অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
আড্ডাবাজ - সৌমিত্র চৌধুরী

     মার ডাকনাম ভোলা। লাল্টুদা ডাকতো অন্য নামে। 
     ভোলা নামটা দেবতার নয়, ঝড়ের। বাংলাদেশের দশ লক্ষ মানুষ মেরে ভোলা তাণ্ডব চালাল। সেবছরই আমার জন্ম। অবশ্য ওপারে না, এপারে। বাঙাল বাবা আমার নাম রাখল ভোলা। একটা বোরিং নাম, লাল্টুদা বলতো। বদখৎ ঝড়ের নামে কখনই ডাকতো না। ডাকতো কখনও ভজহরি, কোনদিন পরেশ। ভালোই লাগতো। সেদিন ডাকলো মদন বলে। মজা পেলাম। লাল্টুদার সম্ভাষণ, কথা-বার্তায় হাসাহাসি হত। আমরা মুখিয়ে থাকতাম বল খেলার মাঠে। লাল্টুদা কখন আসবে, কাকে কী নামে ডাকবে! 
     লাল্টুদা এলে মজাই আলাদা। গানে গল্পে জমে যেত আড্ডা। চা খেত খুব আর সিগারেট। সর্বত্র অবাধ গতি। পাড়ার কালী মন্দিরে সন্ধা গড়িয়ে কচি অন্ধকার নামলে গান ধরত। অসাধারন গলা। রেওয়াজ করত না কিন্তু ওর শ্যামা সঙ্গীতে মন্দির চত্বরে ভক্তির ঢল নামতো। ভক্তদের চোখে জল। পাড়ার মাসীমা কাকিমা মন্দিরের বারান্দায় বসিয়ে লাল্টুদাকে লুচি মন্ডা হালুয়া খাওয়াতো। একদিন নিজের খুড়তুতো বোনের হাত থেকে মিস্টি নিয়ে লাল্টুদা ওকে প্রণাম করে বসল। সেদিনও জোর হাসাহাসি। 
     তবে ক’দিন পর ব্যাপারটা সিরিয়াস হয়ে গেল। এদিকওদিক আড্ডা মেরে রাতে বাড়ি ফিরেছে লাল্টুদা। সটান ওর বাবার ঘরে। চোখ নাচিয়ে বলল, ‘মেসোমশায়, দশটা টাকা ছাড়ো তো’! একটু পরে আবার, ‘দাও না টাকা। চা খাবো একটু, আড্ডা মারবো…’। 
     বিরেন কাকা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। খানিক পরে শুকনো গলায় বললেন, ‘কী বললি লাল্টু? আমি তোর বাবা হই তো’! 
    - তো কী হোল? রোজ এক নামে ব্যাবা ব্যাবা ডাকবো নাকি! বোরিং হয়ে যাবে না? 
    - মানে?
    - মানে আর কি? একদিন বলবো জ্যাঠা, কোন দিন পিসেমশায়। আরেক দিন বিরেনবাবু…।
     বিরেন কাকা থম মেরে তাকিয়ে রইলেন। ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে গেল। কয়েক দিন ডাক্তার দেখানোর পর লাল্টুদা সটান পাগলা গারদে। 
     কালী মন্দিরের মাসীমা দিদিমারা বৃত্তান্ত শুনে হাই হাই করে উঠলেন। আমাদের মজা হাসিঠাট্টা ডকে। তারপর…। 
     মন্দিরে শ্যামা সঙ্গীত নেই। আমাদের আড্ডা নিরস। বাল্য পেরিয়ে কৈশোর ডিঙিয়ে বন্ধুরা সব যুবক। মাঝে মাঝে মনে হত এই বুঝি লাল্টুদা এসে ডাক দেবে, ‘কি রে ভজহরি…’। 
     তেমন হয়নি। অন্য নামে পাড়াতে কেউ আর ডাকেনি। আমার একটা নামই থেকে গেল। ভজহরি পরেশ মদন নয়। ভোলা। শুধু ভোলা। মানুষ মারা বদখৎ একটা ঝড়ের নাম -০-

লেখকঃ ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা।