অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
টান - হাসান গোর্কি

ভোর রাত থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। বিরামহীন একটানা শোঁ শোঁ শব্দ। ঘরের বারান্দায় জলচৌকি পেতে বসে আছে আলিম। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সে মাছ ধরতে যায় না। শরীরে একটু একটু জ্বর। অল্প মাথা ব্যথা। শরীরটা ভাল থাকলে নোনতাখালীর দোনে গিয়ে জাল ফেলত সে। মাঝারি আকৃতির ডিঙিটার পেট এতক্ষণে মেঘনার রুপোলি ইলিশে পূর্ণ হয়ে উঠত। শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণে যখন পুবের খাল বেয়ে ‘গড়া’ নামে তখন নদীর গভীর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উঠে আসে নোনতাখালীর দোনে। পারুল একা ঘরের মধ্যে বসে আছে। ঘরটা এ বছরই ছন দিয়ে ছেয়ে নিয়েছে আলিম। পানি পড়ে না। বৃষ্টি এলে পারুলের ভালই লাগে। জানালা দিয়ে ধলিরচরের জনশূন্য প্রান্তরে তাকিয়ে থাকে। জানালায় ভেসে আসা জলজ  বাতাসের পরিচিত গন্ধটা তাকে শৈশবের বর্ষার কথা মনে করিয়ে দেয়। ময়নারচরের অনেক  কিছুই তার আর মনে নেই। কিন্তু বর্ষাকে মনে আছে খুব। পারুলের মনে হয়, সেরকম বর্ষা আর আসে না। অন্ধকার রাতে ঝমঝম করে যখন টিনের চালে বৃষ্টি পড়ত তখন তার মনে হতো ময়নার চর অথৈ পানির তলায় ডুবে যাচ্ছে; থৈ থৈ ঘোলা জলের প্রবল স্রোতের তোরে ভেসে যাচ্ছে সাগরের দিকে। সে মৃদু ঝাঁকুনি অনুভব করার চেষ্টা করত।

চৌকির কোণায় দুই পায়ের ফাঁকে মাথা রেখে পারুল বসে আছে সেই সকাল থেকে। আজকাল আলিমকে বাড়িতে দেখলেই তার গা জ্বালা করে। গত সাতদিন ধরে সে বাড়িতে বসে আছে। সর্বক্ষণ খক খক করে কাশে। গায়ে চাদর জড়িয়ে চুল টানে। অসহ্য লাগে পারুলের। সে যখন পেয়াদা বলে গালি দেয়, মাটির হাঁড়ি ভেঙে ফেলে, আলিম তখন নির্লিপ্ত বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর পর একটা করে বিড়ি ধরায়। পারুল তখন আরো রেগে যায়; হিতাহিতজ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ে। আলিমের শনের মত শক্ত দাড়িগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে তার। লোকটার বিকার নেই কিছুতেই। পারুল চায় আলিম রাগ করুক। তার সাথে ঝগড়া করুক। তাহলে ভাল হোক মন্দ হোক সমস্যার একটা সমাধান অন্তত বেরিয়ে আসবে।
কিন্তু আলিম কোন বিতর্কে অংশ নেয় না। কোন অভিযোগের জবাব দেয় না। ক্ষোভে দুঃখে পারুলের মাথাটা ঘুরতে থাকে। চোখে অন্ধকার দেখে সে। অথচ এক সময় কি ভীষণ আগ্রহ নিয়েই না সে অপেক্ষা করত আলিমের জন্যে! আলিম মাছ ধরতে গেলে সজনে তলায় বসে রেডিওতে ছায়াছবির গান শুনত সে । তার চেয়েও মনোযোগ দিয়ে শুনত আবহাওয়ার সংবাদ।  ‘... কোন সতর্কবাণী নেই এবং কোন সংকেতও দেখাতে হবে না।’ নৈমিত্তিক হলেও কথাগুলো শুনতে তার খুব ভাল লাগত। মনে হতো, সংবাদপাঠক তাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলছে। বাড়ি ফিরেই আলিম কোমর থেকে টাকার খুতিটা খুলে তুলে দিত পারুলের হাতে। কাগজের নোটগুলো আলাদা করে গুণে রাখত পারুল। সব খুচরো পয়সা জমা করত বাঁশের খুঁটির মধ্যে। 
তার চোখে ভেসে উঠত সেই দৃশ্য─  কেমন করে মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে আলিম মাছ ধরছে। পারুলের মনে হতো, এ টাকাগুলো আলিমের সেই যুদ্ধে জয়ী হবার পুরষ্কার। নদীতে একরত্তি বান ডাকলে, দক্ষিণের দমকা বাতাস বয়ে গেলে বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকতো তার। মনে হতো, সমস্ত ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, বাত্যাপ্রবাহ চিরদিনের জন্যে ধলিরচর থেকে বিদায় নেয়না কেন? শুধুই উজ্জ্বল সূর্যালোক থাকবে; আলিমের ডিঙিটাকে মাঝ দরিয়ায় বয়ে নিয়ে যাবার মত পরিমিত বায়ু প্রবাহ থাকবে; ভাদরের ভরা মেঘনার অনুত্তাল, ঘূর্র্ণিবিহীন, মার্জিত স্রোতে আলিমের ডিঙিটা সাঁতার কেটে কেটে মাছ ধরবে। 
এক যুগ অতিক্রান্ত হলেও সংসারের শুরুটা খুব মনে আছে পারুলের। বিয়ের পরদিন ডঙরের বড় তালগাছটার তলা থেকে নৌকা ছাড়বে। পাড়ার সব লোক এসে হাজির হয়েছে। ছোট খালার হাত ধরে সে নৌকায় উঠলো। সঙ্গে নূরু আর আলেয়া। নৌকা থেকে পারুল তাকালো জলে ডোবা ডঙয়ের পাড়ে দাঁড়ানো বাপজানের দিকে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা। চুল, দাড়ি আর কপালে মাখা সরিষার তেলে সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। তার মুখে আনন্দ, বিষাদ, বিস্ময়, ভীতি─  সব কিছু একসাথে বাসা বেঁধেছে। পারুল স্বর্গ-মর্ত্য ভুলে গেল। আকাশ-পাতাল ভুলে গেল। বিয়ে, স্বামীর বাড়ি যাত্রা, নাকের নথ, হাতের আলতা, কপালের টিপ─  সবই অর্থহীন মনে হলো  পারুলের কাছে। ইচ্ছে করল, দৌড়ে গিয়ে সে বাপজানকে জড়িয়ে ধরে, সমবেত সমস্ত লোককে তাড়িয়ে দেয়, সব আয়োজন ভেঙে ফেলে। কিন্তু তা আর করা হলোনা। সে অসাঢ় হয়ে বসে রইল নৌকার মাঝখানে।
একটু পরে শ্রাবণের ভরা মেঘনায় রাজহাঁসের মত পাল তুলে নৌকাটা যখন ধলিরচরের দিকে তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকল, পশ্চিম দিগন্তে নিস্প্রভ হয়ে আসা সূর্যের কমলা আলোর প্রলেপ পড়ল নদীর জলে তখন চারিদিকে যেন একটা নতুন জীবনের স্পন্দন অনুভব করল পারুল। তার মনে হলো, জীবনটা নদীর কমলা জলের অবারিত বিস্তারের মতই প্রাণময় হবে। বাস্তবে তা হয়নি। বার বছরের বিবাহিত জীবন কেটেছে নিঃসঙ্গ, নিঃসন্তান। দারিদ্র্য বেড়েছে ক্রমাগত। আলিমের গেরস্থালি ছিল, হালের বলদ ছিল, টিনের দুটো ঘর ছিল। নদীর ভাঙনে গেরস্থালি গেছে। ক্ষুধার তাড়নায় বিক্রি করতে হয়েছে হালের গরু, টিনের ঘর। 
দীর্ঘ সময় একটানা বর্ষণের পর বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। পারুল খিচুড়ি রান্না করল। সরিষার তেলে ডিম ভাজি করল। আলিমকে ডেকে খেতে বলল। আলিম বারান্দায় বসে কাশতে কাশতে বলল, ‘তুই খা’। একসময় পারুলকে তুমি বলত আলিম। কখন থেকে তুই বলতে শুরু করেছে পারুলের ঠিক মনে নেই। তার হঠাৎ মনে হলো, এই প্রৌঢ়ত্বপীড়িত মানুষটিকে ঘিরে, এই  জীর্ণতাকে আশ্রয় করে একটা সংসার আসলে চলে না। যে তাকে সুগন্ধি সাবান এনে দিতে পারে না, গঞ্জের হাট থেকে কলাপাতা রঙের ঢাকাই শাড়ি আনতে পারে না, ধলিরচরের সর্বব্যাপ্ত ধুসর নিঃসঙ্গতাকে ঢেকে ফেলে এমন একটা  সন্তান যে দিতে পারে না, তেমন অক্ষম একজন মানুষের সাথে পারুলের আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করল না।  
মাছ ধরতে না যাবার জন্যে সে আলিমকে গালাগালি করল । অসুখের ভান করা নিয়ে কটাক্ষ করল। সবশেষে খিচুড়ির হাঁড়িটা পেয়ারা গাছের তলায়  ছুঁড়ে ফেলে দিল। আলিমকে সে প্রায়ই বাড়ি থেকে চিরদিনের মত বেরিয়ে যাবার ভয় দেখায়। আলিম ভয় পায় কিনা সে বুঝতে পারে না। আজ সত্যি সত্যি সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর পাড়ার দিকে চলে গেল। একটু পর আলিম জাল কাঁধে বৈঠা হাতে বেরিয়ে পড়ল। চরের দক্ষিণ পাড়ে নৌকা বাঁধা ছিল। ক’দিনের বৃষ্টিতে পানি বেড়েছে অনেক। বেশ খানেকটা সাঁতার দিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠল সে। দাঁড় বেয়ে নৌকাটা তীরে নিয়ে এলো। নৌকায় জাল তুলে পাল খাটিয়ে হাল ধরল। ঠাণ্ডায় আলিমের ঠোঁট কাঁপছে। নৌকাটা নোনতাখালীর দোন পেরিয়ে ছুটে চলল আরো দক্ষিণে মেঘনার মোহনার দিকে।
ততক্ষণে ময়নারচরগামী নৌকায় উঠে বসেছে পারুল। চোখ বন্ধ করে নৌকার মাঝখানে বসে রইল সে। ধলিরচরের দিকে আর তাকাবে না। বিগত বার বছরের সবটুকু স্মৃতি সে মন থেকে মুছে ফেলতে চায়। ভাল মন্দ মিলিয়ে যা ঘটেছে তার সবই একটা বিস্মৃতির কৃষ্ণ চাদরে ঢেকে ফেলতে চায় সে। কিন্তু কোন কারণ ছাড়াই পারুলের চোখ দুটো বারবার জলে ভরে উঠল। পাকুল্লার ঘাটে সে নৌকা থেকে নামল। বেশ কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হবে। এ রাস্তাটা তার খুব চেনা। ছোটবেলায় বাপজানের হাত ধরে মাঝে মাঝে পায়রার হাটে যেত এই রাস্তা বেয়ে। সাথে বছর বাঁধা কামলা থাকত। ভারে করে ধান, পাট, সরিষা বয়ে নিয়ে যেত সে। বিক্রি হতো সেগুলো। ফেরার সময় বাপজান ঝুড়িভাজা, খাগড়াই আর বাতাসা কিনে দিত। পথটায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। দু’পাশে নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে অনেক। মাটি ফেলে উঁচু করা হয়েছে রাস্তাটা।
পারুল যখন বাড়ি পৌঁছুল তখন প্রায় সন্ধ্যা। বাড়ির চারিদিকে পানি উঠেছে। তালতলা, ডঙর পেরিয়ে কুয়োতলা পৌঁছে গেছে বানের পানি। সে বাড়ির ভেতর গেল। বুকের মধ্যে কেমন ধকধক করছে তার। চারদিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ নেই। বারান্দায় পেতলের একটা জগ, একটা জলচৌকি─  জন্মের পর থেকেই এ দুটো জিনিসকে এখানে দেখে এসেছে পারুল। তারের ওপর দুটো লুঙ্গি পাশাপাশি শুকোতে দেয়া হয়েছে। সে ঘরের মধ্যে গেল। মা কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। গায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিল। মা ধীরে ধীরে উঠে বসল। দীর্ঘদিন পর মেয়েকে দেখে খুশি হলো
─  তুই কহন আইলি মা? জামাইয়ে কই?
ধান চালের পুরনো মাচানটার দিকে তাকাল পারুল। ধানের কোলার মধ্যে বাবুল আর তাহেরের সাথে সে লুকোচুরি খেলত। শৈশবের সময়টা যেন আটকে আছে ঐ ভাঙাচোরা মাচানটায়। পারুল শিকেয় বাঁধা গুড়ের  হাঁড়িটা হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করল। বলল
─  অহন তোমাগো লগে থাকুম। আর  ধলিরচর যামু না।
শেষ কথাটা উচ্চারণ করে সে হঠাৎ চমকে গেল। সাহস করে আরও বার কয় মনে মনে বলল─  ‘ধলিরচর যামু না’। কিন্তু প্রত্যেক বারই তার মনে হতে থাকল এটা সে কি বলছে! যতবার সে নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাইল কথাটা, ততবারই সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গেল সে। সারারাত প্রবল বর্ষণে ভেসে গেল ময়নারচর। বাতাসের গোঙানি আর টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে পুরোটা রাত জেগে রইল পারুল। ধলিরচরের জনশূন্য কান্দিরপাড়ের একটা খড়ো ঘরের মধ্যে অন্ধকারে শোয়া চল্লিশোর্ধ রুগ্ন, হতশ্রী এক প্রৌঢ়ের জন্যে পারুলের মনটা খুবই ব্যাকুল হয়ে উঠল। জলভরা কৃষ্ণ মেঘের শরীর ভেদ করে সকালের সূর্যের আবছা আলো ফুটে উঠল চারিদিকে। পারুলের মনে হলো, অনাহারক্লিষ্ট আলিম মাঝি এখন ঘরের মেঝেতে জলচৌকি পেতে বসে বসে বিড়ি টানছে আর খক খক করে কাশছে। 
পারুল বাপজানের খুতি থেকে একশ’ টাকার দুটো নোট বের করে আঁচলে বেঁধে নিল। পেয়ারা গাছ থেকে দুটো টসটসে পেয়ারা পেড়ে নিল। হেঁটে এলো পাকুল্লার ঘাটে। ধলিরচরের প্রথম নৌকাটায় উঠে বসল সে। সারাদিন স্রোত ঠেলে সন্ধ্যার পর নৌকাটা ধলিরচরে পৌঁছুল। বানের পানিতে ভেসে গেছে ধলিরচর। লোকজন পালাচ্ছে। নৌকার ওপর গরু, ছাগল, লেপ, তোষক, হাঁড়ি, পাতিল তুলে নিয়েছে তারা। মাজারের কাছে নৌকা থেকে নামল পারুল। পানি ভেঙে কান্দিরপাড়ের দিকে এগোতে থাকল সে। বাড়ির দিকে তাকাল। ঘন অন্ধকার। সে বাড়িতে পৌঁছুল। উঠোনে পানি উঠেছে। ঘরের দরজার বালাটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। পারুল ঘরে ঢুকে কুপি জ্বালাল। আড়ের ওপর জালটা নেই। তার অর্থ আলিম নদীতে মাছ ধরতে গেছে। নোনতাখালীর দোনে। ফিরে আসবে মধ্যরাতে। পারুল মাচানের ওপর চুলাটা বসিয়ে খিচুরি রান্না করে খেয়ে নিল। অর্ধেকটা রেখে দিল আলিমের জন্যে।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। অবিরাম। রাত ধীরে ধীরে গভীর হলো। পেরিয়ে গেল দ্বিপ্রহর। আলিম ফিরছে না। চৌকির মাথার দিকের পা দুটো মাটির মধ্যে বসে গেল। পানি চৌকি ছুঁয়েছে। পারুল ভাবল, মাজারে গেলে নৌকা পাওয়া যেতে পারে। পলায়নপর কিছু চরবাসী এখনও সব কিছু গুছিয়ে নিতে পারেনি। কুপি হাতে সে দরজায় দাঁড়াল। তাকের ওপর রাখা খিচুড়ির হাঁড়িটার দিকে তাকাল। পাশে খালি একটা টিনের গ্লাস, একটা পেতলের থালা। সংসারের শুরু থেকে এ জিনিসগুলো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এ ছোট্ট সংসারের সবকিছুতে আলিমের হাতের ছোঁয়া আছে। এ সব কিছু ফেলে সে কোথায় যাচ্ছে?  সে চলে গেলে শূন্য ঘরটায় ফিরে নিঃসঙ্গ লোকটার কেমন লাগবে? পারুল ঘরে ফিরে এলো। চৌকির ওপর উঠে বসল আবার। তার কেন জানি মনে হলো, আলিম ফিরে আসবে এখনই। এসে দেখবে বার বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে গড়ে তোলা এ ক্ষুদ্র সংসারের সবটুকু এ ভয়ঙ্কর বিপদেও আগলে রেখেছে সে। দেখবে পারুল তাকে ত্যাগ করে যায়নি।
দূর থেকে দাঁড়ের ছপাৎ ছপাৎ শব্দ শোনা গেল। শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। নিকশ কালো অন্ধকারের নিচে বানভাসি ধলিরচরের এ সর্বব্যাপ্ত প্রলয়ের মধ্যে বসে পারুলের মনে পড়ল এক রোমাঞ্চকর দিনের কথা। বিয়ের পর পরই আলিম তাকে নিয়ে ছোট খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। ফেরার পথে চাঁদের আলোয় দাঁড় টানতে টানতে আলিম বেসুরো দরাজ কণ্ঠে গান ধরেছিল, ‘জলে ভাইসা আইলা  তুমি’। ঘর্মাক্ত কালো মাংসল শরীরটায় চাঁদের উজ্জ্বল আলো পড়ে চিকচিক করছিল। পারুলের মনে হলো, আজকের এই আলিমের মধ্যেই তো সেদিনের সেই আলিমটা আছে।
নৌকাটা আরো এগিয়ে এলো। এগিয়ে এসে পারুলের ঘরের পাশ দিয়ে দ্রুত দক্ষিণ দিকে ছুটে গেল। মাঝি চিৎকার করে বলছে, ‘বলো মোমিন মুসলমানও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। চৌকির ওপর জলচৌকি পেতে পারুল কিছুক্ষণ বসে থাকল। স্রোতের তোড়ে ঘরটা একটু একটু নড়ছে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। পেয়ারা দুটো হাতে নিয়ে সে দরজা খুলে বাইরে এলো। উঠোনে স্রোত পড়েছে। মাজারের বটগাছটার গোড়ায় একটা আলো জ্বলছে। সে টাকা বাঁধা আঁচলটা বাম হাতে উঁচু করে ধরে স্রোত ঠেলে মাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করল; দেখল মাজারটা ধীরে ধীরে বাম দিকে সরে যাচ্ছে। কলাবাগানের কাছাকাছি পৌঁছুতে পানিটা বুক অব্দি উঠে এলো। পারুল আর এগোতে পারছে না। পায়ের নিচে থেকে বালি সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বুড়ো আঙুল দুটো বালির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে সামনে এগোতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু উত্তর থেকে নেমে আসা ঘূর্ণিজলের টানে পৃথিবীর সাথে শেষ সংযোগটুকুও বিচ্ছিন্ন হলো তার। পেয়ারা দুটো সে ছেড়ে দিল বানের পানিতে। হাত দুটো মুক্ত হলো। সাঁতরে সাঁতরে মেঘনার মোহনার দিকে চলে গেল পারুল।

হাসান গোর্কি
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।
নভেম্বর ২৯, ২০১৭,                   

hassangorkii@yahoo.com