অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
নীল আপেল - জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

"হ্যাপি বার্থডে টু ইউ" বলে আমরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠলাম।যার জন্মদিনে আমরা সাতজন এই চারতলার ফ্লাটের ছাদে বিকেলে হাজির হয়েছি সে কতটা খুশি হলো সেটা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই।কিন্তু আমরা যে যারপরনাই খুশি সেটা আর না বললেও চলে।
     সবার হাতে হাতে কোল্ড ডিঙ্কসের  গ্লাস।পাশে  টেবিলের ওপর একটা কেক রাখা।একটু আগেই যার জন্মদিনে আসা তার বাবা(?) সেই কেকটি কেটেছেন।আমি তৃপ্তি সহকারে সেই কেকের টুকরো উদরোস্ত করে কোল্ড ডিঙ্কসের  অপূর্ব স্বাদের ঢেঁকুরটা তুলে বাসুদাকে বললাম
" এই একটা কাজের মতো কাজ করেছেন।আমরা তো এই দিনটা মনে রাখবই তার সাথে আমাদের মুখে শুনে, মোবাইলের ছবি দেখে অন্য সবাই এই দিনে উপস্থিত না থাকতে পারার জন্য হা হুতাশ করবে।"
     বাসুদা পন্ডিত ব্যক্তি।ফলিত রসায়নে ডক্টরেট করে চাকরি করেন কিন্তু চাকরিটা করতে ওনার মনে হয় ভালো লাগে না।আগামী বছর অবসর নেবেন।পৃথিবীর বিভিন্ন জিনিসে ওনার দারুন উৎসাহ।নিজে নেড়েচেড়ে কম্পিউটারের যাবতীয় কাজ শিখে নিয়েছেন।ছবি তোলার ভীষণ শখ, এবং তোলেনও ভালো।দেশে বিদেশে একা একা ঘুরতে ভালো বসেন।গত দুবছর গাছ নিয়ে পড়েছেন।প্রথমে ফুলের গাছ নিয়ে বিভিন্ন রিসার্চ করে ক্লান্ত হয়ে এখন ভীষণ ব্যস্ত কলমের  ফলের গাছ লাগানোতে।এই এপ্রিল এর শেষে একা একাই ক্যামেরা নিয়ে কাশ্মীরের টিউলিপ দর্শনে বেরিয়ে পড়েছিলেন।গতকাল সকালে ফিরেছেন কাশ্মীরের সুমিষ্ট আকবারি আপেলের একটা ছানা গাছ নিয়ে।সেই গাছের আগমন ও আজ টবে প্রোথিত হয়াটাকে জন্মদিন ধরে নিয়েই আমরা কজন ঘনিষ্ট বন্ধু নিমন্ত্রিত হয়েছি।এটাকে জন্মদিন না ষষ্ঠী পুজো না অন্নপ্রাসন কি বলবো সেই নিয়ে কিছুক্ষন আগেই অবশ্য আমাদের মধ্যে একচোট তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে।যথারীতি বাসুদা মিটিমিটি হেসেছেন।
     একটা বেশ বড় টবে চারা গাছটিকে লাগানো হয়েছে।মাটির বেশ বড় টবটি লাল রং করা।বৌদি চক দিয়ে টবটির গায়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন।এটাকে ঠিক চারাগাছ বলা যায় কিনা সন্দেহ আছে।পত্রবিহীন একটা গাঢ় বাদামি রঙের প্রায় দেড় ফিটের কাঠি টবের মাঝখানে শোভা পাচ্ছে।দেখে একেবারে শুকনো কাঠি বলে মনে হলেও বাসুদা যদি দুঃখ পান এই ভয়ে বলা যাবে না।বাসুদা আমাদের মনের কথা ধরতে পারলেন।কোল্ড ডিঙ্কসের গ্লাস হাতে টবটির চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বললেন " দেখতে শুকনো লাগলেও ভিতরে কিন্তু রস আছে।" আমরা মাথা নাড়লাম।
     এরপরই বাসুদা এই আপাতশুকনো চারা গাছটির ইতিহাস বলা শুরু করলেন।সুদূর ইরান থেকে কাশ্মীরের আপেল বাগিচার জন্য সম্রাট আকবর কিছু দুষ্প্রাপ্য আপেল গাছের চারা  আনিয়ে নিজে হাতে রোপন করেছিলেন।যে সে আপেল নয় ।যেমন রং তার তেমনি স্বাদ।একটি আপেল দাঁতে কাটলে একশো মিটার দূর পর্য্যন্ত তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।আর স্বাদ।একবার যে নিজে হাতে টসটসে গাছপাকা নীল আপেল পেড়ে খেয়েছে সে মরেছে।সে নিজের বিবি, বাচ্চা, আস্তানা ছেড়ে সেই আপেলের নেশায় কাশ্মীরেই রয়ে গেছে।আকবরের লাগানো আপেল গাছের চারা থেকে সেই কাশ্মীরি সৌন্দর্যে বেড়ে ওঠা ইরানি আপেল যখন নীল ফল দেওয়া শুরু করলো তখন পেটি পেটি সেই আপেল হাতির পিঠে চেপে ফতেপুর সিকরীর প্রাসাদে আসতো।চিস্তির দারগাহে একপেটি আপেল ভেট দিয়ে সেই নীল আপেল সম্রাটের প্রাসাদে প্রবেশ করতো।সম্রাট ও নবরত্নের সদস্যরা রত্নখচিত স্বর্ণথালায় পরিবেশিত সেই আপেল কাড়াকাড়ি করে খেতেন। তিন সম্রাজ্ঞীর ও জেনানা মহলে এ আপেল নাকি সাড়া ফেলে দিয়েছিল।আকবর ফতেপুর ছেড়ে আগ্রায় থাকা শুরু করলেও প্রতিবছর এ আপেল সম্রাটের রসনা তৃপ্ত করতো।তানসেন মিয়া নাকি এই আপেল খেয়ে এক সুরও বেঁধেছিলেন।দুঃখের বিষয় এহেন আপেলের ফলন ভীষণভাবে কমে গেছে।যে কপেটি ফলন হয়, ভারতে বিক্রি হয় না।সব মধ্যপ্রাচ্য আর আমেরিকাতে চলে যায়।পরিবর্তে ডলার ঢোকে।একশোর কম গাছ এখন বেঁচে আছে।জলবায়ুর পরিবর্তন এর কারণ। কাশ্মীরের এক অজানা বাগানে বছর বছর এই সুস্বাদু ফল ভারত বাদে অন্য জায়গার কিছু লোকেদের রসনা তৃপ্ত করে চলেছে।এবারই বাসুদার সাথে নাকি টিউলিপ বাগানের এক মালি রহমানভাইয়ের খুব দহরম মহরম হয়েছিল।সেই নাকি অনেক কষ্টে একটি বহুমূল্যবান চারা জোগাড় করে প্যাকেটে করে বাসুদার হাতে কলকাতা আসার আগে তুলে দিয়ে বলেছিল 
" একে সন্মান করে রাখবেন।কাশ্মীরের শানকে আপনার হাতে তুলে দিলাম।" 
     আমি সপ্তাহে একবার সেই আপেল গাছের খোঁজ নি।প্রায় ছমাস সেই চারা জল-সার এবং সর্বাগ্রে বাসুদার ভালোবাসা পেয়েও একটা পাতাও উপহার দিলো না।বাসুদা ভীষণ মুষড়ে পড়লেন।আমাকে একদিন সকালে ফোনে বললেন
 " গাছটাকে নিয়ে ট্যাক্সি করে কাল কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো, তোর কি সময় হবে; আমার সাথে যাবার?"
     যথারীতি লালটুকটুকে টবে সেই শুকনো কাঠিরূপী গাছ নিয়ে ট্যাক্সি করে আমি আর বাসুদা দুপুর এগারোটায় কল্যানী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতালার এক ল্যাবরেটরিতে হাজির হলাম।বাসুদার এক প্রফেসর বন্ধু আমাদের খাতির করে বসিয়ে চা খাওয়ালেন।আপেল গাছটিকে একটা টেবিলে রেখে উনি গোটা দশেক ছাত্র-ছাত্রী ডেকে আনলেন।সবাই আবার মাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে গাছটিকে আগা থেকে গোড়া পর্য্যন্ত পরীক্ষা করল।টবের মাটির রাসায়নিক বিশ্লেষণ হলো।গাছরূপী কাঠিটির একটু ভেঙে মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলে দেখে ছাত্রীরা খাতায় খচখচ করে অধ্যাপকের থেকে নোট নিলো।বুঝলাম এমন আপেল গাছ ওরা কেউ আগে দেখেনি।প্রফেসর সাহেব দক্ষিণবঙ্গে আপেল চাষের সম্ভাবনা ও তার বাস্তবায়ন নিয়ে নাকি গোটা তিনেক পেপার পাবলিশ করেছেন।তিনিও এই আকবরী আপেল গাছের ছানাটার কাণ্ডকারখানায় কান চুলকতে লাগলেন।বাসুদা হতাশ হয়ে বললেন
" তাহলে কাশ্মীরের শানকে কি আবার কাশ্মীরেই ফেরত দিয়ে আসতে হবে?"
     প্রফেসর সাহেব বললেন " সব তো ঠিক ঠাকই চলছে, ধৈর্য্য ধরা ছাড়া কোনো উপায় নেই।তবে এক কাজ করুন।সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্য্যন্ত গাছটাকে এসির ভিতর রাখুন।ইরানের ঠান্ডা থেকে আনা আর কাশ্মীরের ঠান্ডায় লালিত পালিত এ গাছের জিনে ঠান্ডা ঢুকে গেছে।কলকাতার গরমে বেচারা তাই মুছড়ে পড়েছে।"
     বাসুদা আর আমি সেই আকবরী আপেলের ছানা গাছটিকে নিয়ে চিন্তিত মুখে কলকাতায় ফিরলাম।
     বাসুদার দু কামরার ঘরে চারটি প্রাণী।বৌদি, বাইশ আর কুড়ি বছরের দুই ছেলে।হাঁটা চলা করতেই ধাক্কা ধাক্কি হয়ে যায়।একটা ঘরে এসি আছে,অন্য ঘরে গাছের জন্য আরো একটি এসি বসানো হলো।বাসুদা অবসরের প্রায় মাস ছয়েক আগে  পাক্কা একমাসের ছুটি নিলেন গাছের পরিচর্যা করতে।উনি গাছের ছানাটিকে দশটা নাগাদ কোলে করে ছাদ থেকে নামিয়ে এনে এসি ঘরে ঢোকান।এসি চালিয়ে গলায় মাফলার পরে বসে  ছানাটির পানে চেয়ে বসে থাকেন।আবার বিকেল হলে কোলে করে ছানাটি ছাদে দিয়ে আসেন।বাসুদা একমাসে চিন্তায় চিন্তায় রোগা হয়ে গেলেন।দুপুরে গাছের ছানার পাশে কোনোমতে খেতে বসেন।অবশ্য নিজে মাটির খেতে বসার আগে ফ্রিজের ঠান্ডা জল ছানাটির গায়ে একটু ছিটিয়ে দিতে ভোলেন না।
     গাছের এই অদ্ভুত পরিচর্চায় অন্যান্য ফ্লাটের বাসিন্দারা গাছটির প্রতি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলো।পড়শি এক সন্দেহবাতিক লোক গাছটির এহেন খাতির যত্নে সন্দেহ প্রকাশ করে থানায় খবর দিলেন।একদিন দুপুরে বাসুদা যখন আপেল গাছের ছানাটিকে এসির ঠান্ডা হাওয়া খাওয়াচ্ছেন তখন দুজন পুলিশ এসে দরজার কড়া নাড়লো। পুলিশের উপস্থিতিতে ফ্লাটের অন্যান্য বাসিন্দাদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেলো।পুলিশের অভিযোগ; বাসুদা নাকি ফ্লাটের ভিতর গঞ্জিকা চাষ  শুরু করেছেন।সুতরাং বাসুদাকে ওদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড।যথারীতি আমার কাছে ফোন এলো।আমার চেনাশোনা লালবাজারের কিছু পুলিশের হস্তক্ষেপে সেযাত্রা বাসুদা উদ্ধার হলেন।
     এরও মাস চারেক পর এক রবিবার দুপুরে বাসুদার ফোন।প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বললেন
" জানিস আমার আকবরীর ডালে একটা কচি পাতা উঁকি মারছে।" আমি তখন সবে কচি পাঁঠার ঝোল দিয়ে ভাত সাঁটিয়ে ঢেঁকুর তুলছি।সুখবরটা শুনেই মনটা আমার খুশি খুশি হয়ে উঠলো।হাজার হোক এতো যে সে আপেল গাছ নয়।এ যে সাক্ষাৎ আকবরী আপেল।
     প্রফেসর সাহেবকে সুখবরটা দেওয়া হলো।উনি নিজে একদিন বাসুদার বাড়ি এসে নবপল্লব দেখতে চাইলেন।আবার এক বিকেলে আমাদের পার্টি হলো।গিয়ে দেখি সত্যি একটা সবজেটে পাতা লিকলিকে কাঠিরূপী গাছটির মধ্যিখানে বেরিয়ে আমাদের পানে যেন ভয়ে ভয়ে চেয়ে আছে।সেদিন প্রফেসর সাহেবের সম্মানে  বাসুদা আমাদের চপ-সিঙ্গারা-মিষ্টি খাওয়ালেন।প্রফেসর সাহেব বাসুদাকে এবং আমাদের সবাইকে আপেল গাছের পরিচর্যা নিয়ে আরও কিছু টিপস দিয়ে বিদায় নিলেন।
     বাসুদা অবসর নিয়েছেন।আরও দু বছর ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে।আপেল গাছটি ওনার তৃতীয় সন্তানের মতো ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে।গাছটির দুই মানুষরূপীদাদা(?) ও মাতা(?) ওর বেশ খেয়াল যত্ন করা শুরু করাতে বাসুদা আবার দিন পনেরোর জন্য একা একাই ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন।যাবার আগে আমাকে ফোন করে বলে গেলেন একদিন এসে যেন গাছটিকে অবশ্যই দেখে যাই।
     আমিও গেলাম।গাছটি লম্বায় ফুটখানেক বেড়েছে।লিকলিকে ডালপালাও বেশ কয়েকটা গজিয়েছে।অনেক সবুজ নধর পাতা দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।পরদিন বিকেলে ভয়ার্ত গলায় বৌদির ফোন " ঠাকুরপো, ফ্লাটের একজনের কুকুর এসে বিকেলে আপেল গাছের সব পাতাগুলি চিবিয়ে খেয়ে গেছে।আমি এখন কি করবো?"
" কুকুরটা ছাগল নাকি?এত ভালো ভালো খাবার থাকতে শেষে কিনা আমাদের সাধের আপেল গাছের পাতা খেলো?"মনটা দুঃখে ভরে গেল।বাসুদাকে জানাতে বারণ করলাম।তাহলে হয়তো দুঃখে ইউরোপে কান্নাকাটি শুরু করবে।
     বাসুদা ইউরোপ থেকে ঠিক সময়ে ফিরে যথারীতি নেড়া গাছ দেখে হায় হায় করতে লাগলেন।পত্রবিহীন আকবরীর কিন্তু চার মাস পরে আবার পাতা এলো।তবে শুধু পাতা নয়, সঙ্গে এবার তিনটে কুঁড়িও এলো।
     আবার বাসুদার ছাদে আমাদের তৃতীয় পার্টি।এবার আরো জমকালো পার্টি।বেশি লোক, ভালো খাওয়া।প্রফেসর সাহেব এলেন ওনার দুই ছাত্রী নিয়ে।ছাত্রী দুটি আপেলের ফুল নিয়ে গবেষণায় ভীষণ উৎসাহী।গরম, ধুলো,ধোঁয়ার মধ্যে খাস কলকাতায় ফ্লাটের ছাদে  টবের মধ্যে খোদ আকবরী কাশ্মীরি আপেলের গাছে ফুল ফুটেছে এ নিয়ে পরদিন বহুলপ্রচলিত এক সংবাদ পত্রের পাঁচনম্বর পাতায় লেখাও বেরোলো।ফ্লাটের লোকজনের ধন্য ধন্যর মাঝে প্রফেসর সাহেব এক দুঃখের বাণী শোনালেন।
     গাছটি সবে ঋতুমতী হয়েছে।ঠিকমতো গর্ভধারণ করার জন্য ওর শরীর নাকি তৈরি নয়।সুতরাং উনি তিনটি ফুলকে ছিঁড়ে ফেলবার বিধান দিলেন।ছলছল চোখে বাসুদা আমাদের সবার সামনে তিনটি কুঁড়ি ছিঁড়ে দৌড়ে নিজের ফ্লাটের শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন ।আমরা ভারী মন নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
     এর পরের বছর আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা সত্ত্বেও আপেল গাছটিতে কোনো ফুল এলো না।বাসুদা অন্য কোন গাছ বিশারদের পরামর্শ নিয়ে কি সব হরমোন কিনে নিয়ে এলেন।সেসব দিলেই নাকি গাছ ফুলে ফুলে ভরে যাবে।আমিই বাধা দিলাম। গাছটির বন্ধত্ব আগে প্রমাণিত হোক, তারপর নাহয় হরমোন দিয়ে চিকিৎসা করা যাবে।প্রফেসর সাহেবও সব শুনে আমাকে সমর্থন করলেন।বাসুদা আবার ফুলফোটার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন গুনতে লাগলেন।
     সেবার অক্টোবরের মাঝামাঝি পুজো।ঘামে ভেজা জ্যাবজ্যাবে গরমটা  কমে ভোর বেলায় হালকা শীতের আমেজ।সপ্তমীর দিন বিকেলে বাসুদার ফোন।
" কিরে কাল বিকেলে ফ্রি আছিস?"
" হাঁ বাসুদা।এখন আর পুজোর ভিড়ে কোথাও বেরোই না।বাড়িতে টিভিতে পুজো দেখি।কেন কি হলো? এবারে কি একসাথে পুজো দেখার প্লান করছেন?"
" শোন, কাল বিকেলে কাউকে কিছু না বলে চুপি চুপি চলে আয়।তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব।" বেশ হেঁয়ালি করে বাসুদা বললেন।
     অষ্টমীর বিকেলের ভিড় জমার আগেই আমি বাসুদার ফ্ল্যাটে হাজির হলাম।বৌদি বাপের বাড়ি গেছেন।দুই ছেলে বন্ধু বান্ধবদের সাথে পুজোয় সকাল থেকেই বেরিয়েছে।বাসুদা আমাকে বাইরের ঘরেই বসিয়ে নিজে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পর বাসুদা ঘর থেকে বেরিয়ে আমাকে  ডাকলেন
" ভিতরের ঘরে চলে আয়।" আমি  উৎসাহী হয়ে দরজা ঠেলে ভিতরের ঘরে উঁকি দিলাম।কনকনে ঠান্ডায় বাসুদা এসি চালিয়ে আপেল গাছটির সাথে মেঝেতে বসে আছেন।
"দেখতো কিছু দেখতে পাস কিনা?"
     আমি দেখি নধরকান্তি আপেলগাছটি থেকে একটি পাতিলেবু সাইজের থেকেও ছোট টুকটুকে নীল আপেল ঝুলছে।অনেকটা মার্বেলের ছোটো নীল গুলির মতো।বাসুদা সন্তানস্নেহে অপেলটির দিকে চেয়ে আছেন।সাত বছর পর গাছটিতে ফল এসেছে।বাসুদা প্রায় দেড়মাস এই সুখবরটা আমাকে চেপে রেখেছেন।
" দিন পাঁচেক হলো আকবরী টা পেকেছে বুঝলি।প্রফেসরকে ছবি পাঠিয়েছি।বলেছে প্রথম ফল ছোট হতে পারে, পরের বছর থেকে ভালো সাইজের হবে।আজ অষ্টমী।শুভ দিন দেখেই তোকে ডাকলাম।তুই আর আমি মিলে আপেলটা আজ টেস্ট করবো।"
" পেকেছে,বুঝলেন কিকরে?"
" কেন গন্ধে।তুই মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছিস না?"
" না তো।সামান্য সর্দি হয়েছে বলে বোধহয় গন্ধটা নাকে আসছে না।" আমি বলি।
     আপেল পেড়ে ডিসে চারফালি করে কেটে রাখা হলো।গাছপাকা ফল বলে কথা।কাটার পর সামান্য মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ সত্যি বেরোচ্ছে।
" তুই আগে টেস্ট কর।" আমার দিকে ডিসটা বাসুদা বাড়িয়ে দিলেন।চীনা মাটির সাদা ডিসে কুলের সাইজের নীল আপেল চারফালি করে কাটা।মাঝে কালো জিরের মতো গোটা কয়েক বিচি।আমিও আকবরী মেজাজ নিয়ে একটা টুকরো আপেলে কামড় বসলাম।
     সারা শরীর কেমন যেন ঝনঝন করে উঠলো।মাথা থেকে পায়ের নখ পর্য্যন্ত একটা টক তরঙ্গ বয়ে গেল।ঘরে এসির ঠাণ্ডাতেও শরীর ঘামতে লাগলো।কোথায় লাগে তেঁতুল!থরথর করে কাঁপা হাত দেখে বিচলিত হয়ে বাসুদা জিজ্ঞাসা করলেন 
" কেমন খেতে রে?"
     বিশ্বসেরা টক সেই আকবরী আপেল খেয়েও বাসুদার সরল মুখটা দেখে বন্ধুত্বের খাতিরে বলতে বাধ্য হলাম " বাঃ। বেশ।স্বাদে নতুনত্ব আছে।"
     বাসুদা আপেলের টুকরোটা হাতে ধরেছে মুখে দেওয়ার জন্য।স্বপ্নভঙ্গের দুঃখ আমি চোখে দেখতে পারবো না।আমি দুর্বলচিত্তের মানুষ।হাজার হোক বাসুদা, আমার প্রিয় বন্ধু, টানা সাতবছর সন্তানস্নেহে গাছটাকে পালন করছে।সন্তানের অপদার্থতায় বাবার  বুকে যেমন শেল বেঁধে, এ ফল ঠিক তেমনই বাসুদাকে দুঃখের সাগরে ভাসাতে চলেছে।আমি সেটা একেবারেই সহ্য করতে পারবো না।
     চোঁ করে আপেলের টুকরোটা বাসুদার হাত থেকে ছিনিয়ে নিজের মুখে পুরে ফেললাম। আমার বিশ্বসঘাতকতায় বাসুদা থ মেরে গেছে।বড় বড় চোখে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে " ব্রুটাস, তুমিও?"
     মাঝে মাঝে প্রিয় বন্ধুর সাথে এমনি বিশ্বাসঘাতকতা করা জরুরি হয়ে পড়ে।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। কলকাতা