অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
দুই পলাশ - কিরণময় নন্দী

     মাঝ রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। কালো মেঘে আকাশ ঢাকা। সকালের উপস্থিতি বোঝার উপায় নেই। সুরঞ্জন ঘুম থেকে না উঠেই হালকা চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। বৃষ্টির বেগ একটু কমলে জানালা খুলে দক্ষিণ দিকের পুকুরপাড়ের দিকে তাকাচ্ছে। ইউক্যালিপটাস গাছের মাথা বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় মাথা নিচু করে বৃষ্টিকে স্বাগত জানাচ্ছে। কাকভোরে উঠে শালিক গুলো কি করবে বুঝতে না পেরে পলাশ গাছের সামনে উঁচু জায়গায় ভিজে ভিজে ঝগড়া করছে। আবার ছোটো ডানা ঝাপটে গোয়াল ঘরের সামনের খড়ের উপরে গিয়ে বসছে। এদিকে কলকাতা "ক" প্রচার তরঙ্গে তখন চলছে "প্রাত্যহিকি" অনুষ্ঠান। সুরঞ্জন সময় পেলেই বেতারের অনুষ্ঠান শোনে। সুমধুর কণ্ঠে সঞ্চালক সঞ্চালিকা সাবলীনভাবে পাঠ করে চলে বহু মানুষের লেখা চিঠি। এই সপ্তাহের বিষয় "না-বলা প্রেম"। না-বলা প্রেমকাহিনীর অজানা গল্প শুনতে শুনতে সুরঞ্জন ধীরে ধীরে ডুব দেয় বেগনকোদায়। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম বেগনকোদা। সামাজিক পটভূমি আজ কিছুটা পরিবর্তিত। কিন্তু ওর কাটানো ছেলেবেলার বেগনকোদা প্রায় যোগাযোগহীন অনুন্নত কিন্তু ভীষণ প্রিয় গ্রাম। একদিকে অযোধ্যা আর অন্যদিকে বাগমুন্ডি যাবার রাস্তা। শহুরে গুটিকয়েক পর্যটক শীতের পুরুলিয়া দেখতে ওদের গাঁয়ের পাশের বড় রাস্তা ধরে চলে যান। 
     সুরঞ্জনের বেশ মনে পড়ে ওর স্কুল রাইচরণ মাহাতো উচ্চবিদ্যালয়ের কথা। তখন নব্বই এর দশক। সবাই ইস্কুলমুখী ছিলো না। দিনগুজরান করে সামান্য অর্থ হাতে থাকলেই, সেই বাড়ির ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে যেতো। সুরঞ্জন বেশ অভিজাত পরিবারের ছেলে। ওর বাবা তখন বেগণকোদা ফাঁড়ির ইনচার্জ। ক্লাস টুয়েলভে সুরঞ্জনের সাথে পরিচয় হয় পরীর। পরী মুর্মু। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। পরিবারের অমতে স্কুলে আসতো পরী।
     রবি ঠাকুরের গান ওর কণ্ঠে সকলকে আকৃষ্ট করতো। রেডিও শুনে ভীষণভাবে রপ্ত করেছিলো। সুরঞ্জনদের স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে পরী খালি গলায় গান গেয়েছিলো। কি সুমধুর কণ্ঠ! সাহিত্যের প্রেমে পড়া সুরঞ্জন পরীর গানে মুগ্ধ। অনুষ্ঠানের শেষে কিঞ্চিৎ বাক্যবিনিময় হয়। তারপর স্কুলে আসার সময় ও ছুটির শেষে পরীর সাথে কথা বলার অপেক্ষা করতো সুরঞ্জন। কখনও পলাশ গাছের তলায় কখনও সানবাঁধানো কুঠীবাঁধের ঘাটে বসে কবিতা-গানে পারস্পরিক ভাববিনিময়। কথায় কথায় উঠে আসতো 'ফটিকের ছুটি', নিরুপমার 'নিদারুন পরিস্থিতি', 'বলাই এর কথা', 'কাবুলিওয়ালা ও মিনির স্নেহের সম্পর্ক','বাবু কালচার' আরও কত কি! 
     তারপর নিজেদের অজানা কথা। পরী খুব সকালে উঠে কুয়ো থেকে সারাদিনের প্রয়োজনীয় জল তোলে, তারপর আগের রাতের বাসন ধোয়া, উনুন ও বাড়ির উঠোন নিকোনো।খুব ভোরে ওর মা বাবা মাঠে চলে যায়। গোরু ছাগল মাঠে ছেড়ে সামান্য জমিতে কিছু ফসল ফলাবার অমানসিক পরিশ্রম। পরী ভাইকে নিয়ে তারপর উঠোনে পড়তে বসে। উনুনে ফ্যানভাত ফুটতে থাকে। 
     উৎসবের দিনে মাটির দেওয়াল নিকিয়ে আদিবাসী ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনে চিত্রশিল্প। ঢেঁকিতে ধান ভানার ছবি, মাঠে কাজ করার ছবি, দলবদ্ধ হয়ে আদিবাসী নৃত্যের ছবি, পশু শিকারের ছবি, ছৌ নাচের ছবি, ধামসা-মাদলের ছবি কত কি! পরীর প্রতিভা ও শেখার ইচ্ছে শুনে সুরঞ্জন অবাক হয়ে যায়। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে পরীকে। কিন্তু না-বলা রয়ে যায় কত কথা।
     এপ্রিলের শেষ সুরঞ্জন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় চলে এলো। যাদবপুরে ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলো। স্মৃতিপট থেকে আবছা হলো রাইচরণ মাহাতো স্কুলের সোনালী দিন গুলো। বাবা এখন বাঁকুড়ায়। ওদের গাঁয়ের বাড়ি জয়পুর। বাবা ছুটি পেলে জয়পুরে চলে আসেন। জয়পুরে সুরঞ্জনদের যৌথ পরিবার। কলকাতা থেকে ছুটির অবসরে সুরঞ্জন ফেরে জয়পুরের বাড়িতে। বেগনকোদার সাথে ওদের পরিবারের আর কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিযোগিতার দৌড়ে সুরঞ্জন বেশ ব্যস্ত। মাস্টার্স কমপ্লিট করেই সুরঞ্জন এসএসসিতে বসেই চাকরি পেলো।
     আবার পুরুলিয়া। ঝালদার কাছে এক মাধ্যমিক স্কুলে। ওর বাড়ি থেকে প্রায় একশো সত্তর কিলোমিটার দূর। দূরত্বের কারণে সুরঞ্জন ইস্কুলের কাছে বাড়ি ভাড়া নিলো। এক বনেদী ব্যবসায়ী পরিবার কলকাতায় থাকেন। পৈতৃক ভিটেই থাকতে দিয়েছেন সুরঞ্জনকে। তখনও মোবাইলের গ্রাম পরিক্রমা হয়নি। ইলেকট্রিক ছিলো। রেডিও ভরসা অবসরে। এছাড়া প্রচুর বই এনেছে সুরঞ্জন। ঝালদায় এসে সুরঞ্জনের বেশ সমস্যা হলো রান্না করা নিয়ে। ও কোনোদিন রান্না করেনি। স্কুলে অনেক সময় দেয়। প্রাইভেট টিউশন নেই কারও। তাই স্কুলের শেষে বিনা বেতনে আন্তরিকতায় আবার ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে দেওয়া। বাড়ি ফিরে আর একার জন্য রান্না করতে ভালো লাগে না। রামানন্দ বাবু, সুরঞ্জনের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই ব্যাপারটা বুঝলেন। আড্ডা দিতে এসে দেখলেন ছেলেটা রাতে মুড়ি খেয়ে বেশিরভাগ দিন কাটিয়ে দেয়। আর সকালে হাত পুড়িয়ে দুটো ভাতে ভাত রাঁধে। 
     সুরঞ্জনের সুবিধার কথা ভেবে একজন রান্নাকরার মহিলা জোগাড় করলেন। প্রথমে সুরঞ্জন না করে দিলেও, হাত পুড়িয়ে রান্না করার নানা ঝক্কির কথা ভেবে হ্যাঁ করে দেয়। বিকেলে রামানন্দ বাবু অল্পবয়সী এক মহিলাকে নিয়ে আসেন। মাথা অনেকটা ঘোমটা দেওয়া। বছর ছয়ের এক শিশু মহিলার আঁচল ধরে আছে। অভাবের নিদারুন ছবি ফুটে উঠেছে ছেলেটির চোখে-মুখে। একহাত মায়ের আঁচল ধরে অন্যহাতে কুশি পেয়ারা খাচ্ছে। রামানন্দ বাবু বললেন সকালে ও বিকালে এসে রোজ রান্না করে দিয়ে যাবে সাথে বাসন মাজা ঘর পরিষ্কার ও বাজার করা, সবই করে দেবে। মাসে সাড়ে তিনশো দিলেই হবে। সুরঞ্জনের কাছে টাকাটা কোনো বিষয় নয়। এতগুলো পরিষেবা আর সামান্য কটা টাকা। সুরঞ্জন রামানন্দ বাবুর পরিচিতা হিসেবে একবাক্যে রাজি হয়ে গেলো। 
     সন্ধ্যেবেলা সুরঞ্জন মন দিয়ে বই পড়ছে। ছোটো ছেলেটি চা দিয়ে গেলো। সুরঞ্জন ছেলেটিকে ডাকলো।
-এই তোর নাম কিরে?
-পলাশ
-বা! বেশ ভারী মিষ্টি নাম। তুই পলাশ ফুল দেখেছিস?
-হ্যাঁ, আমার মা পলাশ ফুল ভীষণ ভালোবাসে।আমার জন্য কুড়িয়ে এনে দেয়।
-তুই পড়াশোনা করিস না?
-হ্যাঁ, মা মুখে মুখে পড়ায়। স্লেটে আমি লিখতে পারি। আমার মরা বাবার নাম, মায়ের নাম, আমার নাম আমাদের গাঁয়ের নাম। অনেক কিছু।
     বেশ কিছু কথোপকথনের পর সুরঞ্জন ওকে খাতা পেন দিয়ে লিখতে বলে। সুরঞ্জন পড়ায় মনোযোগ দেয়। আর পলাশ মাটিতে বসে লিখতে থাকে। কিছুক্ষন পড়ে রান্নাঘর থেকে পলাশের নাম ধরে ওর মা ডাকে। পলাশ চলে আয়, বাড়ি যাবো আর মাস্টারমশাই কে বল- রান্নাঘরের তাকে সব কিছু খাবার চাপা দিয়ে রাখা আছে। 
     এই প্রথম সুরঞ্জন রান্নাকরা মহিলার গলা শোনে। বেশ চেনা চেনা লাগে কণ্ঠস্বর। একছুটে পলাশ চলে যায় আর যাবার আগে মায়ের বলা কথাগুলো দ্রুত বলে যায়।
     রাতে খাবার শেষে সিগারেট ধরালো সুরঞ্জন। বারবার ওই মহিলার কণ্ঠস্বর কানে ভাসতে থাকে। এদিকে প্রচন্ড মেঘ আকাশে। ভীষণ গরম। কারেন্ট চলে গেলো। মোমবাতি জ্বালালো সুরঞ্জন। বারবার বেগণকোদার পরীর কথা মনে হচ্ছিলো। বেশি দূর নয় ঝালদা থেকে। তৎকালীন পিছিয়ে পড়া সমাজ থেকে অনেক লড়াই করে পরী পড়াশোনা করতো। দারিদ্রতা কখনও বুঝতে দেয়নি। মুখে অমলিন হাসি।ভালোলাগার কথা কোনোদিন বলতে পারেনি সুরঞ্জন। তবুও কত কাছাকাছি থাকতো ওরা।
     টর্চ জ্বেলে বাথরুমের দিকে যাবে দরজার সামনে খাতা আর পেনটা পড়ে আছে। সযত্নে তুলে রাখলো সুরঞ্জন।  বাথরুম থেকে ফিরে মোমবাতির আলোয় পলাশের লেখা দেখার চেষ্টা করে সুরঞ্জন। বজ্রপাতের মৃদু চমকানিতেও সুরঞ্জন চমকে ওঠে। পলাশ মায়ের নাম লিখেছে পরী। তাই কি এতটা ঘোমটা দিয়ে ওই মহিলার প্রবেশ, তাই কি পলাশকে দিয়ে চা পাঠানো, তাই কি এই বয়েসে পলাশের এত পারদর্শিতা, তাই কি পলাশের কথায় পলাশের মা পলাশফুল ভীষণ ভালোবাসে?
     সুরঞ্জন নিশ্চুপ হয়ে বিছানায় বসে পড়লো। পরীর একি পরিণতি! এই বয়েসে বৈধব্যজীবন! এতদিন পর পরীকে আবিষ্কার করে এভাবে ডানা-কাটা পরীর মতো দেখতে হলো। নিজেকে ভীষণ দুর্বল মনে হচ্ছিলো সুরঞ্জনের।  বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ার সাথেসাথেই সুরঞ্জনের হৃদ-স্পন্দন বাড়তে থাকে। জানালা ধারে দাঁড়িয়ে থাকে ও। মাঠের মাঝে বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানি। পাশাপাশি দুটি পলাশ গাছ নজরে আসে বারেবারে....

কিরণময় নন্দী
পাতুল খানাকুল হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ