কুলে চাকরি পেয়েছি, তোমাকে ভালোবাসি ললিতা, তোমার ইচ্ছের কথা জানতে চাই,
     আমার বাবা মার সঙ্গে কথা বলো, বিজনদা,
     বিজন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ও বাড়িতে একদিন গিয়েছিল। ওরা মুখের উপর নাকচ করে দেন। শুধু তাই না, ওর মা-বাবা ললিতাকে ওর কাকার বাড়ি কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়।
     বিজন ভেঙে পড়ে। একলা হয়ে যায়। অথচ এমন ঘটনা, ওর জীবনের না ঘটলেও তো পারতো। জীবন সম্পর্কে ভরসা হারিয়ে ফেলেছিল বিজন। কখনো আর ললিতার খবর নেবার চেষ্টা করেনি। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে। দিনগুলো গতানুগতিকভাবে চলে যাচ্ছিল বেশ। দুঃস্বপ্নের স্মৃতিগুলোও তো একসময় ফিকে হয়ে যায়।
     বিজনের কলেজের বন্ধু পার্থিবের সঙ্গে দেখা একদিন কফি হাউসে। ও বলল, তোর ফিয়াসে ললিতা তো এখন সিনেমার নামকরা নায়িকা। নায়িকা মধুপর্না।
     বিজন চমকে যায়। মুখে কিছু বলে না। কিছুদিন পর ও বিয়ে করে সুস্মিতাকে। তারপর গতানুগতিক জীবন। স্কুল, টিউশনি। একটা জীবন, একটা গোলক ধাঁধা। প্রতিদিন একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া। ছেলে বিমান কলেজে গেল। মেয়ে চিত্রিতা মাধ্যমিক পাস করল। বাঁধাধরা জীবন।
     সেই বাঁধাধরা জীবনে একদিন আশ্চর্য এক সংবাদ এলো। সংবাদ নয়, যেন বিস্ফোরণ। গ্রামের লাইব্রেরীর অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠান করতে আসছেন সিনেমা জগতের বিশিষ্ট নায়িকা মধুপর্না।
     এতে বিজনের কিছু যায় আসে না। ভাঙ্গা কাচের আয়নায় মুখ দেখার তাঁর কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু বিজন এড়িয়ে যেতেও পারছে না। সেদিন স্কুলে হঠাৎ ফোন এলো, বিজনের উদ্দেশ্যে।
     ললিতা বলছি, তোমাদের ওখানে প্রোগ্রামে যাচ্ছি। তুমি স্টেজে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।
     ললিতা দেখা করতে বললেও, বিজন নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তাছাড়া, সে এখন বিবাহিত। ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে। ইদানিং শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।
     গ্রামে বিরাট আলোড়ন, নায়িকা মধুপর্না এখানে আসছেন। রাস্তাঘাট মেরামতের কাজ শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় পথের ধারে বাতিস্তম্ভ লাগানো হয়েছে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর হয়ে উঠেছেন।
     নির্দিষ্ট দিনে নায়িকা মধুপর্না মঞ্চে এলেন। প্রবল জনস্রোত চারদিকে। মধুপর্না কাউকে খুঁজছেন। বারবার কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, বিজন সান্যাল কি এসেছেন, এলে আমার কাছে ওনাকে ডেকে আনবেন।
     একজন কর্মকর্তা বললেন, না ম্যাডাম, উনি আসেন নি।
     অনুষ্ঠান শেষে মধুপর্না চললেন বিজন সান্যালের বাড়িতে। অসুস্থ বিজন তখন প্রায় অন্ধকার ঘরে জানালার কাছে শুয়ে আছেন। মধুপর্ণা ওর ছেলেমেয়েদের দেখলেন, বিজনের স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হলো। অনেক রাত পর্যন্ত কথাবার্তা বলে গল্প করে সেই রাতে তিনি শহরে ফিরে গেলেন।
     শহরে গিয়ে আবার যথারীতি ব্যস্ততা। কারণ, তিনি এখন শহরের ব্যস্ততম সেলিব্রিটি। সপ্তাহ খানেক বাদে থেকে প্রতিদিন রাত দশটা বাজলে, তাঁর ফোন বেজে উঠতো। মধুপর্না কাজের মানুষ। তার ওপর শহরের নামকরা সেলিব্রিটি। এইসব ফোন ধরা তাঁর পক্ষে অসম্ভব, এবং মোটেই মানানসই নয়। বিজনের কি আবার বুড়ো বয়সে প্রেম জাগলো। পরপর কয়েক দিন মধুপর্না বিজনের ফোন ধরেননি। ভেবেছিলেন, ফোন না ধরলে, ওপারের ফোনকারী হতাশ হয়ে একসময় ফোন করা বন্ধ করবেন।
     কিন্তু তা হলো না। আজ রাতেও যখন ফোনটা বেজে উঠলো, মধুপর্না নিজেই ফোনটি তুলে কড়া উত্তর দিতে প্রস্তুত হলেন। বললেন, কি ব্যাপার বিজনদা, রেগুলার ফোন করে আমাকে ডিস্টার্ব করছো কেন,
     ও প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এলো। পিসী, আমি বিমান বলছি। আপনি আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবার পর, দু'দিন পরেই আমার বাবা মারা গিয়েছেন। শুধু এই সংবাদটা দেবার জন্যই আমি বারবার এ কদিন ধরে আপনাকে ফোন করে চলেছি।
     এ্যা, বিজনদা চলে গেল। চলে গেল, চলে গেল, চলে গেল। তাঁর অবরুদ্ধ কন্ঠস্বর উদাস হাওয়ায় বুকের পাঁজরের  মই বেয়ে দীর্ঘশ্বাসের মতো ঝরে পড়ল। কাচের সার্সির ওপার থেকে উড়ালপুলের আকাশের দিকে চেয়ে মধুপর্না দেখলেন, আকাশ থেকে একটি তারা যেন দূরে কোথাও খসে পড়ল।

সুনির্মল বসু
দক্ষিণ 24 পরগনা
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ