হলুদ গোলাপ - শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
১
গাড়িতে অফিস যেতে মন্দিরার প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগে রোজ। জ্যামে আর সিগনালে হোঁচট খেতে খেতে সকাল দশটা নাগাদ গন্তব্যস্থলে পৌঁছায় সে। এই একঘন্টা সময় একঘেয়েমি কাটাতে মন্দিরা মুঠোফোনে আশ্রয় নেয়। কখনো কানে ইয়ারফোনে গুঁজে রবীন্দ্রসংগীত শোনে, কখনো চটজলদি মেল চেক করে ,কখনো ফেসবুক খুলে এর ওর পোস্ট দেখে দু চারটে লাইক মারে, আবার কখনো হোয়াটস্যাপ মেসেজ দেখে কাউকে কাউকে উত্তর দেয়, জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা, সাফল্যে অভিনন্দন-বার্তা, মৃত্যুতে শোকবার্তা জানায়। আজকাল অনুভূতির প্রকাশও যেন কেমন নিয়মমাফিক হয়ে গেছে। রো জকার মতো আজও মুঠোফোনে গুচ্ছ গুচ্ছ গুড মর্নিং মেসেজের মাঝে দু একটা কাজের মেসেজের সন্ধান করছিলো মন্দিরা। কে কে নতুন প্রোফাইল চিত্র দিলো দেখতে দেখতে হঠাৎ নজর পড়লো হলুদ গোলাপটার দিকে। কি আশ্চর্য! দু একবার চোখ রগড়ালো সে। নাঃ, ভুল দেখছে না সে। সৌরভের নামের পাশে গোলাকার প্রদর্শন চিত্রে একটি হলুদ গোলাপের ছবি।
সৌরভ মজুমদার - তার এককালের সহপাঠী, বন্ধু ও প্রেমিক। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়বার সময় প্রথম বর্ষ থেকেই সৌরভের সঙ্গে ছিল তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। অবশ্য সকলের থেকে আলাদা হয়ে একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে তাদের দেখেনি তখন কেউ। ওরা পাঁচ জন সবসময় একসঙ্গে থাকতো- সৌরভ, শৈবাল, বিপাশা, শ্রাবনী আর মন্দিরা। ক্লাসে একসাথে, ক্লাস কাটা একসাথে, ক্যান্টিনে একসাথে, সিনেমা দেখাতেও একসাথে। সৌরভের চেহারাটা ছিল বেশ আকর্ষণীয়, সাজপোশাকের দিকে যত্নবান, অন্যদের থেকে কথা কম বলতো। সব মিলিয়ে একটা বেশ নায়কোচিত ব্যাপার ছিল সৌরভের মধ্যে। আঠারো বছরের কিশোরী মন্দিরা যখন একুশের পূর্নযুবতী হয়ে উঠলো, সে বুঝলো তার মধ্যে যেন কোথায় একটা বড়োসড়ো পরিবর্তন হয়ে গেছে। একসাথে সকলে যে হাসির হিল্লোল আর কথার ফোয়ারা ছুটিয়ে চলতো, চেতনে অবচেতনে তার মন যেন সেই বৃত্তের পরিধি ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসে চাইছে শুধু একজনের হাত ধরতে যে তার একান্ত আপন। সৌরভকে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারতো না। স্বল্পভাষী সৌরভের মনের ঠিকানা পাওয়া সত্যি মুশকিল ছিল। ওর নির্মল হাসি আর ভাবুক চোখ মেয়েদের আকৃষ্ট করতো সহজে, কিন্তু সে হাসিতে বা সে দৃষ্টিতে কোথাও অন্তরের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেতো না। তার কঠিন অথচ বিনম্র ব্যক্তিত্ব ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার যেমন অনায়াসে নারীর মন জয় করতো, তেমন সহজে সে কাউকে মন দিতো বলে মনে হতো না। তাই মন্দিরা কলেজের চারটে বছর পার করে ফেললেও কোনোদিন সৌরভকে তার মনের কথা বলে উঠতে পারে নি। কোথায় একটা বাধো বাধো ঠেকতো, যদি প্রত্যাখ্যাত হতে হয় !
ফাইনাল ইয়ারে উঠে ক্যাম্পাসিং শুরু হলো। কেউ কেউ চাকরি পেলো, কেউ মনোমত পেলো না। পাশ করার পর এক এক জন এক এক দিকে ছিটকে গেলো। এক সূত্রে বাঁধা ওদের পাঁচ বন্ধুরও সুতোটা ছিঁড়লো। মন্দিরা কলকাতায় চাকরি পেলো, শৈবাল আর বিপাশা এম. টেক এ ভর্তি হলো, শ্রাবনী বেঙ্গালুরু গেলো আর সৌরভ হায়দ্রাবাদ। মন্দিরা আবার সত্যিটা উপলব্ধি করলো। সবার সাথে দূরত্ব বাড়লেও শুধু একজনকে ছেড়ে থাকাটাই অসম্ভব মনে হচ্ছে। ওদের পাঁচ জনের একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ তৈরি হলো। যারা দূরে গেলো তাদের কারো কারো নাম্বার বদলালো। চললো গ্রুপে বাক্যালাপ, বেশির ভাগ দিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মাঝরাত অবধি। মনে জমে থাকা অনেক কথা ভাষা পায় গভীর রাতের অবসরে পাঁচটি তরুণ-তরুণীর অস্ফুট অঙ্গুলিচালনায়। কেউ শুনতে পায় না তাদের আলাপ, কিন্তু তারা নীরবে বুনে চলে গল্পের জাল। নতুন চাকরি, নতুন পরিবেশ, কারো বা নতুন শহর! নতুন স্বপ্ন চোখে নিয়ে এক অচেনা জগতে নিজেকে অহরহ মানিয়ে নেওয়ার গল্প। গল্পের কাঠামোটা একই, শুধু চালচিত্রগুলো আলাদা।
সৌরভ এই দূরভাষ মধ্যরাতের আড্ডায় আসতো কম। মন্দিরার রাগ হতো খুব। যেদিন ভাগ্যক্রমে সৌরভ ওদের রাতের আসরে হাজির থাকতো মন্দিরার মনে হতো মাটিতে স্বর্গ নেমে এসেছে ; তারপর সে ফের উধাও হতো বেশ কয়েকদিনের জন্য। একদিন কি মনে হলো, মন্দিরা ওর ব্যক্তিগত হোয়াটস্যাপ এ মেসেজ পাঠালো, " কি হলো বাবুর খবর নেই কেন ? রাতে করিস কি ?" " ঘুমোই।" তৎক্ষণাৎ জবাব এলো। চটজলদি উত্তর পাবে এমনটা মন্দিরা আশা করে নি। তাই সে অবাক হলো, আবার খুশিও হলো। বললো, " এই তো কথা ফুটেছে।" উত্তরে শুধু একটা স্মাইলি। মন্দিরা কপট রাগ দেখালো, " ওই হলুদমুখোর দেঁতো হাসি কে দেখতে চেয়েছে রে? তোর হাসিমুখের একটা ছবি পাঠা।" সত্যি এলো একটা ছবি। সেই থেকে শুরু। তারপরে আবার একদিন, আরো একদিন, তারপর রোজ। ধীরে ধীরে পাঁচজনের গল্পটা কমে গেলো, দুজনের নিভৃত আড্ডা জমে উঠলো। মন্দিরাই সর্বত্র প্রধান বক্তার ভূমিকায় থাকতো, তাই মধ্যমনির অনুপস্থিতিতে গ্রুপটা ঝিমিয়ে পড়লো। সবাই কর্মব্যস্ততায় একে অন্যের থেকে নিজেদের অজান্তেই দূরে সরে গেলো। শুধু রাতের অন্ধকারে দুটি তরুণ তাজা প্রাণ বহু দূরে থেকেও ধীরে ধীরে চলে এলো একে অপরের খুব কাছে।
প্রথম প্রথম মন্দিরা খুব অবাক হতো। এতদিন একসাথে ওঠা-বসা, কাঁদা-হাসা- অথচ সৌরভকে সে সত্যি কাছে পেলো যখন সে চলে গেলো কয়েক'শ কিলোমিটার দূরে। বিধাতা মাঝে মাঝে বড়ো অদ্ভুত খেলা খেলেন সম্পর্ক গুলোকে নিয়ে। কথার স্রোতে দুজনে গা ভাসালেও সৌরভ কখনো মন্দিরার কাছে আত্মসমর্পন করে নি। তাদের সম্পর্কের জ্যামিতিটা মন্দিরার কাছে সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট ছিল না। নৈশ আড্ডাতে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করলেও সৌরভকে কখনো মন্দিরা প্রগলভ হতে দেখে নি, ভালোবাসার অভিব্যক্তিও খুব একটা ছিল তা নয়। মন্দিরাকে বক্তার আসনে বসিয়ে সে শ্রোতা হয়েই খুশি থাকতো। সৌরভকে দেখতে মন চাইতো মন্দিরার, কিন্তু সে আশা আর পূর্ণ হলো কই ?
সৌরভের বাড়ি ছিল আসানসোলে। নতুন চাকরিতে দু-একদিন ছুটি পেলে সে আসানসোলের বাড়িতেই যেতো। স্বল্পমেয়াদী ছুটিতে কলকাতা আসার সুযোগ হতো না। যদিও সে আশ্বাস দিতো সুযোগ পেলেই সে এসে দেখা করবে মন্দিরার সাথে। এমনি করে বছর ঘুরে গেলো। দীর্ঘ অপেক্ষায় মন্দিরা ক্লান্ত হয়ে পড়লো, কিছুটা হতাশও। মাঝে মাঝে অভিমান হতো মন্দিরার, তার ভালোবাসায় ভরা অজস্র বার্তার কি সংক্ষিপ্ত আর বিলম্বিত উত্তর! নিজে থেকে সৌরভ কথা বলবে এ তো মন্দিরার ভাবনার অতীত! সে বেশ বুঝতে পারতো সৌরভ কর্মজীবনে খুব জড়িয়ে পড়েছে, এই চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে খুব মুশকিল। অশ্রুসিক্ত অঙ্গুলিলিখনে মন্দিরা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতো, " সৌরভ, যদি আমাদের আর কোনোদিন দেখা না হয় ?" সৌরভ উত্তর দিতো, " নাই বা হলো, কি আসে যায়? দূরে থেকেও তো আমরা কাছেই আছি, কাছে ছিলাম যখন, বোধহয় তখন দূরে ছিলাম।" সত্যি কি সৌরভের কিছু যায় আসে না মন্দিরার সাথে কোনোদিন দেখা না হলে? দু ফোঁটা চোখের জল কখন অজান্তে গড়িয়ে পড়ে মুঠোফোনের বার্তার উপর। কিন্তু এ কালি এমন কালি এ তো চোখের জলেও ভেজে না!
তারপর সেই দিনটা এলো, যে দিনটা মন্দিরার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। সৌরভ জানালো যে সে খুব শীঘ্রই পাড়ি দিচ্ছে তার স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। খুব তাড়াতাড়ি ফেরবার সম্ভাবনা নেই। এক মিশ্র অনুভূতি হলো মন্দিরার। সৌরভের সাফল্যে সে বরাবরই উত্তেজিত হয়ে পড়তো। সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর জন্য বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে এতে মন্দিরার থেকে আর কে খুশি হবে? কিন্তু একই সঙ্গে এক অজানা ভয়ে বুক ধুকপুক করে- তবে কি আর দেখা হবে না? মন্দিরা অনুনয়ের সুরে বলে, " একটি বার আসবি তো যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে?" উত্তরে সৌরভ যা বললো তেমনটা মন্দিরা কোনো দিন আশা করেনি। সৌরভ বললো, " হাতে তো বেশি সময় নেই রে। বাড়ি যেতে হবে দু-একদিনের জন্য। তবে ফিরে এসে নিশ্চয়ই দেখা করবো, চিন্তা করিস না।" ক্ষোভে অনুযোগে মন্দিরার চোখে জল এসে গেলো। এতটুকু আবেগ-অনুভূতি নেই ছেলেটার তার জন্য! তবুও ভিখারির মতো শেষ চেষ্টা করলো সে- "পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও একবার আয়!" পাষাণ-হৃদয় চিরে আবেগের ঝর্ণা ঝরলো না। সৌরভ বেশ দৃপ্ত ভঙ্গিতেই জবাব দিলো, "ছেলেমানুষি করিস না, বোঝবার চেষ্টা কর। এখন কলকাতা যাওয়া সম্ভব নয়। আর হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়া গুলো থেকেও আমি কিছুদিনের জন্য নিজেকে সরিয়ে নেবো। এমনিতেও তোর সময়ের সঙ্গে আমার সময়ের যা ব্যবধান হবে, তাতে আড্ডা দেওয়া মুশকিল। একজনের ঘুমোবার সময় হবে আর একজনের কাজের সময়। আমার সামনে আসছে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তুই একটু সহযোগিতা কর কান্নাকাটি না করে। আমি দেশ ছেড়েই তো যাচ্ছি, পৃথিবী ছেড়ে তো নয়। তাই আবার দেখা হবে। ততদিন ভালো থাকিস।"
হতভম্ব ভাবটা কাটতে না কাটতে মন্দিরা দেখলো সৌরভের নামের পাশের প্রদর্শন চিত্রটা মিলিয়ে গেলো। মনটা হু হু করে উঠলো, মনে হলো চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছে। তাড়াতাড়ি টাইপ করতে লাগলো কয়েকটা কথা যা বলা একান্ত প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হায়! সৌরভ তার সঙ্গে যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে নিমেষে। মেসেজ, ফোন কল, হোয়াটস্যাপ, সব কিছু থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ফেসবুকেও সে নিশ্চয় তার বন্ধুদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে। সম্পর্কের যে কুঁড়িটা সকলের অলক্ষ্যে ফুল হয়ে ফুটে উঠেছিল, আজ তেমনিই লোকচক্ষুর অন্তরালে বৃন্তচ্যুত হলো। শুধু একরাশ হাহাকার নিয়ে একটা দুমড়ানো মুচড়ানো চুরমার হয়ে যাওয়া মন বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো হোয়াটস্যাপে সৌরভের নামের পাশে সেই ক্ষুদ্র বৃত্তটার দিকে, যা এতদিন ছিল তার ক্ষুদ্র পৃথিবী। সেই পৃথিবীর অলিন্দে একটা ঝকঝকে হাসিভরা মুখ উঁকি মারতো তার দিকে চেয়ে। আজ সেখানে পড়ে রইলো শুধুই শূন্যতা।
২
বার বার ভালো করে দেখে মন্দিরা বুঝতে পারলো সে ভুল করছে না। এ তো সৌরভেরই প্রোফাইল চিত্র। অনেক দিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। কলেজে থাকতে সৌরভ তাকে একবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে একটা হলুদ গোলাপ দিয়েছিলো। মন্দিরা বলেছিলো, "হলুদ কেন? লাল গোলাপ দিলেই পারতিস।" সৌরভ একটু হেসে বলেছিলো, "হলুদ গোলাপ বন্ধুত্বের প্রতীক। তোর সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক তাতে এটাই সবথেকে ভালো উপহার।" আজ বহুদিন বাদে পুরানো স্মৃতি নতুন করে মনে এলো। তবে কি সৌরভ এটাই বোঝাতে চায় তাদের সম্পর্কটা এখনো বন্ধুত্বের, প্রেমের নয়? সৌরভ অদ্ভুতভাবে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাবার পর বিগত ছয়মাস তার যেভাবে কেটেছে তা শুধু সেই জানে। তীব্র যন্ত্রনায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সে, ভিতরটা চুরমার হয়ে গেলেও বাইরে মুখের হাসি বজায় রেখে রোজকার কাজ করে গেছে। শুধু নিশুতি রাতে যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়তো, তার চোখের জল বাঁধ ভাঙতো। নিজেকে নিঃশেষ করে ভালোবাসার মূল্য কি কেবল অপমান, উপেক্ষা আর অবহেলা? তবু অনেক চেষ্টা করেও সৌরভকে ভুলতে পারে নি মন্দিরা। সম্পর্কের শিকড় অনেক দূর অবধি পৌঁছে গেছে বুঝতে পারতো সে, এই শিকড় পুরোপুরি উপড়ে ফেলা বড়ো কঠিন।
তবে আজ হঠাৎ সৌরভের প্রত্যাবর্তন? সে কি দেশে ফিরে এসেছে? মন্দিরা কি তাকে কল করবে? ফোনে কথা তো কমই হতো বরাবর, বেশিরভাগ সময়েই তো হোয়াটস্যাপের নীরব বার্তা। আজও নিজেকে সংযত করতে পারলো না। সমস্ত মানসিক বাধা অতিক্রম করে কোনোরকমে আঙ্গুল বললো মুঠোফোনে, "সৌরভ, তুই কি ফিরে এসেছিস?” অফিসে সারাদিন খুব অস্থিরতার মধ্যে কাটলো। কাজে মন বসছিলো না, বারবার চোখ চলে যাচ্ছিলো মুঠোফোনের দিকে উত্তরের প্রত্যাশায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। অফিসের কাজ শেষ করে মন্দিরা বাড়িমুখো হলো। গাড়িতে বসে আর একবার নজর রাখলো হোয়াটস্যাপের বার্তায়। নাঃ! রাশি রাশি কাজের অকাজের মেসেজের মাঝে কোথাও নেই সৌরভের উত্তর। অথচ সে দেখেছে মন্দিরার মেসেজ। একবার শেষ চেষ্টা করলো মন্দিরা, লিখলো, "উত্তর দিলি না যে? আমি কিন্তু অপেক্ষায় ছিলাম।"
সারা দিনের শেষে একবুক অভিমান নিয়ে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দেবার আগে মুঠোফোনে অ্যালার্ম দিলো মন্দিরা। আর তখনই চোখে পড়লো সৌরভের উত্তর- "না, ফিরি নি, আমি এখনও নিউ ইয়র্কে।" মন্দিরার সারা শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ হলো। কোনোরকমে লিখলো, "কোথায় ছিলি এতদিন? মনে পড়ে নি আমায় একবারও?" ওপাশ থেকে চটজলদি জবাব এলো "মনে পড়বে না কেন? এই তো এলাম ফিরে।” মন্দিরার অভিমানী সুর - "আমাকে এতো কষ্ট দিলি কেন?" দূর থেকে এলো স্নেহভরা লিখিত আশ্বাস-"কষ্ট কিসের? এই তো আমি।" বুকের ওপর চেপে বসা ভারী পাষাণটা যেন এক লহমায় সরে গেলো। অভিমানের বরফ গলে ঝর্ণাধারার মতো চোখ বেয়ে নেমে এলো আবেগের স্রোত। সৌরভ তাকে প্রতারণা করে নি, বলেছিলো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রয়োজনে অদৃশ্য হলেও আবার সে ফিরে আসবে। আজ সে শুধু ফিরেই আসে নি তার কাছে, সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছে তার আত্মপ্রত্যয়, নতুন করে সে ফিরে পেয়েছে মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। কাঁপা হাতে সে লিখলো, "আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবি না তো?" "দূর পাগলী, ছেড়ে যাবো বলে ফিরলাম বুঝি?"- এতো আবেগ নিয়ে সৌরভ আগে কখনো তার সঙ্গে কথা বলে নি। মন্দিরা বুঝলো, কর্মজীবনের সাফল্য সৌরভকে আরো দায়িত্বশীল আর পরিণত করে তুলেছে। মনে কেমন যেন ভরসা হলো, এই সৌরভ তাকে ছেড়ে আর কোথাও উধাও হবে না।
সত্যিই ছেঁড়া সুতোর প্রান্ত দুটোতে আবার গিঁট পড়লো- দুজনেই চেষ্টা করলো এবার বাঁধন আলগা না হয়। কথার স্রোত বয়ে চললো আবার পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। একদিকে খরস্রোতা মন্দিরা- আবেগে উচ্ছাসে মাতোয়ারা, আর অন্য দিকে ধীর শান্তগতিতে বয়ে চলা জলধারার মতো সৌরভের সংযত আবেগ দুজনের সম্পর্কটাকে এক নতুন মাত্রা দিলো। মন্দিরা তার সময়মতো বার্তা পাঠাতো, সৌরভ ওর সময় হলে জবাব দিতো। কখনো মন্দিরা পুরানো দিনের কলেজের মজার ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতো সৌরভকে, প্রত্যুত্তরে সৌরভ মন খুলে হাসতো। কখনো বা মন্দিরা জিজ্ঞাসা করতো,"নিউ ইয়র্কে কোথায় কোথায় ঘুরলি? স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখেছিস?" সৌরভের উত্তর আসে, "অবশ্যই! স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখেছি, টাইম স্কোয়ারে সময় কাটিয়েছি, আকাশচুম্বী এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর ছাদ থেকে নিউ ইয়র্কের প্যানোরামিক ভিউ দেখে মুগ্ধ হয়েছি।" মন্দিরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে, "ওঃ সৌরভ! তোর কি মজা! আমি কোনোদিন এসব দেখতে পাবো?" সৌরভ রসিকতা করে, "এক কাজ কর। আমি হাত তুলছি, তুইও হাত তোল। তারপর হাতে হাতে তালি বাজা আর গুপী-বাঘার স্টাইলে মুখে বাল- নিউ ইয়র্ক। দেখবি ঠিক পৌঁছে গেছিস।" মন্দিরা রাগ করে না; বলে, " ছবি পাঠা না প্লিজ।" সৌরভ যেন অপেক্ষা করে ছিল- সঙ্গে সঙ্গে পাঠায় স্ট্যাচু অফ লিবার্টির সামনে তোলা নিজস্বী। মন্দিরার শরীরটা থাকে কলকাতায় আর মন উড়ে বেড়ায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের এক দেশে, যেখানে থাকে তার মনের মানুষ। পৃথিবীটা যেন কেমন পাল্টে যায় তার কাছে, জীবনের অর্থও যায় বদলে। সুখ নামের অধরা পাখিটা যেন ধরা দেয় তার দু-হাতের মাঝে, বুকের ভিতর ঝড় তোলে কোন অচিনপুরের সুরেলা বাঁশি। দিন যায়, রাত কাটে, আবার আসে দিন। বেতার সরণী বেয়ে নিয়ত চলে প্রাণের আদান -প্রদান। বহু দূরে থাকা দুটি ব্যাকুল হৃদয় আবার বাঁধা পড়ে অটুট বন্ধনে।
৩
আজকের দিনটা ছিল অন্য সব দিনের থেকে অন্যরকম। ধূসর মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে সূয্যিমামা। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে বোধ হয়, তারই বার্তা নিয়ে এলোমেলো ঠান্ডা হাওয়া এসে শিরশির শব্দ করে দোলাচ্ছে গাছের ডাল-পাতা। কখনো বা ঝিরঝির বৃষ্টির শব্দে ডুবে যাচ্ছে গাছের পাতার শিরশিরানি। মন্দিরার আজ অফিস ছুটি। জানালার ধরে বসে মেঘ-বৃষ্টির খেলা দেখছে সে। ভিজে হাওয়ায় এলোমেলো চুল কপালে এসে পড়েছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে মন্দিরার মনে হচ্ছিলো সে যেন অলকাপুরীতে প্রতীক্ষিতা বিরহিনী যক্ষপত্নী। দূর আকাশের মেঘের দল কি বয়ে নিয়ে আসবে সৌরভের বার্তা? মন্দিরা মৃদু হাসলো, এখন মেঘপিয়নের কাজ ঘুচেছে, মুঠোফোনই এখন বার্তাবাহক।
ভাবনার সূত্র ধরেই যেন মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। অচেনা নম্বর থেকে আসা ফোন। অন্যমনস্কভাবে ফোন তুলে কানে দিলো মন্দিরা। অলস কন্ঠে বললো, "হ্যালো!" ওপাশ থেকে যে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তা তার বহুদিনের পরিচিত- সেই শান্ত অথচ গম্ভীর, ভারী অথচ স্পষ্ট বাচনভঙ্গি! এই কণ্ঠস্বর যে সৌরভের তা মন্দিরাকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। সৌরভ জিজ্ঞাসা করলো, "কেমন আছিস?" অসময়ে ফোন পেয়ে মন্দিরা অবাক! সৌরভের ফোনে কথা বলার অভ্যাস ছিল না কোনোদিনই, বরাবরই সে হোয়াটস্যাপে স্বচ্ছন্দ। অবাক হয়ে সে উত্তর দিলো, "কেমন আছি তুই জানিস না? কালও তো কথা হলো হোয়াটস্যাপে। তবে অনেক দিন পরে তোর গলা শুনে সত্যি খুব ভালো লাগছে রে!" টেলিফোনের ওধারে কণ্ঠস্বরে বিস্ময়, "কাল কথা হলো মানে? তোর মাথার ঠিক আছে তো?" এবার মন্দিরার অবাক হবার পালা। একটু রাগত স্বরে বললো সে, "মাথা খারাপ হবে কেন? কাল তুই আমার মেসেজের রিপ্লাই দিস নি?" সৌরভ যেন আকাশ থেকে পড়লো, "কি বলছিস? দীর্ঘদিন তোর সাথে আমার দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা নেই। আমি নিউ ইয়র্কে ছিলাম। সবে কাল এসেছি কলকাতায়। পার্ক হোটেলে আছি। তোকে বলেছিলাম না মন্দিরা, আমি একদিন ঠিক ফিরে আসবো, ততদিন ভালো থাকিস। আসলে জীবনটা তখন বড়ো অনিশ্চিত ছিল, কবে ফিরতে পারবো তার কোনো ঠিক ছিল না। তাই তোকে বন্ধনমুক্ত করে দিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুই যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসিস, আমার জন্য অপেক্ষা করবি, তা না হলে নিজের জীবনটাকে নিজের মতো গড়ে নিবি, একা বা আর কারো সাথে। আমি তোর সাথে থাকতে পারছি না বলে তুই শুধু অপেক্ষায় নিজের জীবনটা নষ্ট করবি এটা আমি চাইনি।" মন্দিরার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে উঠলো, কোনোরকমে চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে সামলালো। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, "তবে আজ ফিরে এলি যে?" সৌরভের গলায় এবার হতাশার সুর, "আমি ফিরে এসেছি বলে তুই খুশি নয়? তবে কি তোর জীবনে আর কেউ এসেছে?" মন্দিরা এক নিঃশ্বাসে জবাব দিলো, "আমার জীবনে তো একটাই সৌরভ ছিল, আমি তো আর কাউকে চিনি না।" সৌরভের গলায় এবার স্পষ্ট খুশির আভাস, "তোকে হারাতে চাই নি কোনো দিন, শুধু আমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে হতাশায় দিন গুনে কাটাবি এ আমি চাইনি, তাই তোকে ইচ্ছেমতো বাঁচবার সুযোগ দিয়েছিলাম। তুই আমাকে বাঁচালি মন্দিরা, তুই মুখ ফিরিয়ে নিলে আমি সত্যি কষ্ট পেতাম। কাল বিকেল পাঁচটায় তোর বাড়িতে যাবো তোর সাথে দেখা করতে। আমি জানি বহুদিন ধরে তুই এই দিনটার অপেক্ষায় আছিস।"
ফোনটা রেখে মন্দিরা সোফায় বসে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিলো। মেঘ কেটে আকাশে রোদ উঠেছে, কিন্তু তার মনের মেঘ যে কাটলো না। কে সে যে সৌরভের নম্বর থেকে দিনের পর দিন তাকে মেসেজ করেছে? মনের সব কথা উজাড় করে বলেছে যাকে কে সেই অদৃশ্য প্রবঞ্চক? মন্দিরা তাড়াতাড়ি মুঠোফোনটা নিয়ে বার্তা পাঠালো হলুদ গোলাপকে, "কে আপনি? আমি জানতে পেরেছি আপনি সৌরভ নন। কোন অধিকারে আমার সঙ্গে প্রতারণা করলেন? জানেন পুলিশে খবর দিলে আপনার কি শাস্তি হতে পারে?" উত্তর এলো মিনিট পাঁচেক বাদে, "আমি সৌরভ নই। সৌরভের হায়দ্রাবাদের অফিসে ওর জায়গায় আমি জয়েন করি, উত্তরাধিকার সূত্রে ওর সিমটা পেয়েছিলাম। একদিন হঠাৎই তোমার মেসেজ পেলাম। তোমার প্রত্যেকটা মেসেজে এক অদ্ভুত আকুতি ছিল, ছিল একান্ত প্রিয়জন দূরে চলে যাওয়ায় এক অব্যক্ত বেদনা। মনে হলো তুমি খুবই কষ্টে আছো। তোমাকে যে ছেড়ে চলে গেছে তার ওপর খুব রাগ হলো, আর সহানুভূতি জন্মালো তোমার জন্য। দু চারটে মিষ্টি কথা বলে প্রবোধ দিলাম মিথ্যে সৌরভ সেজে, মনে হলো এতে হয়তো তোমার মনের কষ্ট কমবে কিছুটা। ওই দু-চারটে কথাতেই তোমার আবেগ দুকূল ছাপিয়ে বাঁধনহারা বন্যার মতো আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই কখন তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম। আমি জানতাম এই প্রতারণা অন্যায়, কিন্তু তোমার মন সৌরভে এতটাই ভরপুর ছিল যে সেখানে আর কারো প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই এই মিথ্যার আশ্রয় ছেড়ে আমি কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারলাম না।" মন্দিরা কেমন যেন অবসন্ন বোধ করছিলো, তাও জিজাসা করলো, "সৌরভের ছবি কোথায় পেতেন?" অচেনা মানুষ উত্তর দিলো, "ফেসবুক থেকে। তোমাকে সৌরভ বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলো বলে তুমি ওগুলো দেখতে পেতে না।" অচেনা মানুষ আবার লিখলো, "তুমি সৌরভের প্রেমে এতটাই মশগুল ছিলে যে ট্রুকলারে আমার প্রকৃত পরিচয় জানার চেষ্টা করো নি কখনো। আমি জানতাম সত্যটা এক দিন না এক দিন প্রকাশ পাবেই, আর তখন আমাকে চরম শাস্তি পেতে হবে। আমি অফিস ট্যুরে আজ কলকাতা এসেছি। কাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ তোমার বাড়িতে পৌছাবো। তোমার দেওয়া শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো কথা দিলাম।"
হোয়াটস্যাপ বন্ধ করে মন্দিরা অবনীকাকুর নম্বরটা খুঁজতে লাগলো। অবনীকাকু মন্দিরার বাবার অভিন্নহৃদয় বন্ধু, লালবাজারে আছেন। জাঁদরেল পুলিশ অফিসার হলেও মন্দিরার প্রতি তিনি বরাবরই খুব স্নেহশীল। এতবড় প্রতারণার যোগ্য শাস্তি তাকে পেতেই হবে, সে যেই হোক। অন্যের আবেগ অনুভূতি নিয়ে খেলার কি পরিণাম সে টের পাবে এবার। আচ্ছা, কি শাস্তি হতে পারে লোকটার? সে কি কখনো মন্দিরাকে কোনো অশালীন কথা লিখেছে? না তো। আবার হোয়াটস্যাপ খুললো সে। পুরানো মেসেজ ডিলিট করার অভ্যাস নেই মন্দিরার। এই কয়েকমাসের কথোপকথন দেখতে দেখতে অতীতে ডুব দিলো সে। কিন্তু এতে তো কোনো অশালীনতা নেই, এতো শুধু দুটি মানুষের রঙ্গিন সুতোয় স্বপের জাল বোনা। সৌরভ চলে গেছে এই নির্মম সত্যটা যখন মেনে নিতে পারছিলো না সে, তখন এই মিথ্যা আশ্বাস আর নির্ভরতাই যে তাকে স্বর্গসুখ দিয়েছে। চোখ বুজলো সে, আজ নিজেকে বড়ো ক্লান্ত মনে হলো।
পরদিন বিকেল পাঁচটা। পড়ন্ত রোদ্দুর এসে পড়েছে মন্দিরাদের ফ্ল্যাটের পশ্চিমের বারান্দায়। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে আজ সকাল থেকেই। কালকের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে সব ধুলো-বালি, চারিদিকে উজ্জ্বল অনাবিল আলো। মন্দিরার মনের মেঘও সরে গেছে আজ। আজ তার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে। ফুলদানিতে সাজানো হলুদ গোলাপগুচ্ছের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে। ঠিক বিকেল পাঁচটায় কলিং বেলটা বাজলো। মন্দিরা বসে আছে পাথরপ্রতিমার মতো। আবার কলিং বেল বাজলো, একই ব্যক্তি না অন্য জন? মনে সাহস আর শক্তি সংগ্রহ করে মন্দিরা দরজার দিকে এগোলো। দরজার ছিদ্র দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো সে। দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে - একজন তার চেনা, আর একজন অচেনা। একজন তাকে একরাশ সুখের স্বপ্ন দেখিয়েছে, আর একজন তার অজান্তে পরম যত্নে তার ক্ষতে মলম লাগিয়েছে। মন্দিরা আজ দুজনের জন্যই ঘরের দরজা খুলবে, কিন্তু তার মনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে শুধুমাত্র একজন।
শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
26-05-2021
-
-